মহান আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেছেন (তর্জমা), “রমজ়ানের মাস, যে মাসে কুরআন নাজ়িল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী এক নির্ভুল মানদন্ড। অতএব তোমাদের মধ্যে যারাই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে তারা যেন অবশ্যই সিয়াম পালন করে।” (কুরআন, ২/১৮৫)
সালমান আল-ফারিসী (রাঃ) বলেছেন, “রসূলুল্লাহ্ (সঃ) শা‘বান মাসের শেষ দিন আমাদের উদ্দেশ্যে খুত্বা (বক্তব্য) দিলেন। তিনি বললেনঃ ‘হে লোকসকল! তোমাদের কাছে এক সুমহান ও অত্যন্ত বরকতময় মাস উপস্থিত। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা হাজ়ার মাসের চেয়ে উত্তম। এ মাসে দিনের বেলা রোজ়া রাখাকে আল্লাহ্ তোমাদের উপর ফরজ় করেছেন এবং রাতের নামাজ়কে (তারাওয়ীহ্) করেছেন নফল। যে মাসে একটি নফল কাজ করল সে মূলতঃ অন্য মাসে একটি ফরজ়ের সমান আমল করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ় কাজ করল সে মূলতঃ অন্য মাসে সত্তুরটি (৭০) ফরজ়ের সমান আমল করল। এটি হচ্ছে সাম্যের [অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার] মাস। আর এ মাসে ঈমানদারদের রিজ়িক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে কেউ কোন কিছু দিয়ে রোজ়াদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য মাগফিরাতের কারণ হবে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উপায় হবে; আর ঐ ব্যক্তি রোজাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে যদিও রোজ়াদারের সোয়াবে কোন কমতি হবেনা’। (বর্ণনাকারী বলেন) আমরা বললামঃ ‘হে আল্লাহ্র রসূল (সঃ)! আমাদের অনেকেরই রোজ়াদারদের কোন কিছু দিয়ে ইফতার করানোর সাধ্য নেই।’ তিনি (সঃ) বলেনঃ ‘আল্লাহ্ তাদেরকে এই পূরস্কার দেবেন যারা পানি মিশ্রিত একটু দুধ, একটি খেজ়ুর অথবা শুধু পানি দিয়ে রোজ়াদারকে ইফতার করাবে। আর যে রোজাদারকে পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে আল্লাহ্ তাকে আমার হাউজ় [হাউজ়ে কাউসার] থেকে পানি পান করাবেন যা জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তার থেকে তৃষ্ণা দূর করে দেবে। এটি এমন একটি মাস যার প্রথমাংশ হলো রহমত, মধ্যমাংশ হলো মাগফিরাত এবং শেষাংশ হলো জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির। এ মাসে যে কেউ তার অধীনস্তদের কাজ সহজ করে দেবে আল্লাহ্ তাকে মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। এ মাসে তোমাদের চারটি অভ্যেস বেশি বেশী অনূশীলন করা দরকার। এর মধ্যে দুটো অভ্যেস তোমাদের রব্বের সন্তুষ্টির কারণ, আর দুটো অভ্যেস এমন যা থেকে তোমরা কখনোই মুখাপেক্ষীহীন থাকতে পারোনা। যে দুটো অভ্যেসের মাধ্যমে তোমাদের রব্বের সন্তুষ্টি পেতে পারো তা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্র’ সাক্ষ্য দেয়া এবং তার কাছে বেশী করে ইস্তিগফার [ক্ষমা] চাওয়া। যে দুটো অভ্যেস থেকে তোমরা মুখাপেক্ষীহীন হতে পারোনা তা হলো তার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া।” [সহীহ্ ইবনু খুজ়ায়মা]
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! আসুন আমরা উপরোক্ত কু্রআনের আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমাদের রমজ়ানের জীবন নিয়ে নিজেদের কিছু প্রশ্ন করি।
রমজান কু্রআন নাজ়িলের মাস – কু্রআনের উত্সবের মাস। এ মাসে কুরআনের পূর্ববর্তী নাজ়িলকৃত সমস্ত অংশ রসূলুল্লাহ্ (সঃ) জিব্রীলকে (আঃ) পড়ে শোনাতেন বলে উল্লেখ রয়েছে হাদীসে। আমরা কি এ মাসে পুরো কুরআন পড়ার পরিকল্পনা গ্রহন করেছি? কুরআনের শিক্ষা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়নের জন্য কি কি পদক্ষেপ আমরা নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহন করেছি?
রমজান বরকতের মাস। নফল কাজগুলোর জন্য ফরজ়ের সমান বরকতের ওয়াদা করা হয়েছে, আর প্রতিটি ফরজ়ের জন্য ৭০ গুন সওয়াব। কতটুকু নফল ইবাদত করার পরিকল্পনা আমরা গ্রহন করেছি? ফরজ়গুলোকে যথার্থ আন্তরিকতা সহকারে আদায়ের কতটুকু উদ্যোগ আমাদের রয়েছে?
রমজান তাকওয়ার মাস। এ মাসে শয়তানগূলোকে আবদ্ধ করে তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা কি শয়তানী প্ররোচনা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছি? এই রমজ়ানেও কি আমরা শয়তানী কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হইনা?
রমজ়ান সংযমের মাস। আমরা কি আমাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে সংযম অবলম্বন করতে পেরেছি? প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় এবং ভোগবিলাসের ইচ্ছা কি আমরা দমন করতে পেরেছি?
রমজ়ান সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও অংশীদারিত্বের মাস। আমরা কি এ বিষয়গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি? আমরা কি আমাদের চারপাশের বঞ্চিত বনী আদমের কথা ভেবেছি? তাদের জন্য কিছু করার (সাধ্যে থাকলে) পরিকল্পনা কি আমাদের মাথায় এসেছে? অভাবী, ক্ষুধার্ত এবং দরিদ্র অনেক আত্মীয়-স্বজন যাঁরা আমাদের রয়েছেন তাঁদেরকে কি আমাদের সম্পদে অংশ দেয়ার কথা আমরা ভেবেছি? অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, “আর তাদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” [কুরআন, ৫১/১৯] দুনিয়াব্যাপী আমাদের যে অসংখ্য মুসলিম ভাই-বোন বিপদক্লিষ্ট জীবনযাপন করছেন, সেহরী এবং ইফতারের জন্য কোন খাবার হয়তো যাদের জুটবেনা, শান্তিতে রাত জেগে নফল ইবাদত করার মতো নিরাপত্তা যাদের নেই, তাদের জন্য সাহায্য ও সহমর্মিতা জানানোর কার্যকর কোন পন্থার কথা কি আমরা ভেবেছি?
রমজ়ান অহেতুক ও বাজে কাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষার মাস। আমরা কি অপ্রয়োজনীয় ও বাজে কাজে সময় ব্যয় করা ছাড়তে পেরেছি? অথবা আমরা কি সমস্ত অর্থহীন কাজ কারবার থেকে বিরত থাকার জন্য কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করেছি?
রমজ়ান মিথ্যা-ফাসেকী ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকার মাস। আমরা কি মিথ্যা বলা ছাড়তে পেরেছি? ফাসেকী আমল ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য কোন সত্যিকার ন্যায়ানুগ পন্থা অনুসরণের পরিকল্পনা কি আমরা করেছি?
রমজ়ান মাস অশ্লীলতা বিমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির মাস। অশ্লীলতা থেকে কতটুকু দূরে আমরা সরতে পেরেছি? আমরা কি রমজ়ানের দিনে এবং রাতে টেলিভিশনের পর্দা থেকে আমাদের চোখ সরাতে পেরেছি? কুরআন, হাদীস ও বিভিন্ন ইসলামী বই-পুস্তক পড়া যা আমাদের আত্মোন্নয়নের চাবিকাঠি তা বাদ দিয়ে এখনো কি আমরা টেলিভিশন-ভিডিও-সিনেমায় বাংলা, ইংরেজী, হিন্দুস্তানী ছায়াছবি-মিউজ়িক-নাটক দেখতে অভ্যস্ত নই? আমাদের ক্যাসেট, সিডি, এমপি-৩ প্লেয়ারে এখনো কি ঐ সমস্ত গান বাজেনা যা আত্মশুদ্ধি অর্জনের অন্তরায়?
প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা! আসুন আমরা উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর আলোকে এ রমজ়ানে আমাদের জীবনগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখি।
রমজ়ান আমাদের কাছে আসে আমাদেরকে তাকওয়া অর্জন করতে সাহায্য করতে। আমাদের জীবনতো রমজ়ানের কারণে ভরে উঠা উচিৎ মুত্তাকীদের গুনাবলীতে। কত রমজ়ান হয়তো আমরা পার করে দিয়েছি। কিন্তু তাকওয়া কি আমরা সত্যি অর্জন করেছি। বছরের প্রতিটি মাসইতো আমরা হেলা-ফেলায় কাটিয়ে দেই। আসুননা, এই রমজ়ানের মাসকে তার পরিপূর্ণ গুরুত্ব সহকারে পালন করি, যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি।
আমদের রমজ়ানের দিনগুলো যদি বছরের অন্যান্য দিনগুলো থেকে ভিন্নতর না হয় তবে আমরা সুস্পষ্ট ক্ষতিতে নিমজ্জিত হবো। একটা হাদীসের অংশ বিশেষের মানে হলো, “যে রমজ়ান মাস পেলো কিন্তু তার জীবনের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করিয়ে নিতে পারলোনা সে ধ্বংস হোক”। [সহীহ ইবনু খুজ়ায়মা ও ইবন হিব্বান]
আমাদেরতো এ মাসের প্রতিটি মুহুর্তের সদ্ব্যবহার করতে হবে যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি, যা আমাদেরকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করতে সাহায্য করবে। টিভি-মুভি দেখে, গান শুনে এবং গল্প-গুজবে সময় ব্যয় না করে গঠনমূলক কাজে বেশী বেশী সময় ব্যয় করতে হবে। বেশী বেশী কুরআন অধ্যয়ন, মুখস্তকরণ এবং জ়িকিরে সময় ব্যয় করতে হবে এমাসে।
আমাদের নামাজ়ে ও অন্যান্য ইবাদতে আরো অনেক বেশী আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার প্রতিফলন ঘটাতে হবে এবং যান্ত্রিকতা ত্যাগ করতে হবে। সাথে সাথে অভ্যস্ত হতে হবে আত্মবিচারে। রসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও ইহ্তিসাব [আত্মবিচার/সওয়াবের আশা] সহকারে রোজ়া পালন করে আল্লাহ্ তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন।” [বুখারী ও মুসলিম] তাই রমজ়ানের প্রতিটি ইবাদতেই নিষ্ঠার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আমাদের রমজ়ানের রোজ়া এবং নামাজ়গুলো যেন আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয়; যেন না হয় কোন প্রথাগত অভ্যাসের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বরং আমাদের নামাজ় ও রোজ়াগুলো যেন হয় আল্লাহ্ প্রেমের সচেতন বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের রোজ়া যেন হয় সে রোজ়া যে সম্পর্কে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, “বনী আদমের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য, শুধূ রোজা ছাড়া। রোজ়া আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব [অন্য বর্ণনায় আমিই তার প্রতিদান হব]।” [বুখারী ও মুসলিম]
প্রিয় ভাই-বোনেরা! আসুননা, আমরা সিয়াম সাধণা করার মাধ্যমে সচেতনভাবে আত্মনিয়োগ করি সে সীমাহীন সংগ্রামে যা আমাদেরকে নিকটবর্তী করবে আমাদের মহান প্রভূর, আর প্রতিদিনই আমাদেরকে রূপান্তরিত করবে ন্যায় ও সত্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক ভিন্ন মানুষরূপে।
ছবির লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ২:৪৪