somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফ্রান্সের পথে পথে ১

১৬ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শাহাবুদ্দিন শুভ :: ফ্রান্সের পথে পথে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই, আর তাদের আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ হই। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা আমার প্রতিটি দিনকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আজ তেমনই দুটি ঘটনার কথা বলব, যা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।

অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ
সেদিন দুপুরে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাসা থেকে বের হলাম। কারিপুর সুপার শপের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ "শুভ !" বলে ডাক দিল। আমি বিস্মিত হয়ে পিছন ফিরে তাকালাম, কিন্তু আশেপাশে কোনো বাংলাদেশি বা পরিচিত এশিয়ান চোখে পড়ল না। মনে প্রশ্ন জাগল—কে আমাকে ডাকছে?
চিন্তায় পড়ে গেলেও পরক্ষণেই দেখতে পেলাম, দুজন ফরাসি বৃদ্ধ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। একটু ভালো করে দেখে চিনতে পারলাম, তাদের একজন মিকা, আর অন্যজন মিশেল (ইংরেজিতে উচ্চারণ করলে মাইকেল হয়)। মিকার সঙ্গে আমার আগেও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, বিশেষ করে কফি শপে। তিনি অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও সদয় একজন মানুষ। দীর্ঘদিন আমাকে না দেখে হয়তো কৌতূহলী হয়েছিলেন, তাই ডাক দিলেন।
আমি ফরাসি ভাষা জানি না, আর তারাও ইংরেজিতে জানেন না । ফলে, আমাদের একমাত্র ভরসা হলো গুগল ট্রান্সলেটর। সেটির সাহায্যে কথা বলা শুরু করলাম। মিকা জানতে চাইলেন, অনেক দিন দেখা হয়নি কেন? আমি জানালাম, কিছুদিন প্যারিসে থাকার কারণে এবং কফিশপে যাওয়া কমিয়ে দেওয়ার ফলে তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। অথচ মিকার ফোন নম্বরও আমার কাছে ছিল, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ করা হয়নি।
মিকা ও মিশেলের বয়স প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে তারা শহরে ঘুরতে বের হন। আমি যেই শহরে থাকি, সেটি খুবই পরিচ্ছন্ন ও সুসংগঠিত। এটি ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত শহর, কারণ এখানেই তৈরি হয় বিশ্বের দ্রুততম ট্রেন TGV। লুতকোজ শহর পাহাড় ও সমতলের সমন্বয়ে গঠিত, যা এটিকে বসবাসের জন্য এক আদর্শ স্থান করে তুলেছে। নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো বিশৃঙ্খলা—শান্ত, সুশৃঙ্খল এবং মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ।
ফরাসিরা সাধারণত আন্তরিক এবং সহযোগিতাপ্রবণ মানুষ, বিশেষ করে বয়স্করা। একদিন মিকা আমাকে একটি সামাজিক সেবার সুবিধা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে, আপাতত আমার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। এতেই তার আন্তরিকতা আরও বেশি করে ফুটে উঠল।

একটু আলাপচারিতার পর আমরা বিদায় নিলাম। মিকা ও মিশেল বললেন, খুব শিগগির আবার দেখা হবে, হয়তো কোনো কফিশপে বসে একসঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হবে।

ট্রেনের সহযাত্রী :
সেদিন প্যারিস থেকে লুতকোজ ফেরার পথে ট্রেনে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি লক্ষ করলাম, একজন বয়স্ক ব্যক্তি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও পরে মনে হলো, হয়তো তিনি কিছু বলতে চান। কিছুক্ষণ পর সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কি কিছু জানতে চাচ্ছেন?"
তিনি হেসে উত্তর দিলেন, "আমি বেশ কয়েকবার ভারতে গিয়েছি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কেও কিছুটা জানি।" কথোপকথনের একপর্যায়ে জানলাম, তিনি প্রকৌশলী ছিলেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট সম্পর্কে ভালোই জানেন।
তার নাম Bonnardot। কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। আমরা বেশ কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বললাম—বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপের সংস্কৃতি, প্রকৌশল, ট্রেন প্রযুক্তি ইত্যাদি। আলাপচারিতা এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে সময় কখন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।
স্টেশনে নামার আগে তিনি আমার সঙ্গে একটি ছবি তুললেন এবং বললেন, "আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি।" নিজের ফোন নম্বরও দিয়ে গেলেন।
এই যাত্রায় আমি আবারও উপলব্ধি করলাম, পৃথিবী সত্যিই বিচিত্র! আমরা যেখানেই যাই না কেন, কিছু মানুষ সবসময় আমাদের জীবনে দাগ রেখে যায়।
ফ্রান্সের পথে পথে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, তাদের আন্তরিকতা অনুভব করি। মিকা ও মিশেলের মতো বয়স্ক ফরাসিদের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আমাকে মুগ্ধ করেছে, ঠিক তেমনি Bonnardot-এর মতো একজন অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে পরিচয় আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।
প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পরিচয় নতুন কিছু শেখার সুযোগ এনে দেয়। ভাষার সীমাবদ্ধতা থাকলেও আন্তরিকতাই মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে। হয়তো এটাই ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর দিক—নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের গল্প শোনা, এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা।

(চলবে...)

শাহাবুদ্দিন শুভ
ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক
ahmedshuvo@gmail.com
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার ভাঙ্গা ল্যাপটপ

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৫ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:০৬


শুক্রবার রাতে আমার মনে হলো, আমি আমার ল্যাপটপে লিনাক্স ওএস সেটআপ দেব। যদিও আমি সারা জীবন উইন্ডোজ ব্যবহার করে এসেছি এবং লিনাক্স সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। রাতে শুয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'মামলেট’ ‘ওমলেট’ ডিম ভাজা, ডিম পোচ, এগ ফ্রাই, এগ রোল আরও কতো কী .....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:৩০

'মামলেট’ ‘ওমলেট’ ডিম ভাজা, ডিম পোচ, এগ ফ্রাই, এগ রোল আরও কতো কী .....

মাছে ভাতে বাঙালির আমিষ হেঁশেলে সেকেন্ড চয়েস গরুর গোসত আর মুরগি। কিন্তু ডিম? তাকে কি বাঙালি কখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈপ্লবিক ছন্দ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৫ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১:১২




বছর তিনেক আগে রাজু ভাস্কর্যের সামনে উড়ন্ত ভঙ্গিতে ছবি তুলেছিলো একটা মেয়ে। তার নাম ইরা।

ইরার ওই ছবিটাই হওয়া উচিত বাংলাদেশের মেয়েদের প্রতীক। আমাদের মেয়েদের মেধা আছে, অদম্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম ও তার আসল বাস্তবতা

লিখেছেন নীল আকাশ, ০৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭







বাংলাদেশের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার নামে যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষের সাথে ভন্ডামি করে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য উপরের ছবিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‌এই সমস্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

কওমি সমস্যার সমাধান কি?

লিখেছেন প্রফেসর সাহেব, ০৫ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

দেশে বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কত জানেন? অসংখ্য। এর নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা কেউ দিতে পারেনাই, নামে বেনামে নিবন্ধিত অনিবন্ধিত মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি, মার্কিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×