অফিসের গাড়ী (ছয় )
পঞ্চাশ সিনড্রোম
জোহরা উম্মে হাসান
নুসরাত আলীর এখন বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই । এ বয়সেও ভারী টিপটপ আর কেতাদুরুস্ত সে। দারুন ম্যানলি । তাঁকে দেখলে মনে হবে তাঁর বয়স তাঁর বড় জোড় ৪০ কিংবা ৪২ । নিজের বয়স প্রায় ন দশ বছর কিভাবে যে লুকিয়ে রেখেছে সে , তা খোদাই জানেন ! এর আলাদা কোন মাজেজা নেই, বাহিরে নুসরাত আলী তা বলে বেড়া্য বটে । কিন্তু আছে ! নুসরাত আলী রেগুলার ডায়েট করে। প্রতিদিন সকালে ওয়াকিং স্যূট আর কেডস পরে চন্দ্রিমা উদ্যানে দুপাক হাঁটা তাঁর রুটিন ওয়ার্ক এ পড়ে । সোবহানবাগ ছ তলা স্টাফ কোয়াটা্রে তাঁর বাস ! সেখান থেকে সংসদ ভবন খুব কাছে , এমন কি খোদ প্রধান মন্ত্রীর বাড়ীও !
যে অফিসটাতে আজ নুসরাত আলীর নুতুন পোস্টিং হোল , সেখানে অনেক মেয়ে চাকরি করে । আগের অফিসের মতোই । আগের সে অফিসটায় কাজ করার অভিজ্ঞতা যদিও তার জন্য ততটা সুখকর নয় । তবুও মেয়েদের সঙ্গে চাকরি করার বাড়তি একটা পাওনা আছে বলে মনে করে নু্সরাত আলী । চারদিক জুড়ে বেশ একটা নব-বসন্ত বসন্ত ভাব । ফুলের মৌ মৌ চাপা সুবাস । ফিনফিনে হাসি বিদেশী পা্রফিউমের মতো সদাই মন কাড়ে । । সহকর্মী হিসেবেও মেয়েরা খুব ভাল হয় । দলাদলি মারামারিতে যায় না । লেগ পুলিং এর ধার ধারে না । আর------ , না আর কিছু না । এরপর নুসরাত আলী নতুন করে আর কিছু বলতে চায় না মেয়েদের নিয়ে । অনেক শিক্ষা হোয়েছে তাঁর !
আগের অফিসের বস ছিলেন জানে আলম সরকার । অফিস পাড়ায় তাঁকে সবাই বেশ সমঝে চলত । দারুন রাশভারি আর একগুয়ে স্বভাবের মানুষ । যা হোক , নুসরাত আলী তাঁর কাজ আর কথা দিয়ে বসকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করে ফেলেছিল । কিন্তু একটা বড় বাজে দোষ ছিল ভদ্রলোকের । আর তা হল কান কথা শোনা । নুসরাত আলীর নামে কে যে কি লাগিয়েছিল , আর তাতেই সাত দিনের মাথায় বদলীর খড়গ ! ঢাকায় থাকা সে কি চাট্টিখানি কথা ! ধরাধরি করে প্রথমে ওএসডি আর তারপর একবছর তপস্যা করে নুতুন এই পোস্টিং ।
আজ নতুন এ অফিসটায় জয়েন করার আগে নুসরাত আলীর বউ রেহনুমা , মানে নুমা বারে বারে তাঁকে বলে দিয়েছে সাবধানে থাকতে । চোখ কান খোলা রেখে চলতে। কারো সাথে বাদ-বিবাদে অযথা জড়িয়ে না পড়তে । আগের অফিসে হালকা একটা বিবাদে নিজেকে জড়িয়েছিল সে বটে । কিন্তু সেটা কি তা আজতক জানে না নুমা। তবে নুসরাত আলী তাঁর সহজ সরল বউটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে এ বিষয়ে এটা ওটা বলে থামিয়ে দিয়েছে ।
নতুন অফিসে জয়নিং এর আগে বউয়ের সাবধান বাণীতে নুসরাত আলী অবোধ শিশুর মত কেবল মাথা নাড়িয়ে হাঁ হাঁ বলেছে । তাতেই মহাখুশী রেহনুমা । বরকে আঁচলের তলায় বেঁধে রাখতে কারই না ভাল্লাগে ! তাও মহাবাঁচা । মনে মনে প্রমাদ গোনে নুসরাত আলী । ভাগ্যিস এখন পর্যন্ত তাঁর বদলির আসল কারণ জানে না নুমা । জানলে তাঁর এত সাধের গেহ প্রেম ভালবাসা শুকনো পাতার মতো পলকা বাতাসে উড়ে যেত ।
স্বামীর অফিশিয়াল ব্যাপার ট্যাপার এসব সব কি ঘরের বউকে জানতে হবে ? নাকি জানাতে হবে ? ঘর আর বাহির এক করোনা ভায়া । এ ছবকটা সে পেয়েছিল তার আদিগুরু মহব্বত খান মাওলার কাছ থেকে। এতদিন এই তত্ত্বের প্রয়োগ বা প্রমাণের তাঁর প্রয়োজন হয়নি । কিন্তু পূর্ব পঞ্চাশে এসে গুরুর কথার গুরুত্ব যে কতখানি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নুসরাত আলী !
আসল কথা হোল আগের বসের সাথে নুসরাত আলীর লেগেছিল জিনাতকে নিয়ে । জিনাত আরা হক । নাম যাইই হোক না ক্যানো, বড়ই নিরীহ আর গোবেচারা স্বভাবের একটা মেয়ে । অতি সাধারণ একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে তেল নিপাট চুলে দুরু দুরু বুকে যোগ দিতে এসেছিল কাজে।
বস কেন জানি তাঁকে দেখেই ভ্রু বাকিয়ে বলেছিলেন - বুঝলে নুসরাত এসব মেয়েরা চাকরি পায় স্রেফ পলিটিকাল ব্যাকিং এ । হাতে পায়ে ধরে । কত ভাল ভাল মেধাবি ছেলেমেয়েরা চাকরি পায় না, কিন্তু এরা পায় । এদের হাতে ধরে কাজ শিখাতে গেলে জীবন যৌবন সব শেষ । দেখ, এই প্যানসে মেয়েটাকে নিয়ে তুমি কি করতে পার ।
নুসরাত আলীর কপালে জিনাতকে কাজ শিখানোর দায়িত্ব পড়েছিল । প্রথম প্রথম একটু বিরক্তই লাগতো তার ! নিজের কাজের দেরী হতো । তারপরও কিভাবে নথি খুলতে হয়, নোট ,মিনিটস লিখতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি কাজগুলো পরম ধৈয্য ধরে জিনাতকে শেখাচ্ছিলো সে । শেখাতে গিয়ে একসময় তাঁর মনে হোচ্ছিল , জিনাতকে শেখানোর এ দায়িত্বটা না পেলে তাঁর জীবন যেন অপূর্ণই থেকে যেত ! কিছুই না, তেমন কিছুই না । কেবল টেবিলের ও পাশে বসে থাকা একটা কোমল সুন্দর মুখ প্রতিদিন দেখা । কখনও বা আচমকা আলতো হাতের স্পর্শ । এর চেয়ে নুসরাত আলীর বেশি কিছুর প্রয়োজন ছিল না । এটুকুই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল !
তবে কোন কোন দিন নুসরাত আলীর মনে হতো- জিনাতের কাজ শেখায় মন নেই । চুপচাপ কেবল এমনি এমনি সে সময় নষ্ট কোরছে । মন খারাপ নাকি তোমার জিনাত ? নুসরাত আলীর কণ্ঠে রাজ্যের ব্যাকুলতা ঝরে পড়তো । বলেই সে মনে মনে কামনা করতো- না, না বলুক জিনাত । না বলুক । মন বা শরীর খারাপ হলেই তো জিনাত তাঁর সামনে থেকে এখনই চলে যাবে । কি ভয়ানক এক অবসেশন !
নিজের বউ নুমাকে আগের মতো ভালো লাগছিল না কি তার ? কি জানি । তবে ফিকে আবছা ভালো !
নুমা কিন্তু আগের মতোই রোজ রোজ বিকেলের খাবার তৈরী করে , সুন্দর করে সেজেগুজে সামনের চিলতে বারান্দাটায় বসে স্বামীর অফিসের মাইক্রো বাসটার হর্নটা শোনার জন্য কান পেতে থাকতো । ক্রিম সাদা গাড়িটা গেটের বুক ছুঁলেই এক দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে সে চঞ্চল পায়ে সামনের দরজা খুলে দিত । প্রতিদানে নুসরাত আলীও আলতো করে বউয়ের গালটা ছুঁয়ে দিত । কিন্তু জিনাতের সাথে পরিচয়ের পর কেন জানি মাঝে মধ্যেই এ কাজটা করতে ভুলে যেত সে !
রোজ রোজ অফিসে এসেই জিনাত আগে ঢুকতো নুসরাত আলীর রুমে । সুমসাম সুন্দর সাজানো গোঁজানো পরিপাটি ঘর । ভারী পর্দা দেয়া । নিঝুম । কেউ নেই চারদিকে । কেবল সে আর নুসরাত আলী । জিনাতকে দেখেই মনে মনে ক্যামন যেন একটা নাম না জানা পুলক অনুভব করতো নুসরাত আলী! সুযোগ পেলেই সে জিনাতের চোখ ফাঁকি দিয়ে আড় চোখে তাকিয়ে দেখতো তাঁকে । তাঁর মতো জিনাতের মনেই কি ভাললাগার ছায়া ? কিন্তু এটা কি ঠিক হোচ্ছে ? পরক্ষণেই নুসরাত আলী মনে মনে নিজেই নিজেকে শুধাতো । না ! না ! কিন্তু ভাললাগা তো কোন দোষের নয় নুসরাত , এতো ভালবাসা নয় – কে যেন তাঁকে কানে কানে বলতো !
দিনকে দিন জিনাত যতই চটপটে আর ফিটফাট হোচ্ছিল , ততই নুসরাত আলীর মনটা ক্যামন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছিল । সে মনে মনে চাইতো , কাজ শিখতে জিনাতের আরও দেরী হোক । সে বার বার একই কাজের জন্য তাঁর কাছে এসে ঘুরপাক খাক । কিন্তু বড়ই ঝটপট করে লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠছিলো জিনাত । নুসরাত আলীর মনে হোচ্ছিল আগের জিনাতই বেশী ভালো ছিলো । গেঁয়ো গেঁয়ো । সহজ সরল । জানে না কিছুই । কিন্তু মেয়েরা কিভাবে যে এতো তাড়াতাড়ি খোল নলচে পালটে ফেলে তা ভেবে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিল না নুসরাত আলী !
মাস কয়েকের মধ্যে জিনাতের নুসরাত আলীর ঘরে আসা ভাটা পড়তে থাকে । এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে । এমনও হোয়েছে যে , নুসরাত আলী নয়টার সময় চেম্বারে ঢুকেই তড়িঘড়ি কোরে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে পিয়নের কাছে জানতে চেয়েছে - জিনাত এসেছিল কি না । এসে সে যদি ফিরে যায় , এই ভাবনাটাই প্রতিনিয়ত গ্রাস করতো তাকে । কিন্তু তারপরও প্রতীক্ষা । নয়টা থেকে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে দশটায় । এরপর এগারো । বারো । এক । নুসরাত আলীর মনটা জিনাতের আগমনী গান শোনার জন্য কান পেতেই থাকতো । কিন্তু জিনাতের দেখা মিলতো না । ইন্টারকমে কথা বলা যেত । ল্যান্ড ফোনে কিংবা মোবাইলে । কিন্ত নুসরাত আলী পণ করে বসেছিল জিনাতের সাথে আগে সে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না ।
জিনাত ততদিনে ঘন ঘন বসের রুমের দিকে পা বাড়াচ্ছে , জেনে গিয়েছিল নুসরাত আলী । তাঁর কাছে যে সময়টায় আসতো , সেই সময়টাকেই বসের রুমে যাবার উপযুক্ত সময় বলে বেছে নিয়েছিল সে ! শোনা কথা , বস নাকি তাঁকে গণিত শেখাচ্ছেন ! অংক শিখে কি করবে মেয়েটি ? বস নাকি তাঁকে হাসি হাসি মুখে বলছেন , তুমি অঙ্কে ভারী কাঁচা হে । কাঁচাই তো । কাঁচা না হলে কি আর সে নুসরাত আলীর মত তিন নম্বর কলিগের সাথে কথা বলে এতো সময় নষ্ট করে । দিনকে দিন অঙ্কে খুব পাকা হোয়ে উঠছিলো জিনাত !
তোমার সেই নুসরাত আলীকে ক্যামন মানুষ বলে মনে হয় জিনাত ? ছিলে তো তাঁর সাথে ম্যালা দিন । বস নীচের ঠোঁটটা চেপে হাসি হাসি মুখে জিনাতকে প্রায়শঃ জিজ্ঞেস করে !
জিনাত ভ্রু উল্টিয়ে বলে , আপনাকে কি আর নতুন কোরে বলতে হবে স্যার ? দারুন সেন্টিমেন্টাল আর মেয়েলী । মেয়ে ঘেঁষা !
আর আমি ?
জিনাত খিল খিল করে হাসতো । আপনি ? রয়েল বেঙ্গল টাইগার ! না, না তাঁর সাথে এই পারিফিউমটার মতোই সুগগ্ধময় ।গুচ্চি !
জিনাতকে দেখার আশা তখনও ছাড়েনি নুসরাত আলী্ । গ্যাপটা কাটিয়ে উঠবার জন্য জিনাতকে সেই মোবাইল সেটটা উপহার দেয়ার পরেই বাঁধলো যত গণ্ডগোল । আসলে নুসরাত আলী নুতুন করে একটু চমক দিতে চেয়েছিল জিনাতকে । আবার একটু আপন হওয়া । এই আর কি । মিসকালো রঙের স্লিম সেটটা পেয়ে জিনাত সত্যই খুব খুশী হয়েছিল । তারপর মুখ ফসকে সে বলে ফেলেছিল - কি দারুন কোইনসিডেনস দেখুন নুসরাত ভাই । ভাই ? স্যারও কিন্তু কাল আমাকে খুব সুন্দর একটা সেট উপহার দিয়েছেন । গ্যালাস্খি থ্রী । হায় রে হায় । তারপরই ট্রান্সফার অর্ডার । এক ঘরমে দো পীর ! জিনাত স্যারকেও নিশ্চয়ই বলেছিল , দেখুন কি দারুন কোইনসিডেনস স্যার ! নাকি ভাই ?
এ ঘটনার পর জিনাতকে নয় নুমাকে হারানোর ভয় পেয়ে বসেছিল নুসরাত আলীকে । কেউ যদি বলে দেয় নুমাকে সব কথা । জিনাতের কথা । মোবাইল সেট । বদলী ! উহ ! কনফেশন ! সত্যিই কি কনফেশন করতে হবে নুমার কাছে । করলে কি হবে । ভাঙ্গা ফুলদানি জোড়া লাগানোর পর যেমন একটা দাগ থেকেই যায় , তেমনি একটা দাগ থেকেই যাবে নুমার বুকে !
কিন্তু তেমন দোষ তো করেনি সে । কিন্তু যা করেছে তাইই বা কম কিসে ? ভালবাসা । আনুগত্য । বিশস্ততা । এগুলো যেন কোথা থেকে উড়ে উড়ে এসে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছিলো নুসরাত আলীকে । আচ্ছা , একটা মানুষের মধ্যে কি হাল্কা পাতলা দোষ ত্থাকতে পারেনা ? মানুষ তো আর দেবতা না । কেবলি একটু ভাললাগা । এর চেয়ে বড় কোন ভুল করেনি সে । কিন্তু যদি সে করেই ফেলতো ? নুসরাত আলীর তাই হঠাৎ করে পাওয়া বদলীর অর্ডারটা আশীর্বাদ বলেই মনে হোয়েছিল !
এবারের অফিসটার যে রুমটায় বসেছে নুসরাত আলী - সেটাও বেশ নিরিবিলি । ছিমছাম ! আগের অফিসের রুমটার চেয়ে অনেক বড় ! হবেই বা না কেন । কেননা একবছর ওএসডি থাকা অবস্থায় সে তাঁর প্রমোশনটা সময় মতই বাগিয়ে নিয়েছে ! তবে এসব , সব সম্ভব হোয়েছে নুমার বাবার কল্যানে ! নুমার ফ্যামিলির লোকেরা রাজনীতি করে । বাঘা বাঘা লোক আছে দু পাশেই ।
নুসরাত আলী এখানে আসার আগেই মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে এসেছে- ভুলেও আর কোন জিনাত কাহিনী নয় ! তবে তারই বা তেমন দোষ কোথায়! পাতলা ফিনফিনে দুধশাদা রঙের বোকাসোকা একটা মেয়ে যদি কাছে এসে নিত্য কাঁদো কাঁদো সুরে বলে, স্যার এটা বুঝি না , ওটা বুঝি না! তবে ধরা তো খেতেই হয় । সেও খেয়েছিল ।
নুতুন এ অফিসের মান্থলি মিটিং এ নুসরাত আলীর পরিচয় হলো সবার সাথে ! মিটিং শেষে কয়েকজন মেয়ে কলিগের নামই কেবল মনে থাকলো তাঁর । নীলা , তানজিলা ,আফরিন , সুতপা ইত্যাদি ! কিন্তু এটা কি খুব ভালো লক্ষণ ? আর সুতপা নামের মেয়েটিকে দেখে ভিমরি খাবার যোগাড় হোল নুসরাত আলীর । ওরে বাবা , এ যেন জিনাতের জেরম কপি !
টেবিলে রাখা টেলিফোনটার আলো জ্বলল ! সাউন্ড কমানো । রেহনুমার কল ! এ আবার এক জ্বালা ।ভালবাসার জ্বালা । অনবরত কল আর কল । রেহনুমা কি ইদানীং তাঁকে সন্দেহ করা শুরু কোরেছে ?
-হু , হ্যালো কি খবর ? বল !
- খবর তো তোমার কাছেই । এই মিটিং কেমন হল । তোমার সহকর্মীরা সব কেমন । তোমায় মন থেকে নিল তো - নুমা বেশ ব্যাকুল হয়েই জানতে চাইলো ।
-দুর , পাগলী , একদিনে বোঝা যায় বুঝি কে কেমন । আমি কেমন । বা ওরা ! বলতে গিয়ে নুসরাত আলীর মনের মধ্যে একবার জিনাত আর একবার সুতপা উঁকি দিল । দূর হ --- দূর হ !
নুমা আজ বেশ খোশ মেজাজে আছে । স্বামীর ভাল পোস্টিং মানে সন্মান বাড়লো তাঁর আবার । কোয়াটারে কোয়াটারে বউদের মধ্যে আলোচনা চলে এসব নিয়ে । কার স্বামীর কোথায় পোস্টিং । কে ওএসডি হয়ে জাবড় কাটছে বছরের পর বছর !
- স্বামীর কথার রেশ টেনে নুমা বলল, বোঝা যায় না ? তা অবশ্য , সারা জীবন এক সাথে থেকেও তো একজন অন্য জনকে চিনতে পারে না ।
নুসরাত আলী একটু ভয়ই পেল । আজ নুমার গলার স্বরটা কেমন যেন অন্য রকম শোনাচ্ছে ! রেহনুমা কি দিনে দিনে ভয়ানক ম্যাচিউরড হয়ে উঠছে । নাকি কোন গায়েবী বার্তা পাচ্ছে আজকাল । কেউ বলে দেয়নি তো জিনাতের কথা ?
- ইউ আর সো সিম্পল এ্যাজ ওয়েল এ্যাজ এট্টাক্টিভ । আই লাভ ইউ ভেরি ম্যাচ নুমা । নুসরাত আলী মনে প্রানে বলতে চাইলো ! পারলো না । এখানে এসব বলার সুযোগ যেন নেই । তাঁর দরজার কোনায় রবিউল নামের ছেলেটি বসা । আচ্ছা, ও ইংরেজি বোঝে নাকি , বাংলা তো অবশ্যই অবশ্যই বোঝে । চোখ দিয়ে গিলছে স্যারের সব কথা ! এর নাম আনুগত্যও হতে পারে ! যাকগে ।
-আই লাভ ইউ মাই ডার্লিং , মিন মিন কোরে শেষমেষ তাঁকে বলেই ফেললো নুসরাত আলী । জিনাত জিনাত করে , অনেকটা দিন সে অবহেলা করেছে নুমাকে । যদিও টের পায়নি বউটি তার , তাই রক্ষে ।
নুমা তখনও ফোনের ওপাশে । মাঝে মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতে ভালবাসে সে! আবার কখনও বোলেও বলে না ।
নুসরাত আলী বেশ হাসিমুখে বললো- নুমা শোন , এ অফিসটা খুব ভালো । বস কিন্তু মহিলা ! সবাইকে ভালই বলে মনে হল ! এ অফিসেও যে একগন্ডা মেয়ে অফিসার আছে আগের অফিসটার মত , তা বলি বলি করেও সে বললোনা রেহনুমাকে ! আসলে এ লক্ষণটা ভাল । মেয়েরা অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে !
নুমা ফোন রাখল !
কিন্তু কোথা থেকে যেন জিনাতই উড়ে এল । থুরি জিনাত নয় সুতপা !
-স্যার , খুব ভাল লাগলো , আপনাকে পেয়ে ! সুতপার হাতে একটা মোটা ফাইল, বহু ব্যবহারে জীর্ণ !
-বসেন সুতপা !
-স্যার , বসেন কেন , আমাকে তুমি বলবেন । এখানে বড়রা সবাই ছোটদেরকে তুমি বলে । ম্যাদাম তো সবাইকেই তুমি বলেন। আপনাকেও বলবে দেখবেন !
ওরে বাবা এ মেয়েটিও দেখছি কম কথা বলে না । একবারে জিনাতের মত। তাঁর কপালেই কেন যে বেশী বেশী কথা বলা মেয়েরা আসে ।
-হু, তিনি তো বলতেই পারেন , এতে অবশ্য র্যাপোট বাড়ে । আমিও তাই পছন্দ করি- তবে এখন থেকে নুসরাত আলী দারুন ফরমাল !
-হোক স্যার , আপনি আমাকে তুমিই বলবেন, অন্যরা তাদেরটা ভাববে !
ফাইলে সই হোল , দুজন ঘুরে সে তিন ! এরপর মাদাম ! নুসরাত আলী বললো , ফাইলে এতজনের স্বাক্ষর দেয়ার নিয়ম তো নেই !
-সুতপা ভ্রু কুঁচকে বলল , কনসারন্ড সবাই এর সব জানা ভাল । এতে সুবিধা হয় কাজের ।
-দেরীও তো হয় !
-না, না স্যার , এখানে সবাই পানচুয়াল । এমন কি ম্যাদামকে না বলে বাহিরেও যায় না কেউ !
-ওরে বাবা !
-কিছু বললেন কি স্যার ?
-না , না তো ।
নুসরাত আলীর সরাসরি মেয়ে বস বলতে গেলে এই প্রথম !যা হোক , বস বেশ ভালই বলতে হবে । মেয়েরা তো মেয়েদের প্রশংসা করে না সহজে । আবার যখন করতে থাকে তখন ভালোর বন্যা বইয়ে দেয় ! এই মেয়েটি সত্যি না মিথ্যে বলছে তা ঠিক বুঝতে পারছে না সে !
সুতপা তো আর মনের কথা পড়তে পারছে না নুসরাত আলীর । না পারুক , কোনদিনই না পারুক । নুতুন কোন জিনাত এপিসোডে জড়িয়ে পড়ার আদৌও ইচ্ছে নেই তাঁর । এক্ষণে তাড়াতাড়ি সুতপাকে বিদায় করতে পারলে যেন বেঁচে যায় নুসরাত আলী ।
সুতপা বেশ একটু অবাকই হোল তাঁর আচরণে । নিরামিষ ! মনে মনে বললো সে । তারপর ফাইল হাতে চলে গেল রিনি ঝিনি মল বাজিয়ে !
সুতপাকে একরকম জোর কোরে বিদায় দিতে একটু কষ্টই হোল নুসরাত আলীর । মেয়েটি হয়তো ভুল বুঝলো তাঁকে। বুঝুক । সে যে কলিগদের ব্যাপারে কতো কনশারন্ড তা কেবল জিনাতই জানতো ! এখনও নিশ্চয় সে - সে কথা অস্বীকার কোরতে পারবে না !সুতপার মাঝে ক্যামন যেন একটা জিনাত জিনাত ভাব ।
কিন্তু জিনাত থেকে বেড়িয়ে আসতেই হবে তাঁকে । উপায় নেই ! না হলে আবার বদলী । আবছা নুমা । ভাললাগা আর ভালবাসার টানপোড়ন । না । মনকে আর বাড়তে দেবে বা নুসরাত আলী ! মেয়েদের দেখলেই ক্যানো মিছে এই ভাললাগা ! আসলে নুসরাত আলী কি কোন সিনড্রোমে ভুগছে ! তার মনের এই অস্বাভাবিক লক্ষণকে সিনড্রোম না বলে সে আর কি বলবে। ছুঁইছুঁই পঞ্চাশের ভীমরতি ? গোল্লায় যাক পঞ্চাশ সিনড্রোম ! কেবল নুমা , নুমাই থাক ।
** সব চরিত্রই কাল্পনিক
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৪