পাঁচ –খেলা ভাঙার খেলা
অফিসে একজন সহকর্মীর সাথে আরেকজন সহকর্মীর খুব যে সখ্যতা থাকে তা নয় । তবে উপরে উপরে ভালোবাসার মুখোশটা পড়ে থাকতেই হয় । না হলে বিপদ বাড়ে , নিজের সন্মানটুকুও কোন এক ফাঁকে ক্ষুণ্ণ হয় !আসাদ সে কথা ভালভাবেই জানে । আর তা জানে বলেই আশফাককে সে বেশ একটু সমঝে চলে। যদিও সে আশফাকের চেয়ে বেশ একটু সিনিয়র –পদে আর বয়সেও ! আর সেই সামান্যতম বড়ত্বের সুবাদে ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় যাই হোক না কেন সে তার উপর মাঝে মধ্যে হম্বিতম্বিও করে !
ছয় তলা অফিসটার চার তলার একবারে শেষ মাথায় কোনার দিকের রুমটায় ওরা দুজন এক সাথেই বসে ।রুমটা যদিও আয়তনে খুব একটা ছোট নয় বরঞ্চ মাঝারীই । তবে বেশ বড় বড় দুটো ক্যাবিনেট ঘরটার অনেকখানি জায়গা খেয়ে ফেলেছে বলে সেটি আকারে এখন বেশ ছোটই দেখায় । বাম দিকটার খোলা স্পেসটায় গায়ে গায়ে দুটো নাতিদীর্ঘ কাঠের টেবিল বসানো । সামনে একই ধরনের মাথা উঁচু গদি আটা দু হাতি চেয়ার । চেয়ার দুটোর মাথায় নীল সাদা স্টাইপের বেশ বড় বড় দুটো তোয়ালে । টেবিলের নীচে আরাম কোরে পা রাখবার জন্য কাঠের ছোট ছোট প্রায় আধা ফুট উঁচু টুল ! আশফাকের পা লম্বা , তাই এ ধরণের টুলটুলে তার দারুন অনীহা । সে প্রতিদিন চেয়ারে বসবার সময় খুব বিরক্তিভরে পা দিয়ে ঠেলে টুলটাকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখে । পরদিন বসার সময় আবার সেটাকে স্বস্থানে দেখতে পেয়ে সহজেই বুঝে নেয় এ নির্ঘাত ঝাড়ুদারের কাণ্ড । তবে আসাদের ব্যাপারটি অন্যরকম । এই হাফ হাতি কাঠের অসাড় বস্তুটি ছাড়া তার যেন একেবারেই চলে না ।
আশফাকের টেবিলের উপর লাল ফিতায় বাঁধা অনেকগুলো খাকি রঙের ফাইল কিছুটা এলোমেলো ভাবেই সব সময় ছড়ানো ছিটানো থাকে । মূলতঃ এগুলো নিয়েই তাঁর কাজ । তার ডেস্কে প্রতিদিন দেশের নানান জেলা ,উপজেলা কিংবা স্কুল থেকে কমপক্ষে ত্রিশ পয়ত্রিশটা কোরে চিঠি আসে উপবৃত্তি বিষয়ে ! সেসব চিঠিপত্রের বুঝেসুঝে জবাব দিতে হয় । আর জবাব দেয়া মানে ফাইলে নোট দেয়া আর তা নিস্পত্তির জন্য উপরে পাঠানো ! ফাইলগুলো আশফাক হোয়ে আসাদের কাছে যায় । জুনিয়র হিসাবে আশফাককেই প্রথম নোট লিখতে হয় । আর এ বিষয়ে তাকে বেশ দক্ষই বলা যায় । সে খুব যে একটা ভেবে চিন্তে নোট দেয় তা নয়, তারপরও প্রায় একই ধরণের বিষয়ে লিখতে লিখতে এ দু বছরে এ ক্ষেত্রে সে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে । ফাইলগুলোতে নোট দেয়া শেষ হলে সেগুলোকে সে দ্রুত হাতে আসাদের টেবিলে চালান দেয় ।
আসাদ অফিসের প্রতিটি কাজকর্মে অত্যন্ত সিরিয়াস । ঝড় মেঘ বৃষ্টি রোদ যাইই হোক না কেন সে ঠিক ঠিক সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে এসে পৌঁছুবে । বেশীর ভাগ দিনই এমন হয় যে পিওন বা এম এল এস এস এসে দরজার তালাই খোলেনি কিন্তু সে এসে গ্যাছে । এসে লিফটের একেবারে পাশে যে চওড়া প্যাসেজ আছে তার উপর পেতে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসে সে দরজা খোলার অপেক্ষা করে আর ডান কব্জিতে এঁটে রাখা ঘড়িটার চারকোণা ডায়ালে ঘন ঘন চোখ বুলায় । হরতালের দিনও আসাদ ঠিক একই সময়ে অফিসে আসার চেষ্টা করে । তবে বাস না পাওয়ার কারণে মীরপুর থেকে রিক্সা ধরে আসতে বেশ কিছুটা দেরীই হয়ে যায় । পুলের অফিসারদের উপর রাগ কোরে বছর দুই হয় সে অফিসের গাড়ীতে চড়া বাদ দিয়েছে ! অফিসের গাড়ীতে চড়া বাদ দেয়ার কারণে আসাদের সাময়িক অসুবিধা হলেও সে এতদিনে সেসব কাটিয়েও উঠেছে । ইচ্ছে থাকলে কিনা হয় । পুলের গাড়ীগুলো অফিসে পৌঁছাবার অনেক আগেই সে অফিসে এসে হাজির হয় । এর জন্য যে সে বাড়তি কোন স্বীকৃতি পাচ্ছে বা পাবে তা নয় । কিন্তু সেই যে রাগ ! সেই রাগের একটা পজিটি্ভ ফলাফল সবাইকে দেখিয়ে একটু তাক লাগিয়ে দেয়া আর কি !
তবে আসাদ যে আদতেই একটা রাগী মানুষ তা কিন্তু নয় । কিন্তু কেন জানি রাগই তাঁর পেছন ছাড়ে না ।সারা জীবন ধরেই সে সব কিছুতেই যথাযথ আর সময়নিষ্ঠ হোতে চেয়েছে । সেই যে ছেলে বেলায় তাদের স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক রুস্তম আলী ফারাজী ছাত্রদের পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন – ওয়ার্ক হোয়াইল ইউ ওয়ার্ক, প্লে হোয়াইল ইউ প্লে অ্যান্ড দ্যাট ইজ দি ওয়ে টু বি হ্যাপী এন্ড গেই ! আনন্দময় আর সুখী জীবন পাওয়ার জন্য কাজের সময় কাজ করার নাকি কোন বিকল্প নেই । আনন্দময় আর সুখী জীবন আসাদ পেয়েছে কি না তা সে জানে না , কিন্ত তার শিক্ষকের সেই বলা কথাগুলোকে সে আপ্তবাক্য বলেই মেনে নিয়েছে ।
আসাদ চেয়ারে বসেই আগে ঘন ঘন আশফাকের টেবিলের দিকে তাকায় । উহ , এতগুলো ফাইল জমা হয়েছে সেদিকে এই ছেলেটার যেন কোন খেয়ালই নেই । ওয়ার্ক হোয়াইল ইউ ওয়ার্ক কবিতাটা বোধকরি পড়েনি সে । পড়লে কি আর কাজটাজ বাদছাদ দিয়ে অফিসে এসেই টেলিফোন ধরে বসে থাকে ! কিন্তু এসব ব্যাপারে বেশী কিছু বলা যাবে না তাকে । বললেই বিপদ । সে হয়তো অন্য টেবিলে যেয়ে তাঁর নামে লাগাবে । বলবে , স্যার এত বিশ্রীভাবে সারা সময় ঘ্যান ঘ্যান করে । আসাদ কিছুই বলবে না । আসলে বলা শুরু করলে সে নিজেকে আর চেক দিতে পারে না !
অনেক হাপিত্যেশের পর আশফাকের টেবিল থেকে ফাইলগুলো নিজের টেবিলে আসা মাত্রই আসাদ যেন হাতে স্বর্গ পায় । সে নিত্যদিনের মতো মাইনাস পাওয়ারের কালো ফ্রেমের চশমাটা দ্রুত পকেট থেকে বের করে রুমালের কোনা দিয়ে গ্লাস দুটো বার কয়েক পরিস্কার করে । এরপর আয়েশ কোরে তা চোখে সেঁটে নেয় । উহ , লেখার কি ছিড়ি । সে মনে মনে বগবগ করে । মুখে কিছু বলে না বটে কিন্তু বিরক্তিটা তাঁর দেহভঙ্গীতে প্রকাশ পায় । একটু দূরে বসা আশফাক বসের এ হেন কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে হাসে । উহ, সো সিরিয়াস একটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে মনে মনে বলে !
প্রতিটি ফাইল কম পক্ষে দু তিন বার করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া আসাদের স্বভাব । আর এই স্বভাব এখন প্রায় বাতিকের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে । যদিও সে নিজে তা বুঝতে পারে না । তার চাই ছাঁকা বিশুদ্ধতা ! এর কোন ব্যত্যয় নেই । এ সব মানতে গিয়ে ছুটির পরও তাঁকে প্রায়শঃ বেশ কিছুক্ষণ অফিসে থাকতে হয় । দারোয়ান পিওন তাতে মহা বিরক্ত । কিন্তু আসাদের সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই !
বাতিক ? আসাদের এই অতি বিশুদ্ধতার বাতিক তার বউ মাসুমাকেও অহরহ বিব্রত করে ! আগে এসব নিয়ে মাসুমা হাসাহাসি করতো। এখন তো আর তা করেই না বরং দাঁতে দাঁত চেপে দুচোখ জোরে বুজে রাখে , যেন স্বামীর সেইসব অদ্ভুত ক্রিয়া কর্ম তাঁকে দেখতে না হয় । এই যেমন , হঠাৎ মধ্যরাতে আসাদের মনে হোল ফ্লাটের মেইন গেটটার তালাটা হয়তো ভুল কোরে লাগানোই হয় নাই । আর তা মনে হতেই সে তাঁর নিজের দরজাটা এক টানে খুলে পড়ি কি মরি করে ছুট লাগায় একেবারে নীচের দিকে । যদিও সে জানে এ বিষয়টি দেখার জন্য তাদের আট তলা এ ফ্লাটে একজন মাইনে করা লোক রাখা হয়েছে ! যা হোক এরপর আরও যেসব বাতিক তাঁকে প্রায়শঃ খোঁচায় তা যদিও নিরেট ঘরোয়া – এগুলো তাঁর দেখার বিষয় নয় , তবুও সে সেসব খুটিয়ে দেখবেই । এই যেমন প্রায়শঃ রাত বিরেতে ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে সটান উঠে পরে বেড রুমের লকটা বার বার খুঁটিয়ে দেখা । বাথরুমের ট্যাপগুলো খোলা না বন্দ অথবা রান্না ঘরের গ্যাসের চুলা অফ না অন এইসব।
কোনদিন একান্তই মন ভালো থাকলে মাসুমা তাঁকে বাতিকেশ্বর বলে সম্বোধন করে । শব্দটা সঠিক কি না তা জানে না মাসুমা । আর জানার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলেও সে মনে করে না ! তবে সে যে একটা উদ্ভট মানুষ নিয়ে ঘর করছে তা সে বেশ বুঝতে পারে !
যাই হোক , আসাদ ফাইলে লেখা নোটগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে কখন কখনও বা খোলা দরজা গলিয়ে বাহিরের বারান্দার দিকে তাকায় । তাঁকে তাকাতেই হয় যখন ফ্লোরের কেউ কেউ খুব উচ্চস্বরে কথা বলতে বলতে তাঁর দরজা পেড়িয়ে সামনের বা পেছনের রুমগুলোতে যায় অথবা কারণে বা অকারণে বারান্দা ধরে যা্তায়ত করে । এসব দোলাচল আসাদের একাগ্রতাতে ক্ষুণ্ণ করে । কাজে কোন ধরনের বিগ্ন ঘটলে তৎক্ষণাৎ তাঁর চওড়া কপালটা কুঁচকে বুড়ো বট গাছের গুড়ির মতো হয়ে যায় । সে বিড় বিড় কোরে কাজ বিঘ্নকারী ব্যক্তিদের গালিগালাজ করে । কিন্তু তা সে ছাড়া বাইরের অন্য কেউ কস্মিনকালে শুনতে পায় না । এমনকি তাঁর গায়ের একেবারে কাছে বসা আশফাক আলীও নয় ।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আশফাক ফাইল লিখে পাঠালে আসাদের মুলতঃ করার কিছুই থাকে না । আরও উপরের বসের কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য তাঁকে কেবলই ডান পাশে ছোট্ট একটা স্বাক্ষর দিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয় । তাঁর কেন জানি মনে হয় এ যেন নাই কাজের কাজ । আশফাকের এই সব কাজের কাজী বিষয়টি আসাদের মাঝে মধ্যে একদম ভালো লাগে না । তবুও এক একটা ফাইল শেষ করার আগে সে আশফাকের দেয়া নোটাংশগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বারে পড়ে । প্রতি প্যারা থেকে দাঁড়ি কমা সেমিকোলন পর্যন্ত । যদি কোন ভুল ধরা যায় ! কিন্তু না । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোন ফাঁক না পেয়ে মনের মধ্যে বিশ্রী একটা রাগ পুষে রেখে আসাদকে চুপ করে থাকতেই হয় ।
আচ্ছা এই রাগের কি কোন মানে আছে ? আসাদ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে । না, না কোন মানেই নাই । একজন জুনিয়র সহকর্মী ভালো কাজ করলে তার তো খুশীই হওয়া উচিত । কিন্তু কেন জানি কারও খুশীতে সে তেমন কোরে খুশী হতে পারে না । তবে তার মনের এই অখুশী ভাবটা সে ভুলেও আশফাকের সামনে প্রকাশ করে না ।
কোন কোন দিন আশফাক তাড়াহুড়ো করে নোটিং সারলে , ফাইল পড়তে পড়তে ওপাশ থেকে আসাদ হঠাৎ করেই মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠে - কি ব্যাপার আশফাক সাহেব , কাজে কর্মে মন নেই নাকি । এত ফাঁকি নিয়ে নোট লিখেছেন । দেখবেন নির্ঘাত এ ফাইল অনুমোদন হবে না। বস আবার কোয়ারী করবে । কি যে করেন না ছাই , মন কোথায় যে থাকে আপনার ! বলেই সে থেমে যায় । এত বলা কি ঠিক হোল ভাবতে থাকে সে । ছেলেটা কি বা ভাবলো তাঁকে । একজন বদরাগী অফিসার হিসাবে পরিচিতি পেতে আসাদ কখনই চায় না । কিন্তু পরিস্থিতিই তাঁকে মাঝে মধ্যে বেকায়দায় ফেলে । তাতে রাগ বাড়ে । রাগ থেকে বাড়ে দুঃখ । যন্ত্রণা বাড়ে। এ যেন এক ভিশাস সাইকল !
কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য কোরে বলা সেই আশফাক তাঁর এত কড়া কড়া কথা একটুকুও গায়ে মেখেছে বলে মনে হয় না ! আসলে আশফাকের স্বভাবটাই এমনি । কারো কোন কথা গায়ে লাগানোর সময়ই যেন নেই তাঁর। তাকে দেখলেই মনে হবে এক ধরণের মহাব্যস্ততার মধ্যে সে সময় কাটাচ্ছে ।আসলেই তাঁর ম্যালা কাজ । বিনে পয়সায় পরের কাজ করে দেবার একটা অদ্ভুত মানসিকতা আশফাকের মধ্যে সবসময় কাজ করে। এ অফিসের অনেকে এমনকি তাঁর শহরের ম্যালা মানুষ তার কাছে অহরহ নানা ধরণের তদবির নিয়ে আসে । এই যেমন বদলীর বা পোস্টিং এর। কখনও বা চাকরির । এসব বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তার করার কিছুই থাকে না । তারপরেও সে দেখি কি করতে পারি বলে জানা অজানা অনেক মানুষের সমস্যার কথাগুলো বেশ মনোযোগ দিয়েই শোনে । আর তার এ রকম একটা দায়িত্বশীল হাভভাব দেখে দূর থেকে আসা মানুষগুলোর তাঁর উপর আস্থা কয়েকগুন বেড়েও যায় ! আশফাক জানে এসব হোল –হেড অফিসে কাজ করার গচ্চা ! সময় দাও । মনোযোগ দাও । ধৈয্য ধরে শোন দশজনের কথা । তারপর পারলে এর ওর কাছে কাজের তদবিড় নিয়ে যাও !
অনেকক্ষণ ধরে আশফাক তার কথার উত্তর দিচ্ছে না দেখে আসাদের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায় । আবার রাগ ! কিন্তু আসাদ তো রাগতে চায় না । কিন্তু রাগ উড়ে এসে তার বুকের মাঝেই যেন জুড়ে বসে ! তা অন্য কাউকে দেখে না । কিন্তু এ রাগ ঝেড়ে ফেলতেই হবে। রাগ দমন করতে পারা নাকি মহামানবের লক্ষ্মণ ! আসাদ মহামানব নয় কিন্তু ভালো মানুষ হোতে চায় । সে সব সময় তাঁর নিজের রাগ দমিত করার কৌশল খুঁজতে থাকে ।
তবে একটা আশার কথা হোল ইতোমধ্যে এসব অফিসিয়াল রাগ কন্ট্রোল করার অদ্ভুত একটা উপায় বেড় করেছে সে ।তবে সেই কৌশলটা ভালো কি মন্দ কিংবা সেটা নীতিগত দিক থেকে কিংবা মানবিক মূল্যবোধ থেকে কতটা যৌক্তিক আজ অবধি জানে না আসাদ । যা হোক সেসব ভাবনা টাবনা বাদছাদ দিয়ে তাঁকে তো আগে বাঁচতে হবে ! অযথা অকারণ বেড়ে ওঠা রাগটা ঝেড়ে কেটে ফেলে দিয়ে মনটাকে বশে আনতে হবে ! না হলে রাগ থেকে ক্রোধ । তা থেকে দুঃখ !
আসাদ তাঁর উদ্ভাবিত কৌশল মোতাবেক বুকের মধ্যে জমে ওঠা বিশ্রী রাগটা দমনের জন্য রুমের দক্ষিন দিকের হা করা জানালাটার পাশে গিয়ে স্থির হোয়ে দাঁড়ায় । পিক আওয়ারে কাজটাজ ফেলে তাঁর এই জানালা ধরে অকারণ দাঁড়িয়ে থাকাটা অভিপ্রেত কিংবা নিজের বা অন্যের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য সে জানে না । তবুও দাঁড়াতে তাঁকে হবেই ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অদ্ভুত ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ঝিম মেরে মস্ত বিল্ডিংটার নীচের প্রাঙ্গণে অচেনা মানুষগুলোর আসা যাওয়া পরখ করে । কত রংবেরঙের মানুষ । কত ভিন্ন ভিন্ন তাদের সাজ পোশাক । আচার আচরণ ! কিন্তু একটা জায়গায় বোধকরি তাদের অনেক মিল । আর তা হোল কাজের তাড়া । ইচ্ছে পূরণের চাহিদা । স্বপ্ন পূরণের হাঙ্গামা ! মানুষগুলো সবাই কেমন হন্যে হোয়ে ইট কাঠ মোড়ানো ছ তলা বিল্ডিঙটার পাথুরে বুকের কয়েকজন মানুষের কৃপা কিংবা করুণা পেতে ছুটে আসছে ! সবার চোখে মুখেই কেমন যেন একটা তাড়াহুড়া আর যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ।
হাসি হাসি মানুষগুলোর মুখ থেকে সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয় । কিন্তু দুঃখ ভেজা মানুষগুলোর মুখের দিকে সে অনেকক্ষণ হা কোরে তাকিয়ে থাকে । তাকিয়েই থাকে , যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ! মন খারাপ করা মানুষগুলোকে আসাদ বেশ ভালভাবেই সনাক্ত করতে পারে । তাদের মধ্যে একেবারে নুইয়ে পড়া লাউ ডগার মতো ক্যামন যেন উসকো খুসকো ভাব । এইসব নেতিয়ে পড়া পরাজিত মানুষগুলোকে দেখতেই কেন জানি বেশী ভালো লাগে আসাদের । সে নিজের জানা অজানা দুঃখগুলোর সাথে ঐসব অচেনা মানুষগুলোর দুঃখগুলোর তুলনা করতে থাকে আর তখনই ব্লটিং পেপারের মতো অন্যের দুঃখগুলো তাঁর ব্যক্তিগত রাগ আর যন্ত্রণাগুলোকে শুষে শুষে নেয় !
এ ক্যামন মানসিকতা তার ! একি পাগলামো কিংবা চারিত্রিক দীনতা কিংবা হীনতা তার কোনটা - তা কিছুই বোঝে না আসাদ ! তবু নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাঁকে অহরহ মনে মনে এই খেলা ভাঙ্গার খেলা খেলতেই হয় ! এ খেলার পদ্ধতি একেবারেই তাঁর নিজস্ব । সে একাই এ খেলা খেলে । এর জন্য কোন পক্ষ বা প্রতিপক্ষের প্রয়োজন পড়ে না । এটা কি তাঁর নিজেকে নিজে বাঁচানোর খেলা ? হবে হয়তো বা !
মাঝে মধ্যে আসাদের রকমশকম দেখে আশফাক দূর থেকে সামান্য হেসে তাঁকে জিজ্ঞেস করে - স্যার কাউকে খুঁজছেন ? কাকে বলেন , আমি ডেকে দিচ্ছি ।
আসাদ মাথা নাড়ে । তার অর্থ না । না , সে কাউকে খুঁজছে না । কাউকে না । কিন্তু সত্যি কি কাউকে সে খুঁজছে না ?
কেবলমাত্র বাতিকের বিষয়টা বাদ দিলে নিজের বাড়ীতে আসাদ একেবারেই অন্য মানুষ । সেখানে কারণে অকারণে রাগের অবকাশ নেই ! আসাদের বউ মাসুমা অত্যন্ত কড়া স্বভাবের মেয়ে । তার মন যোগাতেই আসাদকে নিজের সব রাগটাগ শিকেয় তুলে সদা ব্যস্ত থাকতে হয় । মাসুমার বাবার দেয়া ফ্লাটে অনেকটা ঘর জামাই এর মতো সে দিনপাত করে । একজন ঘর জামাই এর আবার কিসের রাগ । বাড়ীতে তাই আসাদের নিজস্ব কোন ভাবনা নেই । রাগ নেই। সুখ নেই । আনন্দও যেন নেই । কিন্তু মাসুমাকে এসব বুঝতে দেয় না সে । তাকে তাঁর নিজের বাবা মার কাছে প্রত্যেক মাসে মাসে লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা পাঠাতে হয় বিকাশে । মাসুমা এসবের কিছু জানে না । জানলে মহা অনর্থ ঘটাবে সে ! আসাদ এসব ব্যাপারে মাসুমাকে খুব ভয় করে । ভয়ের সাথে বাড়ে রাগ , বাড়ে ক্রোধ , বাড়ে যন্ত্রণা আর দুঃখবোধ !
রাগ কিছুটা প্রশমিত হোলে আসাদ তাঁর নিজস্ব চেয়ারটায় এসে ধপ কোরে বসে পড়ে । মনে মনে বলে, যাক বাবা বাঁচা গেল । ঐ ছোকরাটার উপর আর তোড়জোড় করতে হোল না । আসলেই তো অফিসে রাগারাগি কিংবা গালা গালি করার বিধান নাই । তারপরও মানুষ এসবের জালে জড়িয়ে পড়ে । সে নিজেও যেমন ঘন ঘন পড়ে !
ছোকরা ! ছোকরা মানে আশফাক । আশফাকের যা বয়স তাতে সে তার ছোট ভাই তুল্যই । কিন্তু অফিসে তো আর বড়ভাই ছোট ভাই নাই । ভাইভাই নাই । আছে ছোট বড় । বস সহকর্মী । উপরওয়ালা আর অধস্তন । কোন কোন বস মাঝে মধ্যে এমন ভাব দেখায় যে , তাঁর বড় আর কেউ নাই । কিন্তু বড়র উপরে বড় আছে , যেমন আছে পোয়ার উপর সের কিংবা সেরের উপর সোয়া সের । ডাকসাইটে সের ওজনের বসেরা সোয়া সেরের সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকে । এসব জানে বলেই আসাদ অযথা কারো উপর কঠিন বসগিরি সহজে ফলাতে চায় না । তারপরও কোথা থেকে রাগ এসে সহসা তাঁকে গ্রাস করে !
আশফাক সাহেব , কি নোট দিয়েছেন । পড়েন । একবার নিজে পড়ে দেখেন । মাথা মুণ্ডু ঠিক আছে তো আপনার , নাকি গেছে ? আসাদ গলা খেকিয়ে বলে ।
যাকে উদ্দেশ্য কোরে এত কিছু বলা সে মহাব্যস্ত ফোনটা নিয়ে । নিজের মোবাইল নিয়ে নয় । আশফাক আসাদের টেবিলের উপর রাখা লাল রঙ্গা ল্যান্ড ফোনটা ধরে সেই কখন থেকে বগবগ কোরে চলছে তো চলছেই । এই ফোনটা যদিও তাদের দুজনার ব্যবহারের জন্যই কিন্তু তা আশফাকাকের হাতের তলায়ই সব সময় বন্দী থাকে , আর প্রথম থেকেই এ বিষয়টা আসাদের আর একটা বিরক্তির কারণ । বাহির থেকে কোন কল এলে আশফাকই ফোনটা চিলের মতো ছোঁ মেরে আগেভাগে ধরে ফেলে । যেন সে জানেই এই কলটা তাঁর ।আসাদ প্রায়শঃ মনে মনে ভাবে - তাঁকে নিশ্চয় কেউ কল করেছে আর আশফাক মিছেমিছি কথা বলার ভান করছে । সে আড়চোখে টেলিফোনের আইডি নাম্বার পরখ করে দেখার চেষ্টা করে। চেনা চেনা লাগে কি অন্তত শেষের দুই ডিজিট ? কিন্তু না মনে পড়ে না কিছুই । এই কিছু মনে না পড়াটাও এক ধরণের অক্ষমতা যা অহরহ পীড়িত করে তাঁকে। মনের পীড়ন আর তার শেষ পরিণতি কি ? আবার কি সেই রাগ কিংবা উস্মা । যন্ত্রণা , জ্বালা কিংবা দুঃখ !
বসের হুংকারে আশফাকের দারুন মজা হয় । হাসি পায় । কিন্তু সে হাসির বিন্দুমাত্র কণা সে এখানে ওখানে অযথা ছড়াতে দেবে না । হাসলেই বিপদ । হাসি হাসি মুখ করলেও । বসের কথায় সে ভয় পেয়েছে তা হাবেভাবে অবশ্যই তাঁকে বোঝাতে হবে। রিসিভারটা স্ট্যান্ডে রেখে সে সুবোধ বালকের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে জানতে চায় , তাঁর ভুলটা কোথায় হোল । আসলে সে আজ বসকে একটু ভুল ধরার সুযোগ কোরে দিয়েছে । মাঝে মধ্যে ভুল ধরতে না পারলে বসের মাথাটা যে বিগড়িয়ে যায় তা সে খুব ভালো করেই জানে ।
আসাদ গড়গড় করে নোট পড়া শুরু করে । আশফাকের মাথায় তার ভালোমন্দ কিছুই ঢোকে না । তাঁর মাথায় এখন অন্য চিন্তা । এই মুহূর্তে মন্ত্রণালয় না গেলে নয় । তাঁর খালাতো ভাই যিনি বেড়া সরকারি হাই স্কুল থেকে পাবনা সরকারি বালক বিদ্যালয়ে বদলীর চেষ্টা করছেন , তাঁর জন্য একটু উপর মহলে একটু অনুরোধ করা । উপরের মহল থেকে একটা ফোন করে দিলেই তা দ্রুত গড়াতে গড়াতে এক সময় নীচে নেমে আসবেই । কিন্তু কখন নামবে সে ভরসা নেই । আর নামবেই যে সে গ্যারান্টি কই । তবে আশফাক মুখে মুখেই তদবির করে । কিন্তু মুখে মুখে যে আজকাল চিড়া ভেঁজে না সে কথাটি সে বিশ্বাস করেও করে না !
যাগ গে সেসব কথা । যাক । এক্ষণে বস কি বলছে তা তাঁর কান মন দিয়ে শোনা দরকার । কিন্তু আজ বস তো দেখি থামছেই না । ওপাশের দেয়া সময় দ্রুত স্রোতের মতো গড়িয়ে যাচ্ছে । যা হোক কিছু তো বলতেই হবে । চুপ কোরে থাকাটা আসাদ যে একেবারেই পছন্দ করে না , তা আশফাক বেশ ভালো কোরেই জানে । তাই অনেকটা না ভেবেই কি মনে কোরে একসময় টুক কোরে সে বলে ফেলে- স্যার , আপনি না হয় লিখে দিন । তাতেই তো ল্যাটা মিটে যায় !
বলে কি এই অর্বাচীন ছেলেটা । ল্যাটা ! বসের মুখের উপর ল্যাটা শব্দটা কি উচ্চারণ করা যায় ! হোলই বা সে একেবারেই ইমিডিয়েট বস । বস তো বসই । আগেও আর একবার আশফাক তাঁর সামনে এই শব্দটা উচ্চারণ করেছিল । সেদিন না শোনার ভান কোরে সে তাঁকে এক রকম ক্ষমাই কোরে দিয়েছিল । অবশ্য তা সে কোরছিল নিজের প্রয়োজনেই । তা না করতে পারলে তার নিজেরই ক্ষতি হোত বেশী । রাগ যেত দুম কোরে বেড়ে । রাগ হওয়া মানেই আবার সেই মন্দ চক্র !
কি বললেন আশফাক সাহেব , ল্যাটা ! ইনসাবঅরডিনেশন ! অবাধ্যতা ! অ –ন- ধী -ন -তা ! এমন হলে অফিসে কি কোরে চেইন অব কমান্ড থাকবে ! শোনেন আশফাক সাহেব , আপনার বিরুদ্ধে কিন্তু আমি ডিসিপ্লানারি এ্যাকশান নিতে পারি ।
বস এবারে তাহলে সত্যিই চটেছে !আশফাক উচ্চবাচ্য করে না । এই মুহূর্তে বসকে আরও একটু রাগিয়ে দেয়া যায় বটে , কিন্তু এক্ষণে আশফাক তা ভুলেও করবে না । বাহিরে যাবার তাড়া আছেই তো বটে তাঁর । আর আসাদ তার বাহিরে যাওয়া নিয়ে বাগড়া দিলে বেশ কিছুটা অসুবিধায় পড়বে সে । আবার যেতে হবে তাকে খোদ বড় বসের কাছে । তিনি আবার মহা হিসেবী । কে কতদিনের সি এল নিল , নিল না বলে ছুটি কিংবা অফিসে এসে কাজের অছিলায় বাহিরে চলে গেল এসব যেন তার ঠোটস্ত । কি জানি এসব তিনি নিজের ডায়েরীতে টুকে রাখেন কি না কে জানে !
স্যার , প্লীজ আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি জরুরী কাজে । ফিরে এসে সব ঠিক করে দিচ্ছি ।
যা হোক আশফাককে আজ ছুটি নেবার ব্যাপারে কেন জানি আজ সামান্যতম বাদ সাধে না আসাদ । কেবল সে চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবার আশফাককে কিছুটা অবাক কোরে দিয়েই টুক করে নিজের একটা তদবির তার হাতে ধরিয়ে দেয় । আমতা আমতা করে বলতে থাকে- যান ভাই , যান । তবে বেশি দেরী কোরেন না আর আমার কাজটাও একটু ভালোমতে দেখার চেষ্টা কোরেন ! অবশ্য এটা আমার নয় , আপনার ভাবীর রিকোয়েস্ট !
আসাদ এখন রুমে একা । ঘরে একা থাকলে সে গালে হাত দিয়ে এলোমেলো অনেক কিছুই ভাবতে থাকে । দেশের বাড়ীতে অভাবে পড়ে থাকা বাবা মা আর ছোট ছোট ভাই বোনগুলোর কথা । অতি বিলাসী আত্নকেন্দ্রিক তাঁর নিজের স্রীর কথা । অফিসের অন্য সব সহকমীর কথা বিশেষতঃ নিত্যদিন তার পাশে বসা উজ্জ্বল উচ্ছল আশফাকের কথা ! তাঁকে দেখলেই এমনিতেই বোঝা যায় - কোন দুঃখই নাই ছেলেটার । নেই কোন অভাব । অনটন । হাসি খুশী ফুড়ফুড়ে ! রাগ বা জেদাজেদি করে সে কোনদিন আসাদের সাথে বা অফিসের অন্য কারো সাথে কথা বলেছে এমন ঘটনা কোনদিন ঘটে নাই বলে জানে আসাদ । অথচ সে ? কেবলই বাতিক ! রাগ । উস্মা । দুঃখ আর যন্ত্রণা ! দু হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে খুব জোরে নিজেই নিজের কপালটা চেপে ধরে এক্ষণে আসাদ । রাগ , দুঃখ আর যন্ত্রণা আবার তার দিকে খুব দ্রুত ঘূর্ণি ঝড় হুদ হুদের মতো ধেয়ে আসছে । আশফাকের মতো সুখী সুখী মানুষগুলোকে নিয়ে আর কিছু ভাব্বে না সে ! ভাবলেই বিপদ !
এসব থেকে মুক্তি পেতে তাঁর করণীয় কি তা সহজেই যেন বুঝে ফেলে আসাদ । এক্ষণই চট জলদি তাঁকে যেতে হবে সেই দক্ষিণের জানালার পাশে , যেখান থেকে অনেক অনেক দুঃখী মানুষ সহজেই দেখা যায় ! সেই সব দুঃখী মানুষগুলোর খেলা ভাঙার খেলা দেখে দেখে নিজের মনের যন্ত্রণা ঘুচাবে সে !
** সব চরিত্রই কাল্পনিক !
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৫৭