প্রচলিত বিশ্বাস একজন পুরুষকে কাঁদতে দেখতে চায় না। কিন্তু রাতের নির্জনে ছ'তলার ছাদে ঠিকই কাঁদে তুহিন। কখনো চিৎকারও করতে চায় নিশির অন্ধকারে। তবে, সামাজিক শিষ্টাচার জিওভাকে ভারী করে রাখে।
তুহিনের দুঃখ অনেকদিনের পুরোনো। আটাশ বছরের ছোট্ট জীবনটিতে, অব্যক্ত দুঃখের চক্র তাকে প্রতিনিয়ত শূন্যতার চোরাবালিতে ডুবিয়ে নিচ্ছে। কাউকে সে দুঃখ বোঝানো যায় না। কেউ তার বেদনার কথা শুনে হাসতে লজ্জা পায় না।
কেননা, প্রচলিত বিশ্বাস এও বলে যে, একজন পুরুষকে একজন নারী অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে দুঃখ দিতে পারে না।
আর পাঁচজনের মতোই অনলাইনে তুলতুলির সাথে পরিচয় হয় তুহিনের। ব্যাপারটা বন্ধুত্বে গড়ায়, সবশেষে মুঠোফোনে ভালোবাসা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুহিন আবিষ্কার করে তুলতুলি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। শৈশব, কৈশোর সম্পূর্ণ নারী সঙ্গ ছাড়া লালিত পালিত হওয়ায়, প্রেমের প্রথম দোলায় গা ভাসিয়ে দেয় তুহিন। তুলতুলি মেয়েটিও মন্দ নয়। কিন্তু সেই শুরুর সমস্যাটি, তুহিনকে বন্দী করে রাখে, তুলতুলির পুতুল সুতোয়।
তুহিন তুলতুলিকে ভালোবাসে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যে সে আবিষ্কার করে, তুলতুলি তাকে সন্দেহ করে। চোখে চোখে রাখে। ভালোই লাগতো সেই খুনসুটি। তবে, সদ্য ভার্সিটি ভর্তি হওয়ায়, অন্য মেয়ে বন্ধুদের সাথে তুহিনের সখ্যতার অশ্লীল কল্পনাও সে করে। যদিও, বাস্তবতা এই যে,তুলতুলি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে তুহিনের মাঝারি ধরনের আন্তরিকতার সম্পর্কও নেই। কিন্তু তুলতুলি স্রস্টাকে যেমনটি বিশ্বাস করে, তেমনি বিশ্বাস করে, সে দেখতে ভালো না বিধায়, তুহিন তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তুহিন যদি জাহান্নামেও যায়, তারপরও তুলতুলির খুদেবার্তার জবাব দুমিনিটের মাঝে দেয়া লাগে। তুহিন যেহেতু ফেরেশতা নয়, তাই একসময় গভীর বিতৃষ্ণা নিয়ে সম্পর্কটি ভেঙে দিতে চায় সে।
তুলতুলি কাঁদে। গালি দেয়। আত্নহত্যার হুমকি দেয়। তুহিন নরম মনের মানুষ, একসময় সব মিটিয়ে নেয়।
অমন অনেকবার হয়। তুলতুলি নিজের রূপহীনতার অলীক দৈন্যতায় ভোগে। যদিও তুহিন মনে করে, তুলতুলি দেখতে শুনতে ভালোই।
নিজের পূর্ণ যৌবন বিশ্ববিদ্যালয়ে, লিঙ্গ সংবেদনশীলতায় কাটায় তুহিন। মেয়ে বন্ধু বানানোর ব্যাপারটি তুলতুলি আদতে ঘৃণা করে। তুহিনের দেহ এবং আত্মার উপর তুলতুলি পৈতৃক অধিকার অনুভব করে। কখনো তীব্র বিবাদ হয়, মিটমাট হয়।
এর মধ্যে একদিন তুলতুলি সত্যি সত্যিই কয়েকটি ঘুমের বড়ি খেয়ে নেয়। সে যাত্রায় সুস্থও হয়।
তুহিন সবকিছু স্বাভাবিক করতে চায়, এদিকে তুলতুলির অবিশ্বাস দৃঢ় হয়। তুহিন শুধু তার, সে আর কাউকে ভাগ বসাতে দিবেনা। কখনো তুহিনের বন্ধুকে গোয়েন্দা নিয়োগ দেয়া, বা সহপাঠী মেয়েদের বিরক্ত করা তুলতুলির নিত্যকার দায়িত্ব। তাদের ভালোবাসা ক্যাম্পাসে চলমান হাসির নাটক যেন। তুহিন অপমানিত বোধ করে। সবার হাসিঠাট্টার ভিড়ে, তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে শুধু তার বাবা-মা। তুলতুলির আত্নহত্যার প্রবণতা, তাদের ভাবনায় তালগোল পাকিয়ে দেয়।
তুহিন ফেসবুক টুইটার চালানোর কথা আর কল্পনাও করে না। তুলতুলির পৃথিবীতে একাকী অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে সে। পাঠ্য-অপাঠ্য বইয়ের পৃষ্ঠায় একান্তে মনোনিবেশ করে। সত্যি বলতে, যৌবনের ফুল মুকুলেই ধ্বংস হয়, তাও তুহিন আপত্তি করেনা। সাত পুরুষ ভদ্রলোক হিসেবে বেঁচে থাকার ফলে, তুহিনের রক্ত বলে, হয়তো তুলতুলিই সঠিক। একটু বেশি ভালোবাসাটা হয়তো দোষের কিছু নয়।
এভাবেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়, তুহিনের জীবন।
(২য় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১১