সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার হওয়া ৮ জন ও ঢাকায় ফেরত পাঠানোর পর আবার ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচজন নিয়ে এবার সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার হয়েছে মোট ১৩ জন। এর আগে ২৭ জন বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করেছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ দুই দফায় মোট ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে। সিঙ্গাপুরে দুই দফায় মোট ৪০ জন গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গে জঙ্গীবিরোধী অভিযানসহ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সিঙ্গাপুরের পত্রিকা স্ট্রেইট টাইমস জানিয়েছে, যে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বয়স ২৬ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তাদের দলের নাম ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি)।
সিরিয়া এবং ইরাকে গিয়ে আইএসে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। গত মাসে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিঙ্গাপুরের আইএসএ। গ্রেফতারকৃতদের দলনেতা মিজানুর রহমান (৩১)। তিনি চলতি বছরের মার্চে আইএসের বাংলাদেশ শাখা হিসেবে আইএসবি গঠন করে। বাকি সাতজনের নাম মামুন লিয়াকত আলী (২৯), সোহাগ ইবরাহিম (২৭), মিয়া রুবেল (২৬), দৌলত জামান (৩৪) শরিফুল ইসলাম (২৭) হাজী নুরুল ইসলাম হওলাদার (৩০) এবং ইসমাইল হাওলাদার (২৯)। ঢাকায় যে পাঁচজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গ্রেফতার করেছে তারা হলেনÑ মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান (৩৮), মিয়া পাইলট (২৯), আলমগীর হোসেন (৩১), তানজিমুল ইসলাম (২৪) ও মাসুদ রানা ওরফে সন্টু খান (৩১)। একই কারণে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরত পাঠানো পাঁচ বাংলাদেশীকে মঙ্গলবার রাজধানীর বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি।
সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়া এবং ইরাকে গিয়ে জঙ্গী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ জটিলতাপূর্ণ হওয়ায় তারা বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। সহিংস কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করে। সিঙ্গাপুরে গ্রেফতারকৃতরা বাংলাদেশে ফিরে আইএসের শাখা গঠনের পরিকল্পনা করেছিল।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এপ্রিলে সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় ৮ বাংলাদেশীকে। তারা একটি গোপন দলের সদস্য। গত মার্চে সিঙ্গাপুরে রহমান মিজানুর নামের এক বাংলাদেশী একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন, যার নাম দেন ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি)। আটক হওয়া ব্যক্তিরা ওই সংগঠনের সদস্য। বাংলাদেশে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ ষড়যন্ত্র করা হয়। সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেয়া ছিল গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মূল পরিকল্পনা। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং সরকারী ও সেনা কর্মকর্তাদের নামের তালিকা। তালিকায় পাওয়া এসব কর্মকর্তাকে হামলার লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এমনকি তাদের কাছে যেসব অস্ত্র পাওয়া গেছে সেসবের সঙ্গে আইএস ও আল কায়েদা সদস্যদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মিল রয়েছে বলে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ৩১ বছর বয়সী মিজানুর একজন দক্ষ কর্মীর পাসধারী। অপর সাতজন নিম্নপর্যায়ের কর্মী। নির্মাণ ও জাহাজ শিল্প কারখানায় কাজ করতেন তারা। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে একজন জানান, আইএসবির আরও দুই সদস্য রয়েছে বাংলাদেশে। আইএসবি নামের এই সংগঠনটি বাংলাদেশ থেকে আরও অনেককে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশে ফিরে হামলা চালানোর লক্ষ্যে অস্ত্র কেনার জন্য তারা অর্থ যোগাড় করছিলেন। মন্ত্রণালয় তাদের ওই অর্থ জব্দ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার হওয়া ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে আইএসবির দলনেতা মিজানুর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলেছেন, আইএসের নির্দেশ পেলে তিনি দেশের যে কোন জায়গায় হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে সিঙ্গাপুরও হামলার লক্ষ্য ছিল কি-না, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৬ নবেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে আইএস ও আল কায়েদার মতো উগ্র জঙ্গী সংগঠনগুলোকে সমর্থন করার অভিযোগে সিঙ্গাপুর সরকার ২৭ বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ২৬ জনকে ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে ও একজন সিঙ্গাপুরের কারাগারে আটক আছে। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো এই ২৬ জনের মধ্যে ১৪ জন এখন কারাগারে। তবে আইএস বা আল কায়েদার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন তারা।
ঢাকায় গ্রেফতার ৫ জন ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, গত ২৯ এপ্রিল পাঁচ বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাদের। তারা হচ্ছেনÑ মিজানুর রহমান, রানা, আলমগীর, তানজিমুল ইসলাম ও সন্তু খান। তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে যান গ্রেফার হওয়া পাঁচজন। সিঙ্গাপুরে গিয়ে তারা জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন তারা। মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসা পাঁচ বাংলাদেশীকে গ্রেফতারের কথা জানিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে। রিমান্ডে নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
আগে গ্রেফতাকৃতদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ॥ গত বছরের নবেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে যে ২৭ বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করা হয়েছিল তারাও বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদী কর্মকা-ে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল বলে তখন জানিয়েছিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতারকৃতরা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য। জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত হয়ে সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ পাঠানোর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে জঙ্গী সন্দেহে আটক ২৭ বাংলাদেশী নাগরিকের মধ্যে ২৬ বাংলাদেশী নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়। এর মধ্যে ১৪ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যে ১৪ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে অভিযোগ আছে, তারা আন্তজার্তিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন। জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ছাড়াও আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জন্য জঙ্গী সংগ্রহের উদেশ্যে সিঙ্গাপুরে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন বলে জানান সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানোর পর গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী সন্দেহভাজনরা। রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে খন্দকার ফিলিং স্টেশনের কাছ থেকে ১৪ জনকে তখন গ্রেফতার করা হয় বলে ডিবির রিমান্ডের আবেদনে উল্লেখ করা হয়। আটককৃতরা সিঙ্গাপুরের নির্মাণশিল্পে কাজ করতেন। এবার যে ৮ জন সিঙ্গাপুরে আটক হয়েছেন এবং সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানোর পর ঢাকায় পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছেন তারাও নির্মাণশিল্পে কাজ করতেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৬ সকাল ৮:২৬