প্রতিটা মানুষই তো নিষ্পাপ শিশু হয়ে জন্মায়। কিন্তু জীবনের কি কি ঘটনার মাধ্যমে কেউ এরকম হিংস্র এবং নির্মম হয়ে উঠে? কেন কেউ অবলীলায় শিশুও হত্যা করতে পারে, কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে খুনও করতে পারে, কিভাবে এসব প্রক্রিয়া ‘রিভার্স’ করা যায়- এসবই মনঃচিকিৎসক ও গবেষকদের নিরন্তর গবেষণার বিষয়। আমাদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে সবারই জানা খুবই জরুরী কেন কেউ ‘ঐশী’ হয়ে ওঠে।
কেস স্টাডি ১
আমেরিকার হাওয়ারড কাউন্টিতে এক ঘটনায় ১৪ বছর বয়স্ক এক কিশোরী আর তার ১৯ বছর বয়স্ক ছেলেবন্ধু অভিযুক্ত হয়েছে যেখানে দুজনে প্ল্যান করে মেয়েটার বাবাকে এবং তার বান্ধবীকে ঘুমের মধ্যে হত্যা করেছে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে। এ ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন সাইকাইয়াট্রিস্ট Dr. Jack Vaeth এখানেঃ Click This Link
তিনি বহু বছর টিনেজ ছেলে-মেয়েদের চিকিৎসা করে আসছেন যারা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনেকগুলো ‘ওয়ার্নিং সাইন’ দেখা যায় যা চিহ্নিত করতে পারলে এসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটতো না। তিনি বলেন, ‘যখনি অ-স্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় তাদের মধ্যে, তখনি তাকে প্রশ্ন করতে হবে এ ব্যাপারে। আর যদি না সমাধান করা যায়, তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।’
তিনি বলেন, যেসব শিশু তাদের অভিভাবকদের হত্যা করে, তাদেরকে তিনটি বড়ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১। মানসিক সমস্যাগ্রস্ত (অর্থাৎ স্কিডজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি জাতীয় মানসিক রোগ)
২। বাবা/মার হাতে নির্যাতনের শিকার।
৩। কম বয়সে স্বাভাবিক ছেলে/মেয়ে কিন্তু বয়সের সাথে সাথে বাবা-মার বাধ্যবাধকতা মানতে পারে না এমন।
অর্থাৎ এসব ছেলে/মেয়েকে সর্বক্ষণ বাবা-মা বলে, ‘তুমি আমার বাড়িতে এসব করতে পারবে না!’, ‘তুমি ওটা করতে পারবে না!’ এবং তাতে ধীরে ধীরে শিশুটির মধ্যে এরকম বোধ জন্মায়ঃ ‘তোমরা আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’
পুলিশ বলছে, এই ঘটনা ঘটার বেশ আগে থেকেই এই মেয়েটি ও তার বয়ফ্রেন্ড প্ল্যান করেছে প্রায় ২ মাস ধরে। এবং ধরণের ঘটনায় এটাই স্বাভাবিক। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায়, এসব ঘটনা ঘটার আগে ছেলে/মেয়েটি বাবা-মার সাথে হঠাৎ স্বাভাবিক বা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। এটা করার কারণ সম্ভবত এ আচরণে বাবা/মা অসতর্ক হয়ে পড়ে কিছুটা, আর সন্তানের পক্ষে এরকম কিছু করা সহজ হয়ে যায়।
ডাক্তারের মতে, মূল ব্যাপার হচ্ছে, সন্তানের কম বয়সেই ‘লিমিট’ বোঝাতে হবে। তাদেরকে টিনেজ বয়সে হঠাৎ বাধ্য-বাধকতার ভেতরে নিয়ে আসতে গেলে অনেক সময়ই আর তা কাজ করে না।
এছাড়া সন্তানের মধ্যে হিংস্র বা আক্রমণাত্মক ব্যাবহার দেখা গেলে সতর্ক হওয়া এবং তাকে বিশেষজ্ঞর সেবা দেওয়া খুবই জরুরী। এ ব্যাপারে ডাক্তারের মতামতঃ ‘Its better to be safe than sorry’
কেস স্টাডি ২
আমাদের কাছে এসব ঘটনা যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, সন্তানের হাতে বাবা-মার নিহত হওয়া অবাস্তব না। “Such an act, though thought uncommon, is almost a daily event in the United States. Between 1977 and 1986, more than 300 parents were killed each year by their own children.”
Click This Link
কোন ধরণের শিশুরা এরকম কাজ করে? কোন কারণে কেউ এরকম করতে পারে? স্টাডিতে দেখা যায়, এরা হচ্ছে এমন সব শিশু, যারা মনে করে এছাড়া তাদের আর কোনওই পথ খোলা নেই।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খুনিরা টিনেজার। এর মূল কারণ, বাবা-মার সাথে পরিবারে অসহনীয় পরিবেশে থাকতে থাকতে এরা মনে করে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কিন্তু ভিন্ন জায়গায় চলে যেতে পারে। এছাড়া ১১ বছর বয়সের আগে শিশুদের মৃত্যু সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ডেভেলপ করে না। অনেকেই তাই টিনেজ বয়সে পুরোপুরি বুঝতে পারে না কি করছে সে বা এটা কতবড় ঘটনা।
আগেই বলা হয়েছে এদেরকে তিনটি বড় ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন ঘটনা হচ্ছে বাবা-মার হাতে অকথ্য নির্যাতনের শিকার টিনরা। পল মনে একজন আইনজীবী যিনি লস অ্যাঞ্জেলেস-এ এমন সব টিনেজদের নিয়ে কাজ করেন, যারা বাবা-মাকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার প্রায় ৯০%-ই এমন সব টিনেজার যারা বাবা/মা/উভয়ের হাতে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কখনো কখনো তারা চোখের সামনে কোনও পরিবারের সদস্যকে দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছে। তারা জবানবন্দীতে বলে, খুন করা ছাড়া পরিত্রাণের আর কোনও পথ তারা দেখে নি। উল্লেখ্য, এই নির্যাতন শারীরিক, মানসিক বা যৌন যেকোনো প্রকারের হতে পারে।
মানসিক রোগীর হাতে বাবা/মার নিহত হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। এরা হচ্ছে যারা বাস্তবতার সাথে কোনও সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে তারা। অনেক সময়ই এদেরকে আদালতে বিচার না করে মানসিক কারাগারে পাঠানো হয়।
তবে ট্যাবলয়েড পত্রিকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাদের ওপর তারা হচ্ছে, ‘অ্যান্টিসোশ্যাল’ ধরণের। এদের অনেকেরই খুনের মোটিভ বেশ সামান্য। অনেক সময়ই শুধুমাত্র বাবা-মার বকা না শোনাই মূল মোটিভ হতে পারে।
প্রায় ৫০টি এ ধরণের ঘটনার ক্ষেত্রে কমন যা দেখা যায় তা হচ্ছেঃ
ক। পারিবারিক সহিংসতা
খ। সাহায্য পেতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে
গ। চেষ্টা করেছে পালিয়ে যাবার অথবা আত্মহত্যা করার
ঘ। বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্নতা
ঙ। ধীরে ধীরে অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয় পরিবারে
চ। বাড়িতে পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে না পেরে অসহায় বোধ করে
ছ। তাদের উপর যা ঘটছে তা মোকাবেলা করতে অক্ষমতা
জ। এদের সাধারণত কোন পূর্বের অপরাধের রেকর্ড থাকে না
ঝ। বাড়িতে পাওয়া যায় বন্দুক
ঞ। মাদকাসক্ত বাবা/মা
ট। হত্যার পর Amnesia রিপোর্ট করা, অর্থাৎ তারা বলে তারা মনে করতে পারে না পুরোপুরি কি ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।
এছাড়া এ ধরণের ঘটনা বেশীরভাগই ঘটে ছেলেদের হাতে। (পৃথিবীর সহিংস ঘটনার প্রায় অধিকাংশই ঘটে পুরুষের হাতে।)
কেস স্টাডি ৩
Kathleen Heide, পিএইচডি দক্ষিণ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের criminology অধ্যাপক। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কোনও সন্তান তার বাবা/মাকে বারবার ছুরি দিয়ে আঘাত করলে তা দিয়ে কি বোঝা যায়? তিনি বলেন, প্রায়ই এটা খুব শক্তিশালী নেতিবাচক আবেগ মুক্তির ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ ভিকটিমের প্রতি তার সব আক্রোশ এবং নেতিবাচক আবেগ যতক্ষণ না পর্যন্ত নিঃশেষ হয়েছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত এরা আঘাত করে যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এরা একবার আঘাত শুরু করলে এরপরে কি ঘটছে তা আর মনে করতে পারে না। তাই এ ধরণের কাজ করার সময় তাদের কোনও অনুভূতি বা আবেগ কাজ করে না। অনেকেই বলে যে তারা খুন করার পরে বুঝতে পারে আসলে তারা কি করেছে।
তাহলে এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এ ধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য আমাদের সবার করণীয় কি কি। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের প্রায় সবাইকেই সতর্কভাবে এগিয়ে আশা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। এ ব্যাপারে দায়িত্ব আমাদের সবারই নিতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সবার মাঝে হিংস্র আচরণের মূল কারণ জানানো যাতে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারি।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।