একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো। কণ্ঠস্বরে মনে হলো, কম বয়সী মেয়ে কথা বলছে। সালাম দিয়ে অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে সে বলল,‘ভাইয়া, একটা ভুল হয়ে গেছে।’
বললাম, ‘আপনি কাকে চাচ্ছেন?’
‘আসলে আমি কাউকে চাচ্ছিনা ভাইয়া। আমি নিজের নাম্বারে ফ্লেক্সি করতে গিয়ে ভুল করে আপনার নাম্বারে করে ফেলেছি।’
এই ব্যাপার! আধা ঘণ্টা আগে আমার মোবাইলে একশো টাকার একটা ফ্লেক্সি এসেছে। আমার বড় ছেলে তার চাকরীস্থল থেকে মাঝে মধ্যে এমন ফ্লেক্সি পাঠায় বলে ব্যাপারটাকে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি। বললাম, ‘কত টাকার ফ্লেক্সি?’
‘একশো টাকার,ভাইয়া।’
‘তা আমাকে এখন কি করতে হবে?’
মেয়েটি আরো সংকোচের সাথে বলল, ‘টাকাটা আমার এই নাম্বারে যদি ফ্লেক্সি করে পাঠিয়ে দেন তো খুব উপকার হয়। ভাইয়া,আমার কাছে রিকশা ভাড়ার জন্য আর মাত্র দশ টাকা ছিল। সেই টাকাটা ফ্লেক্সি করে কথা বলছি। সে টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না।’
ভাল হ্যাপা হলো। আমি এখন বাজার করছি। মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট অনুযায়ী পকেটে গোনা টাকা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাতেও টান টান অবস্থা। বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
মাছটা যাতে ভাল থাকে সে জন্য তরিতরকারি কিনে ব্যাগের ওপরের দিকে নেয়ার জন্য আমি সাধারণত মাছটা সব শেষে কিনি। পকেটে দেড়শো টাকার মতো ছিল। একশো টাকা মেয়েটির নাম্বারে ফ্লেক্সি করে দিয়ে মাছ না কিনে বাড়ি ফিরলাম।
আমার মিসেস রান্নাঘরে ব্যাগ উল্টে ফেলে মাছ না পেয়ে বলল, ‘মাছ কই?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘আজকের দিনটা ডাল আর নিরামিষ দিয়ে চালিয়ে দাও। রোজ রোজ মাছ মাংস খাওয়া ঠিক নয়।’
‘এই লোকটা বলে কি?’ কাজের বুয়া না আসায় মশলা বাটা শেষ করে মিসেসের মেজাজ বেশ তিরিক্ষি হয়ে ছিল। মাছ মাংস না খাওয়ার উপদেশ তার পছন্দ হল না। বলল, ‘ভালোই বলেছ। আমরা না হয় লতাপাতা যা ইচ্ছা খেলাম। কিন্তু তোমার শালী আর ভায়রাভাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসেছে। তাদের কি দিয়ে ভাত দেব বলো? কত দিন পর ওরা বেড়াতে এলো!’
আমি খুশি হওয়ার অভিনয় করে বললাম, ‘তাই নাকি? রেনুরা বেড়াতে এসেছে? কখন এলো ওরা?’
জানা গেল,আমি বাজারে যাওয়ার পর ওরা নওগাঁ থেকে নিজেদের মাইক্রোবাস নিয়ে বেড়াতে এসেছে। ভায়রা নজরুল ইসলাম সরকারি চাকরি করে। সে দুই দিন ক্যাজুয়াল লিভ পেয়েছে। এই সুযোগে আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য ফোন না দিয়ে তাদের সরাসরি চলে আসা। এখন তারা স্বামী স্ত্রী দু’জন ড্রয়িংরুমে বসে ‘স্টার প্লাস’-এ ‘প্রতিজ্ঞা’ দেখছে। আর তাদের ছয় বছর বয়সী যমজ ছেলে দুটি আমার বেডরুমে খাটের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে বালিশ ছোঁড়াছুঁড়ি খেলায় ব্যস্ত।
আমাকে দেখে নজরুল সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ‘আরে দুলাভাই,কেমন আছেন?’ বলে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কোরবানির ঈদের মতো কোলাকুলি করে ফেলল। শ্যালিকা রেনু ‘প্রতিজ্ঞা’ সিরিয়ালের দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্সে আটকে ছিল। মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ শশুরের সঙ্গে বউয়ের পক্ষ নিয়ে বৃদ্ধের ছেলে ঝগড়া করছে। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য।
রেনু টিভি থেকে চোখ না সরিয়ে হাত ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত করলো। তারপর বিজ্ঞাপন শুরু হলে সে হাসতে হাসতে বলল, ‘দুলাভাই, কেমন আছেন? আপনারা তো যাবেন না। তাই আমরাই চলে এলাম।’
‘খুব ভাল করেছ।’ আমিও হেসে বললাম, ‘রিটায়ারের পর আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করেনা ভাই। শরীরটা মাঝে মধ্যে বিগড়ে যায়। ইচ্ছা থাকলেও যাওয়া হয় না।’
‘আপনি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছেন দুলাভাই।’ বুড়ো হয়ে যাওয়াটা রেনুর কাছে বেশ আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হল। সে বলল, ‘আমরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। আগের মতো টিভি দেখতে আর ভাল লাগে না।’
আমি বললাম, ‘তাই? আচ্ছা, তোমরা বসো। আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।’
রেনু বলল, ‘এই না আপনি বাজার থেকে এলেন! আবার কেন?’
একটা আইটেম বাদ পড়ে গিয়েছে বলে ওদের নয় ছয় বুঝিয়ে দিয়ে আমি আবার বাজারে গেলাম মাছ কিনতে। যাওয়ার সময় আমার মিসেস কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘ইলিশ মাছ নিও। রেনুর স্বামী খুব পছন্দ করে। সঙ্গে দুই কেজি হাড় ছাড়া গরুর মাংস আর একটা দই নিও তো। মিষ্টির দরকার নেই। মিষ্টি ওরাই নিয়ে এসেছে।’
আমি প্যান্টের পকেটে নেয়া দুটো পাঁচশো টাকার নোটের গায়ে হাত বুলিয়ে ভাবলাম, হবে তো? এ রকম আরেকটা নোট নিতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো। দেখা যাক। তেমন আঁটোসাঁটো হলে গরুর মাংস আধা কেজি কম নেব। ইলিশ মাছটাও জাটকার চেয়ে একটু বড় নিলে চলবে। বলবো এর চেয়ে বড় মাছ বাজারে পেলাম না। অতিথি আপ্যায়নে নিশ্চয় তেমন কিছু হেরফের হবে না।
বাজারে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে আমার পিকপকেট হয়ে গেল। মাংস কিনে পকেটে হাত দিয়ে দেখি দুটো নোটই উধাও। কসাই লোকটা ভালো। আমার হাত থেকে মাংসের ব্যাগটা থাবা মেরে কেড়ে নিয়ে বলল, ‘টাকা নিয়ে এসে ব্যাগটা নিয়ে যাবেন। তখন মাংস আবার ওজন করে দেব। আমরা চোরামি ব্যবসা করি না। এখন যান।’
ভাবলাম, বাড়িতে আবার টাকা নিতে ফিরে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বাজারে পরিচিত এক মহাজনের কাছ থেকে বিকেলে ফেরত দেয়ার শর্তে এক হাজার টাকা ধার নিলাম। এই সময় মেয়েটি আবার ফোন করলো। বলল, ‘ভাইয়া, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার মনে হচ্ছিল ফ্লেক্সির টাকাটা হয়তো আর ফেরত পাবো না’
‘এ রকম মনে হওয়ার কারণ? আগে এমন হয়েছে নাকি?’
‘জি, একবার হয়েছিল। পঞ্চাশ টাকার জন্য আরো ত্রিশ টাকা খরচ করে কথা বলেও টাকাটা ফেরত পাইনি।’
‘তার মানে আশি টাকা লস্?’
লস্ প্রফিট সম্পর্কে আমার জ্ঞান বোধ হয় মেয়েটিকে মুগ্ধ করলো। সে আনন্দের সাথে বলল, ‘হাঁ ভাইয়া, ঠিক ধরেছেন। সবাই তো আপনার মতো ভাল মানুষ নয়। তা আপনি কি করেন ভাইয়া? কলেজে পড়েন নিশ্চয়!’
বললাম, ‘এক কালে পড়তাম। এখন আর পড়ি না। এখন আমার ছোট ছেলে কলেজে পড়ে আর বড় ছেলে ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে এখন চাকরি করছে।’
মেয়েটি থতমত খেয়ে ও, ভাইয়া, আঙ্কেল ইত্যাদি বাক্যবিহীন কিছু শব্দ উচ্চারন করে ফোনের লাইন কেটে দিল। আমি কসাইয়ের টাকা পরিশোধ করে ইলিশ মাছ কিনে দই কিনতে যাচ্ছিলাম। মেয়েটি আবার ফোন দিল। বলল, ‘আঙ্কেল, আই এ্যাম সরি।’
বললাম, ‘সরি কেন?’ মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, ‘আপনার গলা শুনে কলেজ বা ভার্সিটির ছাত্র মনে হয়েছিল। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল।’
‘না না, আমি কিছু মনে করছিনা।’
দুপুরে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে আমি রেনুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, তুমি সকালে বললে যে আমি বুড়ো হয়ে গেছি। এই বয়সের মানুষকে তো বুড়োর মতই দেখাবে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বরে তারুণ্যের কোন লক্ষণ আছে বলে কি তোমার মনে হয়?’
‘কি রকম?’ রেনু এবং ওর স্বামী দু’জনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে ডাইনিং সংলগ্ন কিচেনের দরজার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে বললাম, ‘এই যে এখন তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছো না। মনে কর, আমাকে তোমরা চেন না, কোনদিন দেখোনি। শুধু একজন অচেনা অদেখা মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছো। এই কণ্ঠস্বর শুনে কি তোমাদের মনে হচ্ছে যে আমি তরুণ এবং কলেজে পড়ি?’
‘ও বুবু!’ রেনু তার বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দুলাভাই এসব কি বলছে?’
আমার মিসেস দরজার আড়াল থেকে আমাকে বের করে হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিল। তারপর ভাতের প্লেটটা ঠকাস্ করে আমার সামনে টেবিলে রেখে বলল, ‘বুড়ো বয়সের ভীমরতি! এই বয়সে কলেজের ছাত্র হওয়ার শখ। ঢং করার আর জায়গা পায় না।’
আমার কলেজে পড়া ছোট ছেলেটি বলল, ‘না মা, তুমি যতই বল, আব্বার গলার টোনে কিন্তু একটা ইয়ং ইয়ং ভাব আছে। তাই না খালু?’
নজরুল ইসলাম ইলিশ মাছের পেটিসহ এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে বলল,‘একজাক্টলি।’
******** **** *** ** *
এই গল্পটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার আগস্ট ২০১১, ঈদুল ফিতর সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা এটি পড়েন নি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। আশা করি ভাল লাগবে।