মূল :দার রাহে হাক প্রকাশনীর লেখকবৃন্দ
ভাষান্তরে : মীর আশরাফুল আলম
بسم الله الرحمن الرحیم
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু
আল্লাহর নামে
) و َلَقَدْ كَتَبْنا فِى الزِّبُورِ مِنْ بَعْدِ الذِّكْرِ اَنَّ الْأرْضَ يَرِثُها عِبادِىَ الصَّالِحُونَ (
তৌরাতের পরে যাবুরের মধ্যেও আমরা উল্লেখ করেছি যে আমার সৎকর্মশীলবান্দারাই হবে জমিনের উত্তরাধিকারী(আম্বিয়া : ১০৫)।
ভূমিকা
শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষার পর ,পাহাড়সম ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি ,দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্তের অধিকারী এক অশ্বারোহী আসবে তাঁর ঐশী হাতের তরবারীটি হীন ,নীচ ও জঘন্য লোকদেরকে ধ্বংস করার জন্য ঝংকিত হবে। ভাল মানুষের হেদায়েতের জন্য তার নূরের ছটা প্রজ্জলিত হবে। তিনি আসবেন মানবতার সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনীতে উজ্জ্বল এক উল্কার ন্যায় ,অসত্যের ভয়ংকর পদভূমিতে মহা সত্যের প্রতীক হিসাবে মুহাম্মদ (সা.)-এর পাগড়ি মাথায় ,তাঁর আলখেল্লা পরিধান করে ,তাঁর জুতা পায়ে দিয়ে ,তাঁর কোরআন বুকে নিয়ে এবং আলী (আ.)-এর যুলফিকার (তরবারী) তার হাতে ,যাহরা (সা .আ.)- এর ভালবাসা অন্তরে ধারণ করে ,ইমাম হাসান (আ.)-এর মতো ধৈর্য রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বে ,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মতো সাহসিকতা তার পদক্ষেপে ,ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর মত ইবাদতকারীর খ্যাতি নিয়ে ,ইমাম বাকির (আ.)-এর মত জ্ঞানের ভাণ্ডার ,ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর মত মহানুভবতা ,ইমাম রেযা (আ.)-এর সন্তুষ্টি ,ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর দানশীলতা ,ইমাম হাদী (আ.)-এর হেদায়েত ,ইমাম আসকারী (আ.)-এর ভাবমূর্তি নিয়ে তিনি আসবেন ...।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত নবুয়ত ও ইমামতের প্রতিচ্ছবি ,সমস্ত নবীর বৈশিষ্ট্যে তাঁর অস্তিত্বে প্রতিফলিত ,যেমন হযরত আদম (আ.)-এর মতো মনুষ্যত্বকে আলোকিত করা ,হযরত নূহ (আ.)-এর মতো শতবছর ধরে কষ্ট ও নিপীড়নের বোঝা বহন ,হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মতো তাওহীদের ধ্বনি দিয়ে মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে চুরমার করবেন ,যেমন হযরত মূসা (আ.)-এর ন্যায় ফিরাউনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবেন ,হযরত ঈসা (আ.)-এর ন্যায় মৃত মানুষকে জীবিত করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ন্যায় বিশ্ববাসীর কল্যাণ ও সফলতা বয়ে আনবেন ... ।
যখন তিনি নামায পড়বেন চিরন্তন সত্তার প্রকৃত ইবাদতকারীর প্রতীক স্বরূপ ,যখন তিনি উপদেশ দান করবেন তাঁর কথায় নবীদের উপর নাযিলকৃত ওহীর আওয়াজ ভেসে উঠবে ,তাঁর গর্জন শতাব্দীকে প্রকম্পিত করবে ,অত্যাচারীদের তলোয়ারের ঝন ঝনানি চির দিনের জন্য থামিয়ে দিবেন ,তাঁর কিয়াম কিয়ামতের ন্যায় পৃথিবীকে জাগরিত করবে ,যেহেতু তাঁর আবির্ভাবের অর্থই হচ্ছে ধার্মিকতার উত্থান সেহেতু দীন ইসলামকেই পৃথিবীর উপর প্রতিষ্ঠিত করবেন ,যেহেতু তাঁর হাতদুটি উর্বর ফলদায়ক গাছের ডাল পালার ন্যায় (অর্থাৎ ইমামতেরই অংশ বিশেষ) জমিন এবং আসমানের মধ্যে যোগ সূত্র স্থাপন করবে (অর্থাৎ পৃথিবীকে এমন আধ্যাত্মিকতায় ভরে দিবে যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হবে) ,যেহেতু তার বাণীসমূহ আল্লাহ্ তা ’ য়ালার ওহীর সহগামী তাই ফেরেশতাদেরকেও মানুষের পাশা পাশি ডাকবেন ...।
যখন তাঁর উত্থান ঘটবে বিভ্রান্তিসমূহের বিলুপ্তি ঘটবে ,তিনি যখন শির উঁচু করবেন হেদায়েতের পতাকা উত্তোলিত হবে ,তাঁর উত্থানস্থল বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের বধ্যভূমি ,তাঁর নাম মানবতার শত্রুদের কাছে মৃত্যুদূতের স্মরণ ,তাঁর আবির্ভাব অত্যাচারীদের যবনিকা টানবে ,তাঁর অবস্থান সৎকর্মশীলদের জন্য কল্যাণকর ,তাঁর অন্তর্ধান নিপীড়িতদের জন্য দীর্ঘতম রজনী স্বরূপ এবং তাঁর আবির্ভাব প্রতীক্ষমান সত্যিকার প্রেমিকদের জন্য শুভ সকাল।
তিনি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করেবেন ,মানুষ যে আল্লাহর খলিফা তার প্রকৃত অর্থকে তাদের সামনে তুলে ধরবেন ,তাঁর অস্তিত্ব আল্লাহর উপর ঈমানের বৃহৎ অলৌকিক নিদর্শনসমূহের একটি ,তার অন্তর্ধান হচ্ছে অদৃশ্যের ব্যাখ্যাকারী ,তাঁর আবির্ভাব আখেরাতের সু-সংবাদদাতা ,তাঁর কিয়াম জিহাদ ও ঐশী প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যাকারী ,তাঁর ভাষ্যই কোরআনের ব্যাখ্যা ,পথহারাদের জন্য তাঁর দৃষ্টি নবীদের ভালবাসায় ভরা সমুদ্রের তরঙ্গ স্বরূপ অবশেষে তিনিই একমাত্র ভরসা যিনি দীনের প্রকৃত সৈনিকদেরকে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন এবং নবীদের মিশন ও তাদের কষ্টকে ফলাফলে পৌঁছাবেন ...।
সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
নাম : মাসুম (পাক ও পবিত্র) ইমামগণ তাদের অনুসারীদেরকে ইমাম মাহ্দী (আ.) -এর নাম উচ্চারণ করতে বারণ করেছেন। আর এ বিষয়ে এতটুকুই বলেছেন যে ,আমাদের নবী (সা.)-এর নাম ও ডাক নামই তার নাম ও ডাক নাম ১ এবং তাঁর আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত তাঁর আসল নাম উচ্চারণ করা ঠিক হবে না। ২
উপাধি : এই মহান ব্যক্তির সব থেকে পরিচিত উপাধিগুলো হচ্ছে যথাক্রমে মাহ্দী ,কায়েম ,হুজ্জাত ও বাকিয়াতুল্লাহ্ ।
পিতা : ইমামতের আকাশের একাদশতম নক্ষত্র হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.)।
মাতা : সম্মানীতা ও সম্ভ্রান্ত রমণী নারজীস। তিনি ছিলেন রোম সম্রাটের দৌহিত্রা।
জন্ম তারিখ : ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শা ’ বান রোজ শুক্রবার।
জন্মস্থান : ইরাকের সামাররা শহরে।
বয়স : এখন আরবী ১৪৩৬ সন ,আর তিনি আরবী ২৫৫ সনে জন্ম গ্রহণ করেছেন ;সে অনুযায়ী তাঁর বয়স আনুমানিক একহাজার একশ একাশি বছর চলছে। আর এভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন চান। আর তিনি একদিন আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের অনুমতিতেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীকে অত্যাচার ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে সমস্ত স্থানে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মে হযরত মাহ্দীর উপর বিশ্বাস
ইমাম মাহ্দী (আ.) যিনি আল্লাহর তরফ হতে পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য আসবেন। বিভিন্ন মাযহাব ও দীনের লোকদেরকে তাঁর উপর বিশ্বাস রাখতে দেখা যায়। শুধুমাত্র শিয়ারাই নয় বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা ’ য়াত ও অন্যান্য দীন যেমন ইহুদী ,খৃস্টান ,অগ্নিপূজক ,হিন্দু সবাই আল্লাহর পক্ষ হতে একজন ঐশী সংস্কারকের আবির্ভাবের বিষয়টি স্বীকার করে এবং তাদের ধর্ম গ্রন্থ এরূপ ব্যক্তির আগমনের ঘোষণা দিয়েছে। তারা ও তাঁর অপেক্ষায় দিন গুনছে।
হিন্দু ধর্মের “ দিদ ” নামক ধর্মীয় গ্রন্থে এভাবে লেখা হয়েছে যে : এই পৃথিবী মন্দে (অত্যাচার ,জুলুম ,নিপীড়ন ,অন্যায় ,অবিচার) পূর্ণ হওয়ার পর শেষ জামানায় একজন বাদশাহ্ আসবেন যিনি সৃষ্টি কূলের জন্য পথ প্রদর্শক হবেন। তার নাম মানসুর বা সাহায্যপ্রাপ্ত। ৩ সমস্ত পৃথিবীকে তিনি তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবেন। কে মু ’ মিন আর কে কাফের চিনতে পারবেন। আর তিনি আল্লাহর কাছে যা কিছুই চাইবেন আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তাই তাকে দিবেন। ৪
যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা যারথুষ্ট্রের এক শিষ্যের লেখা “ জামাসব ” নামক বইতে এভাবে উল্লেখ আছে যে : আরবের হাশেমী বংশ থেকে এমন এক লোকের আবির্ভাব হবে যার মাথা ,দেহ ও পা যুগল হবে বিশালাকারের। তাঁর পূর্বপূরুষের দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ঐ ব্যক্তি বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইরানে আসবে এবং এই দেশকে সুখ-শান্তি ,সত্য ও ন্যায়ে পূর্ণ করবেন। আর তাঁর ন্যায় পরায়ণ শাসনে বাঘ ও ছাগল একই ঘাটে পানি পান করবে। ৫
যারথুষ্ট্রদের ধর্মীয় গ্রন্থ “ যানদ ” -এ বর্ণিত হয়েছে যে ,ঐ সময় ইয়ায্দানদের (অগ্নিপূজকদের খোদাদের) পক্ষ হতে বড় ধরনের বিজয় আসবে এবং আহরিমানকে (অশুভ আত্মাকে বা শয়তানকে) নিশ্চিহ্ন করবে। আর পৃথিবীতে আহরিমানের (শয়তানের) সমস্ত অনুচরদেরকে নিরাশ্রয় করা হবে। ইয়াযদানদের বিজয় ও আহরিমানের পরাজয়ের পর এই পৃথিবী তার প্রকৃত পূর্ণতায় পৌঁছাবে এবং আদম সন্তানরা সৌভাগ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবে। ৬
তওরাতে “ সেফরে তাকভীন ” হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশ থেকে যে বারজন ইমাম আসবেন ,তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে : ‘ ইসমাইলের জন্য তোমার দোয়া শুনেছি এ কারণে তাকে বরকতময় করেছি এবং বংশধরের মধ্যে বারজন নেতার আবির্ভাব ঘটাব এবং তাকে বিশাল উম্মত দান করব। ’ ৭
হযরত দাউদ (আ.)-এর মাযামিরে উল্লিখিত হয়েছে : ‘ অবশ্য সৎকর্মশীলদেরকে মহান আল্লাহ্ সাহায্য করবেন সৎকর্মশীলরা এমন এক ভূমির উত্তরাধিকারী হবে যার মধ্যে তারা স্থায়ী হবে। ’ ৮
আর পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ করা হয়েছে :
) و َ لَقَدْ كَتَبْنا فِى الزَّبُورِ مِنْ بَعْدَ الذِّكْرِ أَنَّ الْاَرْضَ يَرِثُها عِيبادِىَ الصَّالِحُونَ ( .
নিশ্চয়ই আমরা জিকরের (অর্থাৎ তওরাতের) ৯ পর যাবুরের (দাউদ) ১০ মধ্যে লিখেছি যে আমার সৎকর্মশীল বান্দারাই জমিনের উত্তরাধিকারী হবে। ১১
পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে :
) و َعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَ عَمِلُوا الصَّالِحاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى الْارْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الّذينَ مِنْ قَبْلِهِمْ و لَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِى ارْتَضَى لَهُمْ وَ لَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْناً يَعْبُدُونَنِى لا يُشْرِكُونَ بِى شَيْئاً (
আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তোমাদের মধ্যে থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদের প্রতি ওয়াদা দিয়েছেন যে ,তাদেরকে জমিনের বুকে নিজের খলিফা ও প্রতিনিধি নিযুক্ত করবেন। যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের খেলাফত ও প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন। যে দীনকে আল্লাহ্ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করবেন , (এই শর্তে) যে ,শুধুমাত্র আমার ইবাদত করবে এবং কোন কিছুকে আমার সাথে শরিক করবে না। ১২
আরও উল্লেখ আছে যে
) و َ نُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِى الْارْضِ وَ نَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَ نَجْعَلَهُمُ الْوارِثِينَ (
পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল আমি চাইলাম তাদেরকে (আল্লাহর সেইসব বান্দা যারা অত্যাচারীর অত্যাচারের সামনে শক্তিহীন অবস্থায় ছিল) অনুগ্রহ করতে এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দান ও জমিনের উত্তরাধিকারী করতে। ১৩
এই আয়াতগুলো যা নমুনা স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। তা থেকে এ ধারণা পাওয়া যায় যে ,অবশেষে এই পৃথিবীর দায়িত্ব আল্লাহর যোগ্য অর্থাৎ মু ’ মিন বান্দাদের হাতে আসবে এবং তারাই এর উত্তরাধিকারী হবে। আর এই বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে তারা সমাসীন হবে। মানবজাতি যদি সঠিক পথ এবং আল্লাহর নির্দেশিত বিধান হতে দূরে সরে যায় তবে যতই সে দূরে সরতে থাকে বিচ্যুতির অতল গহবরে তলিয়ে যেতে থাকে। যখন সে পতনের প্রান্তসীমায় পৌঁছায় হঠাৎ তার বিবেক জাগ্রত হয় তখন বুঝতে পারে নিজের শক্তি ,চিন্তা ,জ্ঞান ,কৌশল ও বস্তুগত প্রযুক্তিসমূহ দিয়ে সে বিশ্বে শৃংখলা ,ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়। আর এ অবস্থায় সে এ সত্যও উপলব্ধি করে যে,ওহী ও ঈমান নির্ভর ঐশী নেতৃত্ব অর্থাৎ শুধুমাত্র একজন বিশ্বজনীন ঐশী সংস্কারকই পারে বিশ্ব ও মানব জাতিকে পতন হতে রক্ষা করতে ও মুক্তি দিতে। শুধুমাত্র তার সাহায্যেই পারে তারা পূর্ণতার পথ অতিক্রম করে ন্যায় ,শান্তি ,নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বিশ্বজনীন শাসন প্রতিষ্ঠা করতে।
ইসলামী উৎসসমূহে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্দীর উপর বিশ্বাস
ইসলামের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং নিষ্পাপ ইমামগণ ,বিভিন্ন সময়ে বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ,উত্থান ,দীর্ঘদিন মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকা এবং তার আরও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে খবরা খবর দিয়েছিলেন। তাদের অনেক অনুসারী বা ছাত্ররাই এই খবর বা হাদীসসমূহকে উল্লেখ করেছেন। “ ইমাম মাহ্দী ” গ্রন্থের লেখক তার এই গ্রন্থে নবী (সা.)-এর ৫০ জন সাহাবী ও ৫০ জন তাবেইন (যারা সরাসরি নবীকে (সা.) দেখেন নি কিন্তু তার সাহাবাদেরকে দেখেছেন) যারা হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে লিপিবদ্ধ করেছে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৪
কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও নামকরা কবি অনেক বছর ধরে এমনকি ইমাম মাহ্দীর জন্মগ্রহণের একশত বছর আগে থেকেই এই হাদীসসমূহের ভাবার্থের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের কবিতা রচনা করেছেন :
কুমাইত একজন বিপ্লবী শিয়া কবি (মৃত্যু ১২৬ হিজরী) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উপর রচিত একটি কবিতা ইমাম বাকির (আ.)-এর সামনে পাঠ করে তাঁর আবির্ভাবের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। ১৫
ইসমাইল হামিরী (মৃত্যু ১৭৩ হিজরী ) ইমাম সাদিক (আ.)-এর সংস্পর্শে এসে তাঁর মাধ্যমে হেদায়েত পাওয়ার পর ,একই ছন্দে গাঁথা প্রশংসা মূলক একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করে যা নিম্নে উল্লিখিত হলো :
وَ اُشْهِدُ رَبِّى أَنَّ قَوْلَكَ حُجَّةٌ
عَلَى الْخَلْقِ طُرّاً مِنْ مُطِيعٍ وَ مُذْنِبٍ
بِاَنَّ وَلِىَّ الْامْرِ وَ الْقاَئِمَ الَّذِى
تَطَلَّعَ نَفْسِى نَحْوَهُ بِتَطَرُّبٍ
لَهُ غَيْبَةٌ لا بُدَّ مِنْ أَنْ يَغِيبَها
فَصَلِّىَ عَلَيْهِ اللَّهُ مِنْ مَتَغَيِّبٍ
فَيَمْكُثُ حِيناً ثُمَّ يَظْهَرُ حِينَهُ
فَيَمْلَأُ عَدْلاً كُلَّ شَرْقٍ وَ مَغْرِبٍ
(আর আমার আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি যে আপনার (ইমাম সাদিক) মুখের কথা সমস্ত সৃষ্টির উপর যারা অনুগত ও যারা পাপী ,তাদের সবার উপর দলিল স্বরূপ।
(বলেছিলেন যে) ওয়ালীয়ে আমর (নির্দেশের অধিকর্তা) ও কায়েম (উত্থানকারী) যার জন্য আমার প্রাণ ব্যাকুল ,তাঁর অন্তর্ধান থাকবে যাতে কোন সন্দেহ নেই ,ঐ অন্তর্ধানের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
একটি নির্দিষ্ট সময় অদৃশ্যে থাকার পর আবির্ভূত হবেন। আর পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত অত্যাচার ও জুলুমকে অপসারণ করে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
দে ’ বেল খুযা ’ ই হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন উচ্চমানের সাহিত্যিক ছিলেন (মৃত্যু ২৪৬ হিজরী)। তিনিও এসম্পর্কে একটি প্রশংসামূলক দীর্ঘ কবিতা রচনা করে ইমাম রেজা (আ.)-এর সামনে পাঠ করেন ,যা এরূপ :
فَلَوْلاَ الَّذِى اَرْجُوهُ فِى الْيَوْمِ اَوْ غَدٍ
تَقَطَّعَ نَفْسِى اَثْرَهُمْ حَسَراتٍ
خُرُوجَ اِمامٍ لاَ مُحالَةَ خاَرِجٌ
يَقُومُ عَلَى اسْمِ اللَّهِ وَ الْبَرَكاَتِ
يُمَيِّزُ فِيناَ كُلَّ حَقٍّ وَ باطِلٍ
وَ يَجْزِى عَلَى النَّعْماءِ وَ النَّقَماتِ
আজ অথবা কাল যা কিছু ঘটবে সে বিষয়ে যদি আমি আশান্বিত না থাকতাম তাহলে আমার অন্তর আহলে বাইতের দুঃখে ও অনুতাপে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।
এবং সেই আশা ,এমন এক ইমামের অবির্ভাবের জন্য যিনি নিঃসন্দেহে আবির্ভূত হবেন। যিনি আল্লাহর নাম ও বরকত সাথে নিয়ে কিয়াম করবেন। আর তিনি আমাদের মধ্যকার সত্য ও বাতিলকেও পৃথক করবেন এবং ভাল কাজের পুরস্কার ও খারাপ কাজের শাস্তি দিবেন। ১৬
যখন দে ’ বেল এই কবিতাটি পাঠ করলো ইমাম রেজা (আ.) মাথা তুলে বললেন : ওহে খুযা ’ ই! এই কবিতাটিকে রুহুল কুদুস তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন। আরও বললেন : তুমি কি জান সেই ইমাম কে ?
দে ’ বেল : না জানিনা। শুধু এতটুকুই শুনেছি যে ,একজন ইমাম আপনার বংশ থেকে আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইমাম : ওহে দে ’ বেল! আমার পরে আমার ছেলে মুহাম্মদ (ইমাম জাওয়াদ) ইমাম ও তারপর তার ছেলে আলী (ইমাম হাদী) ,তারপর তার ছেলে হাসান (ইমাম আসকারী) এবং তারপর তার ছেলে ‘ হুজ্জাতে কায়েম ’ যে থাকবে লোক চক্ষুর অন্তরালে আর মানুষ থাকবে তার অপেক্ষায়। যখন তাঁর আবির্ভাব ঘটবে সবাই তাকে অনুসরণ করে চলবে। যদি দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার মাত্র আর একদিনও বাকি থাকে আল্লাহ্ সেই দিনকে এতটা দীর্ঘ করে দিবেন যাতে করে সেই কায়েমের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং দুনিয়াতে অত্যাচার ও জুলুমের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। অত্যাচার ও জুলুমের পরিমান যতই বেশী হোক না কেন। ১৭
অন্যান্য আরও কিছু সংখ্যক কবি ও লেখক যারা ইমামগণের সমসাময়িক অথবা ইমামগণের সমসাময়িক কবিদের ছাত্র ছিল ,তারা তাদের কবিতায় পরিষ্কারভাবে হযরত মাহ্দী (আ.)-এর বিষয়ে ইশারা করেছে। ১৮ কখনও কখনও এমন হয়েছে যে ইমামদের কাছে অনেকেই প্রশ্ন করত ,আপনি কি রাসূলের বংশের সেই উত্থানকারী (কায়েম আলে মুহাম্মদ) অথবা প্রতীক্ষিত মাহ্দী (মাহ্দী মুনতাযার) ?ইমামগণ তাদের প্রশ্নের উত্তরে স্থান ,কাল ,পাত্র ভেদে ইমাম মাহদী আল কায়েম (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরতেন।
আর এ সম্পর্কিত (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবের) হাদীসসমূহের প্রসিদ্ধির কারণেই তাঁর জন্মের পূর্ব থেকেই অনেকেই নিজেদেরকে মাহ্দী হওয়ার মিথ্যা দাবী করেছে অথবা তাদেরকে মাহ্দী বলে অভিহিত ও প্রচার চালিয়ে অন্যরা এই পথে সুবিধা আদায় করেছে। উদাহরণ স্বরূপ : কিসানিয়াহ্ ফেরকার অনুসারীরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের প্রায় দুইশত বছর আগে মুহাম্মদ হানাফিয়াকে ইমাম ও প্রতীক্ষিত মাহ্দী বলে মনে করত। আর তাদের ধারণা ছিল যে ,সে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। একদিন আবার আবির্ভূত হবে। তারা তাদের দাবি অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে নবী (সা.) ও অতীত ইমামগণের নিকট থেকে যে সকল হাদীস শুনেছিল তা মুহাম্মদ হানাফিয়ার ব্যাপারে বলতে শুরু করলো। ১৯ আব্বাসীয় খলিফা মাহ্দীও নিজেকে “ প্রতিশ্রুত মাহ্দী ” বলে মানুষের মাঝে পরিচিত করাতে চেয়েছিল যাতে করে ইমাম মাহ্দীর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত ও শিয়া মাযহাবের অনেক আলেমই ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে বিভিন্ন রেওয়ায়েত ও হাদীস তাদের লিখিত বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন। ২০ মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল (মৃত্যু ২৪১ হিজরী) ও সহীহ বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হিজরী) যা আহলে সুন্নতের আলেমদের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য তাতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের অনেক আগেই তাঁর ব্যাপারে হাদীস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ২১
হাসান বিন মাহবুব কর্তৃক লিখিত “ মাশিখাহ্ ” বইটি যা মরহুম তাবরাসীর ভাষ্য অনুযায়ী ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দীর্ঘ কালীন অন্তর্ধানের একশত বছর পূর্বে লিখিত হয়েছে। তাতে ইমামের অন্তর্ধান সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ২২ মরহুম তাবারসী আরও বলেন যে ,ইমাম বাকির ও সাদিক (আ.)-এর সময়কার শিয়া মুহাদ্দিসরা ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানে থাকার বিষয়টিকে তাদের গ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন। ২৩
আরও কিছু শিয়া ও সুন্নি মনীষী প্রতীক্ষিত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন ২৪ যার কিছু কিছু তার জন্মের পূর্বেই রচিত হয়েছে। রাওয়াজনী (মৃত্যু ২৫০ হিজরী) একজন সুন্নি আলেম ,তিনি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর জন্মের আগেই তাঁর সম্পর্কে “ আখবারুল মাহ্দী ” নামে একটি বই লিখেন। ২৫ ইমামদের কিছু সাহাবাও যেমন : আনমাতী ,মুহাম্মদ বিন হাসান বিন জুমহুর ইমামের জন্ম ও তাঁর অন্তর্ধানের পূর্বেই তাঁর সম্বন্ধে বই লিখেন। ২৬
তাঁর বিষয়ে এত পরিমানে হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে ,ইসলামের অন্য কোন বিষয়ে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয় নি। শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের আলেমদের দৃষ্টিতে এই সকল হাদীসগুলো সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত। শুধুমাত্র শিয়া আলেমরাই নন বরং অনেক সুন্নি আলেমও এগুলোকে মুতাওয়াতির বলে স্বীকার করেছেন। ২৭ যেমন সাজযী (মৃত্যু ৩৬৩ হিজরী) তার “ মানাকিবুস শাফিয়ী ” নামক গ্রন্থে লিখেছেন : হযরত মাহ্দী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ যা নবী (সা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তা মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পড়ে। ২৮
শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের সূত্রসমূহে ইমাম মাহ্দীর ব্যাপারে যত হাদীস পাওয়া গেছে তা যদি গণনা করা হয় নিঃসন্দেহে তা এত অধিক পরিমানে হবে যে ,ইসলামের নিশ্চিত বিশ্বাসের বিষয়েও অর্থাৎ যে সকল বিষয়ে মুসলমানরা কোন প্রকার সংশয় রাখেনা বা যে বিষয়গুলোকে মেনে চলা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে তার ব্যাপারেও এত পরিমান হাদীস বর্ণিত হয় নি। ২৯
এ কারণেই মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাসের সেই প্রথম থেকেই মাহ্দী মওউদের (প্রতিশ্রুত মাহদী) আবির্ভাব ও উত্থানের বিষয়ে অবগত ছিল। বিশেষ করে শিয়া মাযহাবের অনুসারী যারা নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের হাতে দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছিল। এ জন্যেই তারা এই বিষয়ের উপর শক্ত ও মজবুত বিশ্বাস রাখতো এবং অন্যান্য ইমামদের জীবদ্দশাতেও ইমাম মাহ্দীর জন্মের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতো।
বিভিন্ন হাদীসে হযরত মাহ্দীর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে তিনি হাশেমী বংশের হযরত ফাতিমা (সা.)-এর সন্তান ,শহীদদের সর্দার ইমাম হুসাইনের বংশধারা হতে হবেন। তাঁর পিতার নাম হচ্ছে হাসান এবং তাঁর নিজের নাম ও ডাক নাম নবী (সাঃ)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। গোপনে জন্মগ্রহণ করবেন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন-যাপন করবেন। দুইটি অন্তর্ধান হবে। যার একটি স্বল্প মেয়াদী অপরটি দীর্ঘ মেয়াদী। যতদিন আল্লাহ্ চাইবেন অন্তর্ধানে থাকবেন। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে আবির্ভূত ও কিয়াম (মহাবিপ্লব) করবেন। আর সারা বিশ্বে দীন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। পৃথিবীকে অত্যাচার ,জুলুম থেকে মুক্ত করে সেখানে আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবেন।
এই হাদীসগুলোতে দ্বাদশ ইমামের শারীরিক ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। আমরা এখানে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি হাদীস তুলে ধরব। সুন্নি ও শিয়া মাযহাবের হাদীসগুলোকে আমরা এখানে পৃথক পৃথকভাবে তুলে ধরবো যাতে করে পাঠকের বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
সুন্নি মাযহাবের হাদীস থেকে
১-রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত মাহ্দী (আ.)-এর অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবের ব্যাপারে বলেছেন : যদি দুনিয়ার বয়স শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকী থাকে ,আল্লাহ্ আমার বংশের থেকে একজনকে পাঠাবেন এই দুনিয়াতে সুবিচার ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ,যতই অন্যায় ও অত্যাচার দুনিয়াকে গ্রাস করে ফেলুক। ৩০
২-নবী (সা.) বলেছেন : ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না যতদিন পর্যন্ত না আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে একজন এই দুনিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করবে ,যার নাম আমার নামের অনুরূপ হবে। ৩১
৩-মহানবী (সা.) বলেছেন : যেমন আলী আমার পরে উম্মতের ইমাম এবং প্রতীক্ষিত মাহদী (তাঁর সন্তানদের মধ্যে থেকে) যখন আবির্ভূত হবে জমিনকে ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ করবে পৃথিবী তখন যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না কেন। তাঁর কসম যিনি আমাকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছেন। সন্দেহাতীতভাবে যারা তাঁর অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায়ও তাঁর উপর দৃঢ় ঈমান রাখবে তাদের সংখ্যা বিরল পরশমনির থেকেও কম হবে।
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ উঁঠে দাঁড়িয়ে বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ,আপনার সন্তান মাহ্দী কি অন্তর্ধানে থাকবেন ?
বললেন : হ্যাঁ। আমার আল্লাহর কসম। মুমিনরা পরীক্ষিত ও পরিশুদ্ধ হবে আর কাফেররা ধ্বংস হয়ে যাবে। হে জাবির! এই নির্দেশ আল্লাহরই একটি নির্দেশ। এই রহস্যপূর্ণ বিষয়টি তাঁর গুপ্ত বিষয়াবলীর মধ্যে একটি যা তাঁর বান্দাদের কাছে তিনি গোপন রেখেছেন ,এটার ব্যাপারে সন্দেহ করা থেকে দূরে থাক কেননা আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে সন্দেহ করা কুফরী কাজ। ৩২
৪-উম্মুল মু ’ মিনীন উম্মে সালামা বলেন : রাসূলুল্লাহ্ প্রতিশ্রুত মাহ্দীর কথা স্মরণ করে বলেছিলেন : হ্যাঁ। সে সত্য এবং সে ফাতিমার বংশধর থেকে আসবে। ৩৩
৫-হযরত সালমান ফারসী বলেন : একদিন নবী (সা.)-এর নিকট গিয়ে দেখলাম ,হুসাইন বিন আলীকে নিজের উরুর উপর বসিয়ে তার চোখগুলোতে ও ঠোঁটে চুম্বন করছেন আর বলছেন : তুমি নেতা ,নেতার সন্তান ও নেতার ভাই ,তুমি ইমাম ,ইমামের সন্তান ও ইমামের ভাই ,তুমি আল্লাহর হুজ্জাত (স্পষ্ট ও প্রামাণ্য দলিল) ,আল্লাহর হুজ্জাতের সন্তান ও তাঁর হুজ্জাতের ভাই ,তুমি আল্লাহর নয়জন প্রামাণ্য দলিলের পিতা তাদের মধ্যে নবম ব্যক্তি হচ্ছে প্রতীক্ষিত মাহ্দী। ৩৪
৬-ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন : হাসান বিন আলী আসকারীর স্থলাভিষিক্ত উপযুক্ত সন্তানই সাহেবুজ্জামান (সময়ের অধিপতি) আর সেই হচ্ছে মাহ্দী মওউদ (প্রতীক্ষিত মাহ্দী)। ৩৫
৭-মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) বলেছেন : তোমাদেরকে মাহ্দীর সুসংবাদ দিচ্ছি ,সে আমার উম্মতের মধ্য থেকেই অভিষিক্ত হবে। যখন আমার উম্মত মতপার্থক্যের ও পদস্খলনের মধ্যে থাকবে। সে জমিনকে পরিপূর্ণভাবে ন্যায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ভরে থাকুক না কেন। আসমান ও জমিনের সকলেই তাঁর উপর সন্তুষ্ট হবে...। ৩৬
৮-ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন : যে লোকের তাকওয়া (খোদভীতি) থাকে না তাঁর কোন দীন নেই। তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় যার পরহেজগারিতা সকলের চেয়ে অধিক। অতঃপর বলেন : আমার বংশধরের চতুর্থ সন্তান এক সম্ভ্রান্ত দাসীর সন্তান ,আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে জমিনকে সব ধরনের জুলুম ও অন্যায় থেকে মুক্তি দিবেন এবং সে ঐ ব্যক্তি যার জন্মের বিষয়ে মানুষের সন্দেহ থাকবে। সে অন্তর্ধানে থাকবে। যখন আবির্ভূত হবেন তখন জমিন আল্লাহর নূরে আলোকিত হবে। আর মানুষের মাঝে ন্যায়ের মানদণ্ড স্থাপন করবে। যার কারণে কেউ অন্যের উপর অত্যাচার করতে পারবে না...। ৩৭
৯-আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.) বলেছেন : আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন এমন এক দল লোককে আনবেন যারা তাঁকে ভালবাসে এবং তিনিও তাদেরকে ভালবাসেন। এমন এক ব্যক্তি তাদের মধ্যে ঐশী নেতৃত্ব লাভ করবে যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকবে। আর সে হচ্ছে মাহ্দী মওউদ (প্রতিশ্রুত মাহ্দী) ...। সে জমিনকে সুবিচার ও ন্যায়ে পূর্ণ করবে এবং এ কাজ করতে তাঁর কোন প্রকার সমস্যা বা অসুবিধা হবে না। শিশু বয়সেই সে তাঁর বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থাকবে মুসলিম দেশগুলোকে নির্বিঘ্নে জয় করবে। যুগের সব কিছু তাঁর অনুকূলে ও তাঁর জন্যে প্রস্তুত থাকবে। তাঁর বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ হবে এবং নবীন প্রবীণ সকলেই তাকে অনুসরণ করে চলবে। তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ করবেন যতটাই তা অন্যায় ও অত্যাচারে পূর্ণ হোক না কেন আর ঠিক ঐ সময় তাঁর ইমামত পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে ও তাঁর খেলাফত বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পৃথিবী ইমাম মাহ্দীর পরশ পেয়ে তাঁর হারিয়ে যাওয়া রূপ বা সৌন্দর্যকে পুনরায় ফিরে পাবে। পৃথিবী তরতাজা ও নির্মল এবং নিয়ামতে পূর্ণ হবে ,নদ-নদীতে নির্মল পানির প্রবাহ বয়ে যাবে। পাপাচার ,শত্রুতা ,ফিতনা ,সকল অন্যায় পৃথিবী থেকে নিশ্চি হ্ন হবে ,বিদ্বেষ দূরীভূত হয়ে মানুষের অন্তরগুলি একে অপরের প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ হবে ,সকল মানুষ ভালকাজে লিপ্ত হবে। আর তাদের সবকিছুই তখন বরকতময় হয়ে উঠবে। এর বেশী কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না শুধুমাত্র ঐ দিনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইলো। ৩৮
শিয়া মাযহাবের হাদীস থেকে
১-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : মানুষ তাদের ইমামকে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে হজ মৌসুমে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে দেখবে। কিন্তু মানুষ তাকে দেখতে পাবে না। ৩৯
২-আসবাগ বিন নাবাতাহ্ বলেন : আমিরুল মু ’ মিনীন আলী (আ.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে চিন্তায় মগ্ন থাকতে দেখলাম। তিনি আঙ্গুল মোবারক দিয়ে মাটিতে টোকা দিচ্ছিলেন। বললাম : আপনাকে কেন চিন্তিত লাগছে ,আপনি কী মাটির প্রতি ভালবাসা রাখেন ?
বললেন : না ,আল্লাহ্ সাক্ষী কখনই মাটি ও এই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা আমার ছিল না বা এখনও নেই। এক জাতকের বিষয়ে চিন্তা করছি যে আমার বংশ থেকে আসবে এবং আমার সন্তানদের মধ্যে একাদশতম ব্যক্তি সে। তার নাম “ মাহ্দী ” । সে দুনিয়াকে ন্যায় ও আদর্শে ভরে দেবে। তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। সে অন্তর্ধানে থাকবে এ বিষয়ে একদল ধ্বংস প্রাপ্ত হবে এবং অন্য একদল হবে হেদায়ত প্রাপ্ত...। ৪০
৩-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : যদি তোমাদের কাছে খবর পৌঁছায় যে জামানার (যুগের) ইমাম অদৃশ্যে আছেন তবে তাঁর এই অদৃশ্য হওয়ার খবরটিকে অস্বীকার করবে না। ৪১
৪-তিনি আরও বলেছেন : আল কায়েমের (ইমাম মাহ্দী) দুইটি অন্তর্ধান থাকবে যার একটি স্বল্প মেয়াদী এবং অন্যটি দীর্ঘ মেয়াদী। স্বল্প মেয়াদী অন্তর্ধানে তাঁর বিশেষ কিছু অনুসারী ছাড়া তাকে কেউ দেখতে পাবে না এবং দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধানে তাঁর অতি নিকটের লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ তাঁর ব্যাপারে জানতে পারবে না। ৪২
৫-তিনি আরও বলেছেন : আল কায়েম (ইমাম মাহ্দী) এমন অবস্থায় কিয়াম করবেন যে তিনি কারো সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ নন বা কেউ তাঁর হতে বাইয়াত গ্রহণ করে নি। ৪৩
৬-নবী করিম (সঃ) বলেছেন : আল কায়েম (ইমাম মাহ্দী) আমার সন্তান ,তার নাম ও ডাক নাম আমার নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। দেখতেও অবিকল আমার মতো। শরীরের আকৃতি ও গঠন আমার মতোই। তার সুন্নত (অনুসৃত নীতি) হচ্ছে আমারই সুন্নত। মানুষদেরকে আমার দীন ও শরীয়তের এবং আল্লাহর কিতাবের প্রতি দাওয়াত দেবে। যারা তাঁকে অনুসরণ করবে তারা আমাকে অনুসরণ করলো এবং যারা তাঁর সাথে বিরোধিতা করবে তারা আমার সাথে বিরোধিতা করলো। আর যারা তাঁর অন্তর্ধানকে অস্বীকার করবে তারা আমাকে অস্বীকার করলো। ৪৪
৭-ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন : আমাদের কায়েমের (ইমাম মাহ্দী) সাথে বিভিন্ন নবীর যেমন নূহ ,ইবরাহীম ,মূসা ,ঈসা ,আইয়ুব ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর মিল রয়েছে। নূহ নবীর সাথে বয়সের দিক দিয়ে। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সাথে গোপনে ভুমিষ্ট হওয়া ও মানুষের থেকে দূরে থাকা। মূসা (আ.)-এর সাথে অদৃশ্য থাকা ও জীবন নাশের ভয়ের ব্যাপারে। ঈসা (আ.)-এর সাথে মানুষ যেভাবে তাঁর ব্যাপারে মতবিরোধ করেছিল সে দিক দিয়ে। আইয়ুব (আ.)-এর সাথে তার দুঃখ-বেদনা ও উদ্বেগ লাঘব হয়ে মুক্তির পথ সুগম হওয়ার দিক থেকে। নবী করীম (সা.)-এর সাথে তার মতো তলোয়ার হাতে সংগ্রাম করা। ৪৫
৮-ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : এরূপ যে শেষ জামানার ইমাম অদৃশ্যে থাকবে। ঐ সময় আল্লাহর বান্দারা অবশ্যই যেন তাকওয়ার (পরহেযগারী) পথ অবলম্বন করে ও আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে থাকে। ৪৬
৯-তিনি আরও বলেছেন : মানুষের সামনে এমন এক সময় আসবে যখন তাদের ইমাম তাদের চোখের অন্তরালে (অদৃশ্যে) থাকবে।
যুরারাহ বলেন : তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ,ঐ সময় মানুষের দায়িত্ব বা করণীয় কী ?
বললেন : যা কিছু তাদেরকে আগেই বলা হয়েছে বা তাদের কাছে আগেই পৌঁছেছে (অর্থাৎ দীনের প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর দেয়া আদেশ-নির্দেশসমূহ) তা জামানার ইমাম আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত মেনে চলা। ৪৭
১০-তিনি আরও বলেছেন : এই ঘটনাটি (ইমামের আবির্ভাব ও তার উত্থান) তখন সংঘটিত হবে যখন এমন কোন দল ও গোষ্ঠী অবশিষ্ট থাকবে না মানুষের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করে নি। যাতে করে কেউ বলতে না পারে যে ,আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে আমরাও ন্যায় ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতাম বা তার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতাম। অবশেষে কায়েম (ইমাম মাহ্দী) ন্যায় ও আদর্শের পক্ষে কিয়াম করবেন। ৪৮
ইমামের জন্মলাভ
ইসলামের দ্বাদশ পথ নির্দেশক হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহ্দী (আ.) ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শাবান (৮৬৮ খৃস্টাব্দে) শুক্রবার ভোরে ইরাকের সামাররা শহরে একাদশ ইমামের গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন। ৪৯
তাঁর পিতামাতা হচ্ছেন যথাক্রমে ইসলামের একাদশ পথ নির্দেশক হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ও সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিতা রমণী নারজীস। যিনি সুসান ও সাইকাল নামেও পরিচিত। তিনি রোমের বাদশার ছেলে ইউসায়া ’ র কন্যা এবং সামউ ’ ন (সে হযরত ঈসা (আ.) এর একনিষ্ঠ অনুসারী ছিল)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি এমনই সম্মানিতা ছিলেন যে ,ইমাম হাদী (আ.)-এর বোন হাকিমা খাতুন তাকে নিজের ও তার বংশের নেত্রী এবং নিজেকে তার সেবিকা হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। ৫০
যখন নারজীস খাতুন রোমে থাকতেন রাতে অসাধারণ স্বপ্ন দেখতেন। একবার তিনি স্বপ্নে নবী আকরাম (সা.) ও ঈসাকে (আ.) দেখলেন যে ,তাকে ইমাম হাসান আসকারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করালেন। অন্য আরও একটি স্বপ্নে দেখলেন যে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর দাওয়াতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়টিকে তিনি তার পরিবারের কাছে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে গোপন রেখেছিলেন।
তারপর মুসলমান ও রোমানদের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় রোমের বাদশাহ্ যুদ্ধের ময়দানের দিকে রওনা হলো। এদিকে নারজীস খাতুন স্বপ্নের মধ্যে নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন যে ,সৈন্যদের সেবা করার জন্য যে সকল দাসী বা সেবিকা যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হয় তাদের সাথে যেন অপরিচিতের মত একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি সৈন্যদের যে তাঁবু আছে সেখানে চলে আসেন। তিনি তাই করলেন। তাদের সাথে যাওয়ার সময় এপাশের মুসলমান সীমান্ত রক্ষীরা তাদেরকে বন্দী করলো। তাকে রাজ পরিবারের সদস্য বুঝতে না পেরে বা সেবিকা ভেবেই বন্দীদের সাথে বাগদাদে নিয়ে গেল।
এই ঘটনাটি ইসলামের দশম পথ প্রদর্শক ইমাম হাদী (আ.)-এর ইমামতের শেষের দিকে ঘটেছিল। ৫১ ইমাম হাদী (আ.) রোমান ভাষায় লেখা একটি চিঠি যা তিনি নিজেই লিখেছিলেন তা তাঁর এক ভৃত্যকে দিয়ে বাগদাদে নারজীস খাতুনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইমামের সেই ভৃত্য তাকে দাসী বিক্রয়ের স্থান থেকে কিনে নিয়ে সামাররায় ইমামের কাছে নিয়ে এল। তিনি স্বপ্নের মধ্যে যা কিছু দেখেছিলেন ইমাম সেগুলো তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন ,তিনি একাদশ ইমামের স্ত্রী ও এমন এক সন্তানের জননী যে এই পৃথিবীর অধিকর্তা হবে। আর পৃথিবীর বুকে ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠাকারী। তারপর ইমাম হাদী (আ.) তাকে তাঁর বোন হাকিমা খাতুনের (যিনি নবী পরিবারের সম্মানিতা নারী ছিলেন) হাতে তুলে দেন। ৫২
হাকিমা খাতুন যখনই ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাছে আসতেন তার ব্যাপারে দোয়া করতেন যে ,আল্লাহ্ যেন তাকে সন্তান দান করেন। তিনি বলেন : একদিন ইমাম আসকারীকে দেখতে গেলাম ও আগের দোয়ারই পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন : যে সন্তানের জন্য দোয়া করছেন আল্লাহ্ তা আমাকে দিয়েছেন। সে আজ রাতেই দুনিয়ায় আগমন করবে। ৫৩
নারজীস খাতুন এগিয়ে এসে আমার পা থেকে জুতা খুলে নেওয়ার জন্য বলল : আমার সম্মানিতা নেত্রী আপনার জুতোজোড়া আমাকে দিন।
বললাম : তুমিই তো আমার নয়ন মণি ও আমার কর্ত্রী। আল্লাহর কসম আপনাকে আমার জুতা খুলে নিতে বা আমার সেবা করতে দেব না। কেননা প্রকৃতপক্ষে আমিই আপনার সেবিকা।
ইমাম আসকারী (আ.) আমার কথাটি শুনতে পেয়ে বললেন : ফুফু আম্মা আল্লাহ্ আপনাকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।
সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কাছে থাকলাম। তারপর চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক দাসীকে আমার পোশাক আনতে বললাম। ইমাম বললেন : ফুফু আম্মা ,আজ রাত আমাদের কাছে থেকে যান। কেননা আজ রাতে এমন এক শিশু ভূমিষ্ঠ হবে যে আল্লাহর কাছে অনেক সম্মানিত ও প্রিয়। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ মৃত দুনিয়াকে আবার জীবিত করবেন।
বললাম : হে আমার পথনির্দেশক! আপনি কার ভুমিষ্ঠ হওয়ার কথা বলছেন ?আমি তো নারজীস খাতুনের মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই দেখলাম না!
বললেন : নারজীসের মাধ্যমেই হবে ,অন্য কারো মাধ্যমে নয়।
আমি উঠে গেলাম এবং নারজীসকে দ্বিতীয় বারের মত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু তার মধ্যে গর্ভবতী থাকার কোন লক্ষণই পেলাম না। ইমামের কাছে ফিরে এলাম এবং আমার পর্যবেক্ষণের কথা তাকে জানালাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন : ভোরে আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে যে ,তার গর্ভে সন্তান ছিল। কেননা সে মূসা কালিমুল্লাহর মায়ের ন্যায়। সে কারণেই তার গর্ভাবস্থা প্রকাশিত নয়। আর কেউ তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়কে জানতো না। কেননা ফেরাউন মূসার খোঁজে (এজন্য যে সে দুনিয়ায় আসতে না পারে) গর্ভবতী মহিলাদের পেট ফেঁড়ে বাচ্চা বের করে মেরে ফেলেছিল। আর যে শিশু আজ রাতে জন্ম নিবে সেও মূসার মতই (ফেরাউনদের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলবে) এবং তারাও তার খোঁজে আছে।
হাকিমা খাতুন বলেন : আমি ভোর পর্যন্ত নারজীস খাতুনের পরিচর্যায় ছিলাম। সে শান্ত হয়ে আমার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। কোন প্রকার নড়া-চড়াও করেনি। রাতের শেষের দিকে অর্থাৎ ছুবহ্ সাদেকের সময় আচমকা নড়ে উঠলে আমি তাকে আমার কোলের মধ্যে নিয়ে আল্লাহর নাম পড়ে তার শরীরে ফুঁক দিলাম।
ইমাম পাশের ঘর থেকে সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে বললেন। আমি তাই করলাম। নারজীসের কাছে তার শরীরের অবস্থা জানতে চাইলাম। সে বলল : যা কিছু আমার মাওলা আপনাকে বলেছিল তা পরিস্কার হয়ে গেছে।
আমি ইমামের নির্দেশ অনুযায়ী সূরা কদর পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিতে থাকলাম। এই সময় তার পেটের শিশুটিও আমার সাথে একই সুরে সূরা পড়তে শুরু করল। আমি যাই পড়ি সেও আমার সাথে তাই পড়ে। সে আমাকে সালাম দিল। আমি দারুণভাবে চমকে উঠলাম। ইমাম পাশের ঘর থেকে আবারও বললেন : আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের কর্মে আশ্চর্যান্বিত হবেন না। আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাদেরকে (ইমামদের) শিশু অবস্থাতেই তাঁর প্রজ্ঞা দ্বারা সজ্জিত করেন আর পরিপূর্ণ বয়সে দুনিয়াতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন।
ইমামের কথা শেষ না হতেই নারজীস আমার পাশ থেকে উধাও হয়ে গেল। বলা যায় যেন আমার ও তার মাঝে একটি পর্দা টাঙানো হয়েছে। কেননা তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। চিৎকার দিয়ে ইমামের কাছে ছুটে গেলাম। তিনি বললেন : ফুফু আম্মা ফিরে যান। তাকে অচিরেই আগের জায়গাতে দেখতে পাবেন।
ফিরে এলাম। কিছু সময় যেতে না যেতেই ঐ পর্দার প্রলেপটি আমাদের মধ্য থেকে সরে গেল। আমি নারজীসকে দেখলাম সে যেন নূরের আলোর মধ্যে ডুবে আছে। তাকে দেখতে গেলে ঐ নূরের আলোক ছটায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। যে পুত্র সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাকেও দেখলাম ,সে সেজদারত অবস্থায় আছে এবং তর্জনী উঠিয়ে বলল :
اَشْهَدُ أَنْ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَ أَنَّ جَدِّى مُحَمَّداً رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَ أَنَّ أَبِى اَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَ
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ,তিনি অদ্বিতীয় ও তাঁর কোন শরিক নেই এবং বাস্তবিকই আমার পিতামহ মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং মু ’ মিনদের নেতা আলী (আ.) আমার পিতা।
তারপর একের পর এক নিজে সহ অন্যান্য ইমামগণের ইমামতের সাক্ষ্য দিয়ে বললেন : হে আল্লাহ্! আমার প্রতিশ্রুতি প্রদানের স্থান ও কালকে ত্বরান্বিত কর ,আমার কাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাও ,আমার প্রতিটি পদক্ষেপ দৃঢ় করতে দাও এবং আমার মাধ্যমেই এই দুনিয়াতে ন্যায় ও নীতির প্রতিষ্ঠা কর ... । ৫৪
ইমামের জন্ম গ্রহণের খবর গোপন থাকার কারণ
ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দান করে বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের শাসনামলে বিশেষ করে ষষ্ঠ ইমাম হযরত সাদিকের পর থেকে আব্বাসীয় খলিফারা অন্যান্য ইমামগণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। তার কারণ হলো সমাজের মানুষের মাঝে তাদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আর যতই দিন যাচ্ছিল সমাজের ভিতর তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি মানুষের ভালবাসা বেড়েই চলছিল। তাই আব্বাসীয় খলিফারা ,নিজেদের খেলাফত হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা করত। বিশেষ করে ইমাম মাহ্দীর বিষয়ে সকলে জানত যে ,তিনি নবীর উত্তরসূরী ও মাসুম ইমামগণের বংশোদ্ভূত এবং হযরত আসকারীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে দুনিয়াকে সমস্ত প্রকার অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্ত করে ন্যায় ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবেন। এই কারণেই ইমাম হাসান আসকারীকে তারা কড়া নজরে রাখে। যেমনভাবে তাঁর দাদা ও পিতাকে তাদের (আব্বাসীয়) খেলাফতের রাজধানী সামাররাতে নিয়ে এসে কড়া নজরে রেখেছিল। আব্বাসীয়রা চেষ্টা করেছিল যে ,ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ ও বেড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে ,কিন্তু মহান স্রষ্টার অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছা ও অখণ্ডনীয় বিধি এটাই ছিল যে ,এই শিশু জন্ম গ্রহণ করবে এবং তাদের সমস্ত প্রকার অপচেষ্টাই অনর্থক হবে। আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তাঁর জন্মকে হযরত মূসার (আ.) মতই গোপন করে রাখলেন। শুধুমাত্র ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) অতি নিকটের কিছু সাহাবা কয়েকবার ইমাম মাহ্দীকে (আ.) তাঁর পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় দেখেছেন। ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) ইন্তেকালের সময় তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং তাঁর পিতার জানাযার নামায পড়ান। সে সময় সাধারণ মানুষও তাকে দেখেছিল। নামায শেষে তিনি আবার অদৃশ্য হয়ে যান ।
জন্মের সময় থেকে শুরু করে তাঁর পিতার শাহাদতের সময় পর্যন্ত তাঁর নিকটতম আত্মীয়-স্বজন ও পিতার নিকটতম সাহাবাগণ তাকে দেখতে সমর্থ হয়েছিল বা তারা ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর বাড়ীতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতো। আসলে ইমামের পদ্ধতি এমন ছিল যে ,তাঁর সর্বসম্মানিত সন্তানকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখলেও সময় ও সুযোগ মতো প্রকৃত সাহাবাদেরকে চাক্ষুসভাবে তাঁকে দেখিয়ে ইমাম মাহ্দীর অস্তিত্ব লাভ সম্পর্কে জ্ঞাত করবেন এবং তারা অন্যান্য অনুসারীদের মধ্যে এ বিষয়টিকে পৌঁছে দেবে। ফলে তাঁর ইন্তেকালের পরে তারা পথভ্রষ্ট হবে না। উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লিখিত হলো :
১-আহমাদ বিন ইসহাক যিনি শিয়াদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর একজন প্রকৃত অনুসারী ছিলেন বলেন : ইমামের পরে কে তাঁর প্রতিনিধি তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। তাঁর কাছে কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : হে আহমাদ! আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন যখন আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন থেকে পৃথিবীকে তাঁর প্রতিনিধি বিহীন রাখেন নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিনিধি বিহীন রাখবেন না । পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি থাকার কারণেই পৃথিবী থেকে বালা-মুছিবত দূর হয় ,বৃষ্টি আসে ,বরকত বৃদ্ধি পায়।
বললাম : হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! আপনার পরে ইমাম বা প্রতিনিধি কে ?তিনি দ্রুত বাড়ীর ভিতরে গেলেন এবং তিন বছর বয়সের একটি শিশু যাকে দেখতে চাঁদের মত দেখাচ্ছিল ঘাড়ে করে ফিরে এসে বললেন : হে আহমাদ বিন ইসহাক! যদি তুমি আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের কাছে অতি প্রিয় না হতে তাহলে কখনই আমি তোমাকে আমার ছেলেকে দেখাতাম না। তাঁর নাম ও ডাক নাম নবী (সা.)-এর নাম ও ডাক নামের অনুরূপ। সে এমনই এক ব্যক্তি যে ,এ পৃথিবীতে ন্যায় ও আদর্শের প্রতিষ্ঠা করবে ,তা যতই জুলুম ও অত্যাচারে ডুবে থাকুক না কেন। হে আহমাদ বিন ইসহাক! সে এই উম্মতের জন্য খিজির (আ.) ও যুলকারনাইনের মতই। আল্লাহর কসম সে অন্তর্ধানে থাকবে। তাঁর অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় ধ্বংস হওয়া থেকে কেউই রেহাই পাবে না। তারা ব্যতীত যাদেরকে আল্লাহ্ তাকে মেনে নেয়া ও এ পথে দৃঢ় থাকার তওফীক দিবেন এবং তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত হওয়ার ব্যাপারে দোয়া করবে।
বললাম : হে আমার নেতা! এমন কোন আলামত আছে যা দেখলে আমার অন্তরে তাঁর ব্যাপারে অধিকতর বিশ্বাস স্থাপিত হবে ?
এ সময় ঐ শিশু পরিশুদ্ধ আরবী ভাষায় আমাকে বলল : হে আহমাদ বিন ইসহাক! জমিনের বুকে আমিই হচ্ছি “ বাকিয়াতুল্লাহ্ (আল্লাহর সঞ্চিত সম্পদ) ” যে আল্লাহর শত্রুদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। সুতরাং এর চেয়ে বেশী আলামত খোঁজা থেকে বিরত থাক ...।
মরহুম সাদুক বলেন এই রেওয়ায়েতটি আলী বিন আবদুল্লাহর হাতে লেখা অবস্থায় পেয়েছি। সে এই রেওয়ায়েতটি কোথা থেকে পেয়েছে জানতে চাইলে সাঈদ বিন আবদুল্লাহর কাছ থেকে আহমাদ বিন ইসহাকের উদ্ধৃতি দিয়ে আমার কাছে বর্ণনা করল। ৫৫
২-আহমাদ বিন হাসান বিন ইসহাক বলেন : যখন পুত পবিত্র শিশু হযরত মাহ্দী জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন আমার মাওলা আবু মুহাম্মদ হাসান আসকারীর (আ.) পক্ষ থেকে আমার দাদা আহমাদ বিন ইসহাকের নিকট একটি চিঠি এসেছিল। যার মধ্যে ইমাম নিজের হাতে লিখেছিলেন : আমাদের একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। তাঁর জন্মের বিষয়টি গোপন থাকার প্রয়োজন আছে। কাউকে এ বিষয়ে অবহিত করবে না। আমরা এই শিশুর জন্মকে কারো কাছে বলব না। শুধুমাত্র অতি নিকট ব্যক্তিবর্গ ,আত্মীয়-স্বজন ,বন্ধু-বান্ধব ছাড়া। তোমাকে ভালবাসি বলেই খবরটি তোমাকে দিয়েছি। যেন আল্লাহ্ তা ’ য়ালা এর মাধ্যমে তোমাকে আনন্দিত করেন যেমনভাবে আমাদেরকে আনন্দিত করেছেন। ওয়াস-সালাম। ৫৬
৩-ইমামের ফুফু হাকিমা খাতুন ,ইমামের খাদেম নাসিম ,শিষ্য আবু জা ’ ফার মুহাম্মদ বিন উসমান আমরী ,হুসাইন বিন হাসান আলাবী ,আমর আল আহ্ওয়াযী ,খাদেম আবু নাসর ,কামেল বিন ইবরাহীম ,আলী বিন আ ’ সেম কুফী ,আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস আলাবী ,ইসমাইল বিন আলী ,ইয়াকুব বিন ইউসুফ যাররাব ,৫৭ ইসমাইল বিন মুসা বিন জা ’ ফার ,আলী বিন মুতাহ্হার ,ইবরাহীম বিন ইদরিস ,তারিফ খাদেম ,৫৮ আবু সাহল নৌবাখতি ,৫৯ এ সকল ব্যক্তিত্বরা ইমাম মাহ্দীর জন্ম গ্রহণ সম্পর্কে জানতেন এবং এ সম্পর্কে খবর দিয়েছেন।
৪-জা ’ ফার বিন মুহাম্মদ বিন মালেক একদল শিয়ার পক্ষ থেকে বর্ণনা করে যে ,ইমাম আসকারী তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আমার পরবর্তী হুজ্জাতের কাছে প্রশ্ন করার জন্য তোমরা এসেছো।
তারা বলল : হ্যাঁ ,আমরা তাঁর কাছে প্রশ্ন করার জন্য এসেছি।
হঠাৎ চাঁদের মত দেখতে একটি শিশু সেখানে উপস্থিত হলো। তাঁকে দেখতে অনেকটা ইমামের মতই লাগছিল অর্থাৎ তাঁর চেহারা ও ইমামের চেহারাতে বেশ মিল ছিল। ইমাম বললেন : এই হচ্ছে আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত বা তোমাদের ইমাম। তাঁর নির্দেশকে মেনে চলবে এবং তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে না তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। জেনে রাখ! তোমরা আজ তাকে দেখার পরে আর দেখবে না ,যতক্ষণ না তাঁর বয়স পরিপূর্ণ হবে। উসমান বিন সাঈদ যা কিছু বলবে তাই মেনে নিবে কেননা সে তোমাদের ইমামের প্রতিনিধি এবং কাজ-কর্ম যা কিছু আছে তা সবই তার দায়িত্বে। ৬০
৫-ঈসা বিন মুহাম্মদ জৌহারী বলেন : আমরা কয়েকজন মিলে দল বেঁধে ইমাম মাহ্দীর জন্মের শুভেচ্ছা জানাতে ইমাম আসকারীর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের অন্যান্য ভায়েরা আগেই আমদেরকে খবর দিয়েছিল যে ,হযরত মাহ্দী শা ’ বান মাসের ১৫ তারিখে শুক্রবার ভোরে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমরা সেখানে পৌঁছে তাকে সালাম দেওয়ার আগেই তাকে শুভেচ্ছা জানালাম... আর কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে তার অন্তরে আমার সন্তান মাহ্দী কোথায় এই প্রশ্নটি মনে পোষণ করে রেখেছে। আমি তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছি যেমনভাবে মূসার মা মূসাকে যখন বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল তখন তাকে আল্লাহর কাছে আমানত রেখেছিল এই বলে যে ,তিনি যেন তাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। ৬১
অন্তর্ধান সম্পর্কিত আলোচনা
ইসলামের মৌলিক উপাদানসমূহ ,রাজনৈতিক ,সামাজিক ,সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলী এবং শিক্ষণীয় অন্যান্য বিষয়সমূহ নবী করিম (সা.)-এর নবুওয়াতের সময় থেকে শুরু করে যতদিন পর্যন্ত ইমামগণ (আ.) সমাজে উপস্থিত ছিলেন (সন ২৬০ হিজরী পর্যন্ত) ব্যাখ্যাসহ বর্ণিত রয়েছে এবং গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যদিও এই সময়কালে অত্যাচারী ও বিরুদ্ধাচারণকারীরা শক্তভাবে কোমর বেঁধেছিল। কিন্তু পুত পবিত্র ইমামগণ সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের সামনে পরিস্কার করে দিয়েছেন । তাঁরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে এমন সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন যে সমগ্র পৃথিবীকে একটি শাসনতন্ত্রের অধীনে এনে তাকে শাসন করার মত ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে। এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। ৬২
এক দিক দিয়ে এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্তম নমুনা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও আমিরুল মু ’ মিনীন আলী (আ.) এর শাসনামল আমাদের (মানবজাতির) সামনে বাস্তব রূপ পেয়েছে। যাতে করে মানুষ তা থেকে শিক্ষা অর্জন করে এবং এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার বিরোধী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । সুতরাং হযরত মাহ্দী (আ.)-এর সময় পর্যন্ত আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের পক্ষ থেকে পৃথিবীর একক শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণভাবে তৈরী ছিল। ইসলামের সকল আইন-কানুন সংকলিত ও ইসলামের ন্যায় ভিত্তিক শাসনের বাস্তব নমুনাও স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে পৃথিবীর মানুষের আল্লাহ্ প্রদত্ত শাসন ব্যবস্থাকে বাস্তবে রূপদান করার প্রস্তুতি বা যোগ্যতা ছিল না। যদি পৃথিবীর মানুষ এই ধরনের শাসন ক্ষমতাকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতো ইমাম লোক চক্ষুর অন্তরালে না গিয়ে আল্লাহর আইন-কানুন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতেন এবং ইসলামের ন্যায়-নীতিকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতেন। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে ,এই কারণেই তিনি লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন এবং ঠিক একই কারণে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধানের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর তিনি সে সময়ই আবির্ভূত হবেন যখন পৃথিবীর অধিবাসীরা তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাঁর শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না এবং সব দিক থেকে তাঁর শাসনকে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবে।
মরহুম খাজা নাসির উদ্দিন তুসি লিখেছেন : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানে যাওয়াটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়এবং তাঁর নিজের পক্ষ থেকেও নয়। অতএব ,এটা মানুষের কারণে হয়েছে। ভয়কে পরাভূত ও ইমামের আনুগত্যের দিকে ধাবিত না হওয়াই হচ্ছে প্রধান কারণ। যখন এই কারণসমূহের অবসান ঘটবে তখনই তিনি আবির্ভূত হবেন। ৬৩
অবশ্য অন্তর্ধানের বিষয়টি আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ইচ্ছায় হয়েছে এবং আমরা ঐ রহস্যময় বিষয়ে অবগত নই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে অন্তর্ধানে যাওয়ার পিছনে যে মৌলিক বিষয়টি সক্রিয় তা হয়তো এটাই হবে। একাদশ ইমামের সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ইমামের ইমামতের স্বীকৃতি না দেয়া ,তাদের নির্দেশ পালন না করে বরং বিরুদ্ধাচারণে ব্রত হওয়া এবং তাঁদের প্রতি মুসলিম সমাজের পৃষ্ঠপ্রদর্শনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল। তাই ইমাম উপস্থিত থাকার অকার্যকারিতার বিষয়টিও আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর এ বিষয়ের প্রতি কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না যে মানুষ ইসলামের ন্যায় ও আদর্শ ভিত্তিক শাসনের অধীনে যেতে চায় না। এরূপ পরিস্থিতিতে ইমামের অন্তর্ধানে থাকা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই সমাজে তাঁর আবির্ভাব ও উপস্থিতিটা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। বরং প্রশ্ন করতে হয় ইমাম কেন এ সমাজে উপস্থিত থাকবেন ?তিনি অদৃশ্যে থেকে তার দায়িত্বকে গোপনেই পালন করে যাবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়। প্রেক্ষাপট তৈরী হলেই তিনি আবির্ভূত হবেন এবং অপেক্ষাকারীদেরকে তাঁর দর্শন ও অলৌকিক সাহায্য দিয়ে সফল করবেন।
اِنَّ اللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ ما بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا ما بِاَنْفُسِهِمْ
অবশ্যই আল্লাহ্ কোন জাতির কিছুই (ভাগ্যের) পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা তার পরিবর্তন ঘটায় ।
এই রহস্যটি আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত গোপন থাকবে এবং ঐ সময় পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারবে যে তাদের নিজেদের মধ্যেই তার অন্তর্ধানে থাকার আসল কারণটি লুকিয়ে ছিল। যা থেকে তারা ছিল উদাসীন। আর যদি তারা নিজেদেরকে তৈরী করত তাহলে ইমাম তাদের মাঝে আবির্ভূত হতেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে তারা তাদের পরিশুদ্ধ ও তৈরীর কাজে এগিয়ে না এসে বিভিন্ন অত্যাচারী ও বিচ্যুত শাসকদের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল এই ভেবে যে ,এই অত্যাচারী ও বিচ্যুত শাসকরা হয়তো তাদের দুঃখ কষ্টকে লাঘব করতে পারবে অথবা বাহ্যিক তথাকথিত নামী দামী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
অবশ্য মানুষই ইমামের অন্তর্ধানে যাওয়ার জন্য দায়ী। এটা বলার অর্থ এই নয় যে ,তারা সবাই এত বড় পাপে লিপ্ত হয়েছে। বরং উদ্দেশ্য এটাই যে ,একটি নির্দিষ্ট পরিমান ভাল মানুষের প্রয়োজন আছে তাঁর আবির্ভাবের জন্য। বলার অবকাশ রাখে না যে ,কিছু সংখ্যক উপযুক্ত ব্যক্তি সব সময়ই তাঁর আবির্ভাবের জন্য তৈরী ছিলেন বা আজও আছেন। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ লোক এই ধরনের প্রস্তুতি রাখে না। আর যে সমাজ এই ধরনের যোগ্যতা রাখে না অবশ্যই ঐ সমাজের সাথে তাঁর প্রশাসনের সমস্যা দেখা দেবে। সুতরাং এ কারণেই তাঁর অন্তর্ধানে থাকাটা অব্যাহত থাকবে। অন্য দিকে আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন অন্তর্ধানের মাধ্যমে ইমাম মাহদী (আ.)-কে নিহত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কেননা যদি তিনি উপযুক্ত সময়ের আগেই আবির্ভূত হন তবে অবশ্যই তাঁকে শত্রুরা হত্যা করবে এবং আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন থেকে তিনি অপারগ হবেন। আর পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হবে না।
মরহুম কুলাইনি তার “ কফি ” নামক গ্রন্থে ও শেখ তুসি তার “ গেইবাত ” নামক গ্রন্থে যুরারাহর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে ,তিনি বলেছেন : ইমাম সাদিক (আ.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়েছিলাম ও তাঁর কাছ থেকে শুনেছি যে ,তিনি বলেছেন : কায়েম (ইমাম মাহ্দী) কিয়াম করার আগে অন্তর্ধানে থাকবেন।
বললাম : কেন ?
ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর পেটের দিকে ইশারা করলেন । এটা বোঝালেন যে ,নিহত হওয়ার ভয়ে। ৬৪
ইমাম মাহ্দী (আ.) কোন অত্যাচারী শাসক বা সরকারকে এমনকি বাহ্যিকভাবেও ( তাকিয়ার { বাধ্য হয়ে কল্যাণকর কোন উদ্দেশ্যে স্বীয় বিশ্বাস গোপন করা } কারণে অন্যান্য ইমামদের যেমনটি করতে হয়েছে ) বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন নি এবং দেবেন না এবং তিনি কোন সরকার বা বাদশাহর থেকে তাঁর বিশ্বাসকে গোপন করে চলছেন না। আর কোন অত্যাচারী সরকার বা বাদশাহর অধীনেও থাকেন নি এবং থাকবেন না। যখন আবির্ভূত হবেন তখন কারো হাতে বাইয়াত করবেন না (অর্থাৎ তিনি কারো আদেশ বা নির্দেশে চলবেন না)।
يَقُومُ الْقاَئِمُ وَ لَيْسَ لِاَحَدٍ فِى عُنُقِه عَهْدٌ وَ لاَ عَقْدٌ وَ لاَ بَيْعَةٌ ৬৫
কেননা অবশ্যই সত্যের অনুবর্তী হয়ে কাজ করবেন এবং আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণভাবে (কোন প্রকার গোপনীয়তা ,ভয়-ভীতি বা অন্য কিছুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে) বাস্তবায়ন ও সমাজে প্রতিষ্ঠা করবেন। অতএব কারো সাথে কোন প্রকার চুক্তি বা সন্ধির প্রয়োজন নেই বা কারো সাথে আলোচনা বা কাউকে সমীহ্ করে চলারও প্রয়োজন হবে না।
তিনি এমন অবস্থায় আবির্ভূত হবেন যে ,অতীতের ঘটে যাওয়া প্রতিটি বিষয়ের প্রতি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা রাখবেন এবং কারো সাথে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতিতে বা অঙ্গিকারে আবদ্ধ হবেন না। আর আবির্ভূত হয়ে সমস্ত তাগুতী শাসন ব্যবস্থাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করবেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ও তার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করবেন।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান
একাদশ ইমামের শাহাদতের পর ২৬০ হিজরী থেকে ৩২৯ হিজরী অর্থাৎ প্রায় ৬৯ বছর হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধান। ৬৬ আর এর পর থেকেই এখনও পর্যন্ত এবং ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভাব করা পর্যন্ত সময়কালটিই হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধান।
স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানকালে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাথে মানুষের যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে ছিল। শিয়া মাযহাবের প্রত্যেকেই তাঁর বিশেষ প্রতিনিধির (যারা শিয়াদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে মনোনীত ছিল) মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা বা বিভিন্ন প্রশ্ন ইমামের সমীপে পৌঁছাতো এবং তাদের মাধ্যমেই ঐ প্রশ্নসমূহের উত্তর গ্রহণ করত। কখনও তারা স্বয়ং ইমামের সামনে উপস্থিত হতো। এই সময়টিকে দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানে পদার্পনের জন্য প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে ধরা যেতে পারে। এভাবে কিছু দিন চলার পর তাঁর সাথে মানুষের ঐ ধরনের সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। তারপর থেকে মানুষ তাদের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে নির্দেশিত হলো ইমামের সাধারণ প্রতিনিধি অর্থাৎ ফকীহ্ বা যারা দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে জ্ঞাত ,তাদেরকে অনুসরণ করে চলতে।
যদি হঠাৎ করেই বা প্রথম থেকেই দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের অবতারণা হতো তাহলে চিন্তা-চেতনায় বিভ্রান্তি দেখা দিত ,তাছাড়া তাদের এরূপ প্রস্তুতি ও ছিল না। কিন্তু স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের মাধ্যমে মানসিকভাবে জনসাধারণকে প্রস্তুত করে তবেই পূর্ণ অন্তর্ধান শুরু হয়েছে অর্থাৎ মানুষের সাথে একেবারে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না করে তাদেরকে দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের জন্য প্রস্তুত করে তিনি সম্পূর্ণভাবে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যান। আর ইমামের স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানে থেকে তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানটা তাঁর জন্ম গ্রহণ ও জীবিত থাকাকেই প্রমাণ করে । যদি দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান এ ধরনের কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই শুরু হতো তাহলে হয়তোবা এই বিষয়টি আমাদের কাছে এমনভাবে পরিস্কার হতো না এবং হয়তো কারো কারো জন্যে এ বিষয়টি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত বা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতো। আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তাঁর ক্ষমতা দিয়ে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের বিষয়টিকে দুইটি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন যেমনটি পূর্ব থেকে নবী (সা.) ও ইমামগণ (আ.) খবর দিয়েছিলেন। অল্প সময়ের জন্য অন্তর্ধানে থাকাটা হচ্ছে দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের জন্য প্রস্তুতি পর্ব (যাকে আমরা স্বল্প বলে আখ্যায়িত করেছি)। তারপর দীর্ঘ বা পূর্ণ অন্তর্ধান শুরু হয়েছে (যাকে আমরা দীর্ঘকালীন অন্তর্ধান বলে আখ্যায়িত করেছি) যাতে করে আহলে বাইতের অনুসারীরা তাদের ঈমানের প্রতি দৃঢ় ও অটল থাকে এবং তারা যেন তাদের ইমামের প্রতি নিজেদের অন্তরের বিশ্বাসকে হারিয়ে না ফেলে। তাঁর অপেক্ষায় থেকে আল্লাহর দেয়া স্বস্তি অনুভব করে এবং আল্লাহর দীনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে নিজেদের আত্মশুদ্ধির পথকে সুদৃঢ় করে। আর এর সাথে সাথে দীনের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তাও যেন প্রকৃতভাবে সম্পন্ন করে ,ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না ইমামের আবির্ভাবের ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন নির্দেশ দেন।
ইমামের চারজন প্রতিনিধি
স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে শিয়া মাযহাবের বিশিষ্ট চারজন ব্যক্তি ইমাম মাহ্দীর (আ.) বিশেষ প্রতিনিধি বা খলিফা ছিলেন। যারা প্রতিনিয়ত তাঁর সান্নিধ্য পেতেন এবং তারা যে ইমামের বিশেষ প্রতিনিধি তা ইমামের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ছিল। ইমামের কাছে লিখিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর লোকজন এই চারজন প্রতিনিধির মাধ্যমেই পেত।
অবশ্য এই চারজন ব্যতীত ইমামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে আরও প্রতিনিধি নিযুক্ত ছিল ,কিন্তু তারাও এই চারজন বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমেই ইমামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। তদ্রূপ ঐ প্রতিনিধিদের ব্যাপারে ইমামের যে আদেশ নির্দেশ থাকতো তা তাঁর এই চারজন বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমেই পাঠাতেন। ৬৭ মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মোহ্সেন আমিনের বক্তব্য অনুযায়ী ইমামের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র এই চারজনই বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে সার্বিক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন কিন্তু অন্যান্য প্রতিনিধিরা এরূপ ছিলেন না বরং অন্যান্য প্রতিনিধিরা যেমন আবুল হুসাইন মুহাম্মদ বিন জা ’ ফার আসাদী ,আহমাদ বিন ইসহাক আশআ ’ রী ,ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ হামাদানী ,আহমাদ বিন হামযাহ্ বিন ইয়াসা প্রমুখ বিশেষ কোন বিষয়ে প্রতিনিধি ছিলেন। ৬৮
ইমামের চারজন বিশেষ প্রতিনিধি হলেন যথাক্রমে :
১-আবু আ ’ মর উসমান বিন সাঈদ আ ’ মরী।
২-আবু জা ’ ফর মুহাম্মদ বিন উসমান বিন সাঈদ আ ’ মরী।
৩-আবুল কাসেম হুসাইন বিন রুহ নওবাখতী।
৪-আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মদ সামারী।
আবু আ ’ মর উসমান বিন সাঈদ আমরী মানুষের আস্থাভাজন ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এবং হযরত হাদী ও হযরত আসকারী (আ.) উভয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। ৬৯ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নির্দেশে তিনি ইমাম আসকারী (আ.)-এর কাফন ও দাফন সম্পন্ন করেন। ৭০ তিনি ইরাকের সামাররা শহরের আসকার অঞ্চলে বসবাস করতেন বিধায় তাকেও আসকারী নামে অভিহিত করা হতো। আব্বাসীয় খলিফার লোকজন যেন বুঝতে না পারে যে তিনি ইমামের প্রতিনিধি এবং তাঁর কাজের ব্যাপারেও যেন কিছু জানতে না পারে সে জন্য তিনি তেল কেনাবেচার কাজ করতেন। ৭১ যখনই ইমাম আসকারীর সাথে অনুসারীদের যোগাযোগ অসম্ভব হয়ে পড়তো তখন তাঁর কাছেই শিয়ারা খুমস ,যাকাত ইত্যাদির অর্থ সম্পদ ইমামের কাছে পৌঁছানোর জন্য দিত। তিনি এই অর্থ সম্পদ তার তেলের টিনের মধ্যে ভরে তেল বিক্রয়ের ছলনায় ইমামের কাছে পৌঁছে দিতেন। ৭২
আহমাদ বিন ইসহাক কোমী বলেন : ইমাম হাদী (আ.)-এর কাছে এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম যে ,আমি কখনও এখানে আবার কখনও অন্য জায়গায় যাই। আর যখন এখানে থাকি সবসময় আপনার কাছেও আসতে পারিনা ,এমতাবস্থায় আমি কাকে অনুসরণ করব বা কার কথা মেনে চলব ?
বললেন : এই আবু আ ’ মর উসমান বিন সাঈদ আ ’ মরী আমার আস্থা ভাজন ও নির্ভরযোগ্য। সে যা কিছু তোমাদেরকে বলবে মনে করবে যে আমিই তোমাদেরকে বলছি। আর যা কিছু তোমাদেরকে দেবে মনে করবে যে আমিই তোমাদেরকে দিয়েছি।
আহমাদ বিন ইসহাক বলেন : ইমাম হাদীর শাহাদাতের পর ইমাম আসকারীর কাছে গিয়েছিলাম এবং ঐ একই রকম প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলাম। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি তাঁর বাবার মতই একই কথা বললেন : আবু আ ’ মর পূর্ববর্তী ইমামের আস্থা ভাজন ছিল ,তদ্রূপ সে আমার জীবদ্দশাতে এবং মৃত্যুর পরেও আমাদের আস্থা ভাজন থাকবে। যা কিছু সে তোমাদেরকে বলবে তা আমার পক্ষ থেকে মনে করবে এবং যা কিছু তোমাদের কাছে পৌঁছে দিবে তাও আমার পক্ষ থেকে মনে করবে। ৭৩
উসমান বিন সাঈদ ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নির্দেশে প্রতিনিধিত্বের কাজকে অব্যাহত রাখেন। নিয়ম অনুযায়ী শিয়ারা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন তার কাছে পৌঁছে দিত এবং ইমামের দেওয়া জবাবকে আবার তার কাছ থেকেই নিয়ে আসতো। ৭৪
মরহুম মুহাক্কেক দমাদ তার “ সিরাতুল মুসতাকিম ” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : আবু আ ’ মর উসমান বিন সাঈদ আ ’ মরী বর্ণনা করেছেন যে ,ইবনে আবি গানিম কাযভীনী বলেন ,ইমাম হাসান আসকারী (আ.) কোন সন্তান-সন্ততি না রেখেই মৃত্যুবরণ করেন! শিয়ারা কাযভীনীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে এবং ইমামের উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠায় ,চিঠিটি কাগজের উপর কালি বিহীন কলম দ্বারা লেখা হয়েছিল। এভাবে লেখার উদ্দেশ্য এই ছিল যে ,তাঁর পক্ষ থেকে আসা উত্তরটি পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় একটি অলৌকিক বিষয় হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকবে। ঐ চিঠির জবাবটি ইমামের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত ভাবে আসে :
“ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ”
আল্লাহ্ তা ’ য়ালা আমাদের ও তোমাদেরকে যেন পথভ্রষ্ট হওয়া এবং ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে দূরে রাখেন। তোমাদের মধ্যে যে একটি অংশ তাদের দীন ও ওয়ালী আমরের বেলায়তের ( নির্দেশদাতা কর্তৃপক্ষের অভিভাবকত্বের ) বিষ য়ে দ্বিধা - দ্বন্দ্বে উপনীত হয়েছে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এই খবরটি আমাদেরকে প্রভাবিত ও দুঃখিত করেছে। অবশ্য আমাদের প্রভাবিত ও দুঃখিত হওয়াটা আমাদের জন্য নয় বরং তা তোমাদের জন্যই। কেননা আল্লাহ্ ও সত্য আমাদের সাথে। যারা আমাদের থেকে দূরে সরে যায় তারা আমাদের জন্য কোন আতঙ্কের বিষয় নয়। আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের মাধ্যমে শিক্ষিত - প্রশিক্ষিত ও পূর্ণতা লাভ করেছি। আর অন্যান্য সকল সৃষ্টি জীব আমাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও পূর্ণতা লাভ করে। আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের নূর থেকে আলোকিত হই আর অন্যান্য সকল কিছুই আমাদের নূর থেকে আলোকিত হয়। কেন তোমরা দ্বিধা - দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছো , তোমরা কি জান না যে পূর্ববর্তী ইমামগণের কাছ থেকে তোমাদের কাছে যা কিছু পৌঁছেছে অবশ্যই তা বাস্তবায়িত হবে ( পূর্ববর্তী ইমামগণ খবর দিয়েছিলেন যে ইমাম মাহ্দী ( আ .) অন্তর্ধানে থাকবেন ) , তোমরা কি দেখ নি যে কিভাবে আল্লাহ্ তা ’ য়ালা হযরত আদম ( আ .) থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী ইমামের সময় পর্যন্ত সর্বদা তাঁদেরকে আশ্রয়স্থ ল হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। যাতে করে মানুষ তাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে এবং তাঁদের সংস্পর্শে থেকে তারা সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারে। যখনই একটি নিদর্শন অন্তরালে চলে গিয়েছে সাথে সাথে আরেকটি নিদর্শন তার স্থানে স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আর যখনই একটি নক্ষত্রের অবসান ঘটেছে তখনই আরেকটি নক্ষত্রের উদয় হয়েছে। তোমরা কি এটাই ভেবে নিয়েছ যে , আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তাঁর পাঠানো এগারতম প্রতিনিধির রূহকে কবজ করে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার পর নিজের দেয়া দীনকে রহিত করে দিয়েছেন এবং তাঁর নিজের ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার যোগাযোগের মাধ্যমকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। অবশ্যই এরকম নয় এবং কিয়ামত না হওয়া পর্যন্ত এরকম কখনও হবে না। আর এমনটি মনে করছো যে আল্লাহর নির্দেশ প্রতিষ্ঠিত হবে যখন কিনা তাঁর পছন্দনীয় ও মনোনীত প্রতিনিধিরা থাকবে না। না তা অবশ্যই না। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করে চল এবং আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর এবং পরিচালনার দায়িত্বকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে উপদেশ দান করছি , আর এ ব্যাপারে আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসাবে রইলেন। ৭৫
উসমান বিন সাঈদ মৃত্যুর পূর্বে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নির্দেশে নিজের সন্তান আবু জা ’ ফর মুহাম্মাদ বিন উসমানকে তার স্থলাভিষিক্ত করে মানুষের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেন।
মুহাম্মদ বিন উসমান নিজেও তার পিতার মতই খোদাভীরুতা ,ন্যায়পরায়নতা ও মহানুভবতার দিক দিয়ে মানুষের মাঝে বিশ্বাসী ও সম্মানের অধিকরী ছিলেন। হযরত ইমাম আসকারী (আ.) ইতিপূর্বেই এই পিতা ও পুত্রের বিশ্বস্ততার ও আস্থাভাজন হওয়ার ব্যাপারে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মরহুম শেখ তুসি এ ব্যাপারে লিখেন : শিয়া জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায়পরায়নতা ,খোদাভীরুতা ও আমানতদারীতার ব্যাপারে অবগত ছিল। ৭৬
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর প্রথম প্রতিনিধি জনাব উসমান বিন সাঈদ এর মৃত্যুর পরে যে তৌকিয়া ৭৭ পাওয়া যায় তাতে তার মৃত্যুর ও তার সন্তান মুহাম্মদকে ইমামের দ্বিতীয় প্রতিনিধির পদে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারে খবর ও নিদের্শ ছিল ,যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
اِناَّ لِلَّهِ وَ اِناَّ اِلَيْهِ راجِعُون মহান আল্লাহর সকল আদেশ-নির্দেশের নিকট আত্মসমর্পন করছি এবং তাঁর নির্ধারিত সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্ট আছি। তোমার পিতা সম্মানজনকভাবে জীবন-যাপন করেছে এবং সৌভাগ্যবান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আল্লাহ্ তাকে রহমত করুন এবং তাকে তার ইমামদের (আ.) সাথে স্থান দান করুন। সর্বদা সে তার ইমামগণের কাজে শরিক হতো এবং যা কিছুতে আল্লাহ্ তা ’ য়ালা খুশি হবেন ও ইমামগণের পছন্দ ছিল তাই করার চেষ্টা করতো। আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তার উপর রাজী ও খুশি হোন এবং তার ভুল-ত্রুটিগুলোকে ক্ষমা করুন।
এই তৌকিয়া অন্য আরেক জায়গায় বলেছেন :
আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তোমাকে উত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করুন এবং তোমাকে মুসিবতের মধ্যেও স্বস্তি ও শান্তি দান করুন। তুমি মুসিবতের মধ্যে আছো এবং আমরাও একই পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। তোমার বাবার বিচ্ছেদ তোমাকে ও আমাদেরকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে এবং তার অনুপস্থিতি তোমাকে ও আমাদেরকে মুসিবতের মধ্যে পতিত করেছে। আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তাঁর রহমতের ছায়ায় তাকে তার চিরস্থায়ী আবাসে প্রশান্তি দান করুন। তোমার পিতা এতই সৌভাগ্যবান ছিল যে আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তাকে তোমার মত সন্তান দিয়েছেন ,যে পিতার পরে তার স্থলাভিষিক্ত হবে ও তার প্রতিটি বিষয়ের দায়িত্বশীল হবে। তার জন্য আল্লাহর কাছে রহমত ও মাগফিরাত কামনা করবে। আমি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি এ কারণে যে ,সমস্ত ইমামগণের দৃষ্টি তোমার উপর এবং যা কিছু আল্লাহ্ তোমার মধ্যে ও তোমাকে দিয়েছেন তা সকলের জন্য খুশি ও আনন্দের বিষয়। আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তোমাকে সাহায্য করুন এবং শক্তিশালী ও দৃঢ় করুন। আর তিনি যেন তোমাকে সাফল্য দান করেন এবং তোমার অভিভাবক ও রক্ষক হোন। ৭৮
আবদুল্লাহ্ বিন জাফর হেমইয়ারী বলেন : উসমান বিন সাঈদ এর মৃত্যুর পর ইমামের হাতে লেখা একাট চিঠি আমাদের কাছে আসে। যাতে লেখা ছিল আবু জাফর ( মুহাম্মদ বিন উসমান বিন সাঈদ আ ’ মরী) তার পিতার স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে ৭৯ ।
অন্য আরেকটি তৌকিয়াতে ইসহাক বিন ইয়াকুব কুলাইনীর প্রশ্নের উত্তরে ইমাম এমনই লিখেছেন:
মুহাম্মদ বিন উসমান আ ’ মরী ও তার পিতা যে আগেই গত হয়েছে আল্লাহ্ তাদের উপর রাজী ও খুশি আছেন। সুতরাং সেও ঐরূপ আমার বিশ্বস্ত এবং তার লিখিত বিষয়গুলি হচ্ছে আমারই লেখা। ৮০
আবদুল্লাহ্ বিন জাফর হেমইয়ারী বলেন : মুহাম্মদ বিন উসমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে দেখেছো ?
বলল : হ্যাঁ ,তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল বাইতুল্লাহিল হারামের (কা ’ বা ঘর) পাশে ,আর তিনি বলছিলেন :
اللَّهُمَّ اَنْجِزْلى ما وَعَدْتَنى ৮১
হে আল্লাহ্! আমাকে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করুন।
এবং তাকে মুসতাযারে ৮২ দেখেছিলাম ,আর তিনি বলছিলেন :
اَللَّهُمَّ اَنْتَقِمْ بى اَعْدائى ৮৩
হে আল্লাহ্! আমার শত্রুরদের হতে আপনি প্রতিশোধ গ্রহণ করুন।
মুহাম্মদ বিন উসমান আরও বলেন : ইমাম মাহ্দী (আ.) প্রতি বছর হজের সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে দেখেন এবং সবাইকে চিনতে পারেন। আর অন্যরাও তদ্রুপ তাকে দেখতে পায় কিন্তু চিনতে পারে না। ৮৪
মুহাম্মদ বিন উসমান নিজের জন্য একটি কবর তৈরী করে তা সাজ (এক ধরনের কাপড় বা পোশাক) দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আর সেই কাপড়ের উপর পবিত্র কোরআন মজিদের কয়েকটি আয়াত ও ইমামদের (আ.) নাম লিখে সেই কবরের মধ্যে গিয়ে প্রতিদিন এক পারা কোরআন তেলাওয়াত করত। ৮৫
তিনি তার মৃত্যুর পূর্বেই তার মৃত্যুর দিন সম্পর্কে জানিয়েছিলেন । যে দিনের ব্যাপারে তিনি পূর্বে খবর দিয়েছিলেন ঠিক সে দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৮৬ তার মৃত্যুর কিছু সময় আগে শিয়া মাযহাবের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি তার কাছে আসলে তাদের সামনে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নির্দেশে আবুল কাসেম হুসাইন বিন রূহ নওবাখতিকে ইমামের পরবর্তী প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন : তিনি আমার স্থলাভিষিক্ত ,তোমরা এখন থেকে তার সাথে যোগাযোগ রাখবে। ৮৭
জনাব আবু জাফর মুহাম্মদ বিন উসমান আ ’ মরী ৩০৫ হিজরী সনে মৃত্যুবরণ করেন। ৮৮
হুসাইন বিন রুহ নওবাখতি
জনাব আবুল কাসেম হুসাইন বিন রুহ নওবাখতি তার পক্ষের ও বিপক্ষের লোকজনদের কাছে বিশেষ সম্মানের পাত্র ছিলেন। তিনি আকল ,উন্নত চিন্তা ,খোদাভীরুতা ও মর্যাদার দিক দিয়ে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। বিভিন্ন ফিরকা ও মাযহাবের লোকেরা তার কাছে আসা-যাওয়া করত। ইমামের দ্বিতীয় প্রতিনিধি মুহাম্মদ বিন উসমান আ ’ মরীর আমলে তিনি তার কাজের কয়েকটি বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলেন। বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিশেষ করে মুহাম্মদ বিন উসমান ,জাফর বিন আহমাদ বিন মুতাইল কোমীর সাথে অন্যদের তুলনায় তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক এতই গভীর ছিল যে মুহাম্মদ বিন উসমানের জীবনের শেষ দিকে জাফর বিন আহমাদের বাড়ীতে তার খাবার রান্না হতো। দ্বিতীয় প্রতিনিধির বন্ধুদের মধ্যে জাফর বিন আহমাদ বিন মুতাইলেরই অন্যদের তুলনায় তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী ছিল। জীবনের শেষ সময়ে এবং যখন মুহাম্মদ বিন উসমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় তখন জাফর বিন আহমাদ তার মাথার কাছে ও হুসাইন বিন রুহ নওবাখতি তার পায়ের কাছে বসে ছিলেন। ৮৯ এমতবস্থায় মুহাম্মদ বিন উসমান জাফর বিন আহমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন : ইমামের প্রতিনিধিত্বকে আবুল কাসেম বিন রুহ নওবাখতির উপর অর্পণ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জাফর বিন মুহাম্মদ তার নিজের জায়গা থেকে উঠে গিয়ে হুসাইন বিন রুহ নওবাখতির হাত ধরে তাকে মুহাম্মদ বিন উসমানের মাথার কাছে বসিয়ে দিল ও নিজে তার পায়ের কাছে বসলো। ৯০
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে হুসাইন বিন রুহ নওবাখতির ব্যাপারে এই তৌকিয়া আসে :
“ আমরা তাকে জানি। আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন যেন তার প্রতিটি ভাল ও পছন্দনীয় বিষয়গুলোকে তাকে চিনিয়ে দেন এবং তার ক্ষমতা দিয়ে যেন তাকে সাহায্য করেন। তার লিখিত বিষয়ের প্রতি খবর রাখি ও তার ব্যাপারে বিশ্বাস রাখি। আমাদের কাছে তার মর্যাদা ও সম্মান আছে যা তাকে আনন্দিত করবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন যেন তার মধ্যে উন্নত দিকগুলোকে বৃদ্ধি করে দেন। কেননা তিনি সকলের অভিভাবক ও সকলের উপর কর্তৃত্বশালী। প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা ’ য়ালার যার কোন শরিক নেই এবং দরুদ ও সালাম সেই আল্লাহ্ প্রেরিত নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের উপর। ”
এই চিঠিটি রোজ শনিবার ৩০৫ হিজরীর শাওয়াল মাসের ৬ তারিখে ইস্যু হয়। ৯১
আবু সাহল নওবাখতি যিনি একজন বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি ও নওবাখতি বংশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন এবং অনেক গ্রন্থও রচনা করেছিলেন তার কাছে জানতে চাওয়া হলো যে কেন তিনি ইমামের প্রতিনিধিত্বে অধিষ্ঠিত না হয়ে আবুল কাসেম হুসাইন রুহ নওবাখতি এই পদে উপনীত হলো ?
বললেন : তারা (ইমামগণ) সকলের থেকে বিজ্ঞ এবং যা কিছু নির্বাচন করেন তা অধিকতর উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমি এমন এক লোক যে শত্রুদের সাথে ইমামতের বিষয়ে কথোপকথন ও আলোচনা করি। যদি ইমামের প্রতিনিধি হতাম এবং তার অবস্থান সম্পর্কে জানতাম ,যেমন এখন আবুল কাসেম হুসাইন বিন রুহ নওবাখতি প্রতিনিধিত্বের সূত্রে জানে ,ইমামতের বিষয়ে বিরুদ্ধাবাদীদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে হয়তো তাদের কাছে ইমামের অবস্থানের ব্যাপারে বলে দিতাম। কিন্তু সে এ ব্যাপারে এমন শক্ত যে ,যদি ইমাম তার জোব্বার নিচে লুকিয়ে থাকে এবং তাকে বিশাল ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় তবুও সে তার জোব্বা উঠিয়ে নিবে না এবং ইমামকে শত্রুদের দেখিয়ে দিবে না। ৯২
আবুল কাসেম হুসাইন বিন রুহ নওবাখতি আনুমানিক ২১ বছর ইমামের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার মৃত্যুর আগে তার প্রতিনিধিত্বকে ইমামের নির্দেশে আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মদ সামারীর নিকট হস্তান্তর করে যায়। ৩২৬ হিজরীর শাবান মাসে তার ইন্তেকাল হয়। তার সমাধিস্থানটি বাগদাদে অবস্থিত। ৯৩
আবুল হাসান সামারী
“ মুনতাহাল মাকাল ” নামক গ্রন্থের লেখক ইমামের চতুর্থ প্রতিনিধি আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মদ সামারীর ব্যাপারে এভাবে লিখেছেন : তার সম্মান ও কদর এতই বেশী ছিল যে তার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ৯৪
এই মহান ব্যক্তি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নির্দেশে হুসাইন বিন রুহ নওবাখতির পরে প্রতিনিধির স্থানে স্থলাভিষিক্ত হয়ে শিয়াদের বিভিন্ন বিষয়ে দেখাশুনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
মরহুম মুহাদ্দেস কোমী এভাবে লিখেছেন : আবুল হাসান সামারী একদিন একদল সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তি বৃন্দদের মধ্যে ঘোষণা করেন ,আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তোমাদের প্রতি আলী বিন ববাভেই কোমীকে হারানোর দুঃখে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দান করুন ,সে এখনই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।
উপস্থিত সকলে ঐ সময় ,দিন ও মাস লিখে রাখলো। ১৭/১৮ দিন পরে খবর পৌঁছালো যে ঠিক ঐ সময়েই আলী বিন ববাভেই কোমী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। ৯৫
আলী বিন মুহাম্মদ সামারী ৩২৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ৯৬ তার মৃত্যুর পূর্বে শিয়া মাযহাবের একদল লোক তার পাশে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল ,তোমার পরে তোমার স্থলাভিষিক্ত কে হবে ?
জবাবে বলল : আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় নি যে এ ব্যাপারে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাব। ৯৭ ইমামের কাছ থেকে যে তৌকিয়াটি তার হস্তগত হয়েছিল তা তাদেরকে দেখালো। তারা তা থেকে হুবহু নকল করে রাখলো। সেটির বিষয় বস্তু ছিল এরূপ :
“ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ”
হে আলী বিন মুহাম্মদ সামারী! আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তোমার বিয়োগে তোমার ভাইদের শোক-তাপ করাতে পুরস্কৃত করবেন। তুমি আর ৬ দিন পরে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে।
সুতরাং তোমার দায়িত্বকে গুছিয়ে নিয়ে এসো এবং কাউকে তোমার স্থলাভিষিক্ত হিসাবে পরিচয় করাবে না। দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানের সূচনা হয়েছে এবং আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আবির্ভাবের কোন ঘটনাই ঘটবে না। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে যাবে ,পৃথিবী জুলুম ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে ,তখন অনেকেই আমার অনুসারীদের কাছে আমার প্রতিনিধি বা আমার সাথে যোগাযোগ আছে এমনটি বলে দাবী করবে। জেনে রাখ যারা সুফিয়ানী ও সিইহার ৯৮ উত্থানের আগে এ ধরণের দাবী করবে অর্থাৎ ইমামের পক্ষ হতে দায়িত্ব প্রাপ্তির দাবী করবে তারা হচ্ছে মিথ্যাবাদী।
وَ لاَ حَوْلَ وَ لاَ قُوَّةَ اِلاَّ بِاللّهِ الْعَلى الْعَظِيم ৯৯
৬ষ্ঠ দিনে জনাব আবুল হাসান সামারী দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। খালেনজী রাস্তার কাছে আবী ইতাব নদীর পাশে তাকে দাফন করা হয়। ১০০
ইমামের (আ.) বিশেষ প্রতিনিধিগণ প্রত্যেকেই তাদের জামানায় সবচেয়ে পরহেজগার ও সম্মানিত ছিলেন। তারা শিয়াদের আস্থা ও বিশ্বাসভাজন ছিলেন। স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের পুরো সমস্ত সময়টাতে শিয়ারা তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমস্যাকে তাদের কাছে বর্ণনা করেছে। আর ইমাম সে সকল প্রশ্নের ও সমস্যার সমাধানও তাদের মাধ্যমেই শিয়াদের উদ্দেশ্যে পাঠাতেন। সে সময় এ ধরনের যোগাযোগ সবার জন্যেই সম্ভব ছিল। এমনকি কিছু সংখ্যক যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি এই বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ইমামের সান্নিধ্যে উপনীত হয়ে তাকে দেখার সৌভাগ্যও অর্জন করেছিলেন।
এই স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে ইমামের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে সকল অলৌকিক ঘটনা ঘটতো তা তাদের প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততা আরও বাড়িয়ে দিত। মরহুম শেখ তুসির উদ্ধৃতি দিয়ে “ ইহতিজাজ ” নামক গ্রন্থে লেখা হয়েছে :
ইমামের বিশেষ প্রতিনিধিদের কেউই তাঁর নির্দেশ বা আগের প্রতিনিধির মাধ্যমে পরিচিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন নি। আর শিয়ারাও কাউকে গ্রহণ করেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না ইমামের পক্ষ হতে তাদের মাধ্যমে কোন অলৌকিক ঘটনার অবতারণা হতো বা ইমামের দেয়া নিদর্শন তাদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যেত...। ১০১
যা হোক ,স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের শেষে দীর্ঘকালীন অন্তর্ধান পর্ব শুরু হয় যা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় লোকজন তাদের প্রশ্নের জবাব ইমামের কাছ থেকে তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিতে পারতো। কিন্তু এখন এটা আর সম্ভব নয়। এখন লোকজন অবশ্যই তাদের প্রশ্নকে ইমামের সাধারণ প্রতিনিধিদের কাছে বর্ণনা করে তাদের কাছ থেকেই জবাব সংগ্রহ করবে। কেননা তারা ফতোয়া দেয়ার বিষয়ে পাণ্ডিত্ব লাভ করেছেন এবং তারা এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় রয়েছেন তদুপরি হাদীসসমূহেও বিশেষজ্ঞ ফকীহর শরণাপন্ন হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা সকলের জন্য দলিল। মরহুম কাশশি লিখেছেন যে ইমামের কাছ থেকে তৌকিয়া হস্তগত হয়েছে তাতে তিনি বলেছেন : আমাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিরা আমাদের থেকে যা বর্ণনা করে সে ব্যাপারে আমাদের অনুসারীদের যেন কোন প্রকার অজুহাত ,আপত্তি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না থাকে ,কেননা তোমরা জেনে রাখ যে আমাদের গোপন রহস্যগুলোকে তাদের কাছে অর্পণ করেছি বা তাদেরকে দিয়েছি। ১০২
শেখ তুসি ,শেখ সাদুক ও শেখ তাবারসী ,ইসহাক বিন আম্মারের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করে বলেছেন : আমাদের মাওলা হযরত মাহ্দী (আ.) তার অন্তর্ধান থাকার সময় শিয়াদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে বলেছেন :
وَ اَماَّ الْحَوادِثُ الْواقِعَةُ فَاْرجِعُوا فِيها اِلى رُواةِ حَديِثِنا فَاِنَّهُمْ حُجَّتى عَلَيْكُمْ وَ اَناَ حُجَّةُ اللَّهِ عَلَيْهِمْ
যে কোন পরিস্থিতির অবতারণা হলে বা যে কোন ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তাতে আমাদের হাদীস বর্ণনাকারীদের (বিশেষজ্ঞদের) শরণাপন্ন হবে ,কেননা তারা হচ্ছে তোমাদের জন্য আমার প্রতিনিধি এবং আমি হচ্ছি তাদের জন্য আল্লাহর প্রতিনিধি। ১০৩
মরহুম তাবারসীর উদ্ধৃতি দিয়ে “ ইহতিজাজ ” নামক গ্রন্থে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,তিনি বলেছেন :
وَ اَماَّ مَنْ كانَ مِنَ الْفُقَهاءِ صائِناً لِنَفْسِهِ حاَفِظاً لِديِنِهِ مُخاَلِفاً لِهَواهُ مُطيِعاً لِاَمْرِ مَوْلاَهُ فَلِلْعَوامِ أَنْ يُقَلِّدوُهُ
যে সকল ফকীহ্ তাদের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে ,স্বীয় দীনের রক্ষক ও প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনার বিরুদ্ধাচারনকারী হয় এবং তার মাওলার (ইমামগণ) নির্দেশের প্রতি অনুগত থাকে ,জনসাধারণের উচিত তাদেরকে অনুসরণ করে চলা। ১০৪
এমতাবস্থায় দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানের সময়ে মুসলমানদের দীন ও দুনিয়ার বিষয়াদি দেখাশুনার দায়িত্ব এমন ফকীহর হাতে অর্পিত হয়েছে যার মধ্যে মুসলমানদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দানের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে এবং নৈতিকভাবেও যিনি সম্পূর্ণ সৎ অর্থাৎ যে ফকীহর নেতৃত্ব দানের সকল যোগ্যতা রয়েছে ও তাকওয়ার অধিকারী তিনিই এ দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই অবশ্যই এসব বিষয়াবলী যেন তার দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী হয়। যদিও ফতোয়া ,বিচার ও রায় প্রদানের অধিকার অনেক আগে থেকেই ইমামগণের পক্ষ থেকে তাদের উপর ন্যস্ত ছিল ,কিন্তু তাদেরকে অনুসরণ করে চলার প্রক্রিয়া এই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
অন্তর্ধানে থাকার ভাল - মন্দ দিকসমূহ
ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন ,বিশ্বাসীদের চিন্তার বিকাশ দান করে ও মনে মুক্তির আশাকে জাগ্রত রাখে। তাঁর উপর এমন বিশ্বাস রাখা যে ,সম্ভাবনা আছে তিনি যে কোন সময় আবির্ভূত হতে পারেন। পবিত্র হৃদয় ও যোগ্য ব্যক্তিদের উপর গঠনমূলক ও গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ,ন্যায় বিচার করবে ,একে অপরের মধ্যে ভালবাসার সৃষ্টি করবে যেন ইমামকে সাহায্য করার তৌফিক অর্জন করে এবং ইমামের সাক্ষাত লাভ করতে পারে বা তার জিয়ারত করা থেকে যেন বঞ্চিত না হয় বা ইমামের অসন্তুষ্টির কারণ না হয়। যারাই তার উপর ঈমান রেখেছে তারা কখনই কোন অত্যাচারী ও দুঃস্কৃতিকারী শাসকের পক্ষে যায় নি। আর যারা তার উপর ঈমান রেখে চলে তাদের ভিতর এক দৃঢ় শক্তির সঞ্চার করে যার কারণে তারা জুলুম ও শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হয় এবং কখনই তারা শয়তানী শক্তির অধীন হয় না বরং তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে।
তার আবির্ভাবের প্রতি ঈমান রাখার অর্থ এটা নয় যে ,মুসলমানরা তার আসার অপেক্ষায় সব কিছু থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখবে এবং ইমাম মাহ্দীর আগমনের আশায় নির্লিপ্ত থেকে সমাধানের দায়িত্ব তাঁর উপর ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণায় অবস্থান গ্রহণ করবে। অথবা কাফির ও দুষ্ট লোকের শাসনকে তারা মেনে নেবে বা জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও শিল্পের ক্ষেত্রে কোনরূপ উন্নতি করবে না বা সমাজকে পরিশুদ্ধ করার কোন চিন্তা করবে না ,এমনটি নয়।
যদি এমনটি মনে করা হয় যে ,তাঁর প্রতি ঈমান অলসতা ,উদাসীনতা বা দায়-দায়িত্বহীনতা ও অবসন্নতা নিয়ে আসবে ,তবে এটা সম্পূর্ণ বাতিল বিষয়। কেননা পবিত্র ইমামগণ ও তাদের সাহাবাগণ নিজেদের উন্নতির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং এ লক্ষ্যে কাজ করতেন সেই সাথে তারা ইমামের আবির্ভাবের প্রতিও ঈমান রাখতেন। ইসলামের বড় বড় যত আলেম ছিলেন ,যারা দীন ও দুনিয়া উভয় জ্ঞানে পারদর্শি ছিলেন তারা কি তাঁর আবির্ভাবের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না ?বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা বিশ্বাসী থেকেই দীনের ও সমাজের উন্নতির জন্য সাধ্যমত কাজ করে গেছেন ,এজন্য আত্মোৎসর্গও করেছেন। তারা কখনও নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে সরে আসেন নি। কঠিনতম কাজ করা থেকেও বিরত থাকেন নি বরং তারা নিজেদের তৈরী করার ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রেখে অকুতোভয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।
ইসলামের প্রথম দিকের মুসলমানরা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছিলেন যে ,ইসলাম এগিয়ে যাবে এবং তাঁর সামনে বিজয়ের পর বিজয় রয়েছে। কিন্তু তারপরও এই বিজয়ের খবর তাদেরকে অলসে পরিণত করে নি বা তাদের কাজ করা হতে বিরত করতে পারে নি ;বরং তাদের চেষ্টার পরিমান আরও দ্বিগুণ হয়েছিল এবং কষ্ট ও ত্যাগের মাধ্যমে সফলতায় পৌঁছেছিল।
বর্তমান সময়ও মুসলমানরা বিভিন্ন বড় বড় দায়িত্বে রয়েছেন। তাদেরকে অবশ্যই দৃঢ়তার সাথে সে সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন। সকল সময় সকল ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকবেন এবং সকলকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। শত্রুর অবৈধ অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করবেন। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর শত্রুর চিন্তাগত ,অর্থনৈতিক ,রাজনৈতিক ও সামরিক হামলাকে প্রতিহত করবে। যতটুকু বা যে পরিমানই সম্ভব নিজেদেরকে নৈতিকতার ব্যাপারে সচেতন করবে যাতে করে ইমাম মাহ্দীর সাহায্য ও সহযোগিতা ,দয়া ও করুণা বেশী করে তাদের ভাগ্যে জোটে। যতটুকু সম্ভব ক্ষেত্রকে এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে করে আল্লাহর সর্বশেষ প্রতিনিধি ও এই শেষ জামানার ইমাম দ্রুত আবির্ভূত হন।
আমিরুল মু ’ মিনীন আলী (আ.) নবী করিম (সা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করে বলেছেন :
اَفْضَلُ الْعِبادَةِ اِنْتِظارُ الْفَرَجِ
হযরত বাকিয়াতুল্লাহর অর্থাৎ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকা হচ্ছে সর্ব উৎকৃষ্ট ইবাদত। ১০৫
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন : দ্বাদশ ইমামের অন্তর্ধান বেশ দীর্ঘ হবে। যারা তাঁর অন্তর্ধানের সময় তাঁর ইমামতের উপর বিশ্বাসী এবং তাঁর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকবে তারা অন্যান্য সকল জামানার জনগণের থেকে উত্তম হবে। কেননা আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তাদেরকে এতটা বিবেক-বুদ্ধি ,বোঝার ক্ষমতা ও জ্ঞান দান করেছেন যে ইমাম অন্তর্ধানে থাকা সত্ত্বেও তাদের কাছে উপস্থিত মনে হবে। আর এ কারণেই আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তাদের মর্যাদাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সঙ্গী হিসেবে তাঁর সাথে যুদ্ধকারী মুজাহিদের স্থান দিয়েছেন। তারা সত্য সত্যই নিবেদিত প্রাণ এবং প্রকৃতই আমাদের অনুসারী। আর তারাই জনসাধারণকে লুকিয়ে বা গোপনে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে।
আরও বলেছেন :
اِنْتِظارُ الْفَرَجِ مِنْ اَعْظَمِ الْفَرَجِ
মহামুক্তির প্রতীক্ষা থাকা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মুক্তি। ১০৬
মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ সাদরুদ্দিন সাদর এভাবে লিখেছেন : মহা মুক্তির জন্য অপেক্ষা হচ্ছে যে বিষয়ের প্রতি অপেক্ষমান তা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সচেষ্ট থাকা। এটা গোপন নয় যে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকার অর্থই হচ্ছে নিজের ও সমাজের বিশেষ করে শিয়া সমাজকে পরিশুদ্ধ করা যা নিম্নরূপ :
১-অপেক্ষা স্বয়ং মানুষের আত্মার জন্য একটি বিশেষ অনুশীলন বা প্রশিক্ষণ। যেমন বলা হয়ে থাকে :
اَلْاِنْتِظارُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ
অপেক্ষা হচ্ছে নিহত হওয়া থেকেও কষ্টকর।
আর অপেক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ,যে বিষয়ে বা জিনিসের জন্য অপেক্ষা করা হয় তার প্রতি চিন্তা-ভাবনাকে ব্যস্ত রাখা ও দৃষ্টি রাখা এবং চিন্তা শক্তিকে একটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত করা। আর এই কঠিন কাজের দু ’ টি সুফল আছে যা নিম্নরূপ :
ক) মানুষের চিন্তাশক্তি তার কার্যশক্তির পরিমান বৃদ্ধি করে।
খ) মানুষ একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি গভীর চিন্তা-ভাবনা করার জন্য তার চিন্তাশক্তি ও ক্ষমতাকে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার শক্তি অর্জন করে। আর এই দু ’ টি সুফল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানুষ তার জীবন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভব করে থাকে।
২-অপেক্ষার কারণে মানুষের মুসিবত ও সমস্যা হালকা হয়। কেননা সে জানে যে পরবর্তীতে এই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বা এর ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব। আর এ দু ’ টির মধ্যে কত পার্থক্য যে সে জানে পরবর্তীতে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বা আদৌও জানে না যে পরবর্তীতে এই সমস্যা সমাধান হবে কি হবে না। বিশেষ করে যদি সম্ভাবনা থাকে যে অতি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে ;হযরত মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হয়ে পৃথিবী থেকে সব অন্যায় ও অত্যাচারকে নির্মূল করে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমস্ত সমস্যা সমাধান করবেন।
৩-মহামুক্তির প্রতীক্ষায় থাকার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সঙ্গী ও অনুসারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে এমন কি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকবে তার বিশেষ সহযোগী ও সৈনিকে পরিণত হওয়ার। আর তার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে নিজের নফসকে পরিশুদ্ধ করার বিশেষ চেষ্টা করা ও নৈতিক গুণাবলীকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে করে তাঁর সহযোগী হওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয় ও তাঁর নির্দেশে তাঁর সাথে থেকে জিহাদ করার তৌফিক অর্জন করতে পারে। হ্যাঁ ,এসবের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রকৃত চরিত্র ,যা আজ আমাদের সমাজে দুষ্প্রাপ্য।
৪-মহামুক্তির প্রতীক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তি চরিত্র সংশোধন নয় ,বরং অন্যের আত্মিক সংশোধনেরও কারণ হয়। এর ফলে মানুষ ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর শত্রুদের উপর আধিপত্য অর্জনের পরিবেশ ও ক্ষেত্রও প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়। আর এই উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় নিজেদেরকে পারদর্শী করা। কারণ শত্রুদের উপর ইমামের বিজয় লাভের বিষয়টি সাধারণ প্রক্রিয়াতেই সংঘটিত হবে।
বর্ণিত চারটি বিষয় প্রকৃত মহামুক্তির প্রতীক্ষায় থাকার অসংখ্য ইতিবাচক প্রভাবের ক্ষুদ্রতম একটি অংশ মাত্র। ১০৭
মরহুম মুজাফফার এভাবে লিখেছেন : হযরত মাহ্দী (আ.)-এর অপেক্ষায় থাকার অর্থ এই নয় যে ,যেহেতু তিনি এসে দুনিয়াকে সংস্কার করবেন এবং যারা সত্যের পথে আছে তাদেরকে নাজাত দিবেন তাই এটা ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ,দীনের কাজ না করা ,বিশেষ করে দীনের ওয়াজিব বিষয়গুলো যেমন দীনের আইন-কানুনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করা ,সৎ কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধ করা ইত্যাদি বর্জন করা কখনই বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা মুসলমানরা যে কোন পরিস্থিতিতেই আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে বাধ্য এবং আল্লাহর নির্দেশাবলী সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমেই সম্ভব সৎ কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করা। এটা সমীচীন নয় যে ,দুনিয়া সংস্কার হওয়ার অপেক্ষায় ওয়াজিব কাজ করা থেকেও বিরত থাকবো। অপেক্ষা কখনই মুসলমানদের ওয়াজিব দায়িত্বকে লাঘব করে না এবং কোন কাজ সম্পাদনের সময়কে পিছিয়ে নিয়ে যায় না। ১০৮
এ কারণে নিশ্চিত যে ইমামের অন্তর্ধানের সময়ে তার অনুসারীরাও (শিয়ারা) বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। অবশ্যই পরীক্ষিত হওয়ার সময় একদিকে যেমন দীনের ছায়াতলে থেকে নিজেকে বাঁচাবে আর অন্যদিকে তেমনই ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যাতে করে ইমামের সৈনিক হিসেবে ইসলামের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। বেশীর ভাগ জনগণই এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে নি।
জাবির জো ’ ফী বলেন : ইমাম বাকির (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে ,আপনাদের মহামুক্তির সময় কখন ?
বললেন : দূরে! দূরে! আমাদের মহামুক্তি ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ না তোমাদেরকে চালনি দিয়ে চালা হচ্ছে। চালনি দিয়ে চালা হবে (তারপর ইমাম চালনি দিয়ে চালার কথাটিকে তিনবার উচ্চারণ করলেন) যাতে করে খারাপ লোকজন ধুলা-বালির ন্যায় চালনির নিচে পড়ে যায় আর ভালরা পৃথক হয়ে যায়। ১০৯
হ্যাঁ অপেক্ষার এই বৈশিষ্ট্য আছে যে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কোন প্রকার নিরাশার অবকাশ নেই এবং অপেক্ষাকারীরা আশান্বিত যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাব ঘটবে ও আল্লাহর পক্ষ থেকে অতি দ্রুত মহা মুক্তি আসবে।
অপরদিকে অন্তর্ধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষ এই সময়ে তাদের নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগাবে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করবে যে ,কোন প্রকার ওহী ,এলহাম অলৌকিক সাহায্য ব্যতিরেকে তারা মানবতার কাফেলাকে তার প্রকৃত ও মহান লক্ষ্য অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। তখন তারা (মানব সমাজের মাঝে অবস্থানের) অবশ্যই ওহী ও আসমানী জ্ঞান ,শিক্ষা ও ঐশী প্রশিক্ষণের সামনে মাথা নোয়াবে।
ইমাম অন্তর্ধানে থাকার সুফল
অনেকেই ইমামগণের (আ.) উপস্থিতির (মানব সমাজের মাঝে অবস্থানের) প্রকৃত রহস্য বা দর্শন ভালভাবে না জানার কারণে প্রশ্ন করে যে ইমামের অন্তর্ধানে থাকার সুফলতা কী ?তারা জানে না যে ,পৃথিবী সৃষ্টির উদ্দেশ্য তখনই পরিপূর্ণ হবে যখন আল্লাহ্ তা ’ য়ালার পবিত্র প্রতিনিধিগণ উপস্থিত থাকবেন যাতে তারা তাদের পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতের পূর্ণতম রূপের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন ।
ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিল। তারা বলেছিল পরবর্তীতে মানব জাতি খারাপ কাজে লিপ্ত হবে। তারা মানুষ জাতির সাথে নিজেদেরকে আল্লাহর ইবাদতের বিষয়টি তুলনা করেছিল এবং তারা মানুষ সৃষ্টির কোন বিশেষত্ব দেখতে না পেয়ে বলেছিল :
أَتَجْعَلُ فِيها مَنْ يُفْسِدُ وَ يَسْفِكُ الدِّماءَ وَ نَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَ نُقَدِّسُ لَكَ
আপনি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা জমিনের বুকে ফ্যাসাদ করবে ও একে অপরের রক্ত ঝরাবে ?আর অপরদিকে আমরা সর্বত্র আপনার প্রশংসা ,ইবাদত ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। ১১০
আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন বিশ্বের পরিচালনা ও তার প্রকৃত বাস্তবতা ও রহস্য সম্পর্কে হযরত আদম (আ.)-এর জ্ঞান ও এ বিষয়ে তার যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বকে ফেরেশতাদের সামনে তুলে ধরে (যা প্রকৃতপক্ষে পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি নিয়ে তাঁর বন্দেগী করা ও তার ইবাদত করার দিকে ফিরে আসে) তাদেরকে পরিতুষ্ট ও শান্ত করলেন ।
আল্লাহর নির্দেশে যখন আদম (আ.) নিজের জ্ঞানকে ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং তারা আল্লাহর হুজ্জাতদের (বিশিষ্ট ও মনোনীত বান্দাদের) অস্তিত্ব ও তাঁর কাছে তাদের বিশেষ মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত হলো তখন বুঝতে পারলো যে ,আল্লাহকে তারা যেভাবে উপাসনা করে আর তাঁর অলিগণ ও হুজ্জাতদের ( মানব জাতির জন্য যারা আল্লাহর দলিল ও স্পষ্ট প্রমাণ স্বরূপ। ) উপাসনার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে এবং এ দুটির মধ্যে তুলনার অবকাশ রাখে না। যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ হচ্ছেন মানব জাতির অন্তর্ভূক্ত ,তাই মানুষ সৃষ্টি যুক্তিযুক্ত ও যথার্থ এবং তারা অন্যান্য সৃষ্টির উপর প্রাধান্য রাখে।
সুতরাং এই উপযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গরাই সৃষ্টির দর্শনকে পরিপূর্ণ করেন। যার কারণে সমস্ত ফেরেশতাগণ তাদের সামনে মাথা নুইয়ে সেজদা করে। কেননা এই ব্যক্তিবর্গের ইবাদত তুলনাহীন এবং কোন ইবাদতই তাদের ইবাদতের স্থানকে পূরণ করতে পারবে না। আর যেভাবে আল্লাহর হুজ্জাতদের অস্তিত্ব মানব জাতির সৃষ্টি ও শুরুর জন্য বিশেষ কারণ হিসাবে চিহ্নিত ছিল তদ্রূপ মানব জাতির অস্তিত্ব অব্যাহত ও প্রবাহমান থাকার জন্যও তাদের অর্থাৎ ঐ বিশেষ কারণের অবশিষ্ট থাকার প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহর হুজ্জাতদের অবশ্যই মানব সমাজে উপস্থিত থাকতে হবে। যদি বলি যে আল্লাহর নেয়ামত আমাদের প্রতি রয়েছে তা শুধুমাত্র এই উপযুক্ত ব্যক্তিদের অস্তিত্বের কারণেই। যদি তারা না থাকতো তাহলে আমরাও থাকতাম না। আমরা এখনও যে দুনিয়ার অস্তিত্বের পোশাক পরে আছি যদি তাদের একজনও অবশিষ্ট না থাকেন তাহলে আমরা আবার অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বো। সুতরাং আল্লাহর হুজ্জাত শুধুমাত্র দীন ও দুনিয়ার জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য নেয়ামত স্বরূপ নয় বরং এই পৃথিবীকে অস্তিত্বদানের ক্ষেত্রেও নেয়ামত স্বরূপ এবং আমাদের উপর দাবী রাখেন।
যিয়ারতে জামে কবীরাতে আমরা পড়ি :
مَوالِىَّ لاَ أُحْصى ثَنائَكُمْ وَ لاَ أَبْلُغُ مِنَ الْمَدْحِ كُنْهَكُمْ وَ مِنَ الْوَصْفِ قَدْرَكُمْ وَ أَنْتُمْ نُورُ الْاخْيارِ وَ هُداةُ الْاَبْرارِ وَ حُجَجُ الْجباَّرِ بِكُمْ فَتَحَ اللَّهُ وَ بِكُمْ يُنْزِلُ الْغَيْثَ وَ بِكُمْ يُمْسِكُ السَّماءَ أَنْ تَقَعَ عَلَى الْاَرْضِ اِلاَّ بِاِذْنِه وَ بِكُمْ يُنَفِّسُ الْهَمَّ وَ يَكْشِفُ الضُرَّ
“ হে আমার নেয়ামতসমূহের অভিভাবকগণ ,তোমাদের প্রশংসাকে গুনে শেষ করতে পারি না ,তোমাদের অস্তিত্বের মর্যাদা অনুযায়ী প্রশংসা করতে পারি না ,তোমাদের মর্যাদা ও ক্ষমতার বর্ণনা দিতে আমি অপারগ ,তোমরা ভালোদের নূর স্বরূপ আর উত্তমদের পথপ্রদর্শক এবং মহান আল্লাহর হজ্জাত ,আল্লাহ্ তা ’ য়ালা তোমাদের কারণেই সৃষ্টির সূচনা করেছেন এবং তোমাদের কারণেই এই পৃথিবীর ইতি হবে ,তোমাদের কারণেই বৃষ্টির বারিধারা নিচে নেমে আসে ,তোমাদের কারণেই আসমানকে পৃথিবীর উপর ভেঙ্গে পড়া থেকে ঠেকিয়ে রেখেছেন , তোমাদের কারণেই সমস্যার সমাধান হয় ও দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটে। ”
ইমাম কাযেম (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইমাম সাদিক (আ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন :
وَ بِعِبادَتِنا عُبِدَ اللَّهُ عَزَّ وَ جَلَّ وَ لَوْلاَنا ما عُبِدَ اللَّهُ
আমাদের জ্ঞান ও ইবাদতের কারণেই মহান আল্লাহর ইবাদত হয় আর যদি আমরা না থাকতাম তাঁর ইবাদতই হতো না। ১১১
অন্য আরেকটি হাদীসে বলেছেন :
اِنَّ الْاَرْضَ لاَ تَخْلُوا اِلاَّ وَ فِيها اِمامٌ
জমিন কখনই পবিত্র ইমাম ব্যতীত থাকে না। ১১২
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : আল্লাহর কসম ,আল্লাহ্ তা ’ য়ালা যখন হযরত আদম (আ.)-এর রূহ মোবারককে কবজ করে নিলেন ,তখন থেকে পৃথিবীকে এমন অবস্থায় ত্যাগ করেন নি যে ,তাতে কোন ইমাম থাকবে না। যার মাধ্যমে মানুষ হেদায়েত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। আর সেই হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহর হুজ্জাত। আর জমিন কখনই ইমাম ছাড়া অর্থাৎ মানুষের জন্য আল্লাহর হুজ্জাত ব্যতীত অবশিষ্ট থাকবে না। ১১৩
আর একটি বিষয় হচ্ছে ইমামগণ আধ্যাত্মিক বিষয়েরও হেদায়েতকারী। আর তা হচ্ছে এমন যে ,পবিত্র ইমামগণ যেভাবে মানুষের বাহ্যিক আমলের ব্যাপারে পথনির্দেশনা দেন বা পরিচালনা করেন তেমনি বাতেনী বা অভ্যন্তরীণ (আধ্যাত্মিক বিষয়ের) ব্যাপারেও নির্দেশনা দেন বা পরিচালনা করেন অর্থাৎ তার হেদায়েতের মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক জীবন পরিচালিত হয় এবং সৎকর্মসমূহ তার ঐশী নির্দেশনায় ঊর্ধ্বে যাত্রা করে। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :
) و َ جَعَلْناهُمْ اَئِمَّةً يَهْدُونَ بِاَمْرِنا وَ اَوْحَيْنا اِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْراتِ (
এবং তাদেরকে ইমাম হিসাবে নির্দিষ্ট করেছি যেন আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী মানুষদেরকে হেদায়েত করে এবং তাদের প্রতি ভালো কাজ সমূহ ওহী হিসেবে প্রেরণ করেছি। ১১৪
এবং অন্য আরেক জায়গায় বলেছেন
) و َ جَعَلْنا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِاَمْرِنا لَماَّ صَبَرُوا (
আমরা তাদের কিছু সংখ্যককে ইমাম হিসাবে নির্দিষ্ট করেছি যেন আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী হেদায়েত করে ,কেননা তাঁরা ধৈর্যধারণ করেছে। ১১৫
আল্লামা তাবাতাবাই এভাবে লিখেছেন : এ সকল আয়াত থেকে এটাই বোঝা যায় যে ,ইমাম বাহ্যিকভাবে দিক নির্দেশনা ও হেদায়েত করা ব্যতিরেকেও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ হেদায়েতের বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার ব্যাপারেও কাজ করে থাকেন যা অবস্তুগত ও ঐশী নির্দেশ স্বরূপ। ইমামগণ তাঁদের অভ্যন্তরীণ সত্তা ,আধ্যাত্মিক আলো ও অস্তিত্বের মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তরে প্রভাব ফেলেন। আর এভাবেই তাদেরকে পরিপূর্ণতা ও ভালো পরিণতির দিকে টেনে আনতে পারেন। ১১৬ যারা আপত্তি করেন যে ,যেহেতু শিয়ারা ইমামের উপস্থিতিকে দীনি আইন-কানুন বর্ণনা এবং তা মানুষের সামনে পরিষ্কার করে দেয়া ও মানুষকে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন মনে করে সেহেতু ইমাম অন্তর্ধানে থাকাতে এই উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হচ্ছে না ,কেননা যে ইমাম অন্তর্ধানে থাকে মানুষ তাঁর সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ রাখতে পারে না তাই তার অস্তিত্বের কোন প্রকার সুফল নেই তারা ইমামতের প্রকৃত অর্থ সম্বন্ধে কোন ধারণাই রাখে না। কেননা ইমামতের আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ,ইমামের দায়িত্ব শুধুমাত্র ইসলামের বাহ্যিক রূপ আলোচনা ও মানুষকে বাহ্যিকভাবে পথনির্দেশনা দান করা নয়। ইমামের যেমন মানুষকে বাহ্যিকভাবে পথনির্দেশনা দেয়ার দায়িত্ব আছে তেমনই তাদের অভ্যন্তরীণভাবে দিক নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্বও রয়েছে। তিনিই হচ্ছেন মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের শৃঙ্খলা বিধানকারী এবং তিনিই মানুষের প্রকৃত আমল আল্লাহ্ তা ’ য়ালার দিকে পরিচালনা করেন। এটা ঠিক নয় যে ,ইমামের শারীরিক উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি এ ব্যাপারে কোন প্রভাব রাখে না। আর ইমাম অভ্যন্তরীণভাবে মানুষের নফস ও রূহের সাথে সম্পর্কযুক্ত যদিও তিনি আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে। আর এ কারণেই তার অস্তিত্ব বিরাজমান থাকার প্রয়োজন রয়েছে যদিও তাঁর আবির্ভাবের ও পৃথিবীকে সংস্কারের সময় আসে নি। ১১৭
মরহুম খাজা নাসির উদ্দিন তুসি (রহঃ) বলেছেন :
وُجُودُهُ لُطْفٌ وَ تَصَرُّفُهُ لُطْفٌ آخَرٌ وَ عَدَمُهُ مِناَّ
ইমামের উপস্থিতি হচ্ছে আল্লাহর একটি অনুগ্রহ এবং (পর্দার অন্তরালে থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণভাবে) দিক-নির্দেশনা দানের বিষয়টি হচ্ছে আরেকটি অনুগ্রহ ,আর তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ না করার কারণ হচ্ছি আমরা।
সূর্য মানুষের জন্য উপকারী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি মানুষ তাঁর থেকে দূরে সরে যায় এতে তার কোন ক্ষতি হবে না। মানুষই এর জন্য দায়ী। কেন সে সূর্যের থেকে দূরে সরে থাকছে এবং কেনইবা নিজেকে তার আলো থেকে গোপন করছে। আর অবশ্যই এমনটা চিন্তা করা ঠিক নয় যে সূর্য কোন উপকারেই আসে না। কেননা যদি এই সূর্যই না থাকতো মানুষ তার গোপন আস্তানাতেও জীবন-যাপন করতে পারতো না এবং এই সূর্যই যার থেকে তারা দূরে সরে থাকছে বা তার আলো থেকে নিজেদেরকে গোপন করে রাখছে ,তাদের কাজের ক্ষেত্র ,পরিসর এবং জীবন ধারনের জন্য খাদ্য উৎপাদন করছে।
হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে ইমাম মাহ্দী (আ.) মেঘের আড়ালে সূর্যের ন্যায় লুকায়িত আছেন। সোলাইমান আ ’ মাশ ইমাম সাদিক (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল : কিভাবে মানুষ আল্লাহর হুজ্জাত অদৃশ্য থাকা অবস্থায় তার কাছ থেকে উপকৃত হবে ?
বললেন : যেমনিভাবে মেঘেরা সূর্যকে আবৃত করে ফেললেও মানুষ তার থেকে উপকৃত হয়ে থাকে। ১১৮
জাবির বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এভাবে প্রশ্ন করেন : শিয়ারা কিভাবে ইমাম মাহ্দী (আ.) অদৃশ্য থাকার সময় তার কাছ থেকে উপকৃত হবে ?
বললেন : হ্যাঁ ,তাঁর কসম খেয়ে বলছি যিনি আমাকে নবুওয়াতের পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। তারা তাঁর নূরের আলোক ছটা থেকে আলোকিত হবে এবং তাঁর বেলায়তের থেকে লাভবান হবে যেমন সূর্যের আলো থেকে সবাই উপকৃত হয় যদিও মেঘেরা সূর্যকে আবৃত করে রাখে। ১১৯
এ ছাড়াও ,ইমাম মাহ্দী (আ.) প্রতি বছর হজে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন মজলিস ও মাহ্ফিলে আসা যাওয়া করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মু ’ মিনদেরকে কোন মাধ্যম অথবা কোন মাধ্যম ছাড়াই তাদের সমস্যার সমাধান করে থাকেন। জনগণ তাকে দেখে কিন্তু তাকে চিনতে পারে না। আর তিনি সবাইকে দেখেন ও চেনেন। কিছু কিছু নেককার (পূণ্যবান) ও পরহেজগার লোককে তাঁর বিশেষ দয়ার কুটিরে আশ্রয় দেন। তিনি স্বল্প ও দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানে থাকার সময় অনেকেই তাঁর সাক্ষাত প্রাপ্ত হয়ে তাঁর অনেক অলৌকিক ঘটনাও দেখেছে এবং তাদের অনেকের সমস্যার সমাধানও করিয়েছে।
মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ সাদরুদ্দিন সাদর এভাবে লিখেছেন : বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে ,অনেকেই ইমাম অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় তাঁকে দেখেছে এবং তাঁর সাক্ষাত পেয়েছে। এ বর্ণনাগুলোর সাথে এই বইতে পূর্বে যে সকল হাদীসে তাঁকে দেখার ব্যাপারে বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে ,কোন প্রকার বিভেদ নেই। কেননা সেসব হাদীস বা রেওয়ায়েতে শুধুমাত্র ইমাম দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় যদি কেউ তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে তবে তাকে মিথ্যাবাদী বা তার এই খবরকে মিথ্যা বলে ধরে নেয়া হবে বলা হয়েছে। কিন্তু হয়তো কেউ তাঁর সাক্ষাত পাবে বা কারো সাথে তাঁর দেখা হবে এমন ঘটনা অস্বীকার করা হয় নি ।
ইমাম দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানে থাকা অবস্থায় অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এবং অনেক মানুষকে দীন ও দুনিয়ার কত প্রকার সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছেন ,কত অসুস্থকে সুস্থ করেছেন ,সহায় সম্বলহীন ও শক্তি সামর্থহীন লোকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ,কত লোককে প্রকৃত বা সত্য পথের সন্ধান দেখিয়েছেন ,কত পিপাসী ব্যক্তির তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন।
এরূপ বর্ণনা সম্বলিত গ্রন্থসমূহ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে সংকলিত হয়েছে যারা একে অপরকে চিনতেন না অথচ এসব বইয়ের লেখকরা মুওয়াছ্ছাক (সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত) ছিলেন বলে রিজাল শাস্ত্রের (হাদীস বর্ণনাকারীদের পরিচিতি সম্পর্কিত জ্ঞান) গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। ঐ সকল বইতে এ ধরণের বিষয় লিপিবদ্ধ আছে যা আমাদের উল্লিখিত বিষয়গুলোর পক্ষে সাক্ষ্য দান করে। আমরা এ বইতে সেই সকল বিষয় হতে কিছু আলোচনা করেছি । এ ধরণের বর্ণনা এত অধিক যে ,সকল প্রকার সন্দেহকে অপনোদন করে। বিশেষতঃ এ সকল বর্ণনা অধ্যয়ন ,বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা ও যে সকল প্রমাণাদি এ বর্ণনাগুলোর সঙ্গেই বিদ্যমান তা দর্শনে যে কেউ অন্তত কিছু বর্ণনাকে অবশ্যই সত্যায়ন করবেন। ১২০
স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে ইমামের অলৌকিকত্ব
স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময়ে ইমাম যে সকল অলৌকিকত্ব দেখিয়েছেন তা তাঁর দূরের ও কাছের অনুসারীদের ঈমানের দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা দানে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অলৌকিক ঘটনাগুলো সেই সব অনুসারীদের জন্যেই বেশী ঘটতো যারা সামাররা ও বাগদাদ শহরে দূরদূরান্ত থেকে আসতো এবং ইমামের বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতো এবং তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাকে স্বচক্ষে অবলোকন করতো।
এই সময়কালে ইমামের অলৌকিক ঘটনার পরিমান এতই বেশী ,যা বর্ণনা করতে আলাদাভাবে বই লেখার প্রয়োজন পড়বে। মরহুম শেখ তুসি (রহঃ) বলেন : ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় তাঁর মাধ্যমে এত অধিক পরিমান অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা গণনাতীত। ১২১
আমরা এখানে নমুনা স্বরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করলাম মাত্র :
১ - ঈসা বিন নাসর বলেন : আলী বিন ছিমারী ইমামের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখে। তাতে সে তাঁর কাছে একটি কাফনের কাপড়ের আবেদন জানায়। চিঠির উত্তর এভাবে আসে যে ,তোমার ৮০ বছর বয়সে (২৮০ হিজরীতে) এই কাপড়ের প্রয়োজন পড়বে। ইমামের বাণী অনুযায়ী সে ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করে এবং তার ইন্তেকালের পূর্বেই ইমাম তার আবেদন অনুযায়ী তার জন্য কাফনের কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১২২
২ - আলী বিন মুহাম্মদ বলেন : ইমামের অনুসারীদের প্রতি তার নিকট থেকে নির্দেশ এসেছিল যে ,তারা যেন ইমামগণের মাজার (কারবালা ও কাযেমাইন) যিয়ারত করতে না যায়। কয়েক মাস যেতে না যেতেই খলিফা তার উজির বাকতানীকে ডেকে বলল : বনি ফুরাত (একটি গোত্র ,এই উজিরও সেই গোত্রের ছিল) ও বুরেস (কুফা ও হিল্লির মধ্যবর্তী স্থান) এলাকার লোকদের সাথে দেখা করে তাদেরকে কাযেমাইনে ইমামগণের মাজার জিয়ারত করতে যেতে নিষেধ কর। আর ইতোমধ্যে খলিফা নির্দেশ দিল যারা ইমামগণের মাজার যিয়ারত করতে যাবে তাদেরকে বন্দী করার জন্য। ১২৩
৩ - ইমামের দ্বিতীয় প্রতিনিধি আবু জা ’ ফর মুহাম্মদ বিন উসমানের নাতী বলেন ,“ নওবাখতী বংশের কিছু লোক যাদের মধ্যে আবুল হাসান বিন কাসির নওবাখতী (রহঃ) এবং আবু জা ’ ফর মুহাম্মদ বিন উসমানের কন্যা উম্মে কুলছুমও রয়েছেন আমাকে বলেছেন : কোম ও তার আশে পাশের এলাকা থেকে খুমস ,জাকাতের অর্থসামগ্রী আবু জা’ ফরের কাছে পাঠানো হয়েছিল ইমামের কাছে পৌঁছানোর জন্য। অর্থসামগ্রী নিয়ে এক ব্যক্তি বাগদাদে আমার পিতার বাড়ীতে তা পৌঁছে দিল। সে চলে যাওয়ার সময় আবু জা ’ ফর তাকে বললো : যা কিছু তোমাকে আমার কাছে পৌঁছানোর জন্য দেয়া হয়েছিল তার কিছু অংশ বাকী রয়েছে ,সেগুলো কোথায় ?
সে বলল : হে আমার অভিভাবক ,কোন কিছুই আমার কাছে বাকী নাই ,সব কিছুই আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি বললেন : কিছু পরিমান বাকী আছে ,নিজের ঘরে ফিরে যাও দেখ কোন কিছু ফেলে এসেছো কি না ,আর যা কিছু তোমাকে দিয়েছিল তা স্মরণে আনার চেষ্টা কর।
সে চলে গেল এবং কয়েক দিন ধরে চিন্তা-ভাবনা ও খোঁজাখুজির পর কিছুই পেল না। আর তার সাথে যারা খোঁজাখুজির কাজে সাহায্য করছিল তারাও কিছু পেল না। সে পুনরায় আবু জা ’ ফরের কাছে ফিরে এসে বলল : কিছুই আমার কাছে অবশিষ্ট নেই যা কিছু দিয়েছিল তা আপনার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।
আবু জা ’ ফর বলল (ইমামের পক্ষ থেকে) তোমাকে বলা হচ্ছে অমুক যে দু ’ টি আলখেল্লা (মরক্কোর নিকটবর্তী বড় দ্বীপের অধিবাসীদের তৈরী বিশেষ পোশাক) তোমাকে দিয়েছিল তা কোথায় ?
সে বলল : হ্যাঁ ,আপনি সত্য বলছেন। আমি সেগুলোকে ভুলেই গিয়েছিলাম। ঐ আলখেল্লা দু ’ টির কথা আমার একেবারেই মনে ছিল না। কিন্তু এখন এও জানি না যে সেগুলো কোথায় রেখেছি।
সে আবার ফিরে গেল এবং তার জিনিসপত্রের মধ্যে খোঁজাখুজি শুরু করে দিল। যারা তার কাছে মাল বহন করে এনেছিল তাদেরকেও খুঁজে দেখার জন্য অনুরোধ জানালো। কিন্তু পোশাক দু ’ টি খুঁজে পাওয়া গেল না।
আবার আবু জা ’ ফরের কাছে ফিরে এলো এবং পোশাক দু ’ টি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করলো । আবু জা ’ ফর বলল : তোমাকে এটা বলতে বলা হয়েছে যে তুমি অমুক তুলা বিক্রেতার কাছে যাও। যার জন্য তুমি দুই গাঁট তুলা নিয়ে গিয়েছিলে এবং ঐ দুই গাঁটের মধ্যে যেটির উপরে এই এই বিষয়গুলো লেখা আছে সেই গাঁটটা খুলে তার মধ্যে খুঁজবে। তার মধ্যে ঐ পোশাক দুটিকে পাবে।
লোকটি আবু জাফরের এই কথা শুনে আশ্চর্য ও হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর সে তার কথা মত সেখানে গেল এবং নির্দেশ মত তুলার গাঁটটিতে খুঁজলো ও তার মধ্যে পোশাক দু ’ টিকে পেল। পোশাক দু ’ টিকে নিয়ে এসে আবু জা ’ ফরের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলল : আমি ঐ পোশাক দু ’ টির ব্যাপারে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মালামাল আপনার কাছে আনার জন্য বস্তায় বেঁধে ফেলেছিলাম এই দু ’ টি পোশাক অতিরিক্ত থেকে গিয়েছিল। আমি ঐ দু ’ টি পোশাক একটি তুলার গাঁটের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম যাতে করে সংরক্ষিত বা নিরাপদে থাকে।
লোকটি বিশেষ করে এই বিষয়টার ব্যাপারে অবাক হয়েছিল। যা সে আবু জা ’ ফরের কাছ থেকে শুনেছিল যা দেখেছিল।
কেননা নবিগণ ও ইমামগণই কেবল আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের নিকট থেকে এ ধরনের বিষয়ে অবগত হন অন্য কেউ নয়। এ বিষয়টি সে সবাইকে বলতে লাগলো। সে আবু জা ’ ফরের ব্যাপারে কোন প্রকার ধারণাই রাখতো না। তার মাধ্যমে শুধুমাত্র অর্থ ও বিভিন্ন সামগ্রী পাঠানো হতো । যেমনিভাবে ব্যবসায়ীরা তাদের মালামালকে দোকানদের উদ্দেশ্যে কোন ভাল লোকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত। তার কাছে ঐ মালামালের কোন ভাউচার বা তার সাথে আবু জা ’ ফরের নামে কোন চিঠিও ছিল না। কেননা আব্বাসীয় খলিফা মো ’ তাজেদের শাসনামলে পরিস্থিতি খুব বিপদজনক ছিল। তার তলোয়ার থেকে সবসময় রক্ত ঝরতো। ইমামের সংশ্লিষ্ট বিষয় শুধুমাত্র তাঁর বিশেষ প্রতিনিধিদের অবগতিতে থাকতো। আর যারা অর্থ ও মালামাল নিয়ে আসতো তারা এসবের কোন কিছুর ব্যাপারেই খবর রাখতো না। শুধুমাত্র তাদেরকে বলা হতো এই অর্থ ও মালামাল এমন জায়গায় এমন লোকের কাছে পৌঁছে দেবে। মালামাল গ্রহণকারীর ব্যাপারে কোন প্রকার আনুষঙ্গিক খবরা খবর ব্যতিরেকেই ও তার নামে কোন প্রকার চিঠি ছাড়াই পাঠানো হতো। এ কারণে যে যদি কেউ কোন দিন বা কখনও এই মালামাল ও অর্থ এবং প্রেরণকারী ও গ্রহণকারীর ব্যাপারে জেনে ফেলে এই ভয়েই এই বিষয়গুলো গোপন থাকতো। ১২৪
৪ - মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম বিন মেহযিয়ার আহওয়াযী বলেন : ইমাম আবু মুহাম্মদ আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অস্তিত্বের ব্যাপারটিতে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম। ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে প্রচুর পরিমানে অর্থ ও মালামাল যা ইমামের সম্পদ আমার বাবার কাছে এসে পৌঁছেছিল এবং আমার বাবা সেগুলোকে সযত্নে দেখাশুনা করছিল ইমামের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। সেগুলোকে একটি বড় নৌকায় তুলে রওনা হওয়ার সময় হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা শুরু হল। যেহেতু আমি তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলাম তাই তিনি আমাকে বললেন : আমাকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো কেননা আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। এই মালামালের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর এবং সেগুলোকে আমার হাতে দিয়ে ইমামের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বলে ইন্তেকাল করলেন।
আমি মনে মনে বললাম : আমার পিতা এমন লোক ছিলেন না যিনি কোন ভুল বিষয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। অতএব ,এই মালামালগুলিকে ইরাকে নিয়ে যাব এবং নদীর ঘাটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে এগুলিকে তার মধ্যে রেখে দিব বা কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলবো না। যদি এমন কিছু যা ইমাম আসকারী (আ.)-এর জামানায় ঘটেছিল তা আমার সামনে ঘটে তবেই এই জিনিসগুলিকে প্রেরণ করবো অন্যথায় পুরোটাই ছদকা দিয়ে দেব।
ইরাকে গিলাম এবং নদীর ঘাটে একটি ঘর ভাড়া নিলাম। কয়েক দিন সেখানে থাকার পর একজন পত্র বাহক আমার কাছে আসলো এবং আমাকে একটি চিঠি দিল যার মধ্যে এমন লেখা ছিল : হে মুহাম্মদ! তোমার সাথে যে থলেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে এই এই জিনিসগুলো আছে। আমার সাথে যে মালামালগুলো ছিল সেগুলোর সম্বন্ধে আমি এত কিছু জানতাম না যা সেই চিঠিতে সবগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া ছিল।
সমস্ত সম্পদগুলো পত্র বাহকের কাছে হস্তান্তর করলাম। আর আমি আরও কয়েকদিন সেখানে থাকলাম। কিন্তু কেউ আমার খোঁজ খবর নিতে আসলো না। আমি খুব দুঃখিত হলাম। এমতাবস্থায় আমার কাছে অন্য আরেকটি চিঠি পৌঁছালো যাতে এমন লেখা ছিল : তোমাকে তোমার বাবার স্থলাভিষিক্ত করেছি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। ১২৫
৫ - হাসান বিন ফাযল ইয়ামানী বলেন : আমি সামাররাতে আসার পর ইমাম (আ.) এর পক্ষ থেকে একটি ব্যাগ যার মধ্যে কয়েকটি দিনার ছিল এবং দু ’ টুকরো কাপড় আমার কাছে পৌঁছালো। আমি সেগুলোকে ফেরত পাঠালাম এবং মনে মনে বললাম : আমার শান ও মর্যাদা তাদের কাছে এতটুকুই! অহংকার আমাকে ঘিরে ধরলো। পরে অনুতপ্ত হয়ে ছিলাম। অবশেষে চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছিলাম এবং ইসতেগফার করলাম এবং নির্জনে আল্লাহকে বললাম ,হে আল্লাহ্! তোমার পবিত্র নামের প্রতি কসম খেয়ে বলছি যে ,যদি দিনার ভর্তি কয়েকটি ব্যাগও আমার কাছে পাঠায় ,আমি সেগুলোকে খুলেও দেখবো না এবং তার থেকে কোন কিছু খরচও করবো না ,যতক্ষণ না আমার বাবার কাছে যাবো। কেননা সে আমার থেকেও অধিক জ্ঞানী।
ইমামের পক্ষ থেকে সেই বাহকের প্রতি (যে আমার কাছে দিনারের ব্যাগটি ও দু ’ টুকরো কাপড় নিয়ে এসেছিল) পত্র এল যার বিষয়বস্তু এমন : তুমি কাজটি ভাল করনি। তাকে বল নি যে আমরা কখনও কখনও আমাদের বন্ধু ও অনুসারীদের সাথে এমনই করে থাকি আবার কখনও কখনও তাদেরকে আমরা এমন কিছু দিয়ে থাকি । এজন্য যে সেগুলো থেকে যেন তারা বরকত নিতে পারে। আর আমার প্রতি বলা হলো : তুমি ভুল করেছো আমাদের উপহার ও ভালবাসাকে গ্রহণ না করে। যেহেতু আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছো আল্লাহ্ তোমাকে যেন ক্ষমা করে দেন এবং যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছো যে দিনারগুলোর উপর হস্তক্ষেপ করবে না বা সেগুলোকে খরচ করবে না ,সুতরাং সেগুলোকে তোমাকে আর দিলাম না । কিন্তু দু ’ টুকরা কাপড়ের প্রয়োজন তোমার আছে। ঐ দু ’ টুকরো কাপড় দিয়ে তুমি মোহরেম হবে (ঐ কাপড়কে তুমি তোমার এহরামের কাপড় হিসাবে ব্যবহার করবে) ...। ১২৬
৬ - মুহাম্মদ বিন সুরী কোমী ( রহঃ ) বলেন : আলী বিন হুসাইন ববাভেই তার চাচাতো বোনকে (মুহাম্মদ বিন মুসা ববাভেইর কন্যা) বিবাহ করেন। কিন্তু তাদের কোন সন্তান হতো না। ইমামের তৃতীয় প্রতিনিধি জনাব হুসাইন বিন রূহ নওবাখতীর উদ্দেশ্যে এই মর্মে চিঠি লিখে যে ,তিনি যেন তাঁর পক্ষ হয়ে ইমামের কাছে আবেদন জানায় তারা যেন উত্তম জ্ঞানী সন্তান লাভে সমর্থ হয়।
ইমামের পক্ষ থেকে ঐ চিঠির উত্তর আসে এভাবে : তুমি তোমার বর্তমান স্ত্রীর দ্বারা সন্তানলাভে সমর্থ হবে না। তবে অতিসত্ত্বর তুমি উন্নত চরিত্রবতী একটি দাসীর মালিক হবে। আর তার মাধ্যমে দুই জ্ঞানী পুত্র সন্তানের অধিকারী হবে।
ইবনে ববাভেই তিনটি ছেলে সন্তানের জনক হন মুহাম্মদ ১২৭ ,হুসাইন ও হাসান। মুহাম্মদ ও হুসাইন দু ’ জন প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন ফকীহ্ ছিলেন এবং এমন সব বিষয়ে তারা পারদর্শী ছিলেন যা কোম শহরের কেউ জানতেন না। তাদের ভাই হাসান সবসময় ইবাদতে লিপ্ত থাকতো ও একরূপ দুনিয়া নিরাসক্ত ছিল তাই জনগণের সাথেও কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না এবং ফিকাহ্ শাস্ত্র থেকে উপকৃত হওয়া থেকেও বঞ্চিত ছিল।
জনগণ আবু জা ’ ফর (মুহাম্মদ) ও আবু আবদুল্লাহ্ (হুসাইন) আলী বিন হুসাইন ববাভেইর দুই সন্তান এর প্রখর স্মৃতি শক্তি দেখে ও তাদের হাদীস ও রেওয়ায়েতের উপর জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলো যে এই প্রখরতা ও তীক্ষ্ণতা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর দোয়ার কারণে হয়েছে। এ বিষয়টি কোমের জনগণের মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ আছে। ১২৮
ইমামের সাক্ষাৎ
মরহুম শেখ তাবারসী তার “ এলামুল ওয়ারা ” নামক গ্রন্থে যারা ইমাম মাহ্দীকে (আ.) ও তাঁর দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক কোন ঘটনা দেখতে সমর্থ হয়েছেন তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন তেরজন ইমামের সাধারণ প্রতিনিধি ও খেদমতকারী যারা ,বাগদাদ ,কুফা ,আহওয়ায ,কোম ,হামাদান ,রেই ,আযারবাইজান ও নিশাবুরে ছিলেন এবং পঞ্চাশজন যারা বাগদাদ ,হামাদান ,দিনাওয়ার ,ইসফাহান ,সীমারী ,কাযভীনের আশে পাশের এলাকায় ও অন্যান্য জায়গায় ছিলেন। ১২৯
মরহুম হাজী নূরী যিনি ১৪ শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত বই “ মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল ” -এ ও অন্য একটি সুপরিচিত বই “ নাজমুস সাকিব ” -এ ১২০ জনেরও বেশী লোকের নাম উল্লেখ করেছেন। মরহুম তাবারসী বর্ণিতদের নামও তিনি উল্লেখ করে বলেন ,যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হয় হযরত মাহ্দী (আ.)-কে দেখেছেন অথবা তাঁর হতে কোন অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন অথবা দু ’ টি সৌভাগ্যই তারা লাভ করেছেন। তিনি বলেন : হয়তো উল্লিখিতদের বেশীরভাগই উভয় সৌভাগ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহর রহমতে বিভিন্ন শিয়া লেখকের রচিত গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। প্রসিদ্ধ যে ,নিরপেক্ষ যে কোন ব্যক্তি যদি এই বইগুলোর লেখকদের ব্যক্তিত্ব ,খোদাভীরুতা ,মর্যাদা ,সত্যবাদিতা ও কর্মের ক্ষেত্রে সতর্কতা সম্পর্কে অবহিত হন তবে ঐ বিষয়গুলোর সত্যতাকে স্বীকার করবেন বা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে সংঘটিত অলৌকিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পতিত হবেন না। যেহেতু বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের হতে একইরূপ অর্থের অসংখ্য বর্ণনা (বিভিন্ন সূত্রে ইমাম মাহ্দীর কেরামত প্রমাণ করে বর্ণনা) এসেছে তাদের সবগুলোকেই মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। যদিও ঐ বিষয়গুলোর প্রতিটিতেই এ ধরনের সম্ভাবনা দেয়ার অবকাশও থাকে তথাপিও না। কেননা এইরূপ অলৌকিক ঘটনা তাঁর পবিত্র পিতৃপুরুষদের মাধ্যমেও ঘটেছে তার যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। ১৩০
কোন কোন বড় আলেম ,যারা দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানে যাওয়ার পরেও ইমামের খেদমতে পৌঁছেছে অথবা স্বচক্ষে বা ঘুমের মধ্যে তাঁর বিভিন্ন কারামত প্রত্যক্ষ করেছে তাদের নাম ও ঘটনাকে নিজেদের লেখা গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন : কাশফুল আসতার ,বিহারুল আনওয়ার ও দারুল ইসলাম এবং নাজমুস সাকিবে মরহুম হাজী নূরী এরূপ প্রায় একশত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। যার ভূমিকায় তিনি এমন লিখেছেন :
যা কিছু এই অধ্যায়ে উল্লেখ করছি তা হলো ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মাধ্যমে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাসমূহ। যার সনদসমূহ বিশ্বাসযোগ্য ,সঠিক ও উন্নত পর্যায়ের। বিচার বিশ্লেষণ করলে অতীত অলৌকিক ঘটনা বা পুরাতন গ্রন্থসমূহে ঘাটিয়ে দেখার প্রয়োজন হবে না ... ।
আরও বলেন : যা কিছু বর্ণনাকারীদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রেখেছি তা হলো তাদের সত্যবাদিতা ও ধার্মিকতা এবং যা কিছুই শুনেছি তাই বর্ণনা করি নি বরং আল্লাহ্ সাক্ষী যে ,উদ্ধৃতি উল্লেখের ক্ষেত্রে সত্যতা ও বিশ্বস্ততাকে রক্ষা করেছি। আর যাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ঘটনার উল্লেখ করেছি তারা বেশীরভাগই বিশেষ শান ও মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বা তারাও কেরামতের অধিকারী ছিলেন। ১৩১
হাজী নূরীর পরে আরও অনেকের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ঘটনার অবতারণা হয়। যেমন বিশিষ্ট আলেম আগা লুতফুল্লাহ্ সাফি তার “ ইসালাতে মাহ্দাভিয়াত ” গ্রন্থে (ইমাম মাহ্দীর যথার্থতা ও সত্যতা প্রমাণের উপর লিখিত বই) কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন : সংক্ষিপ্ততার কারণে শুধুমাত্র আমাদের সময়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার বর্ণনা দিয়েই শেষ করছি। ১৩২
আমরাও এই লেখনীতে সংক্ষিপ্ততার দিকে খেয়াল রেখে মহামুল্যবান বই “ নাজমুস সাকিব ” থেকে শুধুমাত্র একটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করবো :
বিশিষ্ট আলেম আলী বিন ঈসা আরবিলী তার “ কাশফুল গুম্মাহ ” নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে ,আমাকে একদল সত্যবাদী লোক খবর দিল যে (আমার বংশীয় এক ভাই যে হিল্লা শহরে বসবাস করতো। সে একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক ছিল। সবাই তাকে ইসমাঈল বিন ঈসা বিন হাসান হারকেলী বলে সম্বোধন করতো। হারকেল এলাকায় বসবাস করতো বলে তাকে হারকেলী বলে ডাকতো) সে ইন্তেকাল করেছে। তাকে আমি কখনও দেখিনি। তার ছেলে (শামসুদ্দিন) আমাকে তার বাবার কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনার বর্ণনা করেছে : তার বাবা বলেছে ,যুবক বয়সে তার বাম পায়ের ঊরুতে হাতের মুষ্টি পরিমান ফোড়া বিশেষ হয়েছিল এবং প্রতি বছর বসন্তকালে সেটি পেকে ফেটে যেত এবং তা থেকে পুঁজ-রক্ত বের হতো। প্রচণ্ড ব্যথা-বেদনায় সে কাতর হয়ে পড়তো। যার কারণে সে কোথাও কাজ করতে পারতো না বা তাকে কোথাও কেউ কাজ দিত না। সে হিল্লা শহরে রাজী উদ্দিন আলী বিন তাউসের কাছে আসে এবং তার কাছে এই উপদংশ রোগের ব্যাপারে সব খুলে বলে। সাইয়্যেদ শহরের অভিজ্ঞ সার্জেনদেরকে এক জায়গায় জমা করলেন। তারা সবাই দেখে বললেন এটা বিশেষ ধরনের ফোড়া যা তার ঊরুর মূল শিরার উপর হয়েছে এবং ভাল করার কোন উপায় নেই একমাত্র কেটে ফেলা ছাড়া। যদি কেটে ফেলি হয়তো তার মূল শিরাটি কাটা পড়তে পারে। যখনই ঐ শিরাটি কাটা পড়বে ইসমাঈলও আর বেঁচে থাকবে না। এই অপারেশনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ,আমরা কেউ তা করতে চাই না।
সাইয়্যেদ ইসমাঈলকে বলল আমি বাগদাদে যাবো। অপেক্ষা কর তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যাবো এবং সেখানকার ডাক্তারদেরকে তোমাকে দেখাবো। হয়তো তারা আরও অভিজ্ঞ ,হয়ত তোমাকে ভাল করতে পারবে। বাগদাদে এসে সেখানকার ডাক্তারদের সাথে কথা বললে তাদের সবাই আগের ডাক্তারদের মতই বলল ও অপরাগতা প্রকাশ করল। এ দিকে ইসমাঈল আরও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। সাইয়্যেদ তাকে এটাই বলল : আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তোমার নামাজকে এই অপবিত্রতা সহই কবুল করবেন। আর এই কষ্ট সহ্য করা নিষ্ফল নয় ,নিশ্চয় এর পুরষ্কার রয়েছে। ইসমাঈল বলল তাহলে যদি তাই হয়ে থাকে যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সামাররাতে যাবো এবং ইমামগণের (আ.) কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবো। এই বলে সে সামাররার দিকে রওনা হলো।
“ কাশফুল গুম্মাহ্ ” -এর লেখক বলেন তার ছেলের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে ,সে তার বাবার কাছ থেকে শুনেছে তিনি বলেছেন: যেখানে ইমাম আলী নাকী ও ইমাম হাসান আসকারী (আ.) শায়িত আছেন আমি সেখানে গেলাম এবং তাদের যিয়ারত করলাম । সারদাবেহর ১৩৩ নিকটে রাত্রটা কাটালাম। আর সারা রাত ধরে প্রচুর কান্না-কাটি করলাম। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর সাহায্য কামনা করলাম। সকালে তাইগ্রীস নদীতে গিয়ে জামা-কাপড় ধুয়ে যিয়ারত করার জন্য গোসল করলাম এবং যে কটি এবরীকি (চামড়ার তৈরী থলে বিশেষ যার মধ্যে পানি বহন করা হতো) ছিল তা পানি ভর্তি করে নিলাম। আর একবারের মত যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ইমামগণের মাজার শরীফের দিকে রওনা হলাম। ওখানে পৌঁছানোর আগেই চারজন ঘোড় সওয়ারীকে এ দিকেই আসতে দেখলাম। যেহেতু ইমামদের মাজারের আশে পাশে কিছু সংখ্যক ভদ্র ও অভিজাত পরিবারের লোকজন বসবাস করতেন ভাবলাম হয়তো তারা হবে। আমার কাছে পৌঁছালে দেখতে পেলাম যে দু ’ যুবকের কোমরে তলোয়ার বাঁধা আছে। তাদের একজনের সবে দাড়ি দেখা দিয়েছে। তাদের সাথে একজন বৃদ্ধ যিনি অত্যন্ত পরিপাটি ছিলেন এবং তার হাতে একটি বল্লম ছিল। আর অন্যজনের সাথে ছিল তলোয়ার ,গায়ে ছিল আলখেল্লা ,মাথায় বড় পাগড়ী ,যা মাথা হয়ে গলায় পেচিয়ে পিঠে গিয়ে পড়েছিল। তার হাতে ছিল বল্লম। বৃদ্ধ লোকটি হাতের ডান পাশে বল্লমটিকে মাটিতে গেঁথে দিয়ে দাঁড়ালো। ঐ যুবক দু ’ টি হাতের বাম পাশে এসে দাঁড়ালো এবং আলখেল্লা পরিহিত ব্যক্তিটি মধ্যখানে থাকলেন। আমাকে সালাম দিলেন। আমি সালামের জবাব দিলাম। তিনি আমাকে বললেন : আগামীকাল বাড়ীর দিকে রওনা হবে ?
বললাম : জী হ্যাঁ।
বললেন : এগিয়ে এসো দেখি কী তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে।
আমার চিন্তায় আসলো যে মরুভূমিতে বসবাসকারীরা অপবিত্রতার বিষয়কে এড়িয়ে চলে না। মনে মনে (নিজেকে )বললাম তুমি গোসল করেছো এবং তোমার জামা-কাপড় সবে ধুয়েছো এখনও ভিজা আছে। তার হাত তোমার শরীরে না লাগাই ভাল। এই চিন্তায় মগ্ন ছিলাম হঠাৎ তিনি নিচু হয়ে আমাকে তার কাছে টেনে নিলেন এবং তার হাত দিয়ে আমার উরুর ঐ জায়গাটায় চাপ দিলেন। এমনভাবে চাপ দিলেন যে আমি প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। তারপর আমার পা সোজা হয়ে মাটি স্পর্শ করলো। সে সময় ঐ বৃদ্ধ লোকটি বলল :
(أَفْلَحْتَ يا اِسْماعِيلُ )ত ুমি সফল হয়েছো ,হে ইসমাঈল। আমি বললাম : ( أَفْلَحْتُمْ ) (আপনি সফল হয়েছেন)। আমি আশ্চর্য হলাম যে তিনি আমার নাম জানলেন কিভাবে। ঐ বৃদ্ধ লোকটি আমাকে আলখেল্লা পরিহিত লোকটিকে দেখিয়ে বললেন যে তিনি হচ্ছেন ইমাম। আমি আঁখি জল ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে চুমু দিতে লাগলাম। ইমাম চলতে শুরু করলেন আর আমিও তার পিছু পিছু জ্ঞানহীনের মত ছুটতে লাগলাম। তিনি আমাকে ফিরে যেতে বললেন।
বললাম : আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
বললেন : ফিরে যাও এতে তোমার মঙ্গল হবে।
আমি আমার আগের কথাটিই পুনরায় বললাম। ঐ বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বললেন ,হে ইসমাঈল! তোমার লজ্জা নেই ,ইমাম দুই বার তোমাকে ফিরে যেতে বললেন আর তুমি তার কথার অবমাননা করছো!
তার এই কথাটি আমার উপর দারুণভাবে প্রভাব ফেললো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তারা আমার থেকে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকেই আমাকে বললেন : বাগদাদে পৌছার কয়েকদিন পর মুসতানসের ১৩৪ তোমাকে ডেকে পাঠাবে এবং সে তোমাকে কিছু উপহার সামগ্রী দান করবে। তুমি যেন তা নিও না। আমার সন্তান রাজীকে বলবে যে আমি তোমার ব্যাপারে আলী বিন আরাযকে কিছু লিখতে বলেছি যে ,তুমি যা কিছু চাও তা যেন সে তোমাকে দেয়।
আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম । কিছু সময় পরে তারা আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন। ভীষণ দুঃখে কয়েক ঘন্টা ওখানেই বসে ছিলাম। তারপর ইমাম নাকী ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর হারাম শরীফে ফিরে এলাম। যেহেতু হারাম শরীফের লোকেরা আমাকে আগে দেখেছিল সেহেতু বলল ,তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার অবস্থার উন্নতি হয়েছে ,এখন কোন কষ্ট অনুভব করছো কী ?
বললাম : না।
তারা বলল : কারো সাথে মারা-মারি বা হাতা-হাতি করেছো নাকি ?
বললাম : না ,বল দেখি এই যে এখান থেকে ঘোড় সওয়ারীরা গিয়েছে তাদেরকে দেখেছ কি না ?
তারা বলল : তারা হয়তো কোন সম্ভ্রান্ত লোক হবেন।
বললাম : তারা সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ইমাম ছিলেন।
তারা বলল : ঐ বৃদ্ধ লোকটি না ঐ আলখেল্লা পরিহিত লোকটি ?
বললাম : আলখেল্লা পরিহিত লোকটি।
তারা বলল : তোমার অসুস্থতাকে কি তিনি ভাল করেছেন ?
বললাম : হ্যাঁ। তিনি ওখানে চাপ দিলেন। আমার ভীষণ ব্যথা লাগলো। তারপর আমার উরুর কাপড়টি খুললেন। কিন্তু সেখানে কোন কিছুই ছিল না। আমি নিজেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। অন্য পায়ের উরুতেও ভালভাবে লক্ষ্য করলাম কিন্তু সেখানেও কিছু দেখতে পেলাম না। এই কথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত সবাই আমার উপর হুমড়ী খেয়ে পড়লো ,আমার শরীর ছোয়ার জন্য। আমার জামা-কাপড় ছিড়ে ফেললো। যদি হারাম শরীফের খাদেমরা আমাকে সরিয়ে নিয়ে না আসতো তাহলে আমি তাদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যেতাম। এমন সময় “ বাইনুন্নাহারাইন ” এর গর্ভণরের চিৎকার শোনা গেল। কাছে এসে ঘটনাটি শুনে চলে গেল এ কারণে যে বিষয়টি খলিফার কাছে লিখে জানাতে হবে। আমি রাতে সেখানে থাকলাম। সকালে একদল লোক এসে তাদের মধ্যে দুইজনকে আমার সাথে দিয়ে আমাকে বিদায় জানিয়ে ফিরে গেল। আমরা তারপর দিন সকালে বাগদাদে পৌঁছে দেখলাম প্রচুর পরিমানে মানুষ শহরের পুলের মাথায় জমা হয়ে আছে। শহরে কেউ এলে সবাই তার নাম জানতে চায় তদ্রুপ আমরাও এসেছি আমাদের নামও জানতে চাইলো। আমরা আমাদের নাম বলতেই সবাই মিলে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। কিছু সময় আগে যে পোশাকটি পরেছিলাম তাও ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম যেন আর একটু হলেই আমার নিঃশ্বাস বের হয়ে যেত। সাইয়্যেদ রাজী আমাকে মানুষের মধ্য থেকে বের করে এনে তাদেরকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। “ বাইনুন্নাহারাইন ” এর গভর্ণরের লেখা প্রতিবেদনটি বাগদাদ শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল যা সাইয়্যেদের কানেও গিয়েছিল। সাইয়্যেদ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন : এখানকার সবাই বলছে যে কে যেন শাফা (অসুস্থতা থেকে আরোগ্যলাভ করা) পেয়েছে সে ব্যক্তি কি তুমি ?
বললাম : জী হ্যাঁ।
তিনি ঘোড়া থেকে নেমে এসে আমার উরুর কাপড় সরিয়ে দেখলেন। যেহেতু তিনি আগেও আমার উরুর অবস্থাটি দেখেছিলেন আর এখন তার কোন চি হ্ন দেখতে না পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে এলে বললেন : খলিফার উজির আমাকে ডেকে বলেছিলো সামাররা থেকে একটি চিঠি এসেছে ,আর তাতে বর্ণিত লোকটির সাথে তোমার সম্পর্ক আছে ,যত দ্রুত সম্ভব আমাকে তার খবর জানাও।
সাইয়্যেদ আমাকে তার সাথে নিয়ে ঐ উজিরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন : এই লোকটি আমার ভাই এবং সে আমার সব থেকে প্রিয় সঙ্গী।
উজির বললো : আমাকে তোমার ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দাও।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তার বর্ণনা দিলাম। ঐ সময় উজির কাউকে ডাক্তারদের ডাকতে পাঠালো। তারা হাজির হওয়ার পর তাদেরকে বললো : তোমরা এই লোকের উরুর ক্ষতটি দেখেছিলে কি ?
তারা বললো : হ্যাঁ দেখেছিলাম ।
জিজ্ঞেস করলো : এই রোগের চিকিৎসা কি ?
তারা বললো : একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে কেটে ফেলা। যদি কেটে ফেলা হয় তবে ভয় হচ্ছে যে ,আদৌ সে বেঁচে থাকবে কি না।
জিজ্ঞেস করলো : যদি ধরে নেই যে সে বেঁচে থাকবে তাহলে কত দিনে তার ভাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ?
বললো : প্রায় দু ’ মাস লাগবে তার ভাল হয়ে উঠতে। ভাল হয়ে উঠার পরে তার ঐ জায়গায় সাদা হয়ে থাকবে বা কোন দিন ওখানে লোম উঠবে না।
আবারও জিজ্ঞেস করলো : কত দিন হয়েছে তোমরা তাকে দেখেছ ?
বললো : আজকে নিয়ে দশদিন আগে দেখেছি।
সুতরাং উজির আমার কাছে এসে আমার উরুর কাপড় সরিয়ে দেখলেন যে অন্য একটি উরুর সাথে কোন পার্থক্য নেই বা কোন প্রকার ক্ষত এর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঐ সময় একজন ডাক্তার যে ছিল খৃস্টান চিৎকার দিয়ে বললো : ( وَ اللَّهِ هَذا مِنْ عَمِلِ الْمَسيِحِ )-- আল্লাহর কসম! এটা সাধারণ রোগ মুক্তি নয় ,বরং এটা মাসীহ এর (ঈসা ইবনে মারিয়াম) অলৌকিক শক্তিতে অর্জিত রোগমুক্তি।
উজির বলল : যেহেতু এটা তোমাদের কারো কাজ নয় ,সেহেতু আমি জানি এটা কার কাজ।
এই খবর খলিফার কাছে পৌঁছালে সে উজিরকে ডেকে পাঠালো। উজির আমাকে সাথে নিয়ে খলিফার দরবারে উপস্থিত হলো। খলিফা মুসতানসির আমাকে ঐ ঘটনাটি পুনরায় বর্ণনা করার জন্য বলল। আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করায় আমাকে একটি ব্যাগ যার মধ্যে একহজার দিনার ছিল উপহার স্বরূপ দিয়ে খলিফা বলল : এই অর্থ তুমি তোমার নিজের খরচের জন্য রাখ।
বললাম : এটা আমি নিতে পারবো না।
বলল : তুমি কার ভয় পাচ্ছ ?
বললাম : যে আমাকে সুস্থ করে দিয়েছে। কেননা তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে ,তোমার কাছ থেকে যেন কোন কিছু গ্রহণ না করি। এ কথা শুনে খলিফা মর্মাহত হয়ে কাঁদতে লাগলো।
“ কাশফুল গুম্মাহ ” এর লেখক বলেন : এই ঘটনায় আমি দারুণভাবে আশ্চর্য হয়ে ইসমাঈলের ছেলে শামসুদ্দিন মুহাম্মদকে বললাম : তুমি তোমার বাবার ঐ স্থানটি ক্ষত থাকা অবস্থায় দেখেছিলে কী ?
বলল : আমি তখন খুব ছোট ছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যখন সুস্থ হয়েছিলেন তখন দেখেছিলাম যে তার ওখানে লোম উঠেছে এবং ক্ষত হওয়ার কোন চিহ্নই সেখানে ছিল না। আমার পিতা প্রতি বছর একবার বাগদাদে যেতেন এবং সেখান থেকে সামাররাতে। অনেক সময় ধরে সেখানে থাকতেন এবং প্রচুর কান্না-কাটি করতেন। তার বিশেষ ইচ্ছা ছিল আর একবার ইমামকে দেখবে। সে কারণেই সেখানে তাঁকে খুঁজে বেড়াতেন কিন্তু আর তাকে দেখতে পান নি। আমি যতুটুকু জানি যে তিনি ৪০ বার সামাররা যিয়ারত করতে গিয়েছিলেন এবং পুনরায় তাকে দেখতে না পাওয়ার ব্যথায় মৃত্যুবরণ করবেন।
এই ঘটনা বর্ণনা শেষে “ নাজমুস সাকিব ” এর লেখক শেখ হুররে আ ’ মিলির ‘ আমালুল আ ’ মাল ’ নামক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল একজন বিশিষ্ট আলেম ও আল্লামা হিল্লির ছাত্র ছিল। ১৩৫
সাইয়্যেদ বিন তাউস বলেন : আমি আমার জামানায় কিছু সংখ্যককে দেখেছি যে ,বলতেন হযরত মাহ্দীকে (আ.) দেখিছি এবং অন্যদেরকে দেখেছি তাদের কাছে ইমামের চিঠি ও প্রশ্নের উত্তর আসতো। ১৩৬
মরহুম শেখ হুররে আ ’ মিলি যিনি একজন বিশিষ্ট আলেম ও শিয়া বিশিষ্ট মারজা ছিলেন। হিজরী একাদশ শতকের প্রথক দিকে তিনি হারকেলীর অনুরূপ একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন : এই ঘটনার মত আরও অনেক ঘটনা আমাদের জামানায় অথবা অতীতে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পক্ষ থেকে সত্য সত্যই সংঘটিত হয়েছে যার প্রকৃত প্রমান আছে ১৩৭ ।
তিনি আরও বলেন : সত্যবাদী হিসাবে পরিচিত একদল লোক আমাকে বলেছেন যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে তারা স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তাঁর বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি তাদেরকে অদৃশ্যের ব্যাপারে কিছু কথা বলেন এবং তাদের জন্য দোয়া করেন যা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন যা বর্ণনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেগুলো সবই তাঁর দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক ঘটনার মধ্যে শামিল হবে। ১৩৮
আরও বলেন : আমি নিজেও ঘুমন্ত অবস্থায় ইমাম মাহ্দী (আ.) এর কারামতকে প্রত্যক্ষ করেছি ১৩৯ ,যা পরবর্তীতে বর্ণনাও করেছি ।
আবির্ভাবের সময় নির্ধারণ
যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি : ইমামের চতুর্থ প্রতিনিধি জনাব আবুল হাসান সামারীর ইন্তেকালের পর দীর্ঘকালীন অন্তর্ধান শুরু হয় এবং এখনও পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। ইমামের আবির্ভাব ও কিয়াম আল্লাহর নির্দেশে এই সময়কালের শেষে হবে। আমাদের পবিত্র ইমামগণও তাদের বিভিন্ন হাদীসে বলেছেন যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন তাঁর আবির্ভাবের কথা বা তার নির্দেশেই হঠাৎ তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। যদি কেউ তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে কোন সময় নির্ধারণ করে তাহলে ধরে নিতে হবে যে সে মিথ্যা কথা বলছে।
ফুযাইল ইমাম বাকের (আ.)-এর কাছে প্রশ্ন করেছিল : এই বিশেষ নির্দেশের ব্যাপারে কোন সময় নির্ধারিত আছে কী ?
ইমাম তিনবার বলেন : ( كَذِبَ الْوَقاَّتُونَ )সময় নির্ধারণকারীগণ মিথ্যাবাদী। ১৪০
ইসহাক বিন ইয়াকুব জনাব মুহাম্মদ বিন উসমান আ ’ মরীর মাধ্যমে ইমাম মাহ্দীর উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠায়। সেই চিঠিতে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল। ইমাম তাঁর আবির্ভূত হওয়ার সময়ের ব্যাপারে এভাবে জবাব দেন :
وَ اَماَّ ظُهُورُ الْفَرَجِ فَاِنَّهُ اِلَى اللَّهِ تَعالى ذِكْرُهُ وَ كَذِبَ الْوَقاَّتُونَ
অতঃপর ,আমার আবির্ভাবের সময় আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের হাতে ,আর যারা সময় নির্ধারণ করে তারা মিথ্যাবাদী। ১৪১
অবশ্য সময় নির্দিষ্ট করা বলতে আবির্ভাবের প্রকৃত সময়কে বুঝানো হয়েছে। এ ধরণের প্রকৃত সময় নিদিষ্ট করাকে পবিত্র ইমামগণও সঠিক কাজ বলে বিবেচনা করেন নি। এ কাজটিকে তারা আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের একান্ত গোপন বিষয় বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন যা তার আবির্ভাবের নিকটবর্তী সময়ে ঘটবে এবং তা দেখে অনুভব করা যাবে যে তার আবির্ভাবের সময় ত্বরান্বিত হয়ে এসেছে।
আবির্ভাবের আলামতসমূহ
যে সকল রেওয়ায়েতে আবির্ভাবপূর্ব ঘটনাবলীর বিষয়াদি উল্লেখ আছে তার পরিমান অনেক ও বিভিন্ন ধরণের। কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত সামাজিক অবস্থার উপর বিশেষ করে আবির্ভাবের পূর্বে মুসলিম সমাজের অবস্থা বর্ণনা করেছে এবং অন্য কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েতে যে সকল ঘটনা আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করবে তার বর্ণনা দিয়েছে। অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলো বিভিন্ন আশ্চর্য বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই সমস্ত রেওয়ায়েতগুলোতে যে সকল জটিল ও সাংকেতিক বিষয়সমূহ বর্ণিত হয়েছে যদি বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে তার প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা বই লেখার প্রয়োজন হবে। যারা এ বিষয়ে আগ্রহী তারা যে বই বা টেক্সট সমূহে এ রেওয়ায়েতগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তা অধ্যয়ন করতে পারেন। আমরা এই বইতে কয়েকটি আলামত যা সহজেই বোধগম্য তা উল্লেখ করব :
ক) যে সকল রেওয়ায়েত আবির্ভাবের আগেকার অবস্থার বর্ণনা করেছে যেমন : ইসলামী বিশ্বে ও পৃথিবী ব্যাপী জুলুম ,অত্যাচার ,ফিতনা-ফ্যাসাদ ,পাপ ও ধর্মহীনতার ব্যাপক বিস্তার ঘটবে : অনেক রেওয়ায়েতে ইমামগণ (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর পবিত্র কিয়ামের ব্যাপারে এভাবে ইশারা করেছে যে “ ইমাম মাহ্দী (আ.) তখনই কিয়াম করবেন যখন পৃথিবী পরিপূর্ণভাবে জুলুম ,অত্যাচার ,পাপ ও পঙ্কিলতায় ভরে যাবে। ” এছাড়া আরও ব্যাপক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। অন্য রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এমনকি একেবারে নিকটতম সময়ে বিশেষ করে মুসলিম সমাজ বিভিন্ন ধরনের পাপ-পঙ্কিলতায় ভরে যাবে যেমন :
মদ বা নেশাকর পানীয় অবাধে বেচা-কেনা হবে। সুদ খাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাবে। ব্যভিচার অন্যান্য অপছন্দনীয় কাজসমূহের (যেমন সমকামিতা) ব্যাপক বিস্তার ঘটবে এবং তা প্রকাশ্যে করা হবে। নির্মম-নিষ্ঠুরতা ,অবৈধ কর্ম ,মুনাফেকী ,ঘুস খাওয়া ,লোক দেখানো কাজ ,বিদআত ,গীবত ,অপরের ক্ষতি করার পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। অসচ্চরিত্রতা ,বেহায়াপনা ,জুলুম-অত্যাচার ,যেখানে সেখানে দেখা যাবে। মহিলারা বেপর্দা ও উত্তেজক পোশাক পরে সমাজে বের হবে। পুরুষেরা মহিলাদের মত ,মহিলারা পুরুষের মত পোশাক পরবে এবং একই রকম সাজ-সজ্জা করবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দান করার প্রক্রিয়া উঠে যাবে। মুমিন ব্যক্তিরা অপমান-অপদস্থ হবে এবং পাপ ও খারাপ কাজগুলো ঠেকানোর মত শক্তি তাদের থাকবে না। কাফের বা ধর্মহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং ইসলাম ও কোরআনের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই থাকবে না। সন্তানরা তাদের পিতা-মাতাকে অসম্ভব কষ্ট দিবে এবং তাদের অসম্মান করবে। বড়দের সামান্য পরিমাণ সম্মান দেয়া থেকেও তারা বিরত থাকবে। কারো অন্তরে কিঞ্চিত পরিমাণ ভালবাসাও থাকবে না। কেউ খুমস ও জাকাত দিবে না আর দিলেও তা প্রকৃত পথে খরচ হবে না। বেদীন ও কাফের এবং অসৎ লোকেরা মুসলমানদের উপর আধিপত্যশীল হবে এবং তাদেরকে নিজেদের দিকে নিয়ে যাবে ,মুসলমানরা তাদের পোশাক-আষাক ,চাল-চলন ,ধ্যান-ধরনকে অনুসরণ করে চলবে এবং আল্লাহর আইন-কানুনকে অকার্যকর করে দিবে ...।
এবং আরও অনেক বিষয় যা আমাদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) তাঁদের রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন। ১৪২ ইরানের জনগণ এই ধরনের ঘটনাগুলোকে অতীত শতাব্দীতে ইরানের ভূ-খণ্ডে দেখেছেন। এ দেশের (ইরানের) মুসলমানদের ইসলামী বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের পাপ-পঙ্কিলতার বিরুদ্ধেই হয়েছিল (এ বিপ্লব সম্পর্কে তাদের আশা এটাই যে হয়তো ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কিয়ামের সূচনা স্বরূপ হতে পারে) । পাপ-পঙ্কিলতা ,ফিতনা-ফ্যাসাদ ,ধর্মহীনতা ,অসৎ লোকদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা ও অশুভ বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে সকলেই একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ঐ সকল ধর্মবিরোধী কর্মের মন্দ প্রভাব মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি দিকে পড়ছিল। আল্লাহর অশেষ প্রশংসা যে ,এই দেশের প্রচুর মন্দ বিষয়কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সকলেই জানেন যে পৃথিবীতে বিশেষ করে ইসলামী দেশগুলোতে এ ধরনের খারাপ কাজগুলো এখনও অব্যাহত আছে ...।
খ) যে সকল রেওয়ায়েতগুলোতে আবির্ভাবের আগেকার ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যেমন :
১ - সুফিয়ানীর উত্থান ।
২-সুফিয়ানীর বাহিনীর মাটির তলায় প্রোথিত হওয়া।
এই আলামতগুলোর প্রতি আমাদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং পরিষ্কারভাবে সেগুলো বর্ণনা দিয়েছেন। যার একটি হচ্ছে সুফিয়ানীর উত্থান। রেওয়ায়েত অনুযায়ী বুঝা যায় সুফিয়ানী হচ্ছে উমাইয়া বংশোদ্ভূত ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এর উত্তর পুরুষ এবং জঘন্য প্রকৃতির লোক হবে। তার নাম উসমান বিন আ ’ নবাসেহ। সে নবী ও পবিত্র ইমামদের পরিবার (বংশ) ও তাদের অনুসারীদের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে। লাল বংয়ের চেহারা ,গাঢ় নীল বংয়ের চোখ ,মুখে বসন্তের দাগ ,দেখতে কুৎসিত ,অত্যাচারী ও বিশ্বাসঘাতক। সিরিয়ায় আবির্ভূত হবে এবং দ্রুত পাঁচটি শহরকে (দামেস্ক ,জর্ডান ,হিমস ,কানসিরিন ও ফিলিস্তিন) তার দখলে নিয়ে আসবে। তারপর একটি বড় সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইরাকের কুফা শহরের দিকে আসবে। ইরাকের বিভিন্ন শহর বিশেষ করে নাজাফ ও কুফাতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। তার আরেকটি সৈন্য দলকে মদীনার দিকে পাঠাবে। তারা মদীনায় পৌঁছে মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করবে ,তাদের অর্থ সম্পত্তি লুট করবে। তারপর সেই সৈন্য বাহিনীটি মদীনা হয়ে মক্কায় যাওয়ার পথে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের নির্দেশে মরুভূমির মধ্যে মাটির নিচে তলিয়ে যাবে। সে সময় ইমাম মাহ্দী (আ.) আবির্ভূত হবেন। এই ঘটনার পরে তিনি মক্কা থেকে মদীনায় এবং মদীনা থেকে ইরাক ও কুফাতে আসবেন। এদিকে সুফিয়ানী ইরাক থেকে সিরিয়ায় (দামেস্কে) পালিয়ে যাবে। ইমাম একটি বিশাল সৈন্য বাহিনীকে তার পিছু ধাওয়া করার জন্য পাঠাবেন। অবশেষে তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে তার শিরোচ্ছেদ করা হবে। ১৪৩
৩ - সাইয়্যেদ হাসানীর উত্থান : ইমামগণের রেওয়ায়েত অনুযায়ী সাইয়্যেদ হাসানী শিয়া মাযহাবের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। যিনি ইরানের দেইলামী ও কাযভীন শহর থেকে উত্থিত হবেন। তিনি একজন খোদাভীরু ও মহানুভব ব্যক্তি। ইমাম ও মাহ্দী হওয়ার দাবি করবেন না। শুধুমাত্র জনগণকে ইমামগণের পদ্ধতিতে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিবেন। তার এই দাওয়াতী কাজটি প্রসারলাভ করবে এবং প্রচুর সঙ্গী সাথিও পাবেন। নিজের এলাকা থেকে নিয়ে কুফা পর্যন্ত জুলুম-অত্যাচার ও সকল ধরনের পাপ-পঙ্কিলতাকে উৎখাত করবেন। ন্যায় পরায়ন শাসকের ন্যায় প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করবেন। তিনি যখন তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে কুফাতে পৌঁছাবেন সে সময় তাকে খবর দেয়া হবে যে ইমাম তার সৈন্য বাহিনী ও সঙ্গী সাথিদের নিয়ে কুফার নিকটে চলে এসেছেন। তখন তিনি তার বাহিনী নিয়ে ইমামের সাখে দেখা করবেন ;ইমাম সাদিক (আ.) বলেন যে ,সাইয়্যেদ ইমামকে চেনেন ও জানেন কিন্তু যাতে করে তার সঙ্গী-সাথিরা ইমামের ইমামত ও ফযিলতকে জানতে পারে সে কারণে তিনি তার পরিচয়কে গোপন করবেন। ইমামের কাছে তাঁর ইমামতের পক্ষে প্রমাণ চাইবেন এবং নবিগণের পক্ষ থেকে যে জিনিসগুলো তাঁর কাছে আছে তা দেখাতে বলবেন। ইমাম সে জিনিসগুলোকে দেখাবেন এবং অলৌকিক ঘটনাও ঘটাবেন। সাইয়্যেদ হাসানী ইমামের হাতে বাইয়াত করবেন এবং তার সঙ্গী-সাথিরাও ইমামের হাতে বাইয়াত করবে। শুধুমাত্র চার হাজার লোক ব্যতীত আর সবাই ইমামকে মেনে নিবে। ঐ চার হাজার লোক ইমামকে যাদুকর বলে সম্বোধন করবে। ইমাম তিন দিন ধরে তাদের সাথে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় রত থাকবেন। তারপরও যখন তারা তাকে মেনে নিতে রাজী হবে না ,তিনি তাদেরকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দিবেন। ইমামের নির্দেশে তাদেরকে হত্যা করা হবে। ১৪৪
৪ - আসমানী ধ্বনি : অন্য আরেকটি আলামত হচ্ছে আসমানী ধ্বনি। এটা এরূপ যে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে মক্কায় বিরাট ভয়ংকর ও স্পষ্ট আসমানী চিৎকার ধ্বনি শোনা যাবে। তাতে ইমামের নাম ও বংশ পরিচিতি তুলে ধরে মানুষের সামনে তাঁর পরিচয় পেশ করা হবে। এই ধ্বনি হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি। এই ধ্বনিতে জনগণকে আদেশ দান করা হবে তারা যেন ইমামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে যাতে করে তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। তার বিরুদ্ধে যেন কেউ কথা না বলে বা তার নির্দেশের বিপরীতে যেন কেউ না চলে ,যাতে করে তারা বিভ্রান্ত না হয়ে যায়। ১৪৫
আর ইমামের আবির্ভাবের আগে অন্য আরেকটি ধ্বনি উচ্চারিত হবে তাতে ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীরাই যে সত্য পথের প্রতীক ছিল তার প্রমাণ দিবে। ১৪৬
৫-ঈসা (আ.)-এর প্রত্যাবর্তন এবং ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে অনুসরণ করা :
আসমান থেকে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ এবং নামাযের সময় ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে অনুসরণ করা (ইমাম মাহ্দীর পিছনে নামায পড়বেন) এ সকল বিষয় তাঁর আবির্ভাবের সাথে সাথে ঘটবে। এভাবেই বিভিন্ন রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে। নবী আকরাম (সা.) তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কে বলেছেন :
وَ مِناَّ وَ اللَّهِ الَّذِى لاَ اِلَهَ اِلاَّ هُوَ مَهْدِىُّ هَذِهِ الْاُمَّةِ الَّذِى يُصَلِّى خَلْفَهُ عِيسى بْنُ مَريمَ
সেই আল্লাহ্ যিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কসম যে ,মাহ্দী আমার উম্মতের থেকেই। আর এমনই যে ,ঈসা ইবনে মারিয়াম তাঁর পিছনে নামায পড়বে। ১৪৭
অন্যান্য আলামতসমূহ বিভিন্ন বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে ,এ সমস্ত আলামত বা সংকেতের সবগুলোই কী যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই রূপ নেবে না প্রয়োজন বোধে তার পরিবর্তনও হতে পারে ?এটা এমন একটা বিষয় যা তার নিজের জায়গায় আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আলামতসমূহের ব্যাপারে যেভাবে বলা হয়েছে তা হচ্ছে ,আলামত দুই ধরনের : নিশ্চিত ও অনিশ্চিত। যা কিছু নিশ্চিত তা অবশ্যই ঘটবে।
অন্য কিছু রেওয়ায়েতে আবার বলা হয়েছে যে ,এমনকি নিশ্চিত বিষয়গুলোও প্রয়োজন বোধে পরিবর্তিত হতে পারে । শুধুমাত্র ঐ বিষয়গুলোর পরিবর্তন সম্ভব নয় ,যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন ওয়াদা দান করেছেন। আর আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন কখনও ওয়াদার বরখেলাপ করেন না :
) ا ِنَّ اللَّهَ لاَ يُخْلِفُ الْميعادَ ( ১৪৮
সুস্পষ্ট যে ,যেখানে রেওয়ায়েতসমূহে উদ্ধৃত বিষয়সমূহেরও পরিবর্তন হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে ইমাম মাহ্দীর জন্য অপেক্ষার অনুভূতিকে শিয়া সমাজে আরও শক্তিশালী ও মজবুত করবে। এজন্য যে ,সবসময় তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকতে হবে এবং নিজেকে সেভাবে তৈরী করবে। কেননা সম্ভাবনা আছে যে হয়তো আলামত বা সংকেতের কোন খবর নেই অথচ ইমাম আবির্ভূত হয়েছেন।
ইমাম মাহ্দী ( আ .)-এর কিয়াম
যে সকল রেওয়ায়েতে আমাদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর কিয়ামের ব্যাপারে কথা বলেছেন তা থেকে বুঝা যায় :
তিনি দীর্ঘকালীন অন্তর্ধানে থাকার পর আল্লাহ্ তা ’ য়ালার নির্দেশে মক্কায় কাবা ঘরের পাশে (রোকন ও মাকাম এর মধ্যবর্তীস্থানে) আবির্ভূত হবেন। নবী (সা.)-এর পতাকা ,তলোয়ার ,পাগড়ী ও আলখেল্লা তাঁর কাছে থাকবে এবং ফেরেশতাদের মাধ্যমে সাহায্য প্রাপ্ত হবেন। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত অবস্থায় কিয়াম করবেন। আল্লাহ্ ও ইসলামের শত্রুদেরকে কোন প্রকার নিরাপত্তা দেয়া ছাড়াই হত্যা এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ।
তার বিশেষ সঙ্গী-সাথিগণের সংখ্যা হচ্ছে তিনশত তের জন যারা মক্কায় তার হাতে বাইয়াত করবেন। ইমাম কিছু সময় মক্কায় থাকবেন এবং তারপর মদীনায় আসবেন। তার সঙ্গী-সাথিগণ হচ্ছে বিশিষ্ট যোদ্ধা ,সাহসী ,ঈমানদার ,রাতে আল্লাহর ভয়ে কাতর ,দিনে সিংহের মত গর্জন করে ,তাদের অন্তরসমূহ লোহার মত মজবুত ,ইমামকে মেনে চলার ব্যাপারে যাদের কোন ত্রুটি নেই এবং যে দিকেই পাঠানো হয় বিজয়ী হয়ে ফিরে আসে।
ইমাম মদীনায় কিছু সংগ্রাম করার পর নিজের সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইরাক ও কুফার দিকে অগ্রসর হবেন। কুফাতে সাইয়্যেদ হাসানীর সাথে দেখা হবে। সাইয়্যেদ হাসানী তার বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ইমামের হাতে বাইয়াত করবেন। ঈসা (আ.) আসমান থেকে নেমে আসবেন এবং ইমামকে সাহায্য করবেন ও তাঁর পিছনে নামায পড়বেন।
ইমামের শাসনকার্যের মূল কেন্দ্র হবে কুফাতে। তিনি পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ ভূমিকে নিজের আওতায় নিয়ে আসবেন। ইসলামের আইন-কানুনকেই সমস্ত জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। দীনকে নতুন রূপ দান করবেন এবং ইসলামের চেহারাতে যে সব ধূলা মাটি পড়েছিল তা পরিষ্কার করে নতুন দীপ্তি আনবেন। আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও নবী (সা.)-এর সুন্নতকে অনুসরণ করে চলবেন। আমিরুল মু ’ মিনিন আলী (আ.)-এর মতই তার খাবার হবে সাদাসিধা এবং পোশাক-আষাক হবে অমসৃন ও সাধারণ।
ইমামের সুশাসনের বরকতে জমিতে ফসল হবে প্রচুর পরিমানে ,মানুষ হবে অর্থ-বিত্তশালী ,নেয়ামত আসবে সবদিক থেকে ,সব কাজে বরকত পাওয়া যাবে ,ফল-ফলাদি হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। দারিদ্রের হবে অবসান ,সবাই অর্থনৈতিকভাবে এমন সুখ-শান্তিতে থাকবে যে যাকাত দেয়ার জন্য কোন অভাবীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যার কাছেই দিতে যাবে সেই ফিরিয়ে দিবে। ইমামকে ভালবেসে অসংখ্য মুমিন ব্যক্তি ,ভক্ত ও অনুসারী তাঁর প্রতিবেশী হিসাবে কুফায় আবাস গড়ে তুলবে। ইমামের পিছনে নামাজ পড়ার জন্য সবাই এত ভিড় করবে যে পরবর্তীতে নামাজীদের জায়গা হওয়ার জন্য এশটি বিশাল মসজিদ তৈরী করা হবে। মসজিদটি এতই বড় হবে যার একহাজারটি দরজা থাকবে।
ইমামের শাসনামলে ন্যায়-নীতি ও নিরাপত্তা এত পরিমাণে থাকবে যে ,সমস্ত জায়গায় শান্তির ছায়া ছড়িয়ে পড়বে। এমন হবে যে ,যদি কোন বৃদ্ধ মহিলা তার সর্ব শরীরে স্বর্ণ অলংকার পরে একাকী এ শহর থেকে ও শহরে ঘুরে বেড়ায় তারপরও কেউ তাকে অত্যাচার করবে না বা তার সম্পদে কেউ হাত দিবে না।
জমিন তার নিজের মধ্যে যা কিছু অর্থ সম্পদ লুকায়িত বা প্রোথিত আছে তা ইমামের জন্য বের করে দিবে। তিনি সকল অত্যাচারিত বিধ্বস্তদেরকে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। যখন তিনি কিয়াম করবেন তখন আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তার অনুসারীদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিকে আরও প্রখর করে দিবেন যাতে করে ইমামের ও তাদের মধ্যে কোন প্রকার অন্তরায় না থাকে। তিনি তাদের সাথে কথা বলবেন এবং তারা তার কথাকে শুনতে পাবে। ইমাম তার অবস্থানের স্থানে থাকলেও তারা তাঁকে দেখতে পারবে। আবির্ভূত হওয়ার সময় আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিন তার বান্দাদের উপর দয়া ও রহমতের পরশ বুলিয়ে দিবেন এবং তাদের আকলসমূহকে পরিপূর্ণ করে দিবেন। ইমাম মাহ্দী হযরত দাউদ (আ.)-এর পদ্ধতিতে হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে বিচার করবেন। যা কিছু নবী আকরাম (সা.) করে গেছেন তিনি তাই করবেন। যেভাবে নবী মুহাম্মদ (সা.) জাহেলি যুগের বিদআত ও কুপ্রথাকে সমাজ থেকে ঝেড়ে মুছে সাফ করে দিতেন ,তিনিও তেমনিভাবে ইসলামী সমাজকে সেগুলো থেকে বাঁচিয়ে নতুন জীবন দান করবেন। ১৪৯
ইমাম অন্তর্ধানে থাকার সময় তার অনুসারীদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য
১-নিম্মলিখিত দোয়াটি পড়া যা আল্লাহ্ রাব্বুল আ ’ লামিনের কাছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ব্যাপারে বেশী করে জানতে চেয়ে প্রার্থনা করা :
اَللَّهُمَّ عَرِّفْنى نَفْسَكَ فَاِنَّكَ اِنْ لَمْ تُعَرِّفْنى نَفْسَكَ لَمْ اَعْرِفْ نَبِيِّكَ، اَللَّهُمَّ عَرِفْنى رَسُلَكَ فَاِنَّكَ اِنْ لَمْ تُعَرِّفْنى رَسُلَكَ لَمْ اَعْرِفْ حُجَّتَكَ، اَللَّهُمَّ عَرِّفْنى حُجَّتَكَ فَاِنَّكَ اِنْ لَمْ تُعَرِّفْنى حُجَّتَكَ ضَلَلْتُ عَنْ دِينى
হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার সত্ত্বার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। যদি তুমি তোমাকে আমার নিকট পরিচয় না করাও তাহলে আমি তোমার নবীর সাথেও পরিচিত হতে পারবো না। হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার রাসূলের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। যদি তুমি আমাকে তোমার রাসূলের সাথে পরিচয় না করিয়ে দাও তাহলে আমি তোমার হুজ্জাতের (মনোনীত ইমামের) সাথেও পরিচিত হতে পারবো না। হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার হুজ্জাতের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। যদি তুমি তোমার হুজ্জাতের সাথে আমাকে পরিচয় না করিয়ে দাও তাহলে আমি আমার দ্বীনের থেকে পথ ভ্রষ্ট হয়ে যাব। ১৫০
২-এই দোয়াটি পড়া :
يا اَللَّه يا رَحْمَنُ يا رَحِيمُ يا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبى عَلى دِيِنك
হে আল্লাহ্! হে পরম দয়ালু! হে দয়াবান! হে হৃদয়ের উপর কর্তৃত্বশীল! আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর স্থিতিশীল করে দাও। ১৫১
৩-ইমামের জন্য দোয়া করা ,যেমন এই দোয়াটি পড়া :
اَللَّهُمَّ كُنْ لِوَلِيِّكَ الْحُجَّةِ بْنِ الْحَسَنِ صَلَوَتُكَ عَلَيْهِ وَ عَلىَ آبائهِ فى هَذِهِ السَّاعَةِ وَ فِى كُلِّ ساعَةِ وَلِياً وَ حافِظاً وَ قائِداً وَ ناصِراً وَ دَلِيلاً وَ عَيْناً حَتَّى تُسْكِنَهُ اَرْضَكَ طَوْعاً وَ تُمَتِّعَهُ فِيها طَويلا
হে আল্লাহ! হুজ্জাত ইবনুল হাসান (আ.) ও তাঁর পূর্বপুরুষদের উপর তোমার অগণিত রহমত বর্ষণ কর ঠিক এই সময় এবং প্রতিটি সময় তুমি তার অভিভাবক ,রক্ষাকারী ,পথনিদের্শক ,সাহায্যকারী ,নিয়ন্ত্রণকারী ,পরিচালনাকারী হও এবং তাকে তোমার জমিনের উপর ফজিলাত ও মর্যাদা দিয়ে প্রতিনিধি করে তাকে তার অনুগত কর ,আর তাঁকে দীর্ঘ সময়ের জন্য জমিনের বুকে সৌভাগ্যবান কর। ১৫২
৪-তাঁর জন্যে দরূদ শরিফ পাঠ করা এবং তাঁর আবির্ভাব তরান্বিত হওয়ার জন্য দোয়া করা :
اَللِّهُمَّ صِلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَ آلِ مُحَمَّدٍ وَ عَجِّل فَرَجَهُم
হে আল্লাহ্! নবী (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর তোমার রহমত বর্ষণ কর আর ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত কর।
ইমাম মাহ্দী (আ.) কাছ থেকে রেওয়ায়েত এসেছে যে ,তিনি বলেছেন : আমার দ্রুত আবির্ভাবের জন্য প্রচুর দোয়া করবে ,কেননা তাতে তোমাদের সুফল রয়েছে। ১৫৩
৫-জুমার দিনে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর যিয়ারত পড়া যা মাফাতিহুল জিনানে উল্লিখিত আছে।
৬-দোয়ায়ে নুদবাহ্ পড়া। প্রতি জুমার দিনে ,ঈদে ফিতর ও ঈদে কোরবান এবং ঈদে গাদীরের দিনে।
৭-তাঁর নাম শোনার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ানো।
৮-বিভিন্ন যিয়ারত পড়ার সময় তাঁর প্রতি দৃষ্টি রাখা।
৯-বিভিন্ন সমস্যার থেকে থেকে উদ্ধারের জন্য তাঁর উছিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়া। নিজের ভাল আমলকে তাঁর প্রতি উৎসর্গ করা। যেমন : কোরআন তেলওয়াত ,হজ ,ওমরাহ্ ,তাওয়াফ ,তাঁর পক্ষ থেকে ইমামগণের মাজার যিয়ারত করা ,তার সুস্থ থাকার জন্য ছদকা দেয়া।
১০-গুনাহ থেকে প্রকৃতভাবে তওবা করা। যদিও গোনাহ্গারদের জন্য সকল সময় তওবা করা ফরজ কাজ। কেননা আমাদের পাপের কারণেই তাঁর অন্তর্ধান ঘটেছে।
১১-জনগণকে তার প্রতি নিবন্ধ করা। অর্থাৎ প্রতিটি শিয়া যেন তাঁর কথাকে (আমলের মাধ্যমে ও বলার মাধ্যমে) অন্যের কাছে পৌঁছে দেয় । যতদূর সম্ভব দীন প্রচারের লক্ষ্যে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা এবং এটি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা আমরা সব সময় তাঁর আসার অপেক্ষায় থাকবো। আর তাঁর আসার অপেক্ষায় থাকার অর্থই হচ্ছে ,আমাদের জীবনকে এমনভাবে তৈরী করবো যেন তিনি তাতে রাজী থাকেন। আমরা আমাদের আচার-আচরণে প্রমাণ করবো যে আমরা ন্যায়ের সাথী এবং তাঁর ন্যায়-নীতিপূর্ণ শাসনামলের অপেক্ষায় আছি। যদি আমাদের দৃষ্টি আল্লাহ্ ,নবী ও ইমামগণের প্রতি নিবদ্ধ না থাকে এবং আচার-আচরণ ও কর্ম তাঁদের নির্দেশিত পথে না হয় তাহলে আমরা যতই বলি না কেন যে আমরা তাঁর আসার অপেক্ষায় আছি ,আমাদের এই বলা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
সংক্ষিপ্তাকারে জামকারান মসজিদের পরিচিতি
কোম শহরের ইতিহাসের বইতে মরহুম নাসিরুস শারিয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে হাজী মির্যা হুসাইন নূরী তার “ মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল ” নামক গ্রন্থে লিখেছেন : শেখ হাসান বিন মোসাল্লা জামকারানী (রহঃ) বলেন : ১৭ই রমযান ৩৯৩ হিজরী মঙ্গলবার রাতে নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ একদল লোক আমার ঘরের সামনে এসে আমাকে জাগ্রত করে বলল ,‘ ওঠো ,ইমাম মাহ্দী (আ.) তোমাকে যেতে বলেছেন। ’ সদর দরজায় এসে দেখি বড় বড় ব্যক্তিত্বরা সেখানে উপস্থিত। তারা আমাকে নিয়ে গেলেন যেখানে বর্তমানে মসজিদটি অবস্থিত আছে। সেখানে এসে দেখলাম ইমাম একটি সিংহাসনের উপর বসে আছেন। আমাকে আমার নাম ধরে ডেকে বললেন : হাসন মুসলিমকে (যে ঐ জমির মালিক) বল যে ,আল্লাহ্ অন্য সব জমির মধ্যে এই জমিকে পছন্দ করেছেন। সাইয়্যেদ আবুল হাসানের কাছে গিয়ে বল যে ,এই জমিটিকে হাসান মুসলিমের কাছ থেকে কিনে অন্যদেরকে দিয়ে দিতে তারা এখানে মসজিদ তৈরী করবে। জনগণের উদ্দেশ্যে বল যে ,এই জমির দিকে যেন খেয়াল রাখে আর এটার প্রতি ভালবাসা দেখায় এবং এই মসজিদে চার রাকাত নামায পড়ে ,যার দুই রাকাত হচ্ছে মসজিদের সম্মানে যা হচ্ছে এরূপ : প্রতি রাকাতে একবার সূরা হামদ ও সাতবার সূরা এখলাস ,রুকু ও সেজদাতে সাতবার তসবীহ্ পড়তে হবে। অন্য দুই রাকাত হচ্ছে ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর উদ্দেশ্যে যা হচ্ছে এরূপ : প্রতি রাকাতে সূরা হামদ পড়ার সময় ( اياك نعبد و اياك نستعين ) এই বাক্যটিকে একশতবার পড়ে সূরা শেষ করতে হবে। রুকু ও সেজদায় তসবীহ্ পড়তে হবে সাতবার। তারপর নামায শেষে লা ইলাহা ইল্লালাহ্ বলে হযরত ফাতিমা (সা.)-এর তসবীহ্ পড়তে হবে এরূপে (আল্লাহ্ আকবার ৩৪ বার ,আলহামদুলিল্লাহ্ ৩৩ বার ,সুবহানা আল্লাহ্ ৩৩ বার)। তারপর সেজদায় গিয়ে একশতবার দরূদ শরিফ পাঠ করতে হবে। এই দুই রাকাত নামাযের মূল্য কাবা ঘরে নামায পড়ার সমতুল্য। এভাবেই এই মসজিদ তৈরী হয় যা আজও ইমাম মাহদীর ভক্ত-অনুরাগীদের যিয়ারতের স্থান হয়ে আছে।
আরও অধিক জানতে হলে মির্যা হুসেইন নূরী রচিত “ নাজমুস সাকিব ” নামক গ্রন্থ দেখা যেতে পারে।
তৌকি ’ য়াত১৫৪
শেখ সাদুক রচিত “ কামাল উদ্দিন ” ও শেখ তুসি রচিত “ গাইবাত ” এ দুটি গ্রন্থে প্রায় আশিটি তৌকি ’ য়াত উল্লেখিত হয়েছে। যার কিছু তিনি বিশিষ্ট আলেম ও ফকীহদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। এ থেকেই বুঝা যায় যে ,ইমাম মাহ্দী (আ.) অন্তর্ধানে থেকেও তিনি তাঁর অনুসারী ও প্রিয় লোকদের প্রতি দৃষ্টি রাখছেন এবং যারা হেদায়াত পেতে ও পরিশুদ্ধ হতে চায় তাদের প্রতি তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখছেন। যারা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে যেমন : গুরুত্বপূর্ণ কাজের ব্যাপারে ,বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ,জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে ,দীনি কাজের ব্যাপারে তাঁর কাছে কাতর হয়ে সাহায্য কামনা করেছে ,তারা তাঁর মাধ্যমে দিক নির্দেশনা পেয়েছে ও উপকৃত হয়েছে। বিশেষ করে যাদের হাতে দীনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে তাদেরকে তিনি বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। এগুলো ইমামের কাছ থেকে প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে তাঁর তৌওকি ’ য়াতের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় যেমন :
উল্লেখ আছে যে ,এই সংবাদটি ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নিকট থেকে মরহুম আয়াতুল্লাহ্ আল উযমা আগা সাইয়্যেদ আবুল হাসান ইসফাহানী (মৃত্যু ১৩৬৫ হিজরী) যিনি শিয়া মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ্ ছিলেন প্রায় ৫০ বছর আগে তার কাছে এসেছে :
اَرْخِص نَفْسَكَ وَ اجْعَلْ مَجْلِسَكَ فِى الدِّهْليز وَ اَقْضِ حَوائِجَ النَّاس ، نَحْنُ نَنْصُرُكَ
তোমাকে মানুষের মাঝে বিলীন করে দাও এবং তোমার বসার জায়গাটিকে সদর দরজার কাছে কর (যাতে করে মানুষ সহজেই তোমার সাথে সাক্ষাত করতে পারে) এবং মানুষের চাওয়া পাওয়াকে পূরণ কর ,আমরা তোমাকে সাহায্য করবো।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ وَ عَلَى آبائِهِ الطاَّهِرينَ وَ عَجِّلْ فَرَجَهُ الشَّريفَ وَ سَهلْ مَخْرَجَهُ وَ اَقْضِ جَميعَ حَوائِجِهِ بِرَحْمَتِكَ يا اَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ ، وَ آخِرُ دَعَوانا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمينَ
তথ্যসূত্র :
১ । সাদুক ,কামাল উদ্দিন ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৪০৩-৪০৪ ,ও ২য় খণ্ড ,পৃ. ৪৯ ,১৫৯ ,১৬০।
২ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩১-৩৪ ,কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৩২-৩৩৩ ,কামাল উদ্দিন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২ ,৮ ,৪৯ ,৩৬১ ,৩৬২। ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আসল নাম ( م ح م د ) উচ্চারণের ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে ,কেউ কেউ যেমন শেখ আনসারী মাকরুহ্ মনে করেন এবং তাদের আগে আরও কেউ কেউ যেমন শেখ তুসি সম্পূর্ণভাবে হারাম মনে করেন আর অন্যরা যেমন হাজী নূরী বলেন শুধু সভা ও মাহ্ফিলে উচ্চারণ করা হারাম ,দেখুন নাজমুস সাকিব ,পৃ. ৪৮।
৩ । মরহুম মুহাদ্দেছ (হাদীস বিশারদ) নূরী তার “ নাজমুস সাকিব ” গ্রন্থে এভাবে লিখেছেন : যাখীরাহ্ ও তাযখীরাহ্ নামক গ্রন্থে লিখিত আছে যে ,ঐ মহান ব্যক্তির “ মানসুর ” নামটি “ দিদ ” গ্রন্থে হচ্ছে বেরাহ্মাহ্। আর তার বিশ্বাস অনুযায়ী এটি অন্যতম আসমানি কিতাব। শেখ ফুরাত বিন ইবরাহীম কুফির লেখা কোরআনের তাফসীরে আছে হযরত ইমাম বাকির (আ.) এই আয়াতের তাফসীরে বলেছেন :
) و َ مَنْ قُتِلَ مَظْلُوماً فَقَدْ جَعَلْنا لِوَلِيِّهِ سُلْطاَناً (
এটা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যাকে মজলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে ,এবং এই আয়াতের তাফসীরে আল্লাহ্ তা ’ য়ালা ( فَلا َيُسْرِفْ فِى الْقَتْلِ اِنَّهُ كانَ مَنْصُورا ً ) মাহদি (আ.)-কে মানছুর নামকরণ করেছেন ,যেমনিভাবে নবী (সা.)- কে আহমাদ ,মুহাম্মদ ,মাহমুদ নামকরণ করা হয়েছে ,এবং যেমনিভাবে ঈসাকে (আ.) মসীহ্ নামকরণ করা হয়েছে , (বিহার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩০) ,আর হয়তোবা শেষ ইমামকে মানছুর হিসাবে অভিহিত করার কারণটি জিয়ারতে আশুরায় এসেছে :
فَاسْئَلُ اللَّهَ الَّذِى اكْرَمَ مَقَامَكَ وَ أَكْرَمَنى أَنْ يَرْزُقَّنِى طَلَبَ ثَارِكَ مَعَ اِمامٍ مَنْصُورٍ مِنْ أَهلِ بَيْتِ مُحَمَّدٍ (ص (
(নাজমুস সাকিব ,পৃ. ৪৭) ,
এবং দুয়ায়ে নুদবাতে এসেছে :
اَيْنَ الْمَنْصُورُ عَلَى مَنِ اعْتَدىَ عَلَيْهِ
৪ । বিশারাতে আহদাইন (তওরাত ও বাইবেলের সুসংবাদসমূহ) ,পৃ.২৪৫।
৫ । ঐ পৃ. ২৫৮। ঐ বইয়ের ২৪৩ পৃষ্ঠার টিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে : ইতিহাস বেত্তারা এভাবে লিখেছে : “ জামাসব ” “ গুসতাসব বিন লাহরাসবের ” ভাই সে কিছু দিন যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা যারথুষ্ট্রের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিল।
এ বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ,“ জামাসব ” গ্রন্থ থেকে যে অংশটি আমরা উদ্ধৃত করেছি একই অর্থের বর্ণনা আমাদের হাদিস গ্রন্থেও এসেছে যেমন ,আমিরুল মু ’ মিনীন আলী (আ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ সাদুকের “ খেসাল ” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে:
وَ لَوْ قَدْ قامَ قائِمُنا لَاَنْزَلَتْ السَّمَاءُ قَطْرَهاَ وَ أَخْرَجَتِ الْاَرْضُ نَباتَها وَ لَذَهَبَتِ الشَّحْناءُ مِنْ قُلُوبِ الْعِبادِ ، وَ اَصْطَلَحَتِ السِّباعُ وَ الْبَهائِمُ
(মুনতাখাবুল আসার ,পৃ. ৪৭২-৪৭৪)।
৬ । বিশারাতে আহদাইন (তওরাত ও বাইবেলের সুসংবাদসমূহ) ,পৃ. ২৩৮।
৭ । “ সেফরে তাকভীন ( Genesis সৃষ্টি সম্পর্কিত অধ্যায় ) ” (২০ : ১৭)।
৮ । মাযমুর ৩৭ ,অনুচ্ছেদ ১০-৩৭ পবিত্র কিতাব ,প্রিন্ট- ১৯০১। “ মাযামির ” হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ পবিত্র কিতাব যা যাবুর নামে পরিচিত। তওরাতের আরবী অনুবাদের মধ্যে তা উল্লেখ করা হয়েছে বা আল মুনজেদ আরবী অভিধানেও যাবুরের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে যাবুর একটি কিতাবের নাম যা দাউদ (আ.)-এর মাযামিরের আরবী নামকরণ।
৯ । সুরা আম্বিয়ার ৪৮নং আয়াতে তওরাতকে যিকর নামে সম্মোধন করা হয়েছে।
১০ । সুরা ইসরা ’ র ৫৭নং আয়াতে বলা হয়েছে যে ,যাবুরকে দাউদের উপর নাযিল করেছি।
১১ । সুরা আম্বিয়া ,আয়াত নং- ১০৫।
১২ । সুরা নুর ,আয়াত নং- ৫৫।
১৩ । সুরা কাসাস ,আয়াত নং- ৫।
১৪ । আল ইমামুল মাহদি ,আলী মুহাম্মদ আলী দাখিল ,পৃ. ৪০-৪৭ এবং নাভিদে আমন ও আমান ,পৃ. ৯১ ,এই গ্রন্থে ৩৩ জন সাহাবার নাম উল্লেখিত হয়েছে।
১৫ । আল গাদির ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২০১-২০৩ ,বৈরুতে ছাপা।
১৬ । আল গাদির ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৩৬০ ,ও আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ্ ,পৃ. ২৪৯ ,নাজাফে ছাপা।
১৭ । আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ্ ,পৃ. ২৫১।
১৮ । কিতাবুল মাহদি ,পৃ. ১১৩ ।
১৯ । এলামুল ওয়ারা ,পৃ. ৪৪৩।
২০ । তাদের ১০৬ জনের নাম ‘ নাভিদে আমন ও আমান ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে ,পৃ. ৯২-৯৫ ,এবং আরও ৩৭ জনের নাম আল মাহদি মুনতাযার নামক বইতে উল্লেখ আছে ,পৃ. ৮০-৮২ ,লেখক : মুহাম্মদ হাসান আলে ইয়াসিন।
২১ । ইসবাতুল হুদাত ,৭তম খণ্ড ,পৃ. ১৯৮-২০৬ ,মুসনাদে হাম্বাল ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৮৪ ,৯৯ ,৪৪৮ ও ২য় খণ্ড ,পৃ. ২৭ ,৩৮ দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যে হাদিসগুলি এই গ্রন্থগুলিতে এসেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে :
أَبشركم بالمهدى، يبعث فى امّتى على اختلاف من الناس و زلازل ، يملأ الارض قسطاً و عدلاً كماملئت جوراً و ظلماً
২২ । এলামুল ওয়ারা ,পৃ. ৪৪৪ ,ও ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৭।
২৩ । এলামুল ওয়ারা ,পৃ. ৪৪৩।
২৪ । নাভিদে আমন ওয়া আমান ,পৃ. ৯৫ ,গ্রন্থে ৩২টি বইয়ের নাম উল্লেখিত হয়েছে ,এবং “ মাহদীয়ে আহলে বাইত ” গ্রন্থে ৪১জন সুন্নি লেখক ও ১১০জন শিয়া লেখকের নাম উল্লেখিত হয়েছে ,আর “ আল মাহদী মুনতাযার ” গ্রন্থের ২১-২৪ পৃষ্ঠায় ১৪টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ আছে।
২৫ । আল মাহ্দী মুনতাযার ,পৃ. ২১ ,আল ফেহরেস্ত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৭৬।
২৬ । আল ফেহরেস্ত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৮৪ ও ৩০১।
২৭ । নাভিদে আমন ওয়া আমান ,পৃ. ৯০ ,এখানে ১৭ জন বিশিষ্ট সুন্নি আলেমের নাম উল্লেখিত হয়েছে।
২৮ । আল মাহ্দী আল মুনতাযার ,পৃ. ৮৫।
২৯ । ইমাম মাহ্দী ,পৃ. ৬৬।
৩০ । মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯৯।
৩১ । মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৭৬ ও ৪৩০।
৩২ । মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৭৬ ,৪৩০।
৩৩ । মুসতাদরাক আলাস-সাহীহাইন ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ৫৫৪।
৩৪ । ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ্ ,পৃ. ৪৯২।
৩৫ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৪৯১।
৩৬ । মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৩৭।
৩৭ । ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ্ ,পৃ. ৪৪৮।
৩৮ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৪৬৭।
৩৯ । উসুলে কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৩৭।
৪০ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৩৮।
৪১ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৩৮।
৪২ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৪০।
৪৩ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৪২।
৪৪ । এলামুল ওয়ারা ,পৃ. ৪২৫।
৪৫ । কামালুদ্দিন ,পৃ. ৩২২ ,৩১তম অধ্যায় ,হাদিস- ৩।
৪৬ । প্রাগুক্ত ,৩৩তম অধ্যায় ,হাদিস- ২৫।
৪৭ । কামালুদ্দিন ,পৃ. ৩৫০ ,৩৩তম অধ্যায় ,হাদীস- ৪৪।
৪৮ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৪২৭-৪২৮।
৪৯ । উসুলে কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৫১৪।
৫০ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ১২।
৫১ । মাহ্দীয়ে মওউদ গ্রন্থের ভূমিকাতে ১৫২ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছে : ‘ মুরুজুয যাহাব ’ গ্রন্থে ‘ মাসউদী ’ -এর উল্লিখিত রেওয়ায়েত অনুযায়ী- ২৩৫ হিজরীতে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কেলের পক্ষ থেকে ইমাম হাদীকে (আ.) মদীনা থেকে সামররাতে আনা হয়। ২৩২ সালে মদীনায় হযরত ইমাম আসকারী (আ.)-এর জন্ম হয়। সেই সময় থেকে যেভাবে ইসলামী ও অন্যান্য ইতিহাস (বিশেষতঃ ইউরোপীয়দের) গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে যে ,মুসলিম সেনাদল ও পূর্ব রোম অর্থাৎ বাইজান্টাইন বা বর্তমানের তুরস্ক এবং পশ্চিম রোমের (ইটালি) মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। বিশেষ করে যেভাবে কামেল ইবনে আসির এবং অন্যান্য সূত্রসমূহে উল্লিখিত হয়েছে যে ,২৪০ ,২৪৪ ,২৪৫ ,২৪৭ ,২৪৮ ,২৪৯ ,২৫৩ হিজরী বছরগুলোতে মুসলিম সেনাদল ও পূর্ব রোমের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং ঐ সময়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বন্দী বিনিময় হয়েছে। যেমনটি ‘ আল আরাবু ওয়ার রূম ’ গ্রন্থের লেখক নাযিলিফ ফার্সী অনুবাদ ড. মুহাম্মদ আবদুল হাদী সাই ’ রী বর্ণনা করেছেন যে ,২৪৭ হিজরীতে মুসলমান সেনাদল ও রোমের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং মুসলমানদের হাতে অনেক গনিমত আসে। আর ২৪৮ সালে ‘ বালখাজুর ’ মুসলমান সেনাপতি রোমীয়দের সাথে য্দ্ধু করে তাদের রাজ পরিবারের অনেককেই বন্দী করেন (তারিখুল আরাব ওয়ার রূম ,পৃ. ২২৫)। ইবনে আসির ২৪৯ হিজরীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে লিখেন : ওমার ইবনে আবদুল্লাহ্ আকতা ও জা ’ ফর ইবনে আলী সায়েফাহর অধিনায়কত্বে মুসলমান ও রোমীয়দের মধ্যে যুদ্ধ হয় ,আর সেই যুদ্ধে রোম সম্রাট অংশ গ্রহণ করেন। যদি ইমাম মাহ্দীর সম্মানিতা মা ২৪৮ হিজরীতে রাজ পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে বন্দী হয়ে থাকেন তাহলে এই হিসেব মতে তখন ইমাম হাদীর সামাররায় অবস্থানের তেরতম বছর ও ইমাম হাসান আসকারীর ষোল বছর বয়স ছিল।
৫২ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৬-১১।
৫৩ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ২৫।
৫৪ । ইকমালুদ্দিন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ১০০-১০২ ,বিহার ,৫১ তম খণ্ড ,পৃ.১২-১৫।
৫৫ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৫৫-৫৭।
৫৬ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১০৭।
৫৭ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১০৪-১১৪।
৫৮ । এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৩৩০।
৫৯ । আল কুনী ওয়াল আলকাব ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯১।
৬০ । তিনি ইমাম মাহদী (আ.) এর প্রথম প্রতিনিধি।
৬১ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ২৫।
৬২ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৪৩।
৬৩ । রেসালেয়ে ইমামত ,৩য় অধ্যায় ,পৃ. ২৫।
৬৪ । কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৩৭।
৬৫ । কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৪২।
৬৬ । আ ’ য়ানুশ শিয়া ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ১৫।
৬৭ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৮২।
৬৮ । আ ’ য়ানুশ শিয়া ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ২১।
৬৯ । মুনতাহাল মাকাল ,আল মাহ্দী ,পৃ. ১৮১।
৭০ । আ ’ য়ানুশ শিয়া ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ১৬।
৭১ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৬।
৭২ । বিহারুল আনোয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৪।
৭৩ । প্রাগুক্ত ।
৭৪ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৮১ ,বিহার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৬।
৭৫ । আনওয়ারুল বাহীয়াহ্ ,পৃ. ৩২৪।
৭৬ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৫-৩৪৬ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২১৬ ,২১৯।
৭৭ । তৌকিয়া হচ্ছে ইমামে জামান (আ.) এর কাছ থেকে তার অনুসারীদের কাছে আসা চিঠি।
৭৮ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৯ ,কামালুদ্দিন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ১৮৮ ,হাদিস- ৩৮।
৭৯ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৯।
৮০ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৯-৩৫০ ,কাশফুল গুম্মাহ ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ৪৫৭।
৮১ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫১।
৮২ । প্রাগুক্ত ।
৮৩ । মুসতাজার রোকন ইয়ামানী ও কা ’ বার সামনে অবস্থিত সেখানে গোনাহ্গাররা আশ্রয় নেয়।
৮৪ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫১।
৮৫ । আল কুনী ওয়াল আলকাব ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ২৬৭-২৬৮।
৮৬ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ২৬৮।
৮৭ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫৪-৩৫৫ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ৩২৬-৩২৭।
৮৮ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫২।
৮৯ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৫৩-৩ ৫৪।
৯০ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৫৪।
৯১ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫৬ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২২৭।
৯২ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৫৯ ,আল কুনী ওয়াল আলকাব ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯১।
৯৩ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড পৃ. ৩৫৮ ,৩৬০।
৯৪ । মুনতাহাল মাকাল।
৯৫ । আল কুনী ওয়াল আলকাব ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ২৩১ ,বিহার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৬১।
৯৬ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৪২-২৪৩।
৯৭ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১ তম খণ্ড ,পৃ. ৩৬০।
৯৮ । এ দুটি আলামত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আবির্ভূত হওয়ার আগে প্রকাশিত হবে।
৯৯ । বিহারুল আনওয়ার ,৫২তম খণ্ড ,পৃ. ৩৬১ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৪২-২৪৩ ।
১০০ । আ ’ য়ানুশ শিয়া ,পৃ. ১৯৩।
১০১ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩৬২।
১০২ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৮২-১৮৩।
১০৩ । ইহতিজাজ ,পৃ. ২৮৩।
১০৪ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৮২-১৮৩।
১০৫ । ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ্ ,পৃ. ৪৯৩।
১০৬ । বিহারুল আনওয়ার ,৫২তম খণ্ড ,পৃ. ১২২।
১০৭ । আল মাহ্দী ,পৃ. ২০১-২০২।
১০৮ । ইমামের অপেক্ষায় ,পৃ. ৫৪।
১০৯ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৭২।
১১০ । সূরা বাকারা ,আয়াত নং- ৩০।
১১১ । উসুলে কাফি ,১ম খণ্ড ,পৃ. ১৯৩।
১১২ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৭৮ ,হাদিস- ২।
১১৩ । প্রাগুক্ত ,১ম খণ্ড ,পৃ. ১৭৮ ,হাদিস- ৮।
১১৪ । সুরা আম্বিয়া ,আয়াত নং- ৭২।
১১৫ । সুরা সেজদাহ্ ,আয়াত নং- ২৪।
১১৬ । ইসলামে শিয়া মাযহাব ,পৃ. ২৬০।
১১৭ । ইসলামে শিয়া মাযহাব ,পৃ. ৩১২-৩১৩।
১১৮ । মুনতাখাবুল আছার ,পৃ. ২৭১।
১১৯ । কামালুদ্দিন ,১ম খণ্ড ,পৃ. ২৬৫।
১২০ । আল মাহ্দী ,পৃ. ১৭৮-১৭৯।
১২১ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৭০।
১২২ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৭২ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩১২।
১২৩ । প্রাগুক্ত ।
১২৪ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৭৮-১৮০ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩১৬-৩১৭।
১২৫ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৭০-১৭১ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩১০-৩১১।
১২৬ । বিহারুল আনওয়ার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩২৮।
১২৭ । মুহাম্মদ আলী ইবনে হুসাইন ববাভেইয়ের সন্তান। তিনি ইমামে জামান (আ.)-এর দোয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আর পরবর্তীতে তিনি শেখ সাদুক (রহঃ) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
১২৮ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ১৮৮ ,বিহার ,৫১তম খণ্ড ,পৃ. ৩২৪-৩২৫।
১২৯ । এলামুল ওয়ারা ,পৃ. ৪২৫।
১৩০ । নাজমুস সাকিব ,পৃ. ২০৯-২১১।
১৩১ । প্রাগুক্ত ।
১৩২ । ইসালাতুল মাহদাভীয়াত ,পৃ. ৭০।
১৩৩ । ইমাম আসকারী (আ.)-এর হারাম শরীফ সংলগ্ন একটি জায়গা যেটি ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারী (আ.) ঘরের নিচে অর্থাৎ ভূ-গর্ভস্ত ঘর বিশেষ সময়ে যেখানে ইমাম মাহ্দী (আ.)-কে দেখা গিয়েছিল।
১৩৪ । আব্বাসীয় খলিফা ,সে ৬২৩ থেকে ৬৪০ হিজরী পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।
১৩৫ । নাজমুস সাকিব ,পৃ. ২৩১-২২৮।
১৩৬ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৬৩।
১৩৭ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৫৫।
১৩৮ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৮৩।
১৩৯ । প্রাগুক্ত।
১৪০ । গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৬১-২৬২।
১৪১ । কামালুদ্দিন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ১৬০ ,হাদিস-৪।
১৪২ । মুনতাহাল আমাল ,দ্বাদশ ইমামের জীবনী ,পৃ. ১০৬ ,১০৭ ,ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৯০-৩৯১ ,কিফায়াতুল মুয়াহহিদীন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৮৪২-৮৪৪ ,রওজায়ে কাফি ,পৃ. ৩৬-৪২ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫২তম খণ্ড ,পৃ. ২৫৪।
১৪৩ । মুনতাহাল আমাল ,দ্বাদশ ইমামের জীবনী ,পৃ. ১০২ ,১০৩ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৬৫-২৮০ ,ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৯৮ ,৪১৮ ,গাইবাতে নোমানী ,পৃ. ২৪৭-২৮৩ ,এবং এ সম্পর্কিত অন্য রেওয়ায়েতগুলি এই বইয়ের ১৪তম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ,কিফায়াতুল মুয়াহহেদীন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৮৪১-৮৪২ ,রওজায়ে কাফি ,পৃ. ৩১০ ,হাদিস ৪৮৩ ,পৃ. ৩১০ ,হাদিস ৪৮৩ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫২তম খণ্ড ,পৃ. ১৮৬ ,২৩৬-২৩৯।
১৪৪ । মুনতাহাল আমাল ,দ্বাদশ ইমামের জীবনী ,পৃ. ১০৩ ,১০৪ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫৩তম খণ্ড ,পৃ. ১৫ ,১৬ ,কিফায়াতুল মুয়াহহেদীন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৮৪২ ,৮৪৩।
১৪৫ । মুনতাহাল আমাল ,দ্বাদশ ইমামের জীবনী ,পৃ. ১০২ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৭৪ ,ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৪২৪ ,গাইবাতে নোমানী ,পৃ. ২৫৭ ,হাদিস ১৪ ,১৫ এবং এ সম্পর্কিত অন্য রেওয়ায়েতগুলি এই বইয়ের ১৪তম অধ্যায়ে ,কিফায়াতুল মুয়াহহেদীন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৭৪০ ,রওজায়ে কাফি ,পৃ. ২০৯-২১০ ,হাদিস ২৫৫ ,পৃ. ৩১০ ,হাদিস ৪৮৩ ,বিহারুল আনওয়ার ,৫২তম খণ্ড ,পৃ. ১৮১-২৭৮।
১৪৬ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩৯৯।
১৪৭ । প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৪।
১৪৮ । ইসবাতুল হুদাত ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৪৩১।
১৪৯ । বিহারুল আনোয়ার , ৫২তম খণ্ড ,পৃ. ২৭৯ ,২৮৩ ,৩০৫-৩০৭ ,৩১০ ,৩১১ ,৩৪০ ,৩৪৬ ,৩৫২ ,৩৫৪ ,৩৬০ ,৩৬১ ,৩৬৪ ,৩৬৭ ,৩৬৮ ,৩৭৮ ,ও ৫৩ খণ্ড ,পৃ. ১২ ,ইকমালুদ দ্বীন ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৩৬৭ ,৩৬৮ ,কাশফুল গুম্মাহ , ৩য খণ্ড ,পৃঃ- ৩৬০-৩৬৩ ,৩৬৫ ,ইরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃঃ- ৩৪১-৩৪৪ ,গাইবাতে নো ’ মানী ,পৃ. ২৩১ ,২৩৩ ,২৩৪ ,২৩৮ ,২৪৩ ,২৮১-২৮২ ,গাইবাত ,শেখ তুসি ,পৃ. ২৮০-২৮৬ ,মুনতাখাবুল আছার ,পৃ. ৪৮২।
১৫০ । ইকমালুদ দ্বীন ও ইতমামুন নেয়ামাত ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৩৪২।
১৫১ । ইকমালুদ দীন ও ইতমামুন নেয়ামত ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৩৫২।
১৫২ । মাফাতিহুল জিনান ,শবে কদরের আমল অংশে।
১৫৩ । আল ইহ্তাজাজ ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২৮৪।
১৫৪ । ইমামের অন্তর্ধানের সময় তার পক্ষ থেকে যে সকল চিঠি ও নির্দেশনা শিয়াদের কাছে এসেছে যা শিয়া আলেমদের লেখা বইগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে তাকে তৌকি ’ য়াত বলা হয়।
সুত্রঃhttp://alhassanain.org/bengali/?com=book&id=33
ক্যাটেগরি:
ধর্ম
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৮