গত পর্বে বলছিলাম চালনা বন্দরের কথা, যেখানে একসময় অনেক বড় বড় দেশী বিদেশি জাহাজ পন্য খালাশ আর পন্য বোঝাইয়ের অপেক্ষায় নোঙ্গর ফেলে ঠায় দাড়িয়ে থাকত আজ সেখানে দু একটা ছোট ছোট জাহাজ আর ডিঙ্গি/ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আর রয়েছে একটা ছোট্ট জেটি ঘাট।
ছোট্ট জেটি ঘাট যেখান থেকে ছোট ছোট কিছু লঞ্চ ছেড়ে যায় খুলনা এবং কয়রার উদ্দেশ্যে
দীর্ঘদিন পূর্বে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই চালনারও একটা টগবগে যৌবন ছিল কিন্তু ‘সারভাইবাল ফর দ্যা ফিটেস্ট’ নামক তত্ত্বের আওতায় সেই চালনা আজ জ্বরা-মৃতপ্রায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরপর, সমসাময়িক কোরিয়ান যুদ্ধের সমাপ্তিতে সারা বিশ্বে প্রচুর পরিমান পাট এবং পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা অনুভূত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আমদানী-রপ্তানী সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে অধিক মনযোগি হয়ে ওঠে। তখন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর একমাত্র এবং সীমিত আমদানী ও রপ্তানীর স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। পাকিস্তান নেভীর সী-ইন-সী অ্যাডমির্যাতল জেফোর্ড দ্বিতীয় একটি সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব চরম ভাবে অনুভব করতে থাকেন এবং পি এন এস ঝিলাম ও জুলফিকার নামক নেভী কর্মকর্তার সাথে পশুর নদীতে ৬০ কিলোমিটার ঘুরে ঘুরে অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমানোর লক্ষে ‘চালনা’ কে নতুন একটি চ্যানেল হিসেবে আবিস্কার করে ফেলেন। ডিসেম্বর ১, ১৯৫০ হতে ‘চালনা বন্দর’ পাকিস্তান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রলায়ের অধীনে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কার্যক্রম শুরু করে। ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৫০ ‘City of Lyons’ নামক একটি ব্রিটিশ পন্যবাহী জাহাজ চালনা বন্দরে প্রথম নোঙ্গর ফেলার মাধ্যমেই জমজমাট হতে শুরু করে চালনা বন্দর। শুরুর দিক থেকে চালনা বন্দরে কার্গোর নোঙ্গর সংক্রান্ত সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিতে থাকে। ১৯৫৩ সালের দিকে স্যার ক্লদ ইংলিশ নামক জনৈক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেল সার্ভে করতে আসলে একই সাথে তিনি পশুর-শিবসা চ্যানেল সার্ভে করে চালনা বন্দরে নোঙ্গর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হিসেবে বন্দরটি মংলায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। এবং তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০ জুন, ১৯৫৪ তে সমুদ্র বন্দরটি চালনা হতে মংলায় স্থানান্তরিত করা হয়।
দাকোপ উপজেলা মানচিত্র
সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপ উপজেলাটি মূলত তার ভৌগলিক অবস্থানের কারনে ত্রিখন্ডিত অর্থ্যাত ঝপঝপিয়া, ভদ্রা, শিবসা, ঢাকি, চুনকুড়ি , পশুর ইত্যাদি নদী দ্বারা তিনটি পৃথক পৃথক দ্বীপে বিভক্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ এর দশকে ৩১ ৩২ ও ৩৩ পোল্ডার নামে এই দ্বীপ ৩টির নামকরন করে। দাকোপ সদর উপজেলা পানখালী ও তিলডাংগা ইউনিয়ন নিয়ে ৩১ নং পোল্ডার, কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন মিলে ৩২ নং পোল্ডার আর দাকোপ, লাউডোব, কৈলাশগঞ্জ, বানীশান্তা ও বাজুয়া এই ৫টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে ৩৩ নং পোল্ডার গঠিত যার মানচিত্রে স্থলভাগের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। দাকোপ এলাকাটি পূর্বে ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। কালক্রমে এই জঙ্গল কেটে আবাদী জমিতে পরিণত করে বসতি স্থাপন শুরু করা হয়। জনশ্রুতিতে জানা যায় যে, এখানকার ঝোপ-জঙ্গল দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মূল করা হয়। তাই এখানকার নামকরণ করা হয় দাকুপী। পরবর্তীতে দাকুপী নামের কিঞ্ঝিৎ সংশোধন হয়ে দাকোপ নামে পরিণত হয়। উপজেলাটিতে ৯ টি ইউনিয়নে প্রায় ১০৭ টি গ্রাম।
পুরো উপজেলার যেদিকে তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি। এ যেন পানির রাজত্ব, আর এই পানির রাজত্বে সুপেয় পানির-ই তীব্র হাহাকার। এ যেন মানুষের সাথে বিধাতার অদ্ভুত এক প্রহসন। খাবার পানির প্রধান উৎসই হল এখানে বৃষ্টির পানি এবং পুকুর। কিন্তু আইলা পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ পুকুর-ই লবণ পানিতে নষ্ট হয়ে যাবার কারনে এলাকার পানির প্রধান উৎস এখন বৃষ্টির পানি আর নদী। দু-একটা নদীতে পানি ছয় মাস নোনা এবং ছয় মাস মিষ্টি থাকার কারনে এলাকার কিছু কিছু বাড়ির নলকূপের পাইপ গিয়ে ঠেকেছে নদীতে এবং সেই পানি ফিটকিরির সাহাজ্যে বিশুদ্ধ করে চলে পানাহারের কাজ।
পলিব্যাগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন পদ্ধতি
মাটির পাত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন পদ্ধতি
এই অঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত বৃষ্টির পানি মাটিতে, বড় মাটির পাত্র পুতে অথবা বড় পলিব্যাগে সংরক্ষন করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সামান্য অবস্থা সম্পন্ন মানুষেরা বড় প্লাস্টিকের ট্যাংকে (গাজী, মদিনা, অন্যান্য) বর্ষাকালে পানি ধরে রাখে এবং সারা বছর সেই পানি খাওয়া এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করে। কিছু কিছু এন জি ও থেকেও এই ট্যাংক গুলো এখন দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরন করা হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতি পুরোপুরি ঘরে টিনের চালার উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল।
(চুনকুড়ির গর্ভে চলে যাওয়া পোদ্দারগঞ্জ খেয়াঘাট সংলগ্ন বাজারসহ কয়েক শত বিঘা জমি, ঘর, বসতি)
খাবার পানির সমস্যার থেকে দাকোপের মানুষেরা যে সমস্যায় সব থেকে বেশি সর্বশান্ত হয় তা হল নদী ভাঙ্গন। নদী ভাঙ্গন যেন এই অঞ্চলের নিত্য- নৈমত্ত্বিক ঘটনা এমনকি দাকোপের প্রানকেন্দ্র পোদ্দারগঞ্জ খেয়াঘাট সংলগ্ন বাজার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সবটুকু প্রায় চুনকুড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। উপকুল রক্ষায় সরকারের বিস্তর বিস্তর আয়োজন চোখে পড়লেও সেগুলো যে আদৌ কোন কাজে আসে না তা প্রথম নজরেই বোঝা যায়।
যাই হোক, যেমনটা বলছিলাম যে আমার গন্তব্য হল দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের ভিটাভাঙ্গা গ্রামে অর্থ্যাত ৩২ নং পোল্ডার নামক দ্বীপের একটি ইউনিয়নে যেখানে কিনা সর্বনাশা আইলা তার সর্বশক্তি লাগিয়ে দিয়ে সর্বশান্ত করে দিয়েছিল পুরো জনপদ।
(কামারখোলা ইউনিয়ন মানচিত্র)
৩২ নম্বর পোল্ডারের সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন দুটি মূলত একটি দ্বীপ এলাকা। এর চারদিক ঘিরে রয়েছে শিবসা, ঢাকি ও ভদ্রা নদী। এটি উপকূলীয় এলাকার সবচেয়ে দক্ষিণের জনবসতির একটি যার দক্ষিণে রয়েছে সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশের একটি দুর্গম এলাকা হিসেবও পরিচিত। উপজেলা সদরের সঙ্গে এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বরাবরই নাজুক।
(শিবসা, পশুর, ঢাকী তিন নদীর মোহনা)
দাকোপ থেকে কিছুদূর এসে, ৩২ নম্বর পোল্ডারের পথে যেতে পাওয়া যাবে শিবসা, পশুর আর ঢাকী এই তিন নদীর মোহনা। আর এই মোহনা পার হতে হবে ছোট্ট একটা ট্রলারে। পার হতে হতে দেখা মিলবে ভুস করে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাওয়া কিছু ডলফিনের। আসলে দক্ষিনের এই অংশটা এক সময় ডলফিনের অভয়ারন্য হিসেবে বিবেচিত থাকলেও সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে ডলফিনের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে এলাকাবাসীরা জানার এবং একই সাথে কিছু অসাধু ব্যাক্তি যারা হঠাত কোথা থেকে দুটো বড় বড় ইঞ্জিলচালিত বোট নিয়ে দ্রুত গতিতে হাজির হয়ে দ্রুততার সাথে ডলফিন শিকার করা জাল পেতে খুব দ্রুত জাল গুটিয়ে চলে যায়। তারা কি পরিমান ডলফিন শিকার করে তাতক্ষনিক জানা না গেলেও ডলফিনের সংখ্যা যে কমে আসছে তা এলাকাবাসীরা অনুধাবন করতে পারেন।
(গন্তব্য নদীর ওপারে ৩২ নং পোল্ডারের দ্বীপ, কামারখালী ইউনিয়ন)
(ঘাট দিয়ে উপরে উঠলেই মূল ভূখন্ড)
(উপরে উঠেই দেখা মিলবে ছোট একটা বাজারের)
বাজারে দু একটা ছোট ছোট দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। যানবাহন হিসেবে দু একটা মোটর সাইকেল এবং নসিমনের দাড়িয়ে থাকার দেখা মিললেও সভ্য জগত থেকে যে খানিকটা দূরে চলে এসেছি তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
(এই রাস্তাটিই আমাদের নিয়ে যাবে ভিটা ভাঙ্গা গ্রামে)
মূলত কামারখোলা বাজারে প্রবেশ করা মাত্র ভিন্ন এক অনুভূতি মনে কাজ করা শুরু করে দেয়। সব কিছু মিলিয়ে কেমন যেন এক ধরনের উত্তেজনা-ভয় মাখানো অনুভূতি। নতুন একটা গন্ধ হুট করেই নাকে এসে হানা দেয়। কেমন জানি মাতাল করে দেয়া।
(রাস্তার ধারে ধারে গজিয়ে ওঠা গোল গাছ, সুন্দরবনের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়ে দেয়)
কিছুদূর গেলেই গন্ধ আর উত্তেজনা-ভয় মাখানো অনুভূতির বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায় কারন আমরা ততক্ষনে সুন্দরবন এলাকায় প্রবেশ করে ফেলেছি যার প্রমান হল রাস্তার ধারে ধারে গজিয়ে ওঠা গোল গাছের সগৌরব উপস্থিতি।
(চলবে)
অ টঃ গতকাল হতে অনেকগুলো ছবির কারনে পোস্টটি পাবলিশ করতে বেশ ঝামেলা হচ্ছিল, পরবর্তীতে সুমন কর তার সাহাজ্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াতে আজ পোস্টটি আলোর মুখ দেখল। সুমন কর-এর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৫