আগের পর্বের লিংকঃ
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (ক)
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (খ)
দুই. (ক)
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের হলরুম, রাঙ্গামাটি!
টেবিলের উপরে কাঁচের পিরিচ ঢেকে রাখা পানিভর্তি স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস হতে, এক চুমুকে অর্ধেক পানি সাবাড় করে বাকী অর্ধেক পানি সমেত গ্লাসটি সেমিনারে অংশগ্রহনকারীদের দিকে তুলে ধরে আবারও তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন যুলকারনাইন ইসলাম। তার অর্ধেক পানি ভর্তি গ্লাস উঁচু করে ধরা দেখে সেমিনারে অংশগ্রহনকারীগন পাহাড়ী যুবক-যুবতীদের অনেকেই ভেবেছিলেন খুব সম্ভবত তিনি এবার গ্লাস অর্ধেক শূন্য কিংবা অর্ধেক পূর্ন টাইপ কোন প্রশ্ন করে বসবেন। উপস্থিতিকে কিঞ্চিৎ হতাশ করে দিয়ে সেই প্রশ্নে না গিয়ে, মুখে ঈষৎ হাঁসি ঝুলিয়ে যুলকারনাইন ইসলাম জিজ্ঞেস করে বসলেন, "আমি যে পানি ভর্তি গ্লাসটি ধরে রয়েছি, সেটির ওজন কেউ বলতে পারবেন?" তার এমন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ হতভম্ভ হয়ে পরে পুরো ক্লাস। আর যাই হোক এমন একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তারা। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, ইতি-উতি দেখে কেউ কেউ অবশ্য বলছিলেন, দুইশ গ্রাম-আড়াইশ গ্রাম-তিনশ গ্রাম-চারশ গ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি! প্রায় আট-দশ জন হতে উত্তর নেবার পর যুলকারনাইন বলা শুরু করলেন, "আমার কাছে এই গ্লাসের সঠিক ওজন কোন মূল্য রাখে না বরং এখানে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল ঠিক কতটা সময় আমি এটি ধরে রাখতে পারছি। আমি যদি গ্লাসটি এক মিনিট কিংবা দুই মিনিট ধরে রাখি তবে এটা মোটামুটি হালকা আমার কাছে! আমি যদি এটিকে বিরামহীন ভাবে এক ঘন্টা ধরে রাখি তবে এটি আমার হাতে ব্যাথা তৈরি করতে পারে। আবার যদি আমি বিরামহীন ভাবে পুরো একদিন এই অর্ধ পানির গ্লাস আমার হাতে ধরে রাখি তবে আমার হাতে প্রচন্ড ব্যাথা হবে, হাত অনুভূতিহীন ঠেকতে পারে এমনকি প্যারালাইজড পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এখানে একটা বিষয় খেয়াল করবেন, গ্লাস ধরে রাখবার প্রত্যেকটা সময়ের ক্ষেত্রে এখানে গ্লাসের ওজনের কোন তারতম্য হয় নাই বরং পরিবর্তন হয়েছে সময়ের দৈর্ঘের। সময় যত দীর্ঘ হয়েছে গ্লাসের ওজন ততই ভারী ঠেকেছে এবং পরিণামে তা ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে।
আপনাদের জীবনের দুঃখ, ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, হতাশা, দুশ্চিন্তা, টেনশন কিংবা চাপ এসকল বিষয়ও এই অর্ধ পানি ভর্তি গ্লাসটির মতই। খুব সামান্য সময় সেগুলো নিয়ে যখন আপনি ভাবছেন তখন সেগুলো আপনাকে কোন পীড়াই দিতে পারেনা। আপনার ভাবনা, অনুশোচনা, পরিতাপ কিংবা টেনশনের মাত্রা যখন সামান্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে তখন সেটা পীড়ায় পরিণত হচ্ছে আর যখন সেই দীর্ঘায়িত সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তখন সেটি আপনার জন্য শুধু পীড়া নয় বরং দীর্ঘ এক যন্ত্রনা বয়ে নিয়ে আসতে পারে, মুহুর্তেই শেষ করে দিতে পারে আপনার জীবনকে। প্রিয় অংশগ্রহনকারীবৃন্দ, একারনেই আমাদের জীবনের দুঃখ, ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, হতাশা, দুশ্চিন্তা, টেনশন, চাপ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ঝেড়ে ফেলে দেয়া খুব জরুরী। সেগুলো হতে উত্তরনের উপায় নিয়ে ভাবা যেতে পারে সামান্য কিছু সময় কিন্তু পরের দিন পর্যন্ত সেটি বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে রীতিমত আত্মঘাতী।"
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী যুবক-যুবতীদের জন্য টানা দুই ঘন্টা ব্যাপি সাইকো-সোস্যাল সাপোর্টের লেকচার প্রায় শেষের দিকেই ছিল। শেষ বারের মত যুলকারনাইন ইসলাম তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে অংশগ্রহনকারীদের উদ্দেশ্যে তার সহজাত এবং সাবলীল ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলেন, "এ্যনি কোয়েশ্চেন! মাই ডিয়ার পার্টিসিপেন্টস?" হলরুমের চেয়ারগুলোর শেষ সারি হতে দুই সারি সামনের চেয়ারে বসা হ্যাংলা-পাতলা একজন পাহাড়ী যুবক কতকটা ভয় আর সংকোচ মিলিয়ে হাত তুলে বসে। তার ভীত হাত তোলা দেখে যুলকারনাইন তাকে উৎসাহ যুগিয়ে প্রতি উত্তর করে, জ্বি প্লিজ! আপনার প্রশ্ন বলুন। 'স্যার আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?'- হ্যাংলা-পাতলা একজন পাহাড়ী যুবকের এমন প্রশ্নে রীতিমত হকচকিয়ে যায় যুলকারনাইন ইসলাম কারন ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস আদৌ আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর যে তার কাছেও নেই এবং এই সময় এমন প্রশ্নের জন্য কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলনা সে! নিজেকে যথা সম্ভব সামলিয়ে নিয়ে পাহাড়ি যুবককে তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সামনে থাকা টিস্যু বক্স হতে একটা টিস্যু পেপার হাতে নিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে, যুলকারনাইন পাল্টা প্রশ্ন করে বসে- "মনোঃসামাজিক সহায়তার ক্লাসে আপনার হঠাৎ এমন প্রশ্ন মনে আসবার কারনটি কি আমি জানতে পারি?" জুলকারনাইনের পাল্টা প্রশ্নে বেশ ঘাবড়ে গেলেও ছেলেটি তার চোখ এবং মুখের অভিব্যাক্তি অবিচল রেখেই উত্তর করে, "স্যার আমি বিশ্বাস করি! ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিংবা অস্তিত্বহীনতাকে প্রমান করবার জন্য বিজ্ঞানের সর্বোত্তম শাখাটিই হলো পদার্থ বিদ্যা। অন্য কোন শাখা দিয়ে এত সুনিপুন ভাবে এটি প্রমান করা সম্ভব নয়। আর আপনার সম্পর্কে আমি যতদূর জেনেছি, পদার্থ বিদ্যা আর হিউম্যান সাইকোলজি এই দুইয়ে আপনার জ্ঞানের পরিধি অগাধ এবং দুটোর সংমিশ্রন ঘটিয়ে আপনি অনেক বড় বড় রহস্যের উন্মোচন করেছেন।"
পাহাড়ি যুবকের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য যুলকারনাইন রুপপুরের মহামায়া আশ্রমে হারিয়ে গিয়েছিল, যেখানে বন্ধুবর শ্রী শ্রী নারায়ন গোস্বামী তাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বোঝাতে গিয়ে মহা বিস্ফোরনের তিন মিনিট সময়, এটম আর এনার্জির চির অস্তিত্ব বুঝিয়েছিলেন। "ভুল বলেছি স্যার!"- এমন শব্দে যুলকারনাইনের ঘোর কাটে। আবারও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, "দেখুন! এই মহাবিশ্ব একটা অদ্ভুত জায়গা এবং মানুষ এখানে নিরন্তন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বে তার অবস্থান বুঝে উঠবার জন্য। তবে এটা সত্য! বিজ্ঞান মতে এই মহাবিশ্ব তৈরি করবার জন্য কোন স্রস্টার প্রয়োজন নাই। এটা বিজ্ঞান বলছে, আমি বলি নাই কিন্তু!" যুলকারনাইনের উত্তরে যুবকটি যে খুশি হতে পারে নাই সেটা তার চোখ মুখের অভিব্যাক্তি দেখেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল! অসন্তোষ মাখা চোখ মুখ নিয়ে সে আবারও জিজ্ঞেস করে, "কিন্তু স্যার! পদার্থ বিদ্যা শুধু বলছে, শক্তির সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস নেই......!"
জুলকারনাইন জানে পাবলিক পরিসরে ঈশ্বর সংক্রান্ত এমন কথাবার্তা বেশ ঝুকিপূর্ন এবং সাইকো-সোস্যাল সাপোর্ট ক্লাসে তো পুরোপুরি নিষিদ্ধ সে বিষয়ক আলোচনা। ছেলেটিকে তার প্রশ্ন আর না বাড়াতে দিয়ে হাসতে হাসতে তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনার নাম কি?" ছোট্ট করে ছেলেটি উত্তর করে, "জ্বি! অংসাথুই মারমা!" নিজের নাম বলবার সাথেই সে তার সম্পুরক প্রশ্ন জুড়ে দেয়, "আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন স্যার?" ছেলেটির প্রশ্নগুলো যেমন পাবলিক পরিসরে ঝুকিপূর্ন ছিল তেমনি তা ভরা মজলিসে যুলকারনাইনের জানাজানির পরিধিকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল! ছেলেটি নিতান্তই চালাক এবং সে জানে যুলকারনাইন এখন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। যদি উত্তর না দেয় তবে যে মানুষগুলোকে সে এতক্ষন কাউন্সেলিং করল সেগুলো তাদের নিকট মূল্যহীন হয়ে যাবে। কতকটা বিরক্ত হয়ে যুলকারনাইন তাকে উত্তর করে,"শোন ছেলে! এই ঈশ্বর এবং ভূত মানুষের ভয় এবং অনিশ্চয়তা হতে উৎপন্ন। প্রতিটা মানুষ নাথিংনেস তথা তার অস্তিত্বহীনতাকে ভয় পায়! আর এই অস্তিত্বহীনতার ভয় হতেই জীবনের পরবর্তী জীবন, আত্মা, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি ধারনা গুলো চলে আসে। পৃথিবীতে হাজারো ধর্ম, বিশ্বাস, ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারনা রয়েছে। এর মাঝে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা কিংবা আদৌ কিছু রয়েছে কিনা আমার জানা নেই।" অংসাথুই আরও কি যেন বলতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে, ধন্যবাদ জানিয়ে হল রুম ত্যাগ করে যুলকারনাইন।
(চলবে)