আমি আসলে কোন ইতিহাস বেত্তা, অভিবাসন গবেষক অথবা ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান কিংবা অন্য কোন বিষয়ের শিক্ষক নই যে যে মাইগ্রেশন এবং ডায়াসপোরা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্ঞান দিয়ে যাব। আমি খুব সাধাসিধা একজন পাঠক মাত্র আর মাঝে মাঝে যা দেখি, শুনি, বুঝি আমি যা স্বপ্নি তা গল্পে রুপ দিয়ে যাই। আমি জানি অভিবাসন নিয়ে আজকে আমার এই গল্পে অনেক তর্ক, অনেক সমালোচনা থাকবে, কিছু গালা গালি ও থাকতে পারে কিন্তু এই গল্প কাউকে জ্ঞান দেয়ার জন্য নয় এটা দেশ ভাগের ৬৫ বছর পরে বাঙ্গালী তথা বাংলাদেশী মানসিকতার একটা উচ্চারন মাত্র।
দাদার বাবা আমির উদ্দীন যিনি কিনা ইন্ডিয়ার পশ্চিম দিনাজপুরের কোন এক গ্রামে পঞ্চায়েত বুড়া নামে পরিচিত ছিলেন। কারন তিনি সেই গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। তার দুজন স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তান আমার দাদা এবং তার ভাই। দাদার বাবা মারা যাবার পর আমার দাদা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় সাড়ে তিনশত বিঘা (ইন্ডিয়াতে) জমির মালিক হন। তিনি বিয়ে শাদি করেন। ৪৭ এ দেশ ভাগের পর ৬৬ এর দিকে আমার দাদার মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয় চেতনা জেগে উঠে। তিনি এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে হিন্দুস্তান তার নিজের দেশ নয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি বাংলাদেশে মাইগ্রেট করবেন। তিনি বাংলাদেশে তথা দিনাজপুরে আসেন যেখানে তার আত্মীয় স্বজনেরা অনেক আগেই অভিবাসী হয়েছিলেন। দিনাজপুরে এসে তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে জানতে পারেন যে তাদের এলাকার এক হিন্দু ভারতে মাইগ্রেট করতে চায়, তার নাম শীতল ভটরা। দাদা শীতল ভটরার সাথে এক্সচেঞ্জ চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী দাদা তাকে ভারতে ৩০০ বিঘার কিছু বেশি জমি দেন এবং দাদাকে শীতল ভটরা বাংলাদেশে দেন ২২০ বিঘার মত। আমার দাদা স্বপরিবারে ভারত ত্যাগ করেন। শুধু রেখে আসেন আমার দুই ফুপিকে যাদের সেখানেই বিয়ে হয়েছিল। আমার দাদার তিন ছেলে ৫ মেয়ে। ছেলে মেয়েদের মধ্যে আমার বাবা ৬ নম্বর। ছেলেদের মধ্যে আমার বাবা তৃতীয়। বাবা যখন দাদার সাথে বাংলাদেশে আসেন তখন বাবার বয়স১০/১২ বছরের মত হবে। বাংলাদেশে যেই গ্রামে আমার দাদা অভিবাসিত হন সেই গ্রামের সকলেই তার আত্মীয় স্বজন অর্থ্যাত সকলেই ভারত থেকে মাইগ্রেট করে আসেন। এজন্য গ্রামের মধ্যে সমস্যা না হলেও সমস্যা হতে থাকে পাশের গ্রাম গুলো থেকে। মানুষজন একটু অন্য ভাবে দেখা শুরু করে আর যেহেতু আমার দাদাদের অর্থ্যাত সেসময় আমাদের গ্রামের যারা মাইগ্রেট করে এসেছিলেন তাদের অবস্থা বেশ ভাল ছিল তাই অনেকে বাকা চোখে দেখা শুরু করে। এখানে এসে আমার দাদা তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ের বিয়ে আত্মীয়ের মধ্যেই করেন। এর কারন হতে পারে এ দেশীয়রা তাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চাইত না কিংবা আমার দাদা তাদেরকে ভরসা পেতেন না। কিন্তু কিছু দিন পর আমার দাদা খুব বেশি ভাবে ইন সিকিউরড ফিল করা শুরু করেন নানা কারনে। তিনি দেশীয়দের সাথে আত্মীয়তা করতে চান কিন্তু রিফিউজি ট্যাগিং করে দেশীয়রা আত্মীয়তা করতে চাইত না। এরপর পাশের গ্রামে থাকা আমার নানা রাজি হন (তাকে রাজি করানো হয়, তার বাসায় গিয়ে পরে থেকে) তার মেয়ে অর্থ্যাত আমার মায়ের সাথে আমার বাবার বিয়ে দিতে। এই বিয়েটা শুধু একটা বিয়ে ছিল না বরং এটার কারনে আমার দাদা এক ভাবে সিকিউরড ফিল করা শুরু করেন। হাতে একটা শক্তি আসে তার। তিনি ভাবা শুরু করেন এই অপরিচিত দেশে তিনি আর একা নন। এরপর আমার জন্ম হয় আর ঘটনা শুরু হয় আমার এখান থেকেই............... এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার যে আমার একজন চাচা কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার বাবাও নানা ভাবে এটা সেটা নিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহাজ্য করেছিলেন। আমি জানিনা মাত্র ৫ বছরে আমার চাচা কিংবা আমার দাদা (যিনি কিনা মুক্তি যোদ্ধাদের আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন) এই দেশের প্রতি কি এমন টান অনুভব করেছিলেন.........।
আমার জন্মের পর (১৯৮৪) আমি আমার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে ইন্ডিয়ায় তাদের অবস্থা সম্পর্কে শুনতাম। আমার মাঝে মাঝে খুব যেতে ইচ্ছে করত। আমার দেখার ইচ্ছে করত কোথায় আমার বাবার জন্ম, কোথায় সে খেলাধুলা করত কিন্তু সেটা আমার কখনো হয়ে উঠত না। আমার কখনো মনেই হয় নাই যে ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে অভিবাসি হওয়াটা অন্যায়। শুধু যখন আমি আমার নানি বাড়িতে যেতাম তখন বেশ বয়স্ক একজন ভাইয়া এবং আরো দু একজন আমাকে রিফুজি (রিফিউজি) বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করত। কিন্তু আমি কখনোই ক্ষেপতাম না। কারন রিফুজি কথাটার অর্থ টা আমার মাথায় তখনো আসে নাই। আমি শুধু মাকে গিয়ে বলতাম ‘ মা কেন ওরা আমকে রিফুজি বলে’? মা বলত আচ্ছা বলুক। ঠিক সেসময় গুলাতে আমি লক্ষ করা শুরু করি যে আমাদের গ্রামের একটা নাম থাকার পর ও অনেকে সেটাকে বদলী পাড়া হিসেবে ডাকত। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে শুরু করি যে আসলে যারা আমাদেরকে রিফুজি বলে ডাকে তারা নেগেটিভ একটা ট্যাগিং করে আমাদেরকে। আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের এই পাড়া থেকে সেখানকার স্থানীয় রাজনীতিতে কেউ সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করতে পারত না। কোন ধরনের বিচার শালিশ কিংবা অন্য কোন আচার অনুষ্ঠানে আমরা কোন খবর পেতাম না। তাদের সন্তানেরা আমাদের সাথে মিশত না। এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখত সব সময়। স্থানীয় রা আমাদের উপর একভাবে জোড় খাটানোর চেষ্টা করত। এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের থেকে অনেক ভাল থাকার পর ও তাদের সাথে আমাদের কেউ সেভাবে দ্বন্দে জড়াত না ভয়ে, কারন কিছু হলেই তারা একজোট হয়ে চলে আসত। আমি দেখেছি আমাদের গ্রামের মানুষের তথা তথাকথিত ‘রিফুজিরা’ স্থানীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এগুলো ভূলে তাদের সন্তানদের মানুষ করার পেছনে সময় দেয়া শুরু করেন। আমাদের গ্রামে তাদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায় যে কার সন্তান কোথায় পড়াশুনা করে? যেটা স্থানীয় দের মাঝে ছিল না। আমাদের গ্রামের এমন কোন বাড়ি নেই যাদের সন্তানেরা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। ১০০ র মত পরিবারে ৬/৭ জন পি এইচ ডি ডিগ্রি ধারন কারী। বেশ কয়েক ফ্যামিলির ছেলেরা বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেছে এবং করছে।
আমি বড় হলাম। মাস্টার্স শেষ করলাম কোন একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চাকরী ও একটা পেয়ে গেলাম। শুরু হল আমার জন্য মেয়ে খোজা। আমার বিয়ে দেয়া হবে। অনেক মেয়ে দেখলাম আমি। পছন্দ হয় না। পরে যখন একটা মেয়ে আমার পছন্দ হল তখন সমস্যা শুরু হল আমরা রিফিউজি বলে। কোন কিছুতেই মেয়ে পক্ষের কোন সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা ঐ এক জায়গায়। আমরা রিফিউজি। আমাদের সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না। আর এই আপত্তি তুললেন খোদ মেয়ের চাচা যিনি কিনা কোন এক দেশ থেকে ডক্টরেট করে আসা। তিনি নানা ভাবে আমাদেরকে (‘রিফিউজিদেরকে’) ট্যাগিং করা শুরু করলেন। আমরা ওপারে কি ছিলাম তারা জানেন না, রিফিউজিরা অনেক কিপটা হয়, এদের বংশ ভাল না। এরকম নানা অপবাদে আমার বিয়েটা ঝুলে গেল। মেয়ে আমাকেও অনেক পছন্দ করেছে এবং তাকেও আমার বেশ ভাল লেগেছে। দেখা দেখির পর কিছুদিন আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রনয় ও কাজ করা শুরু করে দেয়। কিন্তু বিয়েটা ঝুলে গেল। এক মাসেও তারা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারল না।
এই ছিল আমার পরিবারের অভিবাসন কাহিনী। কিন্তু আমার গল্পের শুরু। এখানে আমি বুঝিনা আমার অন্যায় টা কোথায়? আর এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসি হওয়া কি অন্যায়? আমার দাদা কেন অভিবাসি হয়েছিলেন ইন্ডিয়াতে তার ১০০ বিঘার উপর জমি ছেড়ে দিয়ে? তিনি তো বাংলাদেশে এসেছিলেন স্বজাতিদের টানে!!!!!!! তাহলে কি তিনি অন্যায় করেছিলেন? রিফিউজির সন্তান হয়ে আমাকে আপনারা কিভাবে রিফিউজি বানান? আর যদি বানাতেও চান আমি পরোয়া করিনা। একজন রিফিউজি হিসেবে আমি নিজেকে, নিজের পরিবারের প্রতি গর্ব বোধ করি অন্তত এই ভেবে যে তারা এসেছিলেন স্বজাতির টানে, মাত্র ৫ বছরে আমার ছোট চাচা বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভেবে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনাদের স্থানীয় অনেকেই সেদিন হয়েছিলেন রাজাকার, আল বদর, আল শামস। আপনারা এই ৬৫ বছর পরেও আমাদেরকে গ্রহন করতে পারেন নাই, এটা আপনাদের ব্যার্থতা, আমাদের না।
হবু স্ত্রীর চাচা শুধু নন এখনো অনেকে আছেন (তথাকথিত শিক্ষিত) যারা নিত্য এই চর্চা করে আসছেন। কেন? আমার পরিবার তো ভারত থেকে এসেছে কিন্তু এখন আমরা কি করছি? কোন রকম অস্ট্রেলিয়াতে গিয়া এক খান পি আর জোগাড় করতে পারলে হইছে। তখন কি আপনাদের মনে হয় না আমরাও তো রিফিউজি? আপনাদের বলছি স্মরন আছে বাংলাদেশ থেকে কি পরিমান মানুষ প্রতি বছর ভারতে কাজের খোজে অবৈধ ভাবে মাইগ্রেট করছে। আমি ভারতের পক্ষে কথা বলছি না। কিন্তু ভারত যখন এই মাইগ্রেশন নিয়ে কথা বলে তখন আমরা আমাদের সরকার এর সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। চুপ থাকেন। কোন ধরনের বিধি নিষেধ ও আরোপ করেন না এই অবৈধ মাইগ্রেশনে। কারন সেখান থেকে টাকা আসে। আর যে সকল হিন্দু ৪৭ এর পর বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছেন তারা তো এই সমস্যা ফেইস করছেন না। আমরা কেন করছি এই ৬৫ বছর পরেও?
বাংলাদেশ থেকে একটা ছেলে সামান্য শান্তি নিকেতন কিংবা যাধবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে আমরা তাকে সাবাসী দেই আর বিয়ে দিতে গেলে বলি রিফিউজি।
দিনাজপুর থেকে ভারতে আমার দাদার আদি বাড়িতে যেতে (যদি বর্ডার না থাকত) সময় লাগে আড়াই ঘন্টা। এই আড়াই ঘন্টার ব্যবধানে আমরা আজকেও রিফিউজি..................
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:২৫