১১ –হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেয়া ভালবাসার সময়
আজ সারাটা সময় গল্পে গল্পে আর রসালো আলোচনায় গাড়ীটা মাতিয়ে রাখলো আশফাক । আশফাক দেখতে বড়ই সুদর্শন , উজ্জ্বল শ্যাম গায়ের রঙ , একহারা লম্বা । বুদ্ধিমত্তা আর পরোপকারে তাঁর জুড়ী নেই । আর বিয়ে থা না করা মানুষেরা একটু গায়ে পড়েই পরের উপকার করে থাকে – আশফাক বিষয়ে এ মন্তব্যটি তাঁর বস আসাদের !
গাড়ী জ্যামে আটকালেই আশফাক মজার মজার চুটকির দেরাজ খোলে। আর এমন কোরে সে এসব চুটকী বলতে থাকে যেন হাসির কিছুই হয় নাই । সে নিজে একটুও হাসে না , কিন্তু গাড়ীর সবাই সেসব শুনে খিল খিল করে হাসতে থাকে । এমন প্রায়শঃ ঘটে । আজকে আশফাক প্রথমে লেখাপড়া নিয়ে একটা চুটকি বললো – একজন ছোট বাচ্চা ছেলেকে তাঁর লেখাপড়া বিষয়ক প্রশ্ন ! যেমন;
-এই বাবু তুমি কি পড় ?
-প্যান্ট পড়ি ।
-না , না কোথায় পড় ?
-কেন নাভির নীচে পড়ি ।
ওরে বাবা , এতই পারে আশফাক ! নীলা ঘরদোর আর বাবুদের দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে খিলখিল কোরে হাসতেই থাকে । ভাগ্যিস মালিহা ভাবী ছিলেন , নীলা মনে মনে বলে। না হোলে কি যে হোত এত হাসির। হাসতে পারা মহাভাগ্যের ব্যাপার বটে বিশেষতঃ চাকুরীজীবি মেয়েদের । প্রমীর অসুকটাকে কেন্দ্র করে সত্যিসত্যি তাঁর আর মালিহা ভাবীর মধ্যে যেন একটা জন্মের জন্মের সম্পর্কই তৈরী হয়েছে । তুমি বেঁচে থাকো অনেক অনেক কাল মালিহা ভাবী – নীলা মনে মনে বললো । প্রমী্র মিথ্যে মিথ্যি মা হয়েও তুমি জড়িয়ে রাখো আমার প্রমীকে এমনটা কোরেই চিরকাল।নীলা অনেক অনেক ঋণী মালিহার কাছে , বিশেষতঃ সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে। এখন থেকে নীলার গৃহের বন্ধ দুয়ার সদাই উন্মুক্ত মালিহা ভাবীর জন্য !
রেহানা হাসে কম । খুব হাসির কিছু না হলে তাঁকে হাসতে দেখা যায় না । এহেন রেহানাকেও আশফাকের চুটকী মৃদু হাসায় । আশফাক অনেকটা রেহানার বর আহাদের মতো । আহাদ বোধহয় আরও এক ডিগ্রী উপরে । অন্যকে সে যেমন হাসায় , নিজেও তেমনি হাসতে থাকে । রাগ নেই , ক্রোধ নেই –কেবলই হাসি ঠাট্টা আর হাসি । প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়ীর এতো হাসিখুশী হই-হুল্লোর দেখে রেহানার অবাকই লাগতো । ইদানীং সেসব সয়ে গ্যাছে তার । বেশ এনজয়ও করে সে এ বাড়ীর পুরো পরিবেশটা ।
ঘরে ফিরে আহাদের মতো সেও আজকাল তাঁকে অফিসে ঘটে যাওয়া টুকরো দু চারটা ঘটনা খুলে বলে । শেয়ার করে । অবশ্য মতিয়র রহমান আর তাঁর বউ আজমেরীর তাঁকে নিয়ে কবিতা সবিতা বিষয়টা ব লি ব লি কোরে বলা হয়নি এ বাড়ীর কাউকে , এমনকি আহাদকেও না । কি দরকার , মিছেমিছি মতিয়র রহমানকে ছোট করা । কিন্তু বিশেষ অবাক করা কথা এই যে, রেহানাকে নিয়ে মতিয়র রহমানের বউয়ের সেইসব কবিতা লেখালেখির সন্দেহ নুতুন করে রেহানাকে কবি বানিয়েছে । চেষ্টা কবি আর কি ! লুকিয়ে লুকিয়ে রেহানা আজকাল কবিতা লেখার চেষ্টা করে। আর সেই কবিতার খাতাটা সে অফিসের ড্রয়ারে যক্ষের ধনের মতো চাবি এঁটে লুকিয়ে রাখে !
এবারে শুরু হোল আশফাকের দ্বিতীয় চুটকী আর তা পক্ষী সংএান্ত । সবাই কান খাড়া করে । যেমন ; প্রাইভেট টিউটর ছাত্রকে পাখী বিষয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন । নতুন নতুন পাখীর নাম জিজ্ঞেস করছেন !
শিক্ষক -বাবা , একটা পাখীর নাম বলতো ।
ছাত্র – কুকরা ।
শিক্ষক (মনে মনে)- হ্যাঁ দুই ডানা আছে মুরগীর , মুরগীকে পাখী বলা যায় বটে । তা বাবা আর একটা পাখীর নাম বল !
ছাত্র – বড় কুকরা ।
শিক্ষক (মনে মনে) - আচ্ছা চলে পাখীর মতই তো। তা বাবা আর একটা পাখীর নাম বলতো !
ছাত্র – বাচ্চা কুকরা ।
ওহ চলতেই থাকে ।গাড়ির সবাই আবার হো হো হি হি কোরে হেসে উঠে ! কিন্তু আশফাকের মুখে আগের মতোই হাসি নেই !যেমন ছিল , তেমনি করেই সে অচঞ্চল বসে থাকে তাঁর সিটে !
আজ রবিবার । আলমাসের মেয়ের স্কুল খোলা ।সে যদিও মীরপুর থাকে , তবুও মেয়ের কারণে তাঁকে হোম ইকনমিস্ক কলেজের গেট থেকে রোজ তুলতে হয় । মেয়েকে ওয়াই ডাবলু সি স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আলমাস হাইকোর্ট বরাবর হাঁটতে থাকে। প্রায়দিনই পথের নিয়ম কানুন পেড়িয়ে গাড়ীটা তাঁর কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ঘড়ির কাটা বখাটে ছোকরার মতো নিয়ম কানুন ভাঙ্গে । ছায়াবিহীন নিবান্ধন পথে একা হাঁটতে হাঁটতে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আলমাসের পায়ে ঘুন পোকারা খেলা করে । ঘন নীল সাটের বুকে লুকানো ওর বিষণ্ণ মুখটা দেখা যায় অনেক অনেক দূর থেকে ।এসে গ্যাছে । সাদা রঙের মাইক্রোটা দূর থেকে নজরে এলেই আলমাস একটা নির্ভেজাল হাসি হাসে ।
সুতপার মুখ জুড়ে আজ কেবলি তাঁর নতুন বস নুসরাত আলীর গল্প । স্যার ক্যামন যেন ! আনমনা না আলাভোলো । না নিরামিশ । এসব বুঝতে নাকি বেশ বেগ পেতে হোচ্ছে সুতপার । সবাই এসব শুনেই গেল । কেবল আশফাক বললো - চালিয়ে যান । একদিন বাগে আসবেই আসবে । আশফাকের কথায় সুতপার ভারী রাগ হয় । ক্যামন যেন সৃষ্টি ছাড়া কথা বলে সে সব সময় । কেউ কিছু বলে না তাই । সুতপার ইচ্ছে করে আশফাকের বস আসাদ স্যারকে জড়িয়ে একটা জুতসই উত্তর দিতে । কিন্তু দেয় না । কি মনে কোরে চুপচাপই থাকে সে। কিসে থেকে কি হয় । এ গাড়ীর সবাই আবার আশফাকের মস্ত ফ্যান !
কি ব্যাপার স্যার , আজকে মনে হোচ্ছে আপনার মুডটা ভালোই । রোদটোদ নাই নাকি স্যার, আশফাক আলমাসকে ঘাড় ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে । আলমাস উত্তর দেয়না । কেবল একটু হাসে । এমনিতেই সে খুব কম কথা বলে । কথা মুখ ফুটে বলার চেয়ে মুখ বন্ধ রাখতেই ভালো লাগে তাঁর ।আজ এমনিতেই তাঁর মুড ভালো নেই । দিনাজপুর থেকে গিন্নীর বাবার বাড়ীর একগাদা আত্নীয়সব্জন এসেছে স্কয়ারে ডাক্তার দেখাতে , একজনের সাথে আরও তিনজন । এমন ঘন ঘন মফস্বল থেকে আত্নীয় পরিজন আসলে কিইবা করবে সে । ঘন ঘন ট্যুর কিনবা পি এফ এর টাকা তোলা ছাড়া কোন গতি নেই । অথচ তাঁর নিজের ছোট্ট সংসার । একটা মোটে মেয়ে । এই দুপক্ষ থেকেই ডাক্তার দেখাতে হররোজ আত্নীয় পরিজনের আসা যাওয়া লেগেই আছে । লুবনার এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই । সে বলে ঢাকায় থাকলে এসব সইতেই হবে । আর কিইবা করা । তোমার আর আমার আপনজনরাই তো আসছে । স্ত্রির কথায় আলমাসের রাগ আরও যায় বেড়ে । কিন্তু সে লুবনাকে জোরে শোরে কিছু বলতে পারে না । আর বেচারির কিইবা দোষ !
কার্জন হলটা হাতের ডান দিকটায় রেখে দর্পভরে এগিয়ে চলে মাইক্রোবাসটা । বেশ এসে গেছি , এসে গেছি একটা ভাব । বাঁধা যে সে পায় না তা নয় । কাতারে কাতারে গাড়ী । বাস , প্রাইভেট গাড়ী , অফিস গাড়ী , টেম্পো , রিক্সা আরও কত কি ! আছে পথ- চারীর ভিড় । গাছওয়ালা । বাহারী গাছের মেলা । পসরা দোকানী । অফিস যাত্রী । শিক্ষাথী । ফেরীওয়ালা । ভিখারী । হাই কোর্টের মাজার । পান আর ফুল ওয়ালী ! হাই কোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে কজনা আসল ফকির ! আমাদের সময় গানটা খুব জনপ্রিয় ছিল ফস কোরে বলে ফেলে আলমাস। কে যেন গেয়েছিল গানটা ! ফিরোজ সাঁই , আজম খান নাকি ফকির আলমগির ? গাড়ীর কেঊই শুদ্ধ উত্তরটা দিতে পারলো না । ঢাকা শহরে গান শোনার মানুষ খুব কম কি ! নাহ , এখন সবাই নতুন মুখের গান শোনে কি ! শোনে না গান দেখে !
গানের কথা মনে হতেই রেহানার মাথায় কেন জানি কবিতার ভূত চেপে বসে। গান আর কবিতা দুই সখী যেন ! নতুন নতুন নানা শব্দমালা বুকের চারপাশটায় জমা হয়ে তাঁকে বারে বারে মতিয়র রহমানের কবিতার খাতার সেইসব কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয় । আজমেরীর ? কার্জন হলটার আশপাশের !
ফুটপাতের উপর বসে গায়ে গায়ে রোদ্দুরের
নাকছাবি পোহাচেছ কজন ! টেরিকাট চুল
উড়ু উড়ু মনের উসকো খুসকো যুবকটি লেপটে আছে
ডোরা কাটা শাড়ি , নীল চুড়ি যুবতীটির গায় ! পাশে গোমড়া মুখো একজন,
শাশুড়িই হবে হয়তো , চারদিকে পান পিকছিটিয়ে চোখে মুখে জানান দিচেছ- আমাদেরও তো বয়স ছিলো
তা বোলে এতো আদিখ্যেতা ?
কয়েকটা চুনো পুঁটী রোদ কাঁথা গায়ে । বট পাতার নীচে সুখ সুখ রোদে থৈ থৈ নানান জাতের মুখ !
যে যার মতো মহা ব্যস্ত যেন !
রোদেরও তো আবার হিসেব আছে।কতোটা সময় সে দেবে পোহাবার ,
কতটা সময় ধান কাঁথা শুকোবার
কতটা সময় হেলা ফেলা করে কাটিয়ে দেয়ার আর কতটা সময় অভিসারের ...।
এখন সময় পোহাবার , হয়তো বা
অভিসারের ! ঝুড়ি বাদাম বুকে ফিঁকে ঠোঁট ছেলেটির মন আজ ভারী ।
ভীষণ ভারী ! য়ুনিভা বন্দ অকারনেই
বাদাম খোলার জলে ডুব দেবে কারা ?
ফুলের দোকানীরও একটুএকটু করে কষ্ট জমছে বুকে ! বুকের মধ্যে !
অতঃপর তাদের দেখা মিললো , জোড়ায় জোড়ায় বাঁধা
কপোত –কপোতী যেন !
লাল, নীল , সাদা , বেগুনী
হলুদ , সবুজ কত কত !
ওরা এসে চিলতে ফুটপাতের
বুক জুড়ে বসলো । হাসলো , খেললো –করলো যত হুটোপুটি ,খুনসুটি । বাদাম চিবলো
, কেউ ফুল পড়লো খোঁপায় , কেউবা রেখে দিলো সযত্নে বুক পকেটে !
রোদটা তখন হঠাৎ করেই ভালবাসার সময় দিলো বাড়িয়ে !
**সব চরিত্রই কাল্পনিক
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:০০