ছবিঃ dissociative identity disorder
আগের পর্বের লিংকঃ
কর্ণ পিশাচিনী! পর্বঃ এক (ক)
সেনাবাহিনীর কর্তাব্যাক্তি এবং ইউএনও ঘটনাস্থল হতে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে স্থান ত্যাগ করলে, থানার দারোগা দেয়ালটির লেখাগুলো পানি দিয়ে মুছে দেবার আদেশ দেন। তার আদেশ শুনে উপস্থিত সকলে ভূত শোনার মত চমকে ওঠেন। কারবারী, হেডম্যান, উপস্থিত জনতা দারোগার এমন হুকুমে ভীত হয়ে যে যার মত দ্রুত স্থান ত্যাগ করা শুরু করেন। 'রোওয়াশ্যাংমা' দেবী'র অভিশাপ নিজ কাঁধে কে-ই বা নিতে চায়। সদ্য যৌবনে পদার্পন করা যে যুবকটি অন্যদের মত পালিয়ে না গিয়ে একা দাঁড়িয়ে সেখানে ওসি সাহেবকে এমন কাজ করতে বারবার নিষেধ করছিল, সে ছিল 'অংসাথুই মারমা'। অংসাথুই মারমা ওসি সাহেবকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্ঠা করছিল, তদন্তের স্বার্থে হলেও এটি মুছে ফেলা এখন যৌক্তিক হবে না। ওসি সাহেবকে সে আরও সময় নেবার অনুরোধ করে, কিন্তু ওসি অনড়! তার এক কথা, “ওসব ভূত-প্রেত, দেব-দেবী'র কোন কারবার নেই এখানে। এই লেখনি এলাকার মানুষের মনে ভীতি তৈরি করছে, সেটা মুছে ফেলাই উত্তম। আপনি বাসায় যান, সরকারী কাজে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে। সরকারকে সরকারের কাজ করতে দিন!"
ভয় বস্তুটা সংক্রামক! ব্যাক্তি হতে ব্যাক্তিতে সংক্রমিত হতে সময় নেয় না। ওসি সাহেবের সাথে করে আসা পুলিশ সদস্যরা পাহাড়ি না হলেও, পাহাড়িদের ভাবগতি তাদের মধ্যেও ভীতির সঞ্চার করে। হয়তোবা চাকুরী হারানোর ভয়ে তারা পাহাড়ীদের মত দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে পারছিলেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারাও ঘামছিলেন। ওসি সাহেবের হুংকারেও কোন কাজ হল না, ঘটনাস্থলে তারা নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন। উপায় না দেখে ওসি সাহেব অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে নিজেই দেয়ালে কয়েক বালতি পানি মেরে কিছু অংশ পরিস্কার করে তার জীপে উঠলেন আর বাকীরা তাকে অনুসরণ করলেন!
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অংসাথুই মারমা, দাঁত মাঁজার উদ্দেশ্যে একটা নিম গাছের ডাল ভেংগে হাতে নিয়েছে আর ওমনি চিৎকার শুনতে পায়, 'দেয়াল মা অরলে খবর লাঃ রে'! দেয়ালে আবারও খবর আসবার খবর পেয়ে গায়ে জামা না জড়িয়েই অংসাথুই দৌড় দিয়ে দেওয়ালের সামনে গিয়ে দেখে কিছু মানুষ জটলা পাঁকিয়ে দেয়ালে সিজদা করছে, পুজা দিচ্ছে। ভীর ঠেলে সামনে গিয়ে সে দেখে, ওসি সাহেবের আগের দিন দেয়ালে পানি দিয়ে পরিস্কার করা লেখা অংশগুলো আবারো এমন ভাবে ফুটে উঠেছে যেন কিছুই হয়নি সেখানে, কেউ মোছার কোন চেষ্ঠাই করে নাই কখনো। একেবারে নিচের দিকে আবারও নতুন কয়েক লাইন লেখা হয়েছে সেই দেয়ালে এবং সেই কাটা মাথা আর সিদূর দিয়ে রক্তের ছবি রয়েছে শেষে। অর্থ্যাত আজ আবারও কেউ না কেউ খুন হবে! প্রশ্ন হচ্ছে কে খুন হবে?
দেয়ালে খবর আসার খবরটা পুরো এলাকায় চাউর হতে খুব বেশী সময় নেয় না। সতর্কতা হিসেবে হেডম্যানের আদেশে পাড়ায়-পাড়ায় কারবারীগন পাহাড়া বসানোর ব্যবস্থা করেন আর এই দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয় পাড়ার যুব কমিটির উপর। তারা প্রত্যেক ঘরে জানিয়ে দিয়ে আসেন আজ রাতে কেউ যেন ঘর হতে না বের হয়। পাড়ায় ঢোকার রাস্তায় রাস্তায় তারা দশ-বার জনের দল হয়ে হাতিয়ার সমেত পাহাড়ায় বসে যায়। অনেক কারবারী 'খ্যংশ্যামা' দেবীর পুজা দেয়া শুরু করেন, কেউ বা তাদের পূর্ব পুরুষদের আবার কেউ কেউ 'রোওয়াশ্যাংমা' দেবী'র।
পুরো ইউনিয়নের গ্রামগুলো একভাবে নিশ্চিদ্র নিরাপত্ত্বা নিশ্চিত করে একটা কালো রাত্রী পার করে। তবু অভিশাপ পিছু ছাড়ে না তাদের! পরদিন সকালে, শ্মশানে আবারও একটা অজ্ঞাত কাটা মুন্ডু পাওয়া যায়। ফ্যাঁকাসে হয়ে যাওয়া মুন্ডুর পরিচয় শনাক্ত করতে করতে খবর আসে, গতদিনের আগের দিন থানা সদর হতে তদন্তে আসা ওসি সাহেবকে নিজ বাসায় খুন করে খুনী তার মাথা কেটে নিয়ে চলে গিয়েছে।
ওসি সাহেবের সাথে সেদিন তদন্তে আসা বড় কর্মকর্তাগন ওসি সাহেবের এমন নির্মম হত্যাকান্ডের খবরে বেশ ভীত হয়ে গা ঢাকা দিলেও, প্রশাসনের এমন একজন কর্তাব্যাক্তি খুন হওয়ায় রীতিমত মরিয়া হয়ে ওঠে প্রশাসন। অভিযান চালিয়ে ইউপিডিএফ, জেএসএস, স্যাটেলার মিলিয়ে সন্দেহভাজন প্রায় ২৫-৩০ জন সদস্য এবং নেতা গোছের মানুষকে গ্রেফতার করে তারা। রাস্তায় রাস্তায় চলতে থাকে পুলিশ টহল, সন্দেহ ভাজন যাকেই দেখছিলেন তাকেই পুলিশ ভ্যানে তুলছিলেন তারা।
ওসি সাহেবের মাথা কাটা যাওয়ার পর পাহাড়ীদের মাঝে দেবী 'রোওয়াশ্যাংমা'র রূষ্ঠতা নিয়ে আর কোন প্রশ্নই থাকেনা। পাড়ায়-পাড়ায়, ঘরে-ঘরে 'রোওয়াশ্যাংমা' আর 'খ্যংশ্যামা' দেবীর পুজা চলতে থাকে বেশ জোড়ে-সোরে, ঘটা করে। শত পুজা-অর্চনার পরেও দেবীগন বোধ করি তুষ্ট হন নাই! শ্মশানে কাটা মাথার মিছিল বাড়তে থাকে! বারো থেকে তেরো! চৌদ্দ! পনেরো!
গ্রেফতার, তদন্ত, টহল কোন কিছু করেই প্রশাসন কোন কুল কিনারা করে উঠতে না পারলেও, তারা পাহাড়ীদের সুরে সুর মেলাতে নারাজ ছিল! তাই তো তারা খুনির পিছে হন্যে হয়ে ঘুরছিল কিন্তু কোন সূরাহা করে উঠতে পারছিল না। প্রশাসনের মত করে আরেকজন মানুষ ছিল যে তার স্বগোত্রীয়দের মত করে চিন্তা করতো না বরং এই ঘটনার পেছনে একটা যৌক্তিক কারন খুঁজে চলত সারাটা সময়, সে ছিল অংসাথুই মারমা!
(চলবে)