জয়পারা মাহামুদিয়া মাদ্রাসার সীমানা ঘেঁষে পূর্ব দিকে হিন্দুদের বাড়ি,পশ্চিমে জয়পারা স্কুলের মাস্টার পরেশ স্যার থাকতেন তার পরিবার নিয়ে। কখনো কোন অভিযোগ শুনিনি যে মাদ্রাসার ছাত্ররা ওই হিন্দু পরিবারকে ডিস্টার্ব করছে। মাদ্রাসার পোলাপাইন নামযের অযু করতো পরেশ স্যারদের পুকুরে। পরেশ স্যারের গাছের আম আমরা সবাই ঢিল দিয়ে পেড়ে খাইতাম। পরেশ স্যার মদ্রাসায় বসেই আমাদের ১০/ ১২ জন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতেন। কখনো শুনি নাই এটা নিয়ে কেউ কখনো অভিযোগ করতে। মাদ্রাসার মাঠে ওয়াজ মাহফিল হতো, পরেশ স্যারকে দেখছি প্যান্ডেল তৈরিতে সহায়তা করতে, তদারক করতে। প্যান্ডেল তৈরিতে বাঁশ দিয়ে সহায়তা করতো অনেক হিন্দু পরিবার।
আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে এক চকের পরেই কিছু হিন্দুর পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করে। তাদের সাথে আমাদের কিংবা মুসলিম কোন পরিবারের কোন মনোমালিন্য হয়েছে বলে আমি দেখিনি। সুপ্রতিবেশি হিসেবে একে অপরের বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত।
আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল জ্বল জ্বল করে এখনো জ্বলছে তাদের নাম এবং ছোট খাটো দু-একটা ঘটনাও যদি উল্লেখ করি পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে ধীরেন দা’র কথা না বললেই না,উনার চাউলের ব্যবসা। বাজারে তার একটি দোকান বা আড়ত আছে। তার কাছ থেকেই আমরা চাল খাই। কখনো নগদে আবার কখনো বাকিতে। এই ধীরেন দা’র যাতায়াত ছিল আমার বাবার শোয়ার ঘর পর্যন্ত। পাকঘরের হাঁড়ি থেকে ভাত-তরকারি নিজেই নিয়ে খেতেন। প্রায়ই বাবাকে দেখতাম ধীরেন দা’র বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতেন পাড়ার অন্য মুরিব্বিদের সাথে।
আমাদের বাবা,চাচা মামাদের দেখছি সেই সব হিন্দু বাড়ির অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রতিবেশী হিসেবে সহযোগিতা করতে, নির্দ্বিধায় অনুষ্ঠানে গিয়ে খানা-পিনা করতে। তখনো কোন ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে আজ কেন হচ্ছে?? আমি, গোপাল,বিঁধান,মিন্টু, রাসেল,সাধন হরিপদের বাড়িতে কালী মূর্তির সামনে রাখা মিষ্টি ,কমলা আপেল কতোবার যে খেয়ে সাফ করে দিয়েছি তার হিসাব নাই।
মেইন রাস্তার বদলে হিন্দুদের বাড়ির উপর দিয়েই শর্টকাটে স্কুলে আসতাম। প্রায়ই ভোরবেলা মিহিরদের বাড়িতে গিয়ে ওদের সংগে নাস্তা করে মিহিরকে নিয়েই স্কুলে যেতাম। বাজারে আর স্কুলে আসা যাওয়া করতে আমি রাস্তা ছেড়ে বাড়ির ভিতর দিয়েই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম সেই ছেলেবেলায়। তাই স্কুলের আশেপাশে কোন প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের বাসায় কোরবানির গরুর মাংস পলিথিনে করে হিন্দু বাড়িদের উপর দিয়েই আসতাম। কখনো কোন হিন্দু মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে অভিযোগ করে নাই কেউ, কেউ কখনো এই বিষয়ে কটু কথাও বলেনি। দুর্গা পূজায়,সরস্বতীর পুজায়, রথে হিন্দু বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে উৎসব করছি। উৎসবের ভিতর কখনো হিন্দু বা মুসলিম বলে বিভাজন করতে দেখি নাই কাউকে। আমাদের ঈদে ওরা পাঞ্জাবী পরে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো আমাদের সংগেই। ওদের পূঁজোতে রাত জেগে আড্ডা দিতাম ওদের সংগে। প্যান্ডেলে তৈরি থেকে শুরু করে পুরো অনুষ্ঠান ঝামেলাবিহীনভাবে শেষ করতে সব মুসলিম বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীদের দেখেছে উৎসব মুখর পরিবেশে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে অংশগ্রহণ করতে।
স্কুলে মাঝে মাঝে টিফিনন টাইমে বাড়িতে না এসে মসজিদের নামায পড়ে ঘূরে বেড়াতাম, আমরা নামাযের জন্যে ওজু করতাম, সব শেষে রামকৃষ্ণও আমাদের সাথে আমাদের মতো করে ওজু করতো, আমরা মসজিদের ভিতর নামায পড়াতাম রামকৃষ্ণ মসজিদের ভিতর বারান্দায় চুপ করে বসে থাকতো। নামায শেষে একসাথে বেরিয়ে যেতাম। একদিন মসজিদের ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ওই ছেলেটা নামায আদায় করে না কেন? বলেছিলাম হুজুর ও তো হিন্দু। কই সেইদিন হুজুর তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে বলেন নাই ,হিন্দু ছেলে মসজিদের ভিতর আসছে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে!
মনে আছে, কোন এক রোজার মাস, আমরা কয়েকজন মিলে বাজারে বইসা আড্ডা দিতেছি। ইফতার হইতে আর অল্প সময় বাকী। বন্ধু কৃষ্ণচন্দ্র আসছে, ঘেমে নেয়ে একাকার। দোকান থেকে পানি চাইলো, দোকানদার পানি দিল। বন্ধু পানির গ্লাস নিয়ে দোকানের পেছনের দিকে গোডাউনে চলে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, কিরে পানি নিয়ে গোডাউনে গেলি ক্যান। বন্ধু জবাব দিলো, তোরা সবাই রোজা। এতগুলা মানুষের সামনে পানি ক্যামনে খাই? এই হইলো আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম হৃদ্যতা আর সহাবস্থানের ঐতিহাসিক চিত্র। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, পৃথিবীর কোথাও ধর্মে-ধর্মে এত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নজির নাই। এটাই চিরায়ত বাংলার শাশ্বত রূপ। এটাই বাংলাদেশীদের হাজার বছরের গৌরবের চিত্র।
সেই ধর্মই আছে , সেই আল্লাহ্ই আছেন , সেই কোরআনই পাঠ করানো হয়। তাহলে কেন আজ নতুন করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এতো সহজে ? আজকে সেই দিনের বন্ধু ডাক্তার রাম কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু সত্যি করে বলতো - এই যে তুই মুসলমান ঘেরা এলাকায় বড় হয়এছিস, তুই কি কখনো ভয়-ভীতি বা নিরাপত্তাহীনতা ফিল করছিস ? রামের জবাব, “আমি আমার এ এযাবতকাল কোন দিন অনিশ্চয়তা অথবা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি আমি হিন্দু বলে। আমার ৯৯.৯৯% বন্ধুরা মুসলিম। আমার সাথে এই বন্ধুদের সম্পর্ক অত্যন্ত হৃদ্যতার। আমার বিশ্বাস যে কোন পরিস্থিতে তারা আমাকে সাহায্য করবে”
আমার কথাও পরিস্কার, আমি এক আল্লাহর ইবাদত করি যাঁর শক্তি অপরিসীম। পৃথিবীর সমস্ত মানুষও যদি তার ইবাদত কিংবা আনুগত্য না করে তার কিছুই আসবে যাবে না, তার এক চুল পরিমাণ ক্ষতি হবে না। আমার ধর্ম বিশ্বাসও এতো ঠুনকো নয় যে কেউ একজন কাবা ঘরের উপর গণেশ কিংবা কোন কিছুর আকৃতি উঠায় দিয়ে ফেসবুকে আপলোড করলো আর আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে সেটা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বো। আমার বিশ্বাস সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একটা গোষ্ঠী এসব ছড়িয়ে দিয়ে বড় ধরণের অপ্রীতিকর অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করতে চায় এবং এটা দেশের সমস্ত ধর্মপ্রাণ সচেতন সাধারণ জনগণ বোঝে।
আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিশ্বাস নাসির নগরে গত দুইদিন ধরে যা হলো এটা কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না। বরং সুপরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা লাগানোর পায়তারা যা করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দেশের সব মান্তিকামী মানুষ এটাই বিশ্বাস করে যে, এদেশে আবহমানকাল ধরে চলে আসা অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিকড় অনেক গভীরে। দুই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার দ্বারা তা কিছুতেই বিনষ্ট হতে পারে না।
তবে এটাকে আমি তুচ্ছ ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে চাই না। আমি এও বিশ্বাস করি হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হবে না, দাঙ্গা হবে আওয়ামীলীগ বিএনপি’তে। আওয়ামীলীগ, বিএনপিকে শেষ করে দেওয়ার যে মানসিকতা নিয়ে দেশ শাসন করছে এর ভয়াবহতা দেশ ও জাতিকে ভোগ করতে হবে করুণভাবে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী অবৈধ সরকার ও তার গৃহপালিত প্রশাসন জঙ্গি নাটকে সুবিধা করতে না পেরে মতো নতুন নাটক শুরু করছে সাম্প্রদায়িত দাঙ্গার দোহাই দিয়ে ভারত তথা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে সহানুভূতি পাবার প্রত্যাশায়। এই ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সাবধান ও সজাগ থাকতে হবে। প্রতিটি এলাকায় এলাকায় সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে যাদের কাজ হলো, ধর্মীয় কোন ইস্যুতে উসকানিমূলক কিছু হওয়ার সংগে সংগে সমাজ কমিটি বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিবে এবং এলাকার গণ্যান্য ব্যক্তি ও তরুণদেরকে নিয়ে স্বল্পতম সময়ের ভিতর সেটার শান্তিপূর্ণ সমাধান করে ফেলবে। এ বিষয়ে বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আসা উচিত। এখনই সময় হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমুন্নত রেখে আসন্ন নির্বাচনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া এবং দল গঠনে সর্বাত্নক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:২১