‘মরবার পর কী হয়?’
এটি হুমায়ুনের অচিনপুর উপন্যাসের প্রথম লাইন। আমি হুমায়ুন প্রায় সবগুলোই বই-ই পড়েছি। নানা বইয়ে মৃত্যু উঠে এসেছে নানাভাবে। সাক্ষাৎকারেও তিনি নানান কথা বলেছেন।
মৃত্যু কি?
মৃত্যু জীবনচক্রকে পূর্ণতা দান করে। জীবনের শুরু যেখানটায় সেখানে ফিরে যাওয়া। এর মধ্যখানের মর্ম ও মজেজা বিস্তর। মৃত্যুর মর্মও বিস্তর। মৃত্যু কার কাছে নিয়ে যায়, কেন নিয়ে যায়- তার বাইরে মানুষের কাছে অস্তিত্বের বিনাশক ভয় নিয়ে হাজির। যে অস্তিত্বকে আমি নামে ডাকা হয়। এরপর কি আমি-র অস্তিত্ব থাকে না! আপাতভাবে রক্ত মাংসের সেই আমিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। চিন্তার ধারাবাহিকতায় সেই আমি নানাভাবে হাজির হতে পারে। কিন্তু এই হাজিরানায় যিনি চলে গেলেন তার পায়দা কি? এই ভয় অমূলক নয়। তারপরও এই মর্ত্যে হইলোকের মতো মৃত্যু সত্য। মৃত্যু জীবনের আপনার আপন বস্তু। আমরা তারপরও ব্যথিত হয়। যখন শুনলাম হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন- কি যে কষ্ট লাগল। অথচ কি অদ্ভুতভাবেই না বলছি মৃত্যু জীবনকে পূর্ণ করে। হুমায়ুন তার জীবন চক্রকে পূর্ণ করলেন, যেখান থেকে এসেছেন, যার কাছ থেকে এসেছেন – সেখানে তার কাছে ফেরত গেছেন।
এখানে হুমায়ুন আহমেদকে স্মরণ করব সামান্য কথায়। তাকে যেদিক থেকে স্মরণ করছি তাহলো- দুনিয়ার সৌন্দর্যকে কতো অসাধারণভাবে নিজের মাঝে ধারণ করেছিলেন। এই সৌন্দর্য অতিক্রম করে অচেনা-অদেখা ভূবনের গল্প তুলেছেন। তার রূপও অপার্থিব। সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে, যে ছেলেটা কবরে কয়েকদিন কাটিয়ে হুমায়ুনের গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছিলো। অথবা মেঘ বলেছে যাবো যাবো, কবি, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নাই-র চরিত্রগুলো। যাদের মৃত্যু জীবনকে পূর্ণতা দান করেছে। হুমায়ুন জীবন মৃত্যু দুইকেই উদযাপন করেছেন। এটাই শিল্প আর ব্যক্তির সম্পর্কের শিরা। একই রক্ত প্রবাহিত হয়েছে দুই শরীরে। অথবা একই শরীরকে আমরা দুই নামে ডাকি। তাই মৃত্যুর আগে কুলখানি নিছক ঠাট্টা নয়- সেই অদেখার সাথে সম্পর্ক তৈরিও।
হুমায়ুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সৃজনশীল মানুষ বলে আলাদা কিছু নাই। আমরা সবাই সৃজনশীল। তিনি আরো বলেছিলেন, অন্ধকার নই, মানুষের আলোকিত দিকগুলো নিয়ে কথা বলতে চান। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো ভালো-মন্দ মিলে যে মানুষ তা তার কাছে আলো বা অন্ধকারের তফাত নাই। আমার মাঝে যা আছে- তা নিয়েই আমায় থাকতে হয়। ফলে নানা বেদনা ও হাহাকারের মধ্যে আনন্দের উত্তাপটুকু আমাদের মাঝে জড়িয়েছেন। হুমায়ুনের আত্মজীবনীমূলক লেখাতেই তার আনন্দ বেদনার কথাগুলোতে উচ্চতার উপর-নীচ হয় নাই। সমভাবে পাঠককে আপ্লুত করেছে। তার নিমোর্হতা আনন্দের জোছনা ছড়িয়েছে। কি বৈপরীত্য।
কখনো চৈত্রের রোদ্দুর কখনো বৃষ্টি অথবা জোছনা। রবীন্দ্রনাথের পর কে এইভাবে জোছনা আর বৃষ্টির গান গেয়েছেন। অবদমন নয় জীবনের সত্যগুলো দিয়েই তার চরিত্রগুলো নির্মিত। জোছনা, বৃষ্টি বা রোদ্দুর কেউ আর অলীক নয়। তার জোছনা, রোদ্দুর আলাদা হলেও, কখনো কখনো আলাদা মানে নিয়ে হাজির হয় নাই। হিমু যখন খরতাপে হেটে যায়, তা আর খরতাপ থাকে না- জোছনার ফুল ফোটায়। তিনি জোছনা রাতে মরতে চেয়েছেন। বৃষ্টির দিনে কিনা জানি না। জোছনা হয়তো তাকে ফিরিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তখন আষাঢ়ের ঘনঘটা। অঝোর শ্রাবণ তার জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো অনাদিকালের জোছনা।
এক.
হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের লিভিং লিজেন্ড’সহ খ্যাত-অখ্যাত নানান জনের লেখালেখি আমরা পড়েছি বা পড়ছি। এরা সবাই হুমায়ুনের সাহিত্যে প্রীত বোধ করেছেন এমন নয়। তবে লক্ষ্যনীয় হলো, লেখালেখির এই মচ্ছবের মধ্যে সুনাম বদনামের সুর একই জায়গা আটকা। যেমন- তিনি জনপ্রিয় বলে সস্তা আবার জনপ্রিয় বলেই কালজয়ী। এক যাত্রায় এমন দুই ফল খুব কমই দেখা যায়। মোটা দাগে বাইনারী বিভাজন দিয়া সেই বিভেদকে বুঝা যাচ্ছে না। তবে এই আলোচনার দুটো দিক আছে। একটা হতে পারে সাহিত্যিক বাদানুবাদ, অন্যটি রাজনৈতিক মীমাংসা। আবার এই যে আলাদা করে বলা, তাদের একেবারে সম্পর্কহীন করে দেখাও বোকামী হবে। বাস্তব দুনিয়ায় কোন কিছুই একলা চলে না।
ইতিমধ্যে সিরিয়াসনেস আক্রান্ত আলোচনা হলো তার লেখায় সামাজিক দায়বদ্ধতা নাই। এই আলোচনার অভিমুখটি রাজনৈতিক পাটাতনে ভর দেয়া।অর্থ্যাৎ, হুমায়ুন আহমেদের লেখায় রাজনৈতিক দায় নাই অথবা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনপছন্দ রাজনৈতিক দায় তিনি নেন নাই। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দায়ের বাস্তব দিকটি পরিচ্ছন্ন নয় অথবা কেউ পরিচ্ছন্ন করে বলছেন না। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, এটা মোটা দাগে কমিউনিষ্টগোছের আদর্শের মামলা। সেই মামলা হুমায়ুন কেন জড়াবেন সেটা অস্পষ্ট। দায় কি কমিউনিষ্ট নির্মিত কিছু। আবার মতাদর্শিকভাবে এটা কমিউনিজমের দায় না হয়, তবে এই দায় বিমূর্ত বা এর বিশেষ কোন অভিমুখ নাই। কেননা, আমাদের সমাজ এমনই। সমাজের সবাই ভালো থাকুক, এটা নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু কেন এবং কিভাবে ভালো থাকবে? তো, সেই দায় মানবতাবাদসহ বিপদজনক চোরাবালিতে মুখ লুকানো। কিন্তু হুমায়ুন যা লিখেন বৃহদ্বার্থে রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে নয়। রাজনৈতিক পাঠের দিক থেকে হুমায়ুনের নানান ধরনের ভূমিকা দেখা গেছে। সেটা এক অর্থে বিরাজনৈতিক- যদি আপনি চিহ্নিত করতে যান, আবার অন্যদিকে এটা প্রচলিত রাজনীতির প্রতি সমাজের অনাস্থার সাড়া, যা নতুন ধরণের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বিচারও বটে। সে দিকের আলোচনাও কম হয়েছে। অর্থ্যাৎ, হুমায়ুনকে নতুনরূপে ব্যাখ্যার সম্ভাবনা ষোল আনা তাজা।
আবার তিনি কেন জনপ্রিয় সেই আলোচনার চেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে- জনপ্রিয় সাহিত্য কেন ফেলনা নয়? সেই বিচারের সিড়ি হতে পারে, সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্য সম্পর্কীয় কি ধরনের বিচার গড়ে উঠেছে তার উপর। সেখানে হুমায়ুনের তুলনামূলক মোকাবেলার দিকটি কি অথবা তিনি নতুন কোন ধারা তৈয়ার করেছেন কিনা। আলোচনা শুরু করলে আপনাকে এইভাবেই মানতে হবে। কিন্তু তার গরহাজিরও লক্ষ্যনীয়। এমন কি এর গোড়ার কাজ যেমন কেন জনপ্রিয় সেই আখ্যানটিও স্পষ্ট নয়। এটা ধরতে না পারার কারণে জনপ্রিয়তা একটা ঠুনকো বিশেষণ ছাড়া আর কিছু নয়। বাস্তব জগতে যা ঘটছে কার কোন প্রতিনিধিত্ব সে করে না। এই দায়িত্ব মোটাদাগে লিভিং লিজেন্ড সিরিয়াস লেখকদের। কিন্তু তারা বিমূর্ত জায়গায় দাড়িয়ে হুমায়ুনের বন্দনা বা তিরষ্কারে মত্ত।
ফলে খোদ সাহিত্যে বিচারের প্রশ্নটি অস্পষ্টই রয়ে গেল। এই অস্পষ্টতার মারাত্বক দিক হলো- আমরা আমাদের সমাজকেই ব্যাখ্যা করতে পারছি না এবং সাহিত্য বিচারের রূপটিও এখানে গড়ে উঠে নাই। সেটা উজবুক, কম পড়া, কম বুঝা, নিম্নরূচির মধ্যবিত্ত পাঠক ইত্যাদি দিয়ে বিবেচনায় মারাত্বক ভুল আছে। কারন যে পাঠক মানিক বা আহমদ ছফা (যদিও সবাই ইলিয়াস নিয়েই কথাটা তুলছেন) পড়েন তিনি হুমায়ুন পড়েন না, এমন না। তিনি হুমায়ুনও পড়েন। কেন? আবার জন পরিসরে সাহিত্যিক সুনাম বা বদনামের যে রূপ তা মূলত: পত্রিকার রিভিউ থেকে প্রাপ্ত। খুব কম ক্ষেত্রেই নতুন ধরণের মূল্যায়ন চোখে পড়েছে। বিজ্ঞজনেরা বলেছে ওমুকের সাহিত্য ভালো- তাই ভালো। রাজনৈতিক অর্থেও। আমরা যদি অসম্মান দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা শুরু করি, তবে হয়ে উঠবে বাংলাদেশের সচরাচর রাজনৈতিক কাদা ছুড়াছুড়ির মতো বিষয়। এই হলো নানা মাধ্যমে হুমায়ুন সম্পর্কীয় মূল্যায়নের (প্রায়শ স্মৃতিকথন) ফিরিস্তি। এবার অন্য একটি দিকে নজর দিবো।
দুই.
জনপ্রিয় মানে কি জনে প্রিয়। আরেকটু এগুলে জনে জনে প্রিয়। কেউ একজন কেন প্রিয় হয়ে উঠেন? হৃদয়ের কারবারি হন আর রাজনৈতিক নেতা হন, তিনি জনের কিছু কথা বা আশা আকাঙ্খাকে এমনভাবে প্রকাশ করেন তা জনের হৃদয়ের কাছাকাছি। সেই ঘটনা যদি সাহিত্য বা শিল্পে ঘটে তখন কি দাঁড়ায় – সেই ব্যক্তি হৃদয়বৃ্ত্তির কিছু বিষয় আশয় ধরতে পারেন। সেই ধরাধরি তিনি তার লেখালেখির মধ্যে নিয়ে আসেন। এখন আপনি সেই বাজারী বা সিরিয়াসের তর্কে গেলে কিছু মূল্য নিশ্চয় আরোপ করে এগুবেন। সেটাই সহি। কিন্তু আপনি আরোপিত সাহিত্যের সেই শ্রেনী বা পরিসরকে কতটা ধারণ করেন। সেটা নির্ধারিত হবে সেই প্রিয় কোন জন (শ্রেণী) ধারণ করে। তাদের আকাঙ্খাকে কিভাবে বুঝতে পারে বা ব্যাখ্যা করে। সাহিত্য যেভাবে বর্ণিত হোক তা আসলে সমাজের ‘এজ ইট ইজ’ নয়, বরং প্রতিটি সাহিত্যই বাস্তবতার পরিমার্জিতরূপ, তা যিনিই লিখুন। এই রূপটিই নির্ধারণ করে সে কোন পথে যাবে কি কথা বলবে, কোন রাজনীতি করবে বা কোন নীতি অনুসরণ করবে।
কথা না বাড়াই। হুমায়ুন নিয়া দুই কথা বলা যাক। আসলেও কথা দুইটা। প্রথমত: হুমায়ুন তার ভাষা-ভঙ্গি বা কথনে কি ধরণের সামাজিক মূল্য আরোপ করেছেন। হুমায়ুনের মতে তিনি ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ে লিখতে চেয়েছেন এবং লিখেছেন। সেই সম্পর্ক কিভাবে দেখিয়েছেন এবং এর সাথে জনের প্রিয়তার কি সম্পর্ক। দ্বিতীয় দিকটি হলো ব্যক্তি হুমায়ুনের উপস্থিতি।
হুমায়ুন মানুষের সম্পর্ক নিয়া আগ্রহী ছিলেন। এটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়েছে। সম্পর্কগুলো সহজে এমন- মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রেমিক, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও বন্ধু ইত্যাদি আপনার লোকের সাথে সম্পর্ক। এছাড়া আছে দোকানদার, পাওনাদার, বস, শিক্ষক ইত্যাদি। প্রথম শ্রেনীর সাথে আমরা যেভাবে সম্পর্কিত দ্বিতীয় শ্রেণীর সাথে নয়। আবার একে অর্থ-বিত্ত-র শ্রেণী দিয়ে হিসেব করা যায়। এই সম্পর্কগুলো নানান মোচড় দিয়ে জোড়া লাগানো। এই মোচড়গুলো হুমায়ুনের লেখায় পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা কি? ধরেন আপনি যে শ্রেণীতে থাকেন সেখানে আপনার নিজের অর্থ-বিত্তের সমানে সমানে সম্পর্ক এক ধরণের আবার অন্যদের সাথে আলাদা। কারো সাথে ঈর্ষার আর কারো সাথে দয়ার দেখানোর। এই দেখাদেখি রিকশাওয়ালা বা চায়ের দোকানীকে তুই বলা অথবা আরেক জনকে স্যার বলার সাথে সম্পর্কিত। এই সম্পর্কের রোশনাই এতো প্রবল যে এই তুই বা আপনি দ্বারা তাদের কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন তা নির্ধারিত হয়।
আহা! লোকটা কি গরীব! এই লোকগুলোর ভাগ্য বদল করা দরকার। হুমায়ুনের পাঠকরা যদি আগে থেকে এমন মানব দরদী হয়ে হাজির হন- হুমায়ুন দেখান অন্য জিনিস। এই হৃদয়বৃত্তি হোক, বুদ্ধিজীবিতা আর দার্শনিকতা হোক তা কোন শ্রেণীর একার জিনিস না। সবারই দার্শনিক ও হৃদয়বৃত্তিক ঘটনা আছে। সেটার নানান রূপ দেখানো। এটা দেখানো হুমায়ুনের লেখার বড়ো শক্তি। যেখানে সবগুলো চরিত্র নিজস্ব বয়ান নিয়া হাজির। সেটা যতো অল্প হোক। আপনি কাউকে চিন্তার রাস্তা থেকে ফেলে দিতে পারেন না। এটা অনেক সংবেদনশীল বিষয়। বিরাজনৈতিক হবার দিক থেকে আপনি হিমু চরিত্রটিকে বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু দেখেন পানির পাইপের মধ্যে বসবাস করা লোক আর গলাকাটা অমুক ভাই দুইজনের কথাই হিমু শুনছে। নৈতিকতা বা আইনের কথা তুলে হিমু কারো উপরে কিছু আরোপ করছে না। বরং, সেই চরিত্র নিজেই তার কথাগুলো বলছে। সেই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করে। পাঠক আপনি চাইলে তাকে খণ্ডন করতে পারেন। কিন্তু প্রত্যেকের জীবন ও তার সংবেদনাকে বুঝতে হবে। এটা মানবতাবাদ বা মানব অধিকারের দিক থেকে আমি হাজির করি নাই। বাংলা চলচ্চিত্রের ভাষায় ‘চৌধুরী সাব, গরীব হইলেও আমি মানুষ’, এই ধরণের কিছু না। এটা হলো সম্পর্ক- যা দিয়ে মানুষকে মানুষ বুঝতে পারে।
হুমায়ুন আহমেদের মুগ্ধতার দ্বিতীয় কারণ হলো ব্যক্তি হুমায়ুন। তিনি তার উপন্যাস বা গল্পে কোন না কোনভাবে হাজির। এটা ঠিক যে আমরা যে কোন লেখায় লেখকের (গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা প্রবন্ধ যাইহোক) উপস্থিতি নানাভাবে টের পাই। এটা একটা আইডিয়াল পজিশন। যেহেতু তিনিই উপন্যাসের গতিপথ নির্ধারক। কিন্তু হুমায়ুনের উপন্যাস এমন না। আইডিয়াল পজিশনে গল্পকে সাজায় না। ভেঙ্গে মুচড়ে দেয়। পাঠক আশাহত হন। কিন্তু মেনে নেন কেননা এটা নিয়তি। কোন নিয়তি?
হুমায়ুন উপন্যাসকে চরিত্রের নিয়তির হাতে ছেড়ে দেন। আবার মনে হয় হুমায়ুনের নিয়তিই যেন উপন্যাসের নিয়তি হয়ে হাজির। এটা একটা অদ্ভুত জিনিস। যারা হুমায়ুনের উপন্যাস নিয়মিত পড়েছেন তারা নিশ্চয় দেখেছেন হুমায়ুন কখন যেন উপন্যাসের চরিত্র হয়ে হাজির। এটা যেন শরীরি বিষয়। পাঠক তাকে স্পর্শ করতে পারেন। হুমায়ুন কখনো পারফেক্ট চরিত্র নন। সেখানে নিয়তিই তাকে নিয়ে খেলছে। আবার তার সম্পর্কে লোকে যা শুনে বা পড়ে (আত্মজীবনী নয়) তা নানাভাবে তার লেখায় উঠে আসে। সেখানে হুমায়ুন খুব অসহায় হয়ে হাজির। যেমন- রূমালী, কবি, নীল অপরাজিতা, লীলুয়া বাতাস, কে কথা কয় বা এই ধরণের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো হুমায়ুনকে নানাভাবে উপস্থাপন করে যেন।
লোকে তাকে নিয়ে কৌতুহলী। তিনি কি কি করেন, কেমনে কেমনে করেন। একই সাথে এই করাকরির মধ্যে বেপরোয়া ভাব তো ছিলো। পাঠক তাকে একই সাথে ঘৃণায় ও ভালোবাসায় বরণ করে নিয়েছে। হুমায়ুন তা নিয়ে, বড়ো করে বললে দুনিয়াকে নিয়েই ঠাট্টা করছেন। এক অর্থে জীবন যাপন সহজ করছেন। এই জীবনকেই সেলিব্রেট করেছেন। এটা ক’জনে পারে। তাকে সেলিব্রেটি অর্থে বিচার করা যায়। যাদের সবকিছুই বিক্রিযোগ্য। সেই অর্থে তার জনপ্রিয়তা সহজ বিষয় নয়। সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার বিষম রকম হাজিরার নামই জনপ্রিয়তা। হুমায়ুন আহমেদ তার প্রতিটি নির্মানেই সজীব ও প্রাণবন্ত। যা বাংলাদেশে এর আগে কেউ পারেন নাই।
এই লেখা কোনভাবেই হুমায়ুন আহমেদের যথার্থ মূল্যায়নধর্মী কিছু নয়। সেটা কষ্টসাধ্য ও সময়ের কাজ। শুধুমাত্র বিদ্যমান বাহাসের অভিমুখ নিয়ে কিছু কথা তোলা হলো। আশা করা যায়, বাকি বিচারও সম্পন্ন হবে।
> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:০৪