ছবিঃ dissociative identity disorder, ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত!
পাহাড় আর মারমা কমিউনিটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে নজরবন্দী সিরিজের দ্বিতীয় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখছি। নাম এখনও কনফার্ম কিছু নয়, ব্লগে খন্ড খন্ড করে প্রকাশ করবার আশা রাখছি।
এক.
(ক)
জমাদ্দার টিলার নিচে আরেকটা লাশ পাওয়া গিয়েছে!
ঠিক লাশ বললে ভুল হবে বরং একটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া কাটা মাথা পাওয়া গিয়েছে বলাই শ্রেয়! মাথার আশে পাশে কলিজা আর ফুঁসফুঁস যন্ত্র সদৃশ কিছু অংগ প্রত্যঙ্গও ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। বাকী পুরো শরীর ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত। আশে পাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও, কাটা মাথার বাকী শরীরের কোন হদিস পাওয়া যায় নাই।
এ আবার নতুন কি! এমন ঘটনা তো বিগত কয়েক মাস ধরে হর হামেশাই ঘটে চলছে জমাদ্দার টিলার নিচে কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষা শ্মশান অংশটায়। মাথা পাওয়া যায় শ্মশানে আর খুবলে কলিজা, ফুঁসফুঁস বের করে নেয়া বাকী শরীর পাওয়া যায় দূরে অন্য কোন স্থানে। কে করছে? কেন করছে? কিভাবে করছে? কিছুই জানা নেই! শুধু জানা আছে, এমন লাশের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রশাসন নির্বিকার! নির্বিকার থানা পুলিশ সকলেই। আর নির্বিকার না থেকেই বা করবে কি? কোন স্বাক্ষী নেই! প্রমান নেই! আলামত নেই! যার উপর ভিত্তি করে তারা অপরাধী শনাক্ত করবেন। এলাকাবাসীও এমন সব ইঙ্গীত দিচ্ছেন, যা ধরা-ছোয়ার বাইরে তো অবশ্যই! একই সাথে সে সব গাঁজাখোরী গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিরা।
স্বাক্ষী-প্রমানহীন প্রশাসন নির্বিকার থাকলেও, আজকের খুনের ঘটনার খবর পেয়ে উপজেলা সদর হতে বেশ সকাল-সকাল সেনাবাহিনীর বড় দুই জন অফিসার, ইউএনও, থানা থেকে বড় দারোগা নিজে এবং তাদের সাথে পাঁচ-সাত জন পুলিশ সদস্যও এসেছেন ঘটনা পরিদর্শনে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে অপরাধ অঞ্চলের সব কিছু নিরীক্ষা করছেন তারা। আর তাদের সেই নিরীক্ষায় সংগ এবং দরকারী সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন মৌজার হেডম্যান, ছিংমং গ্রামের কারবারী এবং ওয়াজ্ঞা ইউনিয়ন পরিষদের দুইজন মেম্বার। এই ক'জন ব্যাক্তি ছাড়া সরকারীভাবে ঘটনাস্থলে তথা শ্মশানে জনসাধারনের প্রবেশাধিকার বেশ কড়া ভাবেই ক্ষুন্ন করে রাখা হয়েছে।
উৎসুক এবং একই সাথে আতংকিত জনতা সরকারী নিষেধ সীমারেখা অতিক্রম না করে, ঘটনাস্থল তথা শ্মশান হতে কিঞ্চিত দূরে জমাদ্দার টিলার পাদদেশে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। মোটামুটি বেশ বড়-সড় একটা জমায়েত-ই বলা চলে। উপজেলা সদর হতে কর্তাব্যাক্তিদের সাথে করে আসা পুলিশ সদস্যরা বেশ দক্ষ হাতেই সেই ভীর সামলাচ্ছেন। জন-সাধারনের কাউকেই তারা নিষেধ সীমা অতিক্রম তো করতে দিচ্ছেন-ই না একই সাথে মাঝে মাঝে তাদের হাতে থাকা প্রমান সাইজের লাঠি শূন্যে ঘুড়িয়ে বিপথগামীদের দু একজনের পিঠে দু এক ঘাঁ বসিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কার্পন্য করছেন না। লাঠির ভয়ে ভীত হয়েই হোক আর অন্য যে কারনেই হোক, নিরাপদ দূরত্ব জারি রাখা এই জনতার ভীরে যে প্রশ্নটি বারংবার ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটি ছিল- "এগারো নম্বরে এবার তবে কার মাথা কাটা গেল?"
ফ্যাঁকাসে হয়ে যাওয়া কাটা মাথা দেখে তাৎক্ষণিক লাশ সনাক্ত করা না গেলেও, চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা'র বাড়ি হতে যখন খবর আসলো যে গত রাতে খোদ চেয়ারম্যান-ই খুন হয়েছেন তার নিজ বাড়িতে এবং খুনী তার মাথা কেটে নিয়ে চলে গিয়েছে! তখন শ্মশানে পড়ে থাকা কাটা মুন্ডুটার পরিচয় নিয়ে কোন প্রশ্নের আর অবকাশ থাকেনা। চেয়ারম্যানের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শোনার জন্য উৎসুক জনতা একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। অকস্মাৎ এমন খবরে, একটা অজানা আশঙ্কা তাদের চোখে মুখে প্রচন্ডভাবে ধরা পড়ে। এই শঙ্কা হতে পারে চেয়ারম্যানের সাথে তাদের নৈকট্য, আন্তরিকতা কিংবা নিজেদের নিরাপত্তা প্রশ্নে। যেখানে চেয়ারম্যানের নিজের জীবনেরই কোন নিরাপত্তা নেই সেখানে তারা তো আমজনতা। কাটা মস্তকের পক্ষে যেহেতু ঘটনা সবিস্তারে বর্নন সম্ভব নয় সেহেতু পুরো ঘটনা স্ববিস্তারে জানবার নিমিত্ত্বে কৌতুহলী এই জনতা খুব দ্রুত কাটা মাথার স্থান তথা শ্মশান ত্যাগ করে কাটা শরীর অংশের দিকে তথা চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা'র মৃত্যু সংবাদটা শ্মশানে কর্তাব্যাক্তিদের সাথে অবস্থান করা ওয়াজ্ঞা ইউনিয়নের হেডম্যান, ছিংমং গ্রামের কারবারী এবং উপস্থিত মেম্বারগনের নিকট পাহাড়ে হর-হামেশা ঘটে যাওয়া আর দশটা স্বাভাবিক কোন খুনের খবর ছিলনা। এই কদিনে তারা এমন আরো দশটা কাটা মাথা সমেত লাশের স্বাক্ষী কিন্তু কোন মৃত্যুই তাদেরকে এতটা বিচলিত করতে পারেনি যতটা না আজ চেয়ারম্যানের খুনের ঘটনায় তারা হয়েছেন। তারা শুধু বিচলিতই হন নাই বরং সংবাদটা শুনে পুরো ভেংগে পড়েছিলেন। চেয়ারম্যান উশ্যেপ্রু মারমা শুধু সেই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন না বরং এলাকার কিছু মানুষের নিকট তিনি ছিলেন মসীহা স্বরুপ। এলাকার মেম্বার, হেডম্যান আর কারবারী ছিল তার শরীর আর তিনি নিজে ছিলেন মাথা। ইউনিয়নের যে কোন সংকট মোকাবিলায়, উৎসবে কিংবা পার্বনে তিনি এসব মানুষের সাথে শলা-পরামর্শ না করে কোন সিদ্ধান্তই গ্রহন করতেন না এবং গৃহিত প্রতিটি সিদ্ধান্ত হত জনহিতকর! হোক না, সেটা নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করেই না কেনো! এলাকার প্রত্যেকটা মানুষের নিকট তিনি ছিলেন সজ্জ্বন। লোকে বলে, উশ্যেপ্রু মারমা চেয়ারম্যান নয় বরং যাদুকর! যাদুকর না হলে শুধু হাসি দিয়ে কিভাবে তিনি বারবার নির্বাচনে জয়লাভ করেন, এটাও একটা রহস্য! সদা হাস্যময় এই চেয়ারম্যান, সরকার হতে টানা তিন বার দেশের শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের সম্মাননা অর্জন করেছেন। পাহাড়ে যেখানে বিশৃঙ্খলা, খুন, ধর্ষন, হত্যা, লুটপাট নিত্য-নৈমত্যিক ঘটনা সেখানে তিনি তার এলাকায় পাহাড়ি-সেটেলারদের যেমন এক সূতায় বেঁধে রাখতে পেরেছিলেন, তেমনি নির্মূল করতে পেরেছিলেন পাহাড়ী উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোকেও।
বিগত পাঁচ মাসে, চেয়ারম্যান সহ একই উপায়ে মোট এগারোটি খুন হয়ে গেল! খুনগুলো যে নিছক খুন নয় বরং এর সাথে অতি-প্রাকৃতিক কোন শক্তি জড়িত, সে বিষয়টি থানা সদর হতে আসা কর্তাব্যাক্তিরা মানতে নারাজ! কারবারীর এমন দাবীর প্রেক্ষিতে ইউএনও সাহেব তো বলেই বসলেন, "কোন জমানায় বাস করছেন আপনারা? সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে গেল আর আপনারা কোথায় পড়ে রইলেন বলেন দেখি! খোঁজ নিয়ে দেখেন ইউপিডিএফ কিংবা জেএসএস এর কারো সাথে আপনাদের চেয়ারম্যানের কোন দ্বন্দ্ব ছিল কিনা! পাহাড়ে খুন হতে তো আর সময় লাগেনা।" ইউএনও সাহেবের এমন মন্তব্যে হেডম্যান, কারবারী কিংবা মেম্বারগন কিঞ্চিৎ বিব্রত হলেও তারা নাছোড় বান্দা। এগারো নম্বর খুন এবং এর পূর্বে বাকী দশটি খুনের সাথে যে অবশ্যই অতি প্রাকৃতিক কোন শক্তি জড়িত তা বোঝাতে, কর্তা ব্যাক্তিদের জমাদ্দার টিলার অপর পার্শ্বে তথা রাস্তা সংলগ্ন অংশে তারা তাদের নিয়ে আসেন, যেখানে পাহাড় হতে গড়িয়ে আসা আপদ হতে পথচারী এবং পথে চলাচলকারী যানবাহনের সুরক্ষার্থে সেনাবাহিনী একটি প্রকান্ড প্রাচীর গড়ে দিয়েছে। চুনকাম করা প্রকান্ড সেই দেয়ালের সামনেও ছোট্ট একটা জটলা। কেউ কেউ পুজা দিচ্ছিলেন, কেউ প্রণাম করছিলেন আর কিছু মানুষ দেয়ালের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আগ্রহ ভরে কি যেন বুঝবার চেষ্ঠা করছিলেন। বোঝাবুঝিতে রত জটলা অংশটার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অংসাথুই মারমা নামক তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী এক মারমা যুবক।
আসুন স্যার! সাবধানে আসুন স্যার! সম্বোধন করে কারবারী এবং হেডম্যান, জটলাটিকে একপাশে ঠেলে নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তা-ব্যাক্তিবর্গকে একেবারে দেয়ালের সামনে নিয়ে এসে দেয়ালের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলে অংসাথুই মারমা, হেডম্যানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিজে থেকেই বলা শুরু করেন, “এই খুনগুলোকে কোন জাতিগত কিংবা পাহাড়ি দাংগার ফসল হিসেবে দেখবেন না স্যার! প্রত্যেকটা খুনের আগে এখানে একটা করে মানুষের খুন হবার ছবি আঁকা হয়েছে এই দেয়ালে। গুনে দেখেন স্যার! এগারোটা কাটা মুন্ডুর ছবিই আছে। শেষ ছবিটা গতকাল আঁকা হয়েছে, এর আগের দিন পর্যন্ত দশটা মুন্ডু আঁকা ছিল।"
উপজেলা শহর হতে তদন্তে আসা কর্তাব্যাক্তিরা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে দেখেন, চুনকাম করা প্রকান্ড সেই দেয়ালে কাঠ-কয়লার সাহাজ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় একটার পর একটা লাইন! ঠিক লেখা নয়, কতকটা আঁকিবুঁকি! আবার কতকটা লেখা। এগুলো শব্দ নাকি চিত্র? নাকি চিত্র-শব্দ! পুরো চিত্র-শব্দ গুলো কয়লার সাহাজ্যে লেখা হলেও, মাঝে মাঝে সিদূরের সামান্য ব্যবহার রয়েছে। সিদূরের ব্যবহার রয়েছে শুধু সেই জায়গা গুলোয় যেখানে একটা করে কাটা মস্তকের ছবি আঁকা রয়েছে। কাটা মস্তক হতে ফোঁটাফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়বার চিত্রই শুধু সিদূরে রঙে আঁকা হয়েছে। গুনে দেখলে বাস্তবিক এমন কাটা মস্তক আর সিদূরে রঙের রক্তের ব্যবহার পুরো দেওয়াল জুড়ে মোট এগারো বার-ই খুঁজে পাওয়া যায়।
উপস্থিত জনতার অনেকেই বলছিলেন, পাড়ারক্ষী দেবী 'রোওয়াশ্যাংমা' কোন কারনে তাদের প্রতি ভীষন রুষ্ঠ হয়েছেন বিধায় আজ একটার পর একটা এভাবে মানুষ খুন হয়ে চলছে। না জানি! এরপর দেবী কাকে নেবেন? ইউএনও সাহেব নিজ মোবাইল ফোনে, দেওয়ালে লেখা বিচিত্র শব্দগুলোর ছবি তুলতে তুলতে হেডম্যানকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন, "এগুলো আপনাদের পাহাড়ী কোন সম্প্রদায়ের লেখন পদ্ধতি নয় তো!" গলায় আত্মবিশ্বাসের স্বর অটুট রেখে হেডম্যান উত্তর করেন, "না স্যার! পাহাড়ী কোন সম্প্রদায়ের লেখা এমন নয়।" উপস্থিত জনতার হৈ-চৈ বেড়ে গেলে, ইউএনও উপস্থিত জনতাকে কুসংস্কার হতে বের হয়ে আসবার অনুরোধ করে বলেন, "এখানে দেবী রুষ্ট হবার কিছু নেই। আমাদের দেবী এত নিষ্ঠুর নন! আমরা প্রশাসন তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি! অপরাধী যেই হোক না কেন, অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার করা হবে। আপনারা নির্ভয়ে থাকুন, বাসায় যান।"
(চলবে)