তখন আব্বার ঈদবোনাস কত ছিলো? পাঁচ থেকে ছয়হাজারের মধ্যেই হবে হয়তো। নিরানব্বইয়ের ঢাকায় আমরা তখন নতুন এসেছি। বড়ো বড়ো দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া করা হয়েছে। এর আগে আমরা ছিলাম নানাবাড়ি ময়মনসিংহে। নানা ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেলের অফিসার। সবুজ মাঠের পাশেই ছিলো ধবধবে সাদা কোয়াটার বাড়ি। মামাখালা ছিলো পাঁচজন। তখনো কারো বিয়ে হয়নি। সবাই পড়ছে। কেউ স্কুলে, কেউ কলেজে। ঘরটা সবসময় ভরেই থাকতো। হাসি আনন্দে কেটে যেতো সময়। এসব ছেড়েই ঢাকা এলাম। আরো আগেই বাবা আমাদের ঢাকা আনতে চেয়েছিলো। নানাই নিষেধ করেছে। আমাদের দুই ভাইবোনকে দেখিয়ে আব্বাকে বলেছে; ওরা আরেকটু বেড়ে উঠুক আর তুমিও ইকটু প্রস্তুতি নাও। আব্বা তখন থেকেই ঢাকায়। বেশ কিছুদিন ঢাকায় একাই ছিলেন।এরপর আমরাও এলাম।
আশপাশের মানুষগুলোকে তখনো চিনে উঠতে পারিনি। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, আমাদেরকে প্রায় সবাই চেনে। বাসা থেকে বেরিয়ে কারো সাথে দেখা হলেই নাম জিঙ্গেস করে। মুরুব্বিরা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। কেউবা আবার চিপস চকলেটও কিনে দেয়, সমোবয়েসী ছেলেগুলি বিকেলে মাঠে তাদের সাথে খেলতেও বলে। এভাবে অল্পকদিনেই শহরের বাতাসটাকে কেমন জানি চেনাজানা মনে হলো। এসব উপরি পাওনার বড়ো কারন হলো; আব্বা বেশ কয়েক বছরধরে অত্র এলাকার ইমাম। এলাকার নাম র্পূবরামপুরা। টিভি ভবনটা কাছেই। সকালে কখনো সখনো আব্বা-আম্মা সবাই মিলে ওদিকে হাটতে যাই। টিভিভবনের পেছনের দিকে তখন বালু ফেলা হচ্ছে। পরিকল্পিত নগর নাকি বানাবে (এখনকার বনশ্রী) । সেখানে বালুর উপর হাটি। আর অবাক হয়ে টিভি ভবনের বিশাল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি; নানাবাড়ি বসে যত মিনা কার্টুন, আলিফ লায়লা, রবিনহুড দেখতাম; সবকিছু নাকি এখান থেকেই ছাড়া হয়! কিভাবে সম্ভব!। তারপরের দিনগুলিতে আমি টাওয়ারের শক্তির কথা ভাবি। ফেলে আসা নানাবাড়ির কথা ভাবি। লিপি আন্টির কথা ভাবি। আলম মামার কথা ভাবি। বন্ধু রিয়েলের কথা, সায়মার কথা ভাবি।
এমন শত ভাবনার মাঝেই একদিন রমজান চলে আসে। রমজান মানে রোজা, আর রোজার পরেই ঈদ। আপাতত সব বাদ দিয়ে আমাদের মাথায় তখন ঈদ ঢুকে যায়। ঈদ মানে ঈদের শপিং। নতুন জামা, নতুন জুতা। এর আগে কখনোই আমরা শপিংমলে গিয়ে শপিং করিনি। বড়োরা মাপমত কিনে এনেছে, আমারা পড়েছি, ব্যাস। এখন আমরাও কিছুটা বড়ো হয়েছি। শহরে এসেছি। মার্কেটে যাবার পূর্ণ আশ্বাসও পেয়েছি। এখন শুধু আব্বার ঈদবোনাসের অপেক্ষা। কেবল বেতনের দিকে তাকানোটা তখন সহজ ছিলো না। অই টাকাটাতো দৈনন্দিন বাজার-সদাই আর বাসাভাড়াতেই সমান সমান। তবু আমরা খুশিকে টেনে ধরি। আম্মার কাছে আব্বার ঈদবোনাসের পরিমাণ জানতে চাই। আম্মা অস্পষ্টকরে কিছু বলে। আমরাও পাঁচ/ছয় একটা পরিমাণ ধরে নেই। অংক খাতায় সেই টাকাটা সবার জন্য ভাগকরি। একটা ভাগ ঈদবাজারের জন্য রাখি। তারপর যে যত পেলাম তাই দিয়ে লিস্ট লেখা শুরু করে দেই। রোজার একেকটি দিন যায় আর আমাদের লিস্ট প্রতিনিয়ত সম্পাদনা হতে থাকে। ছোট হয়, বড়ো হয়। যোগ হয়, বিয়োগ হয়। একদিন দেখি; শখগুলো আমার বাজেট ছাড়িয়ে গেছে। সেদিন আমি আমার লিস্ট থেকে রঙিন চশমা আর হাতঘড়িটা কেটে দিলাম।
আব্বার চোখের আড়ালে এভাবেই আমাদের অঙ্কের খাতাটা যখন লিস্টের ভারে প্রায় ফুরিয়ে আসছিলো; তখনই একদিন, উত্তেজনার সন্ধ্যা আসে। চাঁদ উঠতেও পারে নাও উঠতে পারে। চাঁদ উঠলেই কাল ঈদ। বাসার পাশের মাঠে তখন ছোটবড়ো সকলের ভীড় জমেছে। বড়োরা কয়েকজনকরে ছোটছোট আড্ডার মত জমিয়ে আকাশে চাঁদ খুঁজছে। আর মাঠের এপাশ থেকে ওপাশে চলছে ছোটদের অবিরাম গোল্লাছুট। আমরাও ছোট। কিন্তু ওসব কিছুতেই মিশতে পারছি না। হাসতে পারছি না। কারন আমাদের ঈদের কেনাকাটা কিছুই হয়নি এখনো। চোখেমুখে কালো ছাপ। অথচ সন্ধ্যার ছাইরঙা আকাশে এতোক্ষণে ভেসে উঠেছে নতুন চাঁদের হাসি। অস্থিরতায় যখন দমবন্ধ হবার উপক্রম, তখন বাবা আসলো। আমাদের রেডি হতে বল্লো। রেডিই ছিলাম। সাথেই সাথেই বেরিয়ে গেলাম। সাথে মুবারক আঙ্কেলও। মৌচাক আর মালিবাগ মার্কেট ঘুরে জামাজুতো সব কিনে বোনের ফ্রক কেনার জন্য যখন আলামিন সুপার মার্কেটে ঢুকি; তখন কেউ যেনো পাশের একটা দোকান থেকে ডাকলো। ফিরে দেখি; আবু আঙ্কেল। আমাদের মহল্লারই। তাঁর ছেলে, আমরা, একসাথেই খেলাধুলা করি।আমাদেরকে চেয়ার বেরকরে তিনি বসালেন। বড়োরা চা খেলো আর আমাদের জুস দেয়া হলো। কথা শেষে যখন উঠবো তখন তিনি বল্লেন; তোমরা ঈদে কি উপহার চাও বলো!। আমরাতো চুপ। তখন তিনি উঠতে উঠতে বল্লেন; দেখি,আমার দোকানেই তোমাদের কিছু আছে কি না!। দোকানটা ঘড়ি আর চশমার। এতোক্ষণ হা করে ভেতরের একটা দেয়াল ঘড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কী সুন্দর ঘড়িটা। ঘন্টা বাজার চেইনে দুইটা সবুজ টিয়াপাখি পাশাপাশি ঝুলে আছে। এবার আঙ্কেল আমাদের কাছে ডেকে অবাক করে দিয়ে দুইটা রঙিন চশমা দুজনের চোখে পড়িয়ে এবং দুইটা ঘড়ি দুজনের হাতে বেঁধে দিয়ে বল্লো; কি? পছন্দ হয়েছে?। আমিতো খুশিতে নির্বাক। কিছুই বলতে পারলাম না। কেবল ভাবছিলাম; আমাদের লিস্টের কাটাকুটি কি তিনি কোনভাবে জেনেছেন!। নাহ, এটাতো সম্ভব না। তবে?
হ্যাঁ, তবে’র উত্তরও আমি দিলাম অবশেষে। উত্তরটা হলো; আমাদের মনে লুকিয়ে থাকা সখের কথা, সারা রমজানজুড়ে অঙ্কখাতার গুপন লিস্টি-সম্পাদনার কথা বাবা বা আঙ্কেল না জানলেও অর্ন্তজামী আল্লাহ ঠিকই জেনেছেন। সর্বদ্রষ্টা মালিক সবই দেখেছেন। অতঃপর তিনিই এইসব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। ঘঠনাপ্রবাহ সবটাই এর বাহানা ছিলো মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৬ ভোর ৫:৩৮