somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মায়ের রুমালগুলো

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার মায়ের রুমালগুলো। সাদা জমিনের উপর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ সুতোয় বোনা ফুল-পাখি-পাতাদের নকশা আঁকা স্বর্গীয় রুমালসকল। সুতোয় বোনা টিয়ে, ময়ূর আর নাম না জানা মায়াচোখের একটা হলুদ পাখির প্রতি আমার আশৈশব আকর্ষণ। সে-কী দূর্বার; অপ্রতিরোধ্য টান। হাওয়াই মিঠাইয়ের থেকেও লোভনীয় ছিল সেই স্বর্গীয় রুমালসকল।

রঙীন ফুল-পাখি-পাতাদের বর্ণচ্ছটার চেয়ে বেশি হৃদয়হরণকারী ছিল রুমালের কথাগুলো। অন্তমিল দিয়ে বানানো পদগুলো। আঁকাবাঁকা অক্ষর, একটা-দুইটা ভুল বানান আর লাল-নীল সুতোর দ্যুতিতে সেইসব অক্ষরগুলো হয়ে উঠেছিল মায়াপুরের ভাষা। আমি যার কিছুই বুঝিনি। কিন্তু না বোঝা সেই ভাষার দিকেই ঝুঁকেছি বেবুঝ।



মায়াপুরের ভাষা আর অচিন দেশের ফুল-পাখি-তরু-লতা-পাতা সমেত এইসব রুমালগুলোকে আজন্ম দেখেছি আলমারিবন্দী। কাঠের একটা আলমারি, যেটির নিচের অংশ কাঠের ভারী দুই পাল্লা দিয়ে ঢাকা আর উপরের অংশের তিনটা তাক কাচ দিয়ে ঘেরা। সেই আলমারির নিচের অংশে চোখের আড়ালে এইসব স্বর্গীয় রুমাল বন্দী থেকেছে ঋতুর পর ঋতু। বছরের পর বছর। হঠাত কোনো ঘটনায় বা আমার মায়ের দৈবাত ইচ্ছেয় বা দারুণ বর্ষার পর প্রখর ভাদ্র মাসে সব কাপড় বের করে রোদে দেওয়ার সময় এই রুমালসকল সাময়িক মুক্তি পেয়েছে।

খাটে ছড়ানো রুমালগুলোর গা থেকে ভুরভুর করে বের হতো নেপথলিনের সুবাস। জুলুজুলু চোখে রুমালগুলোর দিকে তাকিয়েছি। একটা আঙুল বাড়িয়ে এক কোণায় ছুয়েঁছি একটা রুমালের একটা কোনো নকশা।

নেপথলিনের সুবাস, সাদা জমিন, রঙিন নকশা, পাখির মায়াবী চোখ আর মায়াপুরের ভাষার দিকে চেয়ে মনে হতো, নিশ্চয়ই এই রুমালসকল স্বর্গলোকের চাবি। এই রুমালে একবার চেপে বসতে পারলে চোখের নিমিষেই এরা হয়ে উঠবে জাদুর গালিচা। মেঘেদের রাজ্য ছাড়িয়ে এই গালিচাসকল আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে পরীর দেশে। লাল-নীল-সাদা-হলুদ পরীরা দুইদিকে ডানা নাড়াতে নাড়াতে জানতে চাইবে আমার খায়েশ। আমি ধরবো মায়াপুরের ভাষা শেখার আব্দার। পরীরা সবিস্তারে বলবে, কতই না কঠিণ সেই ভাষা শিক্ষার পথ; কতই না দুরূহ সেই মায়া-ভাষার্জন।



কিন্তু শৈশবে কোনোদিন রুমালগুলোতে আমার চেপে বসার অপূর্ব সুদিন আসেনি। গল্পের দৈত্য যেমন কৌটোর মধ্যে প্রজাপতি করে ভরে রাখে তার প্রাণ, তেমনি মনে হতো যেনো এই রুমালগুলোর ভেতর আমার মায়ের প্রাণ আঁটা। রোদ-পোহানো রুমালগুলো ভাঁজবন্দী হয়ে আবারো চলে যেতো কাঠের আলমারির ভারী কপাটের আড়ালে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বিভূঁইয়ে আসার পর আমি যখন ছুটি-ছাটায় ফিরে যাই আপন দেশে তখন হঠাত কোনোদিন আমার মাকে বলি, ‘আম্মি, তোমার রুমালগুলো কই? দাও তো একটু।’

আমার মা তার আশ্চর্য রুমালসকল ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে আমার হাতে দিয়েছে বিনা শর্তে, বিনা বাক্যব্যায়ে। বলেনি, ‘নষ্ট কইরো না। ময়লা ভরাইয়ো না।’

আমি রুমালগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। উল্টেপাল্টে দেখি। অন্তমিল দেয়া পদগুলো পড়ি।

আম পাতা চিরল চিরল তেতুল পাতা টক
তোমার সঙ্গে দেখা করার আমার বড় সখ।



রুমালের ছত্রে ছত্রে প্রেম।

গাছ হয়েছে সবুজ পাতায়
ফুল হয়েছে লাল
তোমার আমার ভালোবাসা
থাকবে চিরকাল।

রুমালের ছত্রেছত্রে মায়া।

পাখি যদি চলে যায় রেখে যায় ছায়া
বন্ধু যদি চলে যায় রেখে যায় মায়া।




আমি পদগুলো ফিরে ফিরে পড়ি। এমন সময় আমার মা হয়তো বারান্দায় বা রান্নাঘরে বসে সবজি কাটা-বাছা করতে করতে বলে, ‘তোমারে না বলছি নিয়া যাও। যেইটা পছন্দ সেইটা নিয়া যাও।’

‘নাহ! আমি রুমাল নিয়ে কী করবো! তোমার কাছেই থাকুক।’ উত্তরে এই কথা বলি।

আবার একটু পরে হয়তো বিরতি দিয়ে বলেছি, ‘তুমি এইগুলা বান্ধাইয়া রাখলেই পারো। বান্ধাও না কেন!’

সবজি কাটতে-কাটতে মা বলেছে, ‘বান্ধাইয়া আর কী করবাম! থাউক! ঘরই থাউক।’

মায়ের কথা শুনতে-শুনতে আবার মন দিয়েছি রুমালে। রুমালে দেয়া আছে মায়াপুরের গন্তব্য।

স্মৃতিটুকু দিয়া দিলাম
রাখিও যতনে
ভুলে গেলে ফেলে দিও
গহীন বনে।

সময়ের পরিক্রমায়, মাঝবয়সী আমি যখন বাড়ি যাই, আজও হঠাত কোনোদিন আমার মনে হয় রুমালগুলোর কথা। আমি আমার মা-কে বলি, ‘আম্মি, তোমার রুমালগুলো দেও তো।’



বিনাবাক্যব্যায়ে আমার মা রুমালগুলো দেয়। দিতে দিতে বলে, ‘তোমারে না কইছি এইগুলা নিয়া যাইতে। তুমি এইগুলা লইয়া যাও।’

‘নাহ। থাক। বাসায় থাক।’ এইটুকু বলতে-বলতে আমি মন দিই রুমালে, মায়াপুরের ভাষায়।

যাও পাখি বনধুর কাছে
যেয়ে দেখো সে কেমন আছে।

রুমালের ছত্রেছত্রে দরদ। রুমালের ছত্রেছত্রে বিরহ-ব্যাথা।

মানুষ যে হায় ভুলে গেছে
চিরমধুর ভালবাসা।

রুমালের ছত্রেছত্রে জানি-না-কিসের-হাহাকার।



এই সংসার মরুময়,
কেহ কারো নয়
দু’দিনের দেখাশুনা
পথে পরিচয়।

রুমালগুলোর দিকে চেয়ে থাকি। সাধারণ রুমালসকল। অথচ এই সাধারণের গহীনে কী করে গোপন থাকে অনন্য অসাধারণ? এই সাধারণ রুমালের ভাঁজে ভাঁজে কী করে থাকে পরাবাস্তব রুমালগুলোর ঠিকানা!

রুমালগুলো থেকে আজকাল আর নেপথলিনের গন্ধ আসে না। রুমালগুলোকে স্পর্শ করে রাখি; একটা নয়, সবগুলো আঙুল দিয়ে। রাখতে রাখতে আমার মনে আসে সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া কাঠের ভারী আলমারিটার কথা। আলমারিটা নেই। নেই রুমাল যে বানিয়েছিল তার সেই সোনালি তারুণ্য। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দশকে ময়মনসিংহের নান্দাইলের চপই গ্রামে এক সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারে প্রাক তারুণ্য থেকে তারুণ্যের দিকে আসতে আসতে এক শ্যামলা মেয়ে সাদা জমিনে বুনেছে মায়া।

সেই রুমালের ফোঁড়ে ফোঁড়ে ছিল কি তার কাউকে না বলা কোনো কথা? রুমালের ছবি ও কথায় সুঁইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে ছিল কি কাউকে উদ্দেশ্য করে রাখা তার কোনো অভিমান? ফুল তোলা একটা রঙীন রুমাল কাঁপা হাতে সে কি দিয়েছিল কাউকে কোনোদিন? নাকি কেবল নিজেরই জন্য ছিল তার এই মায়াজগত? চিরল চিরল বাঁশের পাতার সঙ্গে তার গহীন, নিবিড় যে বাঁধন ছিল, তাই কি ছিল এই মায়াভাষার উৎসমুখ?



এই মায়াভাষা আমি আজো বুঝি না। তবু এ ভাষা আজো আমায় ঘোরগ্রস্থ করে। আজো মনে হয়, বুঝিবা স্পর্শমাত্র এই রুমাল হবে জাদুর গালিচা। এই গালিচা চড়ে আমি যাবো পরীর দেশে। দুই ডানা নাড়াতে নাড়াতে পরী এসে জানতে চাইবে আমার মনের গোপন-গহীন ইচ্ছা। আমতা-আমতা করতে করতে অবেশেষে বলবো, আমাকে শেখাও রুমালের মায়াভাষা।

এইবার পরীরাও আর সবিস্তার আমাকে দেবে না ভাষা শিক্ষার কঠিন বিবরণ। বরং একটা সুনয়না পরী আমার চোখে গভীর করে রাখবে চোখ। সেই চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার বড্ড অবশ-অবশ লাগবে। ধীরে-ধীরে বন্ধ হয়ে আসবে আমার চোখের মণি। সুখে আমি তলিয়ে যাবো গহীন ঘুমে।

ঘুম থেকে জেগে দেখবো খেজুর-পাটি জুড়ে আমি শুয়ে আছি আমার বাড়ির আঙিনায় বড় কাঠাল গাছের ছায়ায়। আমার পাশেই হঠাত ডেকে উঠবে একটা চড়ুই কি বাবুই কি টুনটুনি। আর তক্ষুণি আমি বুঝে উঠবো তাদের ভাষা। বুঝে উঠবো পরস্পর কী কথা বলে চিরল চিরল বাঁশের পাতার দল। কাঠাল পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়া রোদের দিকে চেয়ে আমি টের পাবো আমার বুকের ভেতর কেমন যেন মাছের মতন ঘাই মারছে একটা অচিনপুর; রুমাল থেকে উঠে এসে আমার ভেতর কেমন যেন ঘাই মারছে একটা মায়াভাষা।



১৪.০৯.১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৮
১৪টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু কবিতা থেকে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২৮

ব্যাংকখাত ধ্বংসের এক মহান (?) কারিগর

লিখেছেন পদ্মপুকুর, ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



০১
ছবির এই ভদ্রলোকের নাম মোঃ নজরুল ইসলাম মজুমদার। পালিয়ে যাওয়া গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার অন্যতম আর্থিক যোগানদার এই লোক বাংলাদেশের ব্যাংকখাত ধ্বংসের প্রধান কারিগর। ব্যাংক পরিচালকদের প্রতিষ্ঠান বিএবি’র চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতা প্রথম দেখেছিলাম তোমায়

লিখেছেন এসো চিন্তা করি, ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৭



"প্রথম দেখেছিলাম তোমায় "
এ.কে.এম. রেদওয়ানূল হক (নাসিফ)
আমি দেখেছিলাম সেদিন তোমায় কোনো এক
জনশুন্য রাস্তায় একাকী হেঁটে যেতে ,
আমি দেখেছিলাম সেদিন তোমার মুখের হাসি
যা বিমোহিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে সব কাজ না করলে ইসকনকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৫২

সম্প্রতি ইসকন নিয়ে টালমাটাল আমাদের দেশ।ইসকনের নাম প্রথম শুনি ২০১৫ সালে। ঐ সময় বেশ কয়েক মাস চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গনে আড্ডা দেওয়া হত। সেখানেই ইসকন সম্পর্কে কিছুটা জানা হয়।
এডভোকেট সাইফুলের অপমৃত্যু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত সীমান্ত দিয়ে বোমা তৈরির রাসায়নিক সরঞ্জাম ঢুকাচ্ছে সমীকরণটা আপনারাই মিলিয়ে নেন

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৯


গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কেরানীগঞ্জ থানা অভিযান পরিচালনা করে ৩৫ বস্তা ( ১৭৫০ কেজি সালফার ) এবং এক বস্তা ভাঙা কাচ উদ্ধার করেছে। তদন্তে জানা যায় এই রাসায়নিক দ্রব্য গুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×