প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সকালের এসেম্বলীতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার নিয়ম থাকলেও এ নিয়মটি মানা হয় না সারা দেশে জামাত পরিচালিত বিপুল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তাদের স্কুলগুলোতে ভুলেও কখনও জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। তার বদলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদ রচিত-'সামনে চল সামনে চল, তৌহিদেরই শান্ত্রি দল' গানটি কোমলমতি শিশুদের শেখানো হয় এবং তাদের দিয়ে গাওয়ানো হয়। যেসব স্কুলে বা মাদ্রাসায় এ গানটি গাওয়া হয় না সেখানে জামাতের দলীয় আদর্শের সাথে মিল রয়েছে এমন কোন কবির অন্য কোন রচনা বা গান, যা জামাতের নীতিনির্ধারক দ্বারা অবশ্যই অনুমোদিত, আমাদের ভবিষ্যত কোমলমতি শিশুদের দিয়ে গাওয়ানো হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও জামাত নেতারা এবং তাদের সমর্থকরা যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে না এটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে অন্য একটি সংগীত বা রচনাকে চালু করার মতো দেশদ্রোহীতার স্পর্ধার নজির আর কী হতে পারে এ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে? অথচ এ কাজটি জামাত পরিচালিত স্কুলগুলোতে প্রকাশ্যে দিবা-লোকে ঘটে যাচ্ছে, প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নাকে ডগায়, বীর বিক্রমে, ক্রামাগতভাবে।
জামাত পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সংগীত না গাওয়ার যুক্তি হিসেবে কোমল-মতি শিশুদের সামনে আমাদের জাতীয় সংগীতের মতো অনবদ্য সৃষ্টির মহান রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মীয় পরিচিতিকে বড় করে তোলা হয়। যা জামাতের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী কর্মকান্ডের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। আর এ ধরনের ব্ক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোররা তাদের অমিত সম্ভাবনার জীবন শুরু করার আগেই জামাতি ফাঁদে পড়ে। তাদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় উগ্র সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চেতনার একটি মনোজগত। এ ভাবে মানুষ কে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শিখার পরিবর্তে ধর্ম-বর্ণ-জাতি ও লিঙ্গভিত্তিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজনের চলমান শোষণ ও নিপীড়নমূলক প্রক্রিয়াকে ন্যয্যতা দানের একটি বিদ্যাজাগতিক পরিসর গড়ে তোলা হয় এ সব শিশুদের মনে। এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম স্পষ্টতই আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার বিরুদ্ধে । সুতরাং এ ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা স্পষ্টতই সংবিধানের লঙ্ঘন এবং অবশ্যই অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহীতার প্রমাণ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জামাত পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের সাথে অথবা শিশুদের অভিভাবকদের সাথে একদিন কথা বললেই এ সব তথ্যের প্রমাণ পেয়ে যাবে। এর জন্য দীর্ঘ তদন্তের প্রয়োজন হবে না।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সারা দেশে বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলোর (জেলা ও উপজেলা শহর) প্রায় প্রত্যেকটিতে জামাত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল ও মাদ্রাসা) পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার এবং বিপুল মুনাফা তৈরির উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল কারিক্যুলাম নির্ধারিত হয় জামাতের অঙ্গ সংগঠন মগবাজারস্থ ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটির মাধ্যমে। সংস্থাটির প্রধান হিসেবে নিয়োজিত থাকেন সব সময় জামাতের একজন কেন্দ্রীয নেতা। তবে একই সাথে মূল শিক্ষা বোর্ডের কারিক্যুলামও পড়ানো হয়। বাধ্য হয়ে এবং শিক্ষা বাণিজ্যের মূল মার্কেট এর কথা বিবেচনা করে। মূল শিক্ষা কারিক্যুলামের পাশাপাশি এসব বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম রচিত 'কিশোর মনে ভাবনা জাগে' বইটিও। এ ছাড়া নিজামী, আব্দুল মান্নান তালিব সহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রচিত বইগুলোও বিভিন্ন শ্রেণীতে বাধ্যতামূলভাবে পড়ানো হয়। যে শিক্ষা-কারিক্যুলামটির একমাত্র টার্গেট থাকে কোমলমতি শিশুদের জামাতের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক আদলে গড়ে তোলা।
বিগত দু'দশকে আমাদের দেশে মূল ধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সীমাহীন সীমাবদ্ধতা, বাজারী অর্থনীতি ও তথাকথিত প্রাইভেটাইজেশ প্রক্রিয়ার নামে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের হাত ধরে জামাত অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তার শিক্ষা বাণিজ্য নেটওয়ার্কটি গড়ে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান টার্গেট হিসেবে বেচে নিয়েছে মফস্বলের শহরগুলো। কিন্ডারগার্টেন স্কুল, কিন্ডার গার্টেন মাদ্রাসা নাম দিয়ে এবং অত্যন্ত চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের আকৃষ্ট করা হয়। চট্রগ্রামে শাহ ওয়ালী উল্যাহ ইনস্টিটিউট, চাঁদপুরের আল আমীন একাডেমী, ঢাকার তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা, ফেনীর ফালাহীয়া, শাহীন একাডেমী, নরসিংসীর জামেয়াই ইসলামিয়া সহ সারা দেশে অসংখ্য বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে জামাত। একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা বাণিজ্যের মাধ্যমে চুষে নিচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল। গড়ে তুলছে মৌলবাদের অর্থনীতি। যে অর্থনীতির উদ্বৃত্ব আবার ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের কাজে। এসব কিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে। এ সব প্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের আবার জামাতের রাজনীতির সাথে যুক্ত করার অশুভ ইচ্ছায় তাদের প্রথমে যুক্ত করা হচ্ছে জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন নামে রেজিস্ট্রি প্রাপ্ত সংগঠন ফুলকুঁড়ির কার্যক্রমরে সাথে। তারপর শিবিরে। এ ভাবে এ সব বিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে জামাতের কর্মী গড়া ও মৌলবাদী মুনাফা তৈরির কারখানায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করার অপরাধে শহীদ জননী জাহানার ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করা হয়েছিল। সে মামলা কাঁদে নিয়েই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চিরতরে, অনেক অভিমান নিয়ে। বিগত কয়েক বছরে অনেক দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে দেশদ্রোহীতার মামলা করা হয়েছে। সেসব মামলায় তাদের জেলেও যেতে হয়েছিল। অথচ আমাদের সবার চোখের সামনে জামাত তার প্রত্যক্ষ পরিচালনায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সংগীতকে উপেক্ষা করার মতো স্পর্ধা ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে যাচ্ছে। তাতে রাষ্ট্র বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোন টনক নড়ছে না। অথচ এ দেশ স্বাধীন না হলে, এ জাতীয় পতাকা না পেলে, এ জাতীয় সংগীত অর্জিত না হলে তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীর এ পদগুলোতে আসীন হয়ে নিজের ও পরিবারের জীবিকা অর্জনা করা কোন দিনই সম্ভব হতো না। থাকতে হতে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। দেশের বিরুদ্ধে, আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনার বিরুদ্ধে, আমাদের সংবিধানের বিরুদ্ধে জামাতের প্রতিদিনের কার্যক্রমের প্রমাণ তাদের শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলো এবং সে সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কারিক্যুলাম। বর্তমান সরকার যদি সত্যি আন্তরিক হোন, সত্যি যদি বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হন এবং বিশ্বাস করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত (সেনা প্রধান, প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশনার বারবার বিষযগুলো তাদের বক্তৃতায় বলেছেন) তবে জামাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী কার্যক্রমের অভিযোগ এনে তা প্রমাণের জন্য এ স্কুল-মাদ্রাসাগুলো পরিদর্শনে যেতে পারেন এবং অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে পারেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের সংবিধানিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার স্বার্থেই এসব শিক্ষা-প্রতিষ্টানের কার্যক্রম সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। শিক্ষাকে, আমাদের শিশুদেরকে জামাতের হাত থেকে বাঁচানোর পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ জরুরি। একই সাথে এ সব শিক্ষা প্রতিষ্টানে দেশদ্রোহী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার অপরাধে আইনী প্রক্রিয়াটাও শুরু হওয়া দরকার। এবং এখনই। তাহলেই সরকারের নীতিনির্ধারকরা যে, আন্তরিকভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কথাগুলো বলেছেন জনগণ তার প্রমাণ পাবে। না হয় অবিশ্বাসের শেকড়গুলো ক্রমশই ডাল-পালা গজাতে থাকবে। তা কোন ভাবেই কাম্য নয়। কাম্য হতে পারে না। এতে গোটা জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা সে ক্ষতির ভার আর বইতে পারবো না। সুতরাং গোটা জাতিকে নতুন ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করার তাগিদেই আইনী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হোক। এবং অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। আজকে থেকেই, এখনই..............................
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১১:৫৯