আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। আর দশটা পাঁচটা সরকারী কর্মচারীদের পারিবারিক জীবন যেমনটা হয়, আমারাও ছিলাম ঠিক সেই রকম। মাসের শুরুটা ভালোই যায়, কিন্তু শেষের দিকে টানাটানি। তবে সুখে যে ছিলাম, তা নিশ্চিত করে বলাই যায়।
আমি ছিলাম, পরিবারের বড় সন্তান। বড় সন্তান হবার বেশ কিছু ঝামেলা আছে। যেমন, ছোট ভাইয়ের সাথে যখন দুস্টামি করতাম, তখন সে যদি আমাকে মেরে নাক ফাটিয়েও দিতো তখন বাবা বলতেন, তোকে মারল, আর তুই কিছুই করতে পারিস নাই? আবার যদি আমি উল্টা মাইর দিতাম, তাহলে আমাকে বলতেন, কি রে! তুই তো বড়! তুই মারতে গেলি কেন? আমরা ছিলাম না?
একবার বাসায় একটা নতুন সাইকেল কেনা হলো, আমাদের তিন ভাইয়ের লাগলো মারামারি। আমি যেহেতু বড়, তাই আমার চেয়ে ছোটদের অধিকার নাকি বেশি। ফলে ছোট দুই ভাই, ভাগ-বাটোয়ারা করে সেই সাইকেল চালালো, আমি ভাগেই পেলাম না।
প্রতি ঈদে তিনটা জামা নিয়ে আসতেন বাবা, ছোট দুইজনের পছন্দ শেষে যেটা বাকি থাকতো, সেটা আমার। অবেলায় মেহমান আসছে, বাজার থেকে মাছ আনতে হবে, সেটা যত অবেলাই হোক, আমাকেই যেতে হবে-বড় ছেলে তো!! মাছের বড় টুকরা, দুধের সর, সবই ওদের জন্মগত অধিকার!! বড়দের নাকি ত্যাগেই সুখ। যাই হোক, অম্ল-মধুর স্মৃতি সব। সবই আমার প্রিয় স্মৃতি।
একবার এক মামাতো ভাই বিদেশ থেকে একটা ক্যামেরা নিয়ে আসলো। বিদেশ থেকে ফেরার পর আমাদের বাড়িতে আসলো সেই ক্যামেরা নিয়ে। ক্যামেরার নাম ইয়াশিকা, এমএফ টু। সারাদিন ক্যামেরাটা আমার কাছে রাখলাম। ভাই যখন ফিরে যাবে, তখন বললাম ক্যামেরাটা রেখে যান, একটা রিল (ফিল্ম) কিনে ছবি তুলবো। আমার ভাই বললেন, না-রেখে যাওয়া যাবেনা। নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমার বাবা ছিলেন পাশেই। ভাই চলে যাবার পর তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন একটা ক্যামেরার দাম কত? আমি খোঁজ নিয়ে রাতে জানালাম এই ক্যামেরাটার দাম প্রায় তিন হাজার টাকা। তিন হাজার টাকা তখন অনেক টাকা। পরের মাসের বেতন পেয়ে আব্বা তিন হাজার টাকা দিলেন আমার হাতে, ক্যামেরা কেনার জন্য। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ক্যামেরা দোকানে গিয়ে আমার আর ক্যামেরা কেনার ইচ্ছে ছিল না। ক্যামেরা না কিনে ঢাকা থেকে বাড়ি চলে গিয়ে আব্বার হাতে টাকাটা দিয়ে দিলাম। আব্বা কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললাম, ছবি তুলতে অনেক খরচ আব্বা। শুধু শুধু জিনিসটা কিনে লাভ নাই। আব্বা নির্বাক, শুধু বললেন তোর মায়ের কাছে দে টাকাটা।
বড় ছেলে হিসেবে কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার হিসেবে যেকোন কারণেই হোক, শখ-আহ্লাদ পূরণের সুযোগ বেশি পাইনি। এটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অন্য সব বাবা-মায়ের মত আমার বাবা-মাও তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটাই করেছিলেন আমাদের জন্য।
এবার আসি অন্য একটা প্রসঙ্গে, যদিও এটাই মূল প্রসঙ্গ। এবার ছুটিতে বাড়ি যাবার পর আমার চার বছর বয়সী মেয়েটার ছবি তুলেছিলাম মোবাইল দিয়ে। পাশের বাসার কার কাছে যেন মেয়ে ডিজিক্যাম দেখেছে, মেয়ে আমাকে বললো আবার আসলে একটা ক্যামেরা যেন নিয়ে যাই। তার মা তাকে মোবাইল ধরতে দেয় না। এজন্য তার একটা ক্যামেরা দরকার। মেয়ের কথাটা মাথায় ছিল। অনেকদিন ধরে একটা ক্যামেরা কিনবো কিনবো ভাবছিলাম। কিন্তু শো-রুমে গিয়ে দাম দেখে আর হিসেব মিলে না। সব ক্যামেরাই ৫০ হাজার টাকার উপরে দাম। আমার বাজেট এত বেশি ছিল না। আরেকটু বাড়লে আরো ফিচার বেশি, আর সামান্য বাড়ালে আরো বেশি মেগা-পিক্সেল। বাড়তে বাড়তে সেই বাজেট লাখের উপরে গিয়ে ঠেকলো। এত টাকা ক্যামেরা কেনা উচিত হবে কিনা, কিংবা কিনেই সেটা কি কাজে লাগবে ভাবতে ভাবতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। শেষে কিনেই ফেললাম একটা নাইকন ডি ৭১০০ মডেলের ডিএসএলআর।
ক্যামেরা কেনার পর এখন পর্যন্ত কোনো ছবি তুলি নাই। রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়েছি। দোকানে ল্যাপটপের কাছে ক্যামেরাটা রাখা। একবার স্ক্রিনের দিকে তাকাই, আরেকবার ক্যামেরার দিকে তাকাই। এটা একটা ছবি তোলার যন্ত্র, এর দাম এক লাখ টাকা এবং এই জিনিসটা আমি আমার মেয়ের জন্য কিনেছি- এই বোধগুলো ছাপিয়ে বারবার যে কথাগুলো মনে পড়ছে তা হলো, আমার শৈশব-কৈশোর আর পারিবারিক জীবন!! বারবার বাবার ক্লান্তু মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে মনের পর্দায়।
সত্যি কথা বলতে, আমি এখনো জানিনা ক্যামেরাটা কি কাজে লাগবে বা কতটুকু কাজে লাগবে, তবে মেয়ে যখন আরেকটু বড় হবে, সে তখন বুঝবে ক্যামেরা টা ভাল। এটা তার বাবা তাকে দিয়েছে-এই বোধটা আমাকে যে আনন্দ দিচ্ছে, তার সংগে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা হয়না। একই সাথে আমার বাবার অনুভূতিটাও নাঁড়া দিচ্ছে সমান ভাবে। বাবা কিংবা পুরুষ মানুষদের কষ্টগুলো অন্য রকম, একটু আলাদা। পৃথিবীর সব বাবা আর তাদের সন্তানেরা ভাল থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৪৪