তখন হেফজখানায় পড়ি। সাত - আট সিপারা মুখস্থ করেছি মাত্র। সিপারার সাথে বয়সের তফাৎটাও খুব বেশি না। তো একদিন রাতের কথা। শীতের রাত। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না মূলত খিদের কারনে। এশার নামাজের পর আরও কিছুক্ষণ পড়তে হতো। তারপরই ছিল খাবারের সময়। আমার তখন খেতে ইচ্ছে করেনি। এখন সবাই ডালভাত খেয়ে ভরপেটে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু আমি খিদের চোটে ঘুমুতে পারছি না।
বোর্ডিং ছিল দূরে। খাবারের সময় খাবার আসতো। খাবারের সময় শেষ হলে সাথেসাথে বাসনপত্র ধুয়ে রেখে দেয়া হত। সুতরাং এত রাতে ভাত পাবার কোন আশা তো নেই। ট্রাঙ্কে অবশ্য বিস্কুট আছে। কিন্তু শীতের এমন নিশ্চুপ রাতে কিছুতেই ট্রাঙ্ক খুলবার সাহস হচ্ছিল না।
অনেকটা সময় এভাবেই কেটে যাবার পরও যখন দেখি ঘুম আসছে না তখন উঠে বসলাম। ডিমলাইটের মিহিন আলোতে দুরুদুরু বুকে ট্রাঙ্কের কাছে গেলাম। খুব ধীরেসুস্থে ট্রাঙ্ক খুলে বিস্কুটের পট থেকে বিস্কুট বেরকরে যেই খেতে যাবো তখনই ট্রাঙ্কের ডালাটা সশব্দে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে হাত থেকে বিস্কুটের দূরে ছিটকে পড়ল। সব মিলিয়ে বিরাট রকমের একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গেল।
পাশ থেকে পর্দা সরিয়ে হুজুর ডাক দিলেন, 'কে রে এতো রাতে, এই দিকে আয়, আয় বলছি এই দিকে!'
বেশ কয়েকজন ছাত্রও শোয়া থেকে উঠে বসলো তখন। আমি প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে ট্রাঙ্ক খুলে কী করোস?। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। সামনে কঠিন পরিণাম ভেবে আমি ভয়ে কাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
হুজুর অন্য এক ছাত্রকে বল্ল, 'দেখ্ তো অয় ট্রাঙ্কে কী করতাসিলো'!
তুলনামূলক বড় একজন ছাত্র তখন লাইট জ্বেলে ট্রাঙ্কের বাইরে পড়ে থাকা বিস্কুটের পটটা নিয়ে হুজুরের কাছে আসলো। হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'রাইতে ভাত খাস নাই?', আমি নিচ দিকে তাকিয়ে ডানেবামে দুইবার মাথা নাড়ালাম শুধু। কথা বলার সাহস সাহস পেলাম না। হুজুর সেই ছাত্রকে কাছে ডাকলো। ভাবলাম বেত আনতে পাঠাবে। এত রাতে সকলের ঘুম নষ্ট করার অপরাধে আমি শাস্তি পাব। কিন্তু
হুজুর তখন ওই ছাত্রটিকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিলো - খাবার আছে কি না দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পর সে শুধু এক প্লেট ভাত নিয়ে এসে জানালো ডাল তরকারি কিছুই পাওয়া যায়নি। তখন হুজুর আমাকে বসিয়ে বল্লেন,
'পানি আর লবন দিয়া মাখাইয়া সবগুলো ভাত খা'! আমি চুপচাপ হুজুরের আদেশ পালন করলাম।
স্বাদহীন সেই পানিভাত বা নুনভাত খেয়ে আমার সেদিন এতোটাই ভালো লেগেছিলো যে খেয়েদেয়ে বিছানায় যাবার পরও আরও অনেকটা সময় আমি জেগেছিলাম শুধু অপার্থিব এক ভালো লাগায়, নির্মোহ এক স্নেহের উপলব্ধিতে। কী ঘটে গেল, এটা ভেবে ভেবে আমার মুখে কেবল একটা তৃপ্তির হাসি লেগে ছিল...
আমি জানি না, সেই হুজুর এখন কোথায় আছেন। কেমন আছেন। দেশে আছেন না বিদেশে। ইহকালে না পরকালে। যেখানেই থাকেন, আল্লাহ যেন তাকে সদাসর্বদা হাসিখুশিই রাখেন!
____________________
আহমাদ মাগফুর,
লাখনৌ, ভারত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৮