হুদাইবিয়ার সন্ধির ভেতর একটা অদ্ভুত শর্ত মক্কার কুফফাররা দিয়েছিলো তা হলো, কোন মুসলিম বা মক্কার অন্য কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মক্কা থেকে মদিনায় গেলে রাসুলুল্লাহ সাঃকে তাকে ফেরত দিতে হবে, কিন্তু মদীনা কিংবা ইসলামের ছাউনি থেকে কেউ যদি পালিয়ে মক্কায় যায় তাহলে তাকে কুরাইশরা ফেরত দেবে না। রাসুলুল্লাহ সাঃ এ শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। চুক্তি লেখা শেষ হলো, কিন্তু স্বাক্ষর হয়নি, এ সময় শৃংখলিত অবস্থায় এসে হাজির হলেন আবু জানদাল বিন সুহাইল রাঃ। তার পিতা সুহাইল বিন আমর তখন কুরাইশের প্রতিনিধি হয়ে সন্ধি করছে। সুহাইল রাসুলুল্লাহ সাঃ কে বললো, "মুহাম্মাদ, আমাদের ভেতর চুক্তি হয়ে গেছে, আবু জানদালকে আমাদের কাছে ফেরত দাও"। আবু জানদাল রাসুল সাঃএর কাছে বললেন, "ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আপনি যদি আমাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন তাহলে তারা অমানুষিক নির্যাতন করবে। আমাকে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করবে"। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, "আবু জানদাল তুমি ধৈর্য্য ধর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তুমি আর তোমার মতো যারা আছে তাদের মুক্তির জন্য পথ খুলে দেবেন"।
এই নির্যাতিত সাহাবাদের মুক্তির পথ আল্লাহ্ যার মাধ্যমে খুলে দিয়েছিলেন তিনি হলেন আবু বাসির রাঃ।
সন্ধির কিছুদিন পর খাইবার যুদ্ধে জয়ী হয়ে রাসুলুল্লাহ সাঃ তখন মদীনায় ফিরে এসেছেন। এমন সময় মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় এলেন সেখানকার নির্যাতিত মুসলিম আবুল বাসির। এর সাথে সাথেই মদীনা পৌঁছালো মক্কার দুজন প্রতিনিধি। তারা রাসুল সাঃ এর কাছে আবু বাসিরকে ফেরত দেয়ার দাবী জানালো। সন্ধির শর্ত মেনে রাসুলুল্লাহ সাঃ তাঁকে ফেরত পাঠালেন। অসহায় আবু বাসির রাসুলুল্লাহ সাঃ কে না পাঠাতে অনুরোধ করলো। রাসুলুল্লাহ সাঃ তাকে আবারো বললেন, "ধৈর্য্য ধরো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমার আর তোমার মতো অন্যদের মুক্তির পথ তৈরী করবেন"।
ফিরে চললেন আবু বাসির। পথিমধ্যে এক যায়গায় তিনজন থামলো বিশ্রামের জন্য। এর মধ্যে একজন দূরে খেজুর খেতে গেলে আবু বাসির অন্য লোকটিকে বললেন, "তোমার তলোয়ারটিতো ভারী সুন্দর। একটু দেখিতো"। তলোয়ার হাতে নিয়ে এক আঘাতে তিনি হত্যা করে দিলেন সেই কুরাইশ প্রতিনিধিকে। এবার অন্য লোকটিকেও আক্রমন করতে উদ্যত হলে সেই লোকটি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে মদীনার দিকে পালিয়ে গেলো। মদীনা গিয়ে লোকটি রাসুলুল্লাহ সাঃকে ঘটনা জানালো। শুনে রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, "হায়, সে তো যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দিলো। হায়, নিহত লোকটির সাথে যদি অন্য কেউ থাকতো"। সেই লোকটি মক্কায় ফিরে গেলো কিন্তু আবু বাসির মদীনা ফিরে গেলেন না। তিনি জানতেন রাসুলুল্লাহ সাঃ তাকে আবারো ফিরিয়ে দেবেন। তিনি একাকী লোহিত সাগরের উপকূলে ঈ'স নামের এক গহীন বনে আশ্রয় নিলেন। একা সেই বনে তিনি গড়ে তুললেন একটি সেনা ছাউনি যার সদস্য সংখ্যা মাত্র একজন। সেনাপতিও তিনি, সিপাহীও তিনি।
অল্পদিনের ভেতর মক্কার নির্যাতিত মুসলিমদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছালো যে, আবু বাসির ঈ'সের জঙ্গলে ঘাঁটি গড়েছে। এরপর মক্কা থেকে পালিয়ে তার সাথে যোগ দিলেন আবু জানদাল। তারপর একে একে আরো অনেক সাহাবা। এবার তারা এক হয়ে শপথ নিলেন, আমারা কুরাইশের কাফেলাকে বিপর্যস্ত করে ছাড়বো। তাদের শামের বাণিয্য পথ রুদ্ধ করে দেব। শুরু হলো একের পর এক কাফেলা আক্রমণ। কুরাইশদের যে কাফেলাই এ পথ দিয়ে যেতো, আবু বাসিরের বাহিনী আক্রমণ করে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতো। তাদের কেউ হতো নিহত, কেউবা আহত।
কুরাইশদের জন্য শামের ব্যবসা পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। শীঘ্রই তারা মন্দা আর খাদ্যের অনটনের ভেতর পড়লো। হুদাইবিয়ার চুক্তি অনুযায়ী এই দুর্ধষ বাহিনী রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে ফিরে যাবার কোন উপায় ছিলো না। বাধ্য হয়ে কুরাইশরা রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে দূত পাঠিয়ে আবেদন করলো, "হে মুহাম্মাদ, আপনি তাদেরকে মদীনায় ফিরিয়ে আনুন। তাদের অনিষ্ট থেকে আমাদের মুক্তি দিন। আমরা স্বেচ্ছায় সন্ধির এই ধারা তুলে নিচ্ছি"। রাসুলুল্লাহ সাঃ আবু বাসিরকে তার সঙ্গীদের সহ মদীনা ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখলেন।
ইতিমধ্যেই কুরাইশ এক কাফেলা হামলা করে যথেষ্ট হতাহত করে আবুল বাসির রাঃ নিজেও মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায় এমন সময় রাসুল সাঃএর চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছালো। প্রিয় রাসুলের চিঠিটি পড়ে তিনি তা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হলো। তাঁর সাথীরা ফিরে এলো মদীনায়। মুক্তির সুবাস পেলো নির্যাতিত মুসলিমরা।
হুদাইবিয়ার সন্ধির শুরুর শব্দটি থেকে শুরু করে চুক্তির প্রতিটি ধারা ছিলো দৃশ্যত মুসলিমদের বিপক্ষে। তবে এই চুক্তিকেই কুরআনের আয়াত নাযিল করে অদৃশ্যের মালিক আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা কেনো সুস্পষ্ট বিজয় বলেছিলেন, তা মানুষ টের পাচ্ছিলো ধীরে ধীরে। আবু বাসিরের দলটির মুক্তি ছিলো সে সুস্পষ্ট বিজয়ের একটি।
(সূত্রঃ আর রাহিকুল মাখতুম, তাফসিরে সুরা তাওবা-ডঃ আবদুল্লাহ আযযাম)