“....আমার পরিচয় ?
আমি এই বাংলার একজন গর্বিত নারী যাকে অরক্ষিত ফেলে রেখে
আপনারা প্রাণ ভয়ে পদ্মা পার হয়েছিলেন।
ফিরে এসে গায়ে লেবাস চিড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার। ” পৃ ৬৩
এই উক্তি সাধারণভাবে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে নয়।
বরং সামগ্রীক পুরুষ সমাজকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারণ করেছেন একজন বীরাঙ্গনা।
তিনিই ব্যাখ্যা করেছেন পরের বাক্যে:
“....কিন্তু সুযোগ সন্ধানী পুরুষ, অন্তরে ছিলেন রাজাকার মুখে বলেছেন ‘জয়বাংলা’
মনে মনে উচ্চারণ করেছেন ‘তওবা’ ’তওবা’ !
নইলে এইযে রক্তবীজের ঝাড় রাজাকার, আলবদর
এরা কি পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে ?
না এরাই আপনারা, আপনাদের ভাই বন্ধুরা....” পৃ ৬৩
একই কথা আর একটু নরম করে বলেছেন অন্য আর একজন বীরাঙ্গনা এভাবে:
ওরা আমাদের একা ফেলে রেখে দেশের কাজে গিয়েছিল এ কথা সত্যি;
কিন্তু আমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছিল কার ওপর?
একবারও কি আমাদের পরিনামের কথা ভাবেনি?
আমরা কেমন করে নিজেদের বাঁচাবো,
যুদ্ধের উন্মাদনায় আমাদের কথা তো কেউ মনে রাখেনি।
পেছনে পড়েছিল গর্ভবতী স্ত্রী, বিধবা মা, যুবতী ভগ্নি কারও কথাই সেদিন মনে হয়নি।
অথচ তাদের আত্বরক্ষার কোনও ব্যাবস্থাই ছিল না।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা মরে বেঁচেছেন, গর্ভবতী পত্নির সন্তান গর্ভেই নিহত হয়েছে।
যুবতী স্ত্রী, তরুনী ভগ্নি পাক দস্যুদের শয্যাশায়িনী হয়েছে।
অথচ আজ যখন বিজয়ের লগ্ন এসেছে,
মুক্তির মূহুর্ত উপস্থিত হয়েছে তখনো একবুক ঘৃণা নিয়ে
তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে সামাজিক জীবেরা ।
একটা পথই এসব মেয়েদের জন্য খোলা ছিল- তা হল মৃত্যু ।
নিজেকে যখন রক্ষা করতে পারেণি তখন মরেনি কেন?
সে পথ তো কেউ আটকে রাখেনি। কিন্তু কেন মরবো?
সে প্রশ্ন তো আমার আজও।
মরিনি বলে আজও আর পাঁচজনের মতো আছি,
ভালই আছি জাগতিক কোনো সূখেরই অভাব নেই।
নেই শুধু বীরাঙ্গনার সম্মান। উপরন্তু গোপনে পাই ঘৃণা,
অবজ্ঞা আর ভ্রকুঞ্চিত অবমাননা।” পৃ: ৪৮
উপরের কথাগুলি যে বীরাঙ্গনার তার নাম রীনা।
মেহেরজান (এই নামে সম্তাবত তাঁর গল্প নিয়েই একটা বাংলা সিনেমা হয়েছে।
৪/৫ বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকা আছে সেটা)
নামে আর এক বীরাঙ্গনার কথায় রীনার কথার উত্তর মিলে। তিনি বলেছেন:
“....শুধু পাকিস্তানী দস্যু নয়, নিজেদের দুবৃত্তদেরও চিনেছি এ দুর্দিনে ।
যারা আমাদের যায়গা দেবে তাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে ?
নিজেরা তো মরেছি, ওরা তো এমনি মরে আছে, ওদের আর মেরে লাভ কি? ” পৃ:৩৩
বীরাঙ্গনা কারা কি তাদের পরিচয় এ বিষয়ে বলার ইচ্ছা নেই।
বইটা দুই খন্ডে রচিত । তৃত্বীয় খন্ড প্রকাশে লেখক অক্ষমতা জানিয়েছেন। তাঁর কারণ ?
কারণ আমাদের কৌতুহল। অতি কৌতুহল ।
অনেকেই লেখককে পীড়াপীড়ি করেছেন বইয়ে উল্লেখীত বীরাঙ্গনাদের বর্তমান নাম ঠিকানার জন্য।
তাদের একনজর দেখে তারা কোনো বিলুপ্তপ্রায় প্রানী দর্শণ (ধ ও হতে পারে) করতে কৌতুহলী।
লেখকের বক্তব্য এরকম:
“...উপরন্তু অনেক সহৃদয় উৎসুক ব্যাক্তি
এঁদের নাম ঠিকানা জানবার জন্য আমাকে যথেষ্ট পরিমান বিব্রত করেছেন।
আমার ধারণা একদিন যাদের অবহেলাভরে সমাজচ্যুত করেছি,
আজ আবার নতুন করে তাদের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে ,
নতুন করে তাঁদের বেদনার্ত ও অপমানিত করা ঠিক হবেনা।
এ কারণে তৃত্বীয় খন্ড প্রকাশে আমি অক্ষম।
আমি আপনাদের মার্জণা ভিক্ষা করছি। ”
----অখন্ড সংস্করণের ভূমিকা। জাগৃতি প্রকাশনী।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৫৫