পরদিন ঘুম থেকে উঠে আগেরদিনের কীর্তিকলাপ খুব বেশি মনে ছিল না। বয়সটাই ছিল অমন, কোনোকিছুই মনে ছাপ ফেলতো না। যাহোক স্কুল গেলাম। যেতে একটু দেরী করে ফেললাম। গিয়ে দেখি ক্লাস প্রায় ভর্তি। সবাই চলে আসছে। আমার প্রিয় টিচার আপাও ক্লাসে। আমি হাসিমুখে ঢুকার অনুমতি চাইতেই আপা আমার দিকে তাকালেন। তার চোখে একি সাথে ক্রোধ আর বেদনা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আপার চোখে রাগ দেখে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। আপা আমার দিকে হিংস্র ভাবে এগিয়ে এসে আমাকে টানতে টানতে ক্লাসের মাঝখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন কাল আমি ফাল্গুনির সাথে কি করসি। আমি পুরা চমকে গেলাম। ধারণাও করতে পারিনি ফাল্গুনি সামান্য ঘটনা এভাবে আপাদের কাছে নালিশ দিয়ে বসবে। কিচ্ছু বলতে পারলাম না। আপা শাস্তি দিলেন। আমার স্কুলজীবনের প্রথম ও সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি। সারাদিন ক্লাসের সবার সামনে কানে ধরে দাঁড়ায় থাকতে হবে। বেপারটা শুনতে হয় তো অতটা কঠিন মনে হচ্ছে না কিন্তু আমাদের স্কুলে ওটাই ছিল তখন সবচেয়ে অপমানকর শাস্তি। সাধারণত নিজের বেঞ্চের উপর দাঁড়ানোই ছিল হাইয়েস্ট লেভেলের শাস্তি, আর সবার সামনে দাঁড়ানো ছিল স্কুল থেকে টিসি নেয়ার থেকেও খারাপ। আমার সাথে কোনদিন এমন কিছু ঘটবে ভাবিনি। ঘটনার গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। একটা কথাও না বলে কানে হাত দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। আপা পুরো ক্লাস আমাকে ইগ্নোর করে গেলেন, মাঝে মাঝে শুধু কথার হুল ফুটাচ্ছিলেন। পুরো ক্লাস সেদিন অবাক হয়ে ছিল। ফাল্গুনিও এত কিছু আশা করেনি। মনে আছে ও তখন বারবার আপাকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কমপ্লেন তুলে নিতে চায় কিন্তু আপা কিছুই শুনবেন না। আমাকে উনি ই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। আমার সব দোষ ঢেকে ফেলতেন। কিন্তু সেদিন উনি যে কি করলেন খোদা ! অন্যান্য আপারা যখন এসে তাকে শাস্তি মাফ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে তখন ও তিনি কারো কথায় কান দিলেন না। পরপর ৩টা ক্লাস নিজে নিলেন যাতে আর কেউ শাস্তি মাফ করার সুযোগ না পায়। এরপর টিফিন পিরিয়ড। তিনি চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। সবাই এসে বসতে বলল, আমি দাঁড়ায় থাকলাম। ফাল্গুনি কাঁদতে কাঁদতে টানাহেঁচড়া করলো, আমি দাঁড়ায় রইলাম। পরের পিরিয়ডের আপা এসে আমাকে বেঞ্চে বসতে বলার পর মাথা ওভাবেই নিচু করে এসে বসে রইলাম। স্কুল ছুটি হওয়ার আগ পর্যন্ত একইভাবে বসে ছিলাম। একবার ও মুখ তুলিনি, চোখ সরাইনি। আপা সেদিন একটি চিরন্তন কথার সাথে আমাকে প্রথমবার পরিচয় করায় দেন, প্রচন্ড ভালোবাসা আর প্রবল ঘৃণার মাঝে এক সুতা পরিমাণ পার্থক্য থাকে। কোনো কারণে সেই সুতা ছিঁড়লে ভালোবাসা ঘৃণায় পাল্টে যায়। একই পরিমাণে।
সেবারই প্রথমবার আমি দ্বিতীয় হই এক মার্কের জন্য। ফাল্গুনি হয় তৃতীয়। আমার কাজিন প্রথম।