বনজীবীদের জন্য আমি সব সময় চরম এক ধরনের টান অনুভব করে চলি। তাদের দুঃসাহসিক এবং রোমাঞ্চকর জীবন আমাকে খুব বেশি কাছে টানে। মাঝে মাঝে বনজীবী হয়ে সুন্দরবনের এই খাল সেই খালে মাছ ধরে বেড়ানোর চরম ইচ্ছাটাকে দাবিয়ে রাখতে পারিনা। কিন্তু জঙ্গলে যাওয়া অনেক বেশি রিস্কি একটা কাজ। আর তাই জঙ্গলে না যেতে পারলেও আমি বারবার ফিরে যাই তাদের কাছে। শুনি জঙ্গলের গল্প, তাদের সুখ দুঃখ আর হাসি কান্নার গল্প। যেন তারা পরম আত্মীয়।
বনজীবীদের নিয়ে পূর্বের হিজিবিজি লেখাগুলো পড়তে পারেনঃ
বনজীবিদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না-শেষ পর্ব
বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না
বনজীবীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-পর্ব তিন
উপরোক্ত লেখাগুলো ছিল খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন অংশের উপর নির্ভর করে লেখা। কিন্তু এবার আর কয়রা না, এবার গিয়েছি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দরবন অংশে। চলুন তাহলে ঘুরে আসা যাকঃ
খুলনা থেকে মুন্সীগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে গেলে শ্যামনগর পর্যন্ত বাসে ডিরেক্ট যাওয়া যেতে পারে। তারপর শ্যামনগর থেকে বাকীটুকু ভটভটি, নসিমন অথবা বাসে। আর খুলনা থেকে লোকাল বাসে যেতে চাইলে তা হবে রীতিমত আত্মঘাতি। ঠিক কবে পৌছাবেন তার দিনক্ষন বলে উঠা বেশ মুশকিল। তাই এই অঞ্চলে যাবার সব থেকে ভাল একটা উপায় হল একটা ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়া। ব্যাক্তিগত গাড়িতে খুলনা থেকে যেতে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা লাগবে।
মুন্সীগঞ্জ বাজারটা খুব বেশি বড় নয়। একটা বাস স্ট্যান্ড আর কিছু দোকান। এই বাজারের সব থেকে আকর্ষনীয় হল বাজারের পাশে সুন্দরবন ঘেষা ছোট নদীটা আর নদীর ওপারে সুন্দরবন। মূলত সুন্দরবনের অনেক গুলো অংশের, একটার শুরু এখান থেকেই।
বাজারে নেমে হালকা চা-বিস্কিট অথবা মিষ্টি খেয়ে নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া আর তেমন কিছু পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। আর খুব খুধা লেগে গেলে হারুনের হোটেল তো রয়েছেই। হারুনের হোটেলে দক্ষিনের বিভিন্ন মাছের সাথে জঙ্গলের নদীর বিভিন্ন মাছ ও রান্না হয়। সব থেকে অসাধারন রান্না হয় কাইর মাগুর নামক মাছটা। কাইর মাগুর মাছটা কতকটা বিদেশী মাগুর মাছের মত দেখতে, সুন্দর বনের নদীতে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। অনেক টেস্টি একটা খাবার।
যাই হোক, তবে আমাদের গন্তব্যের শেষ কিন্তু এখানেই নয়। যেতে হবে বনজীবীদের গ্রাম, মীরগাং এ। মুন্সীগঞ্জ থেকে ভাঙ্গা রাস্তা পথে প্রায় আরো ৮/১০ কিলোমিটার। আমার পরামর্শ হল সাথে করে নিয়ে আসাটা গাড়িটা এখানে রেখে দিয়ে একটা ভাঁড়ায় চালিত মোটর সাইকেল নিয়ে নেয়া। গর্ত ভর্তি রাস্তায় গাড়ির চাকা একবার দেবে গেলে সেই গাড়ি ই তখন নিজের ঘাড়ে উঠে যাবে।
চিত্রঃ হরিনগর বাজারের পেছন থেকে সুন্দরবন
চিত্রঃ হরিনগর বাজারের পেছন থেকে সুন্দরবন
মীরগাং যাবার আগে পথে পড়বে ছোট্ট একটা বাজার হরিনগর। এই বাজার থেকেই মোটামুটি সুন্দর বনের চমৎকার একটা ভিউ পাওয়া যায়। বাজারের পেছনে নদী আর নদীর ওপারে সুন্দরবন। হরিনগর বাজার থেকে আমাদের যেতে হবে সুন্দরবন বাজার। সুন্দরবন বাজারের পাশেই বনজীবীদের গ্রাম মীরগাং।
মীরগাং ঢুকতে হবে আমাদের এমন একটা ইট বিছানো/ কাঁচা রাস্তা ধরে। এটা আসলে ওয়াপদার একটা বাঁধ এবং একই সাথে রাস্তা।
মাঝখানে নদী, নদীর একপাশে সুন্দরবন আর অপর পাশে বনজীবীদের গ্রাম। গ্রাম, নদী আর জঙ্গল যেন মিলে- মিশে একাকার।
গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে অসংখ্য রকম এমন বাক্স রাস্তার পাশে পড়ে আছে আর সেগুলো কে ঘিরে মৌমাছিরা ভন ভন করে চলেছে। এটা আসলে মধু চাষের একটা পদ্ধতি। বাক্সের মধ্যে কিছু মধু রেখে জঙ্গলের মৌমাছিদের এখানে আকৃষ্ট করা হয় এবং পরবর্তীতে ঐসব মৌমাছিরা জঙ্গল থেকে দলে দলে মৌ নিয়ে এসে এখানে তাদের চাক তৈরি করে। একভাবে কৃত্রিম মধুচাষ আরকি।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই গ্রামে বাঘের উপদ্রপ বেশ ভালই ছিল। নদী পাড় হয়ে বাঘেরা লোকালয়ে চলে আসত। এসে গরু, ছাগল এমনকি মানুষ পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাবার নজির রয়েছে। আর তাই বাঘের এই উপদ্রপ ঠেকাতে তথা বাঘ যেন নদী পাড় হয়ে লোকালয়ে চলে না আসতে পারে তার জন্য কারিতাস নামক এন জি ও থেকে ওয়াপদা বাঁধ তথা রাস্তার পাশ ধরে নেটের বেড়া দেয়া হয়েছে সুরক্ষা হিসেবে।
পথে চলতে চলতে দেখা মিলবে দু একজন বনজীবী ছায়ায় বসে বেশ আয়েশ করে তাদের স্বাধের নৌকা বানিয়ে চলেছেন সাধ্যমত। নৌকাটি ই তাদের সহায়, সম্বল এবং অন্ন যোগানদাতা। নৌকা নিয়ে তারা ভেসে পড়ে সুন্দরবনের এই খাল সেই খাল। এক গোন (১৫ দিন), দুই গোন। গোনের পর গোন।
সুন্দরবনের নদীর পাশে ফাকা অংশে এদের অনেকে আবার কাঁকড়া চাষ করেন। চাষের প্রতিটা অংশকে একেকটা পয়েন্ট বলে। কাঁকড়া চাষীরা সুন্দরবন থেকে বনজীবীদের ধরে নিয়ে আসা ছোট কাঁকড়া কেজি দরে কিনে নিয়ে এই পয়েন্টে চাষ করেন।
ছোট কাকড়ার বাচ্চাটি অনেক বড় হয় আর সেই সাথে বৃদ্ধি পায় তার দাম। এদের বেশির ভাগই আবার প্লেনে চড়ে পাড়ি দেয় সুদীর্ঘ পথ।
মনের মিল হলে বনজীবীদের কেউ আপনাকে দাওয়াত ও দিতে পারেন। কাঁকড়া খাবার দাওয়াত। বনজীবীর স্ত্রীর হাতে সত্যি যাদু আছে। সেই রান্না করা কাকড়ার স্বাদ এখনো জ্বিভে লেগে আছে যেন। বনজীবির স্ত্রী সব থেকে ভাল বানান কাকরার কোপতা কিন্তু তা খাবার সৌভাগ্য আমার হল না।
সুন্দরবনের সব থেকে পরিচিত একটা ফল হল কেওড়া ফল। কিন্তু সাবধান! কেওড়া ফল আনতে যেন আবার জঙ্গলে যাবেন না। কারন জঙ্গলে গেলেই বিপদ। কোথাও না কোথাও হয়তো বা ঘাপটি মেরে বসে আছে বাঘ মামা। বাঘের থেকে বেশি ভয় হল ডাকাতদের। তারা বাঘের থেকে বেশি হিংস্র। সুন্দরবনের এই অংশটুকুতে প্রায় ৭/৮ টা ডাকাত দল রয়েছে। বনজীবিদের মুক্তিপনের রেট হিসেবে তারা ২০ হাজার টাকা করে নিলেও আপনার আর আমার জন্য হেকে বসবে কয়েক লক্ষ্য টাকা এবং সাথে মারধোর ফ্রি। মুক্তিপন নামক এই অভিশাপ থেকে রেহাই পাবার জন্য বনজীবীদের কার্ড করতে হয়। প্রতি কার্ডে একটা নাম্বার দেয়া থাকে। সেই কার্ড দেখালে ডাকাত দল আর কিছু বলে না। সমস্যা হল একটা কার্ড দেখিয়ে এক দলের কাছে নিরাপত্তা পাওয়া যায় কিন্তু অন্য দলগুলোর হাতে পড়লে আবারো বিপদ। ডাকাত দল গুলো যে শুধু এদেশীয় তা নয়। ৮ কিলোমিটার পর ভারতী সীমান্ত হওয়ার কারনে ভারতীয় ডাকাত দল ও এই অঞ্চলে অবলীলায় চলে এসে তাদের ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে। মাঝে মাঝে আবার বাংলাদেশ ভারত মিলে যৌথ দল তৈরি হয়।
আমার পূর্বের পোস্টগুলোতে যেমনটা বলেছিলাম, জঙ্গল হল পবিত্র এক স্বত্ত্বা। এখানে নারীদের যাওয়া নিষেধ। এই নিষেধাজ্ঞা এই অঞ্চলেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলা হয়। নারীরা ঘরের কাজ করে। জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা দ্রব্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে। কেওড়া ফল শুকিয়ে রাখে ভবিষ্যতের জন্য।
চিত্রঃ বর্ষা রিসোর্ট
যাই হোক এবার ফেরার পালা, সন্ধ্যার পর কক্ষনোই এখানে অবস্থান করবেন না। ফিরতি পথে খুব খুধা লেগে গেলে মুন্সীগঞ্জে হারুনের হোটেল তো রয়েছেই। এখানে যদি রাতে থেকে যেতে চান তাহলে থাকার মত চমৎকার দুটো জায়গার একটি হল, সুশীলন নামক এন জি ও র গেস্ট হাউস (টাইগার পয়েন্ট) এবং বর্ষা রিসোর্ট। টাইগার পয়েন্টে আমার যাওয়া হয় নাই তবে বর্ষা রিসোর্ট টা আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। রিসোর্টের ছাদ থেকে আপনি সুন্দরবনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
রিসোর্টের ভেতরের কিছু ছবিঃ
বসার স্থান
রিসোর্টের ভেতরে বাগান
রিসোর্টের দুই পাহাড়াদার
রিসোর্টের বাইরে পুকুর
সব মিলিয়ে আমার কাছে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে রিসোর্টটি।
যাই হোক যদি ইচ্ছা হয় তবে ঘুরে আসতে পারেন, বনজীবিদের ছোট্ট গ্রাম মীরগাং থেকে.............।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৯