যখন ঢাকা শহরে থাকতাম তখন আমার একটা ভটভটি (মোটরসাইকেল) ছিল। প্রতি শুক্রবার সেটায় করে অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যেতাম। আমি বলতাম মিসিং ফ্রাইডে। খুলনা শহরে এসে ভটভটিটাকে যদিও খুব মিস করি তবু আমার ঘোরাঘুরি থামে নাই। চেষ্টা করি এই পাড়া সেই পাড়া ঘুরে বেড়াতে। আমার সহকর্মী কামাল ভাই যাকে অবশ্য আমি পাগলা কামাল নামেই চিনি, ভদ্র লোকের জানাজানির প্রশংসা অবশ্যই করতে হবে তিনি গত দুইদিন আগে আমার রুমে এসে আমাকে তার এমফিল গবেষনায় সামান্য সাহাজ্যের জন্য তার সাথে তার গবেষনা এলাকায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে বসলেন। এবং তাকে সামান্য সাহজ্য করা ছাড়াও কেন আমার সেই গ্রামে যাওয়া দরকার তার রীতিমত ফিরিস্তি হাজির করলেন। প্রথমে তিনি আমাকে গবেষিত গ্রামের একটা ম্যাপ একে দেখালেন।
কামাল ভাই-র হাতে আঁকা গ্রামের ম্যাপ
ম্যাপ আকার পর তিনি যে তথ্যগুলো হাজির করলেন তা রীতিমত ভয়ানক। আমার জন্য ভয়ানক তো বটেই, আমি একে নাচুনে বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি। কামাল ভাই যে গ্রামের কথা বলছিলেন সেই গ্রামের নাম 'ভিটাভাঙ্গা'। গ্রামটি খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কামার খোলা ইউনিয়নে অবস্থিত। দাকোপ উপজেলাটি হল আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা। আর এই উপজেলার সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলোর একটি হল এই 'ভিটাভাঙ্গা' গ্রাম। গ্রামটিকে ক্ষতিগ্রস্থ বলার সাথে তিনি এটিকে একইসাথে চরম দূর্যোগ প্রবন হিসেবেও দাবী করছেন, কারন গ্রামের অবস্থান। গ্রামটি মোটামুটি শিবশা, পশুর, ঢাকী সহ আরো দু একটা বড় নদীর মোহনায় অবস্থিত। একই সাথে এই বড় বড় নদীগুলোর পতিতস্থল তথা বঙ্গোপসাগরও গ্রামটি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সুন্দরবন, সাগর আর কয়েকটা বড় নদীর মোহনা, আইলা ইত্যাদি শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। কামাল ভাই-র সাথে চুক্তি হল সকল খরচ সে বহন করবে, আমি তাকে তার কাজে সাহাজ্য করব একই সাথে নিজের কাজও (ফুডু তুলা) করব বিনিময়ে সে আমাকে গ্রামটির পাশে অবস্থিত সুন্দরবনের একটা ফরেস্ট অফিস তথা নলিয়ান ফরেস্ট-এ নিয়ে যাবেন। যাই হোক দিন গুনতে লাগলাম, কবে শুক্রবার আসবে।
শুক্রবার সকাল ৬ টা ৩০ এ আমরা দুভাই একটা মোটর সাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
ডেভেলপমেন্ট আর অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে করতে পৌছে গেলাম পানখালি ঘাটে।
এটা মূলত ৩ টা নদীর মোহনা। একটা রুপসা, একটা শিবসা আর একটা পশুর (নামে ভূলও হতে পারে)
নদীর উপর দিয়ে তার ঝুলিয়ে অপর প্রান্তে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে আর তারে উপরে দেয়া হয়েছে সিগন্যাল। সি-প্লেনের ল্যান্ডিং এর সময় যেন বিদ্যুতে তারের উপর এসে না পরে তাই এই ব্যবস্থা।
গল্প করতে করতে কখন চালনা বাজার এসে গেছি জানিনা, যদিও আমি চিনি না কিছুই।
চালনা বন্দর নিয়ে যখন ছোট বেলায় পড়েছিলাম তখন মনে হত না জানি কি এক বিশাল সমুদ্র বন্দর। কিন্তু এখন সেই চালনা বন্দর শুধুই লঞ্চ ঘাট। একটা জেটি আর দু একটা ছোট জাহাজ ছাড়া কিছুই নেই।
চালনা লঞ্চ ঘাট
ঘাটে ঢুকতেই চোখে পড়বে এই ভাসমান ডিজেলের দোকান, পেট্রল পাম্প কতকটা। ট্রলার গুলো যেন ভাসতে ভাসতেই তেল নিতে পারে তাই এই ব্যবস্থা।
এক সময় এখানে অনেক বড় বড় শিপ ঢুকত কিন্তু এখন ছোট ছোট দু একটা মালবাহী জাহাজ, ডিঙ্গি আর লঞ্চ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
এই জাহাজটায় বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়া দুই দেশের পতাকা দেখে কামাল ভাইকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন এই জাহাজ এখান থেকে পন্য নিয়ে কুড়িগ্রামের ধরলা, ব্রহ্মপূত্র দিয়ে ইন্ডিয়ার উড়িষ্যা চলে যায়। যতক্ষন এটা বাংলাদেশের জলসীমায় চলে ততক্ষন এটার নিয়ন্ত্রনে থাকে বাংলাদেশী চালক আর ইন্ডিয়ার জলসীমায় ঢুকলেই ইন্ডিয়ান চালক এর দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সময় লেগে যায় ৫ থেকে ৭ দিন।
এটা চালনা মেরিন প্রোডাক্টসের অফিস। এখানে সামুদ্রিক বিশেষত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
এই লাল গালিচা আমাদের নিয়ে যাবে একেবারে দাকোপ উপজেলায়, কিন্তু সেখানে উপজেলার আর কোন কিছুই অবশিষ্ঠ নেই পুরো উপজেলা এবং তার সেটাপ পশুর নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবার কারনে এখন দাকোপ উপজেলা সেটাপ চালনাতে তৈরি করা হয়েছে।
দূরে যে টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছে তার আগের অংশ ছিল পুরো দাকোপ উপজেলা, কিন্তু সর্বনাশা পশুর পুরোটাই তার গর্ভে নিয়ে ফেলেছে।
দাকোপের নামকরনের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে বলতেই আমরা একটা ঘাটে এসে পৌছে গেলাম। নদীর নাম ঢাকী।
মোটামুটি তিন বড় নদীর মোহনা এটা। শিবসা, পশুর আর ঢাকী। এই নদীর বিশেষত্ব হল, এখানে প্রচুর ডলফিন রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় এদের শুশুক বলে। নদী পাড় হবার সামান্য সময়টুকুতে আমি বেশ অনেক গুলোই ডলফিন দেখতে পেয়েছিলাম কিন্তু আফসোস, একটা ডলফিন ও আমাকে ছবি তোলার সময় টুকু দেয় নাই। তবে ছোট ছোট ডলফিনের ভীরে ফেরার পথে খুব কাছ থেকে বেশ বড় এক মা ডলফিন ও তার বাচ্চাকে ভেসে উঠে হারিয়ে যাবার দৃশ্য কখনোই ভূলতে পারবো না। স্থানীয় লোকেরা বলেন, এখানে আসলে কেউ ডলফিনদের বিরক্ত করে না তবে মাঝে মাঝে কোথা থেকে বড় বড় কয়েকটি ইঞ্জিন সম্বলিত দ্রুতগতির দুটি বোট এসে একবার ঝুপ করে ডলফিন ধরার জাল ফেলে সেই জাল তুলেই, কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তারা কারা, কি পরিমান ডলফিন শিকার করে এসব জানার অবকাশ দেয় না।
নদীর ওপারে কামারখালী ইউনিয়ন। চারদিকে বড় বড় নদী বেষ্টিত এটা আসলে একটা দ্বীপ। আয়তনে ৫/৬ শ বর্গ কিলোমিটারে কম হবে না। আমাদের গন্তব্য আসলে ওটার শেষ প্রান্তের গ্রামটায়, যেটাকে সর্বনাশা আইলা করে গিয়েছে ক্ষত-বিক্ষত।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৫