তিন – চিলতে দুঃখটা
তিন তলার রেহানা যখন অফিসের গাড়ী থেকে নামে , তখন তাকে দু দণ্ড চেয়ে দেখতে হয় । খুব কাটা কাটা সুন্দরী সে নয় , তারপরও কেমন একটা অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে থাকে ওর গোটা অবয়ব জুড়ে । এ অফিসের লোকেরা যদি কোন মন হারানো দিনে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, তাহলে রেহানা নির্ঘাত প্রথম হবেই হবে !
রেহানা তাঁর সৌন্দরজের খবর জানে ! সবাই যে একটু সুযোগ পেলেই তাঁকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তা সে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে ! কিন্তু এতো কিছুর পরও এসবে কারো কিছু যায় আসে না, কারণ রেহানা বিবাহিতা । তার স্বামী উচ্চ পদস্ত সরকারি চাকুরে !
মোহন্মদপুর থেকে রেহানা অফিসের যে মাইক্রোবাসটায় চড়ে তাতে বেজায় ঠেলাঠেলি । পিছনের ছিটগুলোতে একবারে টাসাটাসি হয়ে চারজন করে বসতে হয় । গোটা গাড়ীতে সে নিজেই কেবল মেয়ে । আগে সামনে ড্রাইভার এর ঠিক পাশের সীটটায় বসতো সে। তাতে বেশ নিশিচন্তে যাওয়া আসা করা যেত । কারো গায়ের সাথে লাগালাগি চাপাচাপি নাই । কিন্তু আর একজন পুরুষ মেম্বার বৃদ্ধি পাওয়ায় সামনের সিটটা ছাড়তে হয়েছে তাকে । এখন ওখানটায় দু’জন করে বসে ।
যা হোক , রেহানাকে একটু কৃপা করে বটে সবাই ।একবারে সামনের দরজার কোণার সিটটায় তাকে বসবার অনুমতি দিয়েছে গাড়ীর সকলে । সরকারি গাড়ীতে চড়বার আবার নিয়ম আছে । জুনিয়ররা সব সময় পেছনে বসবে । কিন্তু সে মেয়ে হওয়ায় আর বিশেষত একা মেয়ে হওয়ায় এই বাড়তি সুবিধাটুকু বোধহয় পেয়েছে ।
রেহানার ঠিক পাশে মতিয়র রহমান বসেন । ডেপুটেশনে এ্যাসিসটান্ট ডাইরেক্টর । সাবজেক্টের কারণে কলেজগুলোতে পোস্ট না থাকায় ঠিক সময়ে প্রমোশন হয় নাই তার । কিন্তু তাঁর অনেক জুনিয়র কলিগরাই এখন তার বস !
মতিয়র রহমান এগুলো খুব গায়ে মাখেন বলে মনে হয় না । দিব্বি দিল খোলা মনে তিনি চুটিয়ে রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজনীতি এসব নিয়ে কথা বলেন । আর গাড়ীর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা গেলে । মাঝে মধ্যে এমন একটা অবস্থা হয় যে , মতিয়র রহমান যা বলেন শেষ মেশ সবাই তাই মেনে নেয় !
গাড়ীতে যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা একেবারেই হয় না , তা ঠিক নয় । বরঞ্চ বেশীই হয় । এই কার কর্তা বা গিন্নী কি করেন , কার কাচ্চাবাচ্চা ক’জন বা কার দেশ কোথায় –এসব খবর সবারই প্রায় জানা । মায় কার কবে জ্বর এল , কে কবে সিএল নিল - এসবেরও ফিরিস্তি মাঝে মধ্যে দিতে হয় বৈকি ।
তবে এখানে আর সবার থেকে কেমন জানি একটু ব্যতিক্রম মতিয়র রহমান । ব্যক্তিগত আলাপ-চারিতার বেশীরভাগ সময়ে তিনি মুখ বুজে থাকেন , যা তাঁর স্বভাবের সাথে মানায় না। কারো বিষয়ে তেমন কোন মন্তব্য বা নিজের সংসারের বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায় না তাঁর মুখ দিয়ে । তবে অফিসের সবাই জানে মতিয়র রহমান সাহেব বিবাহিত । তার এক মাত্র পুত্র সন্তান ধানমণ্ডি বয়েজ স্কুলে দশম শ্রেনীতে পড়ে ! মতিয়র রহমান কালে ভদ্রে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছোট খাট মন্তব্য করেন বটে । কিন্তু এত টুকুতেই বেশ বুঝা যায় যে , তিনি ছেলের ব্যাপারে ভয়ানক কনসারনড !
গাড়ীতে রেহানা সব সময় মতিয়র রহমানের পাশে বসে । আর এই বসাটাকে সে মনে মনে বেশ এনজয় করে এভেবে যে , এ গাড়ীর সবচাইতে নিরাসক্ত মানুষটার কাছে সে বসতে পেরেছে । পয়তাল্লিস পেড়োনো লিকলিকে প্রায় হাড্ডিসার চেহারার একজন লম্বা গড়নের মানুষ । তামাটে গায়ের রঙ । সিগারেট খাওয়া কুচকুচে মোটা কালো দু’ঠোট । এলোমেলো একরাশ অবাধ্য চিরুনীবিহীন চুল । এমনতরো একজন নিরেট গদ্য মার্কা মানুষকে পাশে বসিয়ে আর যাই হোক রোমান্সের কোন অবকাশ থাকে না । বলা যায় পুরোপুরি সেফ !
মতিয়র রহমান আসলেই নিরেট ভাল মানুষ । তাকে নিয়ে মন্দ কোন কথা কেউ এ পর্যন্ত শুনে নাই । বরঞ্চ কারো কোন অফিশিয়াল সমস্যা হলে মতিয়র রহমানই এগিয়ে এসেছে অনেকের আগে !
এহেন মতিয়র রহমানকে কেন্দ্র করে আচমকা হঠাৎই একদিন একটা মহা –বিপর্যয় ঘটলো । আর তা ঘটালো স্বয়ং মতিয়র রহমানের বউ !
তিন তলা জুড়ে বেশ একটা চাপা হৈ চৈ । কি না মতিয়র রহমান নাকি মনে মনে ভালবাসে এ অফিসের সবচাইতে সুন্দরী রেহানা নামের মেয়েটিকে ! মতিয়র রহমানের বউ আজমেরী তা ধরতে পেরেছে । ভালো যে বাসে মতিয়র রহমান রেহানাকে তার কি প্রমান ?প্রমান মতিয়র রহমানের নিজের লেখা গুটি কয়েক কবিতা । সেখানে সে নারীর যে রুপ লাবন্যের কথা উল্লেখ করেছে তাতে খুব স্পষ্ট ভাবেই বুঝা যায় , এ মেয়েটি আর কেউ নয় । সে হচ্ছে এ অফিসের রেহানা আকতার!
আচমকা এ ধরণের একটা অভিযোগে রেহানা হতভম্ভ ! কি করবে সে যেন কিছুতেই বুঝে ঊঠতে পারছে না। আহাদকে জানাবে ? না , টেলিফোনে এত দূর থেকে এত আগেভাগে তাকে এসব বলা ঠিক হবে না । আর তাছাড়া শ্বশুর – শাশুরি ননদ দেবর নিয়ে তাদের একান্নবর্তী পরিবার । চট করে না বুঝে আহাদকে কিছু বলাটা কোনমতেই ঠিক হবে না । হোক না স্বামী ! তবুও তো পরের ছেলে। কি থেকে সে কি বলে বসবে সবাইকে আর নানা কানে গিয়ে হয়তো বা তা একটা ভয়ংকর রুপ নেবে !
রেহানা চুপ করেই তার টেবিলে বসে রইল । সামনে মূর্তিমান আজমেরী ! সে তেমন কিছু জোরে শোরে বলছে না বটে , কিন্তু এক এক করে মতিয়র রহমানের লেখা কবিতা গুলো গড় গড় করে পড়ে চলছে । তবে আশ্চয্য হলেও সত্যি , তাঁর কবিতা আবৃত্তির ঢঙ্গটা খুব চমৎকার । কন্ঠস্বর খুব স্পষ্ট আর সুরেলা
।
রেহানার খুব ইচ্ছে করলো আজমেরীকে জিজ্ঞস কোরতে -সেকি স্কুল কলেজে কবিতা আবৃতি করতো ! যা হোক , সেসব ভাবনা ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে রেহানা আজমেরীকে সহজ করার জন্যই বললো- ভাবী আমাকে নিয়ে যে এ লেখা নাও তো হোতে পারে । স্যার আপনাকে নিয়েই হয়তো বা এগুলো লিখেছেন !
আজমেরী তার ছড়িয়ে পড়া ঠোঁট দুটো তিন চার বার করে উল্টিয়ে নিয়ে ম্লান হেসে বললো , আমাকে দেখে কি কেউ কবিতা লিখতে পারে বলে তোমার মনে হয় ! দ্যাখ , কি শরীরের শ্রী । প্রতি মাসে দু’তিন কেজী করে বেড়েই চলেছি । জানো আমি এখন কত ? মানে ওয়েট ! প্রায় আশি কেজি । এরকম একজন বেঢপ মহিলাকে নিয়ে কি কেউ কবিতা লিখতে পারে ?
রেহানা চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে রইলো । এমন একজন ঘোর সন্ধেহ প্রবণ মহিলার সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া মানেই নিজের সন্মান নিজেই খোয়ানো ! তবে এখন কি করা যায় । এ মহিলা তো সহজে তাঁকে ছাড় দেবে বলে মনে হোচ্ছে না ।
দরজায় চোখ মেলে সে দেখতে পেল , তাঁর রুমের সামনে অনেক উৎসুক লোকের ভীড় । আজমেরীকে না হয় বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করা গেল । কিন্তু এদের শত প্রশ্নের জবাব দেবে সে কি করে !আগে এমন পরিস্থিতি হলে ইন্টারকমে মতিয়র রহমান স্যারকে ডাকলে তিনিই দৌড়ে এসে সব সমস্যার সমাধান হয়তো কোরে দিতে পারতেন , কিন্তু এখন সে বেচারার নিজেরই বিপদ ! কি ভাবে এসব যে সামলাবেন তিনি ! আর আজমেরী অভিযোগও বেশ ভয়াবহ !সবাই শেষ কি হয় তাই দেখবার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে বোধহয় ।
রেহানা ভয়ে ভয়ে একবার চারদিকটায় আর এবার আজমেরীর দিকে তাকালো ! ভদ্র মহিলার এককালে চেহারা একদম মন্দ ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ অযত্নে সব কিছু কেমন যেন ফ্যাকাসে আর মলিন হয়ে গেছে ! তার হাতে ধরা কবিতার খাতাটাও প্রায় জীর্ণ ! তারই মতো যেন ।
রেহানা মিষ্টি হেসে আজমেরীর দিকে চেয়ে বলল , ভাবী স্যারের সাথে দেখা হয়েছে আপনার ? ইন্টারকমে ডাকব তাকে !
আজমেরীর ভাবলেশহীন গোলগাল মুখটা যেন এবার রাগে ঝলসে উঠলো । গড় গড় করে সে রাগত সুরে বলে উঠলো , ক্যান তাকে না দেখলে তোমার ভাল লাগছে না! শুনি প্রত্যেক দিন তো পাশাপাশি বসে একসাথে করে গাড়ীতে যাও আবার একসাথে ফের , তাতেও শখ মেটে না ।
ওহ , তাহলে এই ব্যাপার । রেহানা এবার ভদ্র মহিলার রাগের আসল কারণ যেন বুঝতে পারলো । তবুও নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে বলল , ঠিক আছে ভাবী আপনি আর চিন্তা করবেন না। কাল থেকে আমি না হয় অন্যভাবে যাব ! পুলের অন্য কোন গাড়িতে !
এতে মহিলার রাগ একটু কমলো বলে মনে হল । কিন্তু আগের সব ঘটনা ? তিনি যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না এই অতি সুশ্রী মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর স্বামীর কবিতা লেখার কথা !
তবে কবিতাগুলো কিন্তু আসলেই চমৎকার ।মতিয়র রহমানের মত নিরেট গদ্য মার্কা লোক এমনতরো কবিতা যে লিখতে পারে তা স্বপনেও ভাবতে পারে না রেহানা । যদিও কবিতার ব্যাপারে সে দারুন অজ্ঞ । এইচ এস অব্দি বাংলা বইয়ে দু চারটা কবিতা পড়া । তারপর তো নিরেট বিজ্ঞান ! তবে কেউ তাঁকে নিয়ে এমন সুন্দর কবিতা লিখছে তা ভাবতে তাঁর বেশ ভালোই লাগলো ! কিন্তু এ কবিতাগুলো আগে কোথায় যেন শুনেছে সে ! কিন্তু কোথায় ?
হতভম্ব মতিয়র রহমান হন্তদন্ত হয়ে নিজে এসেই এসব বিষয়ের খোলাসা করে দিল ! অত্যন্ত বিব্রত আর প্রাণহীন দেখাচ্ছিল তাকে । লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিল সে ।তার কাছেই জানা গেল , কবিতাগুলো কবি গুরুর লেখা ! আর আজমেরী তা আপন খেয়ালেই খাতায় টুকেছে অনেকদিন আগে । কবিতা নকল কোরে লেখা আর তা তার নিজের লেখা বলে চালিয়ে দেয়া তাঁর পুরানো স্বভাবের মধ্যে পড়ে ! যখন থেকে তাঁর মানসিক রোগটা ধরা পড়েছে তখন থেকেই শুরু হয়েছে এহেন আচরণ!
মতিয়র রহমান তার স্ত্রীর হয়ে রেহানার কাছে ক্ষমা চাইবার আগেই রেহানা তাকে ক্ষমা কোরে দিল মনে মনে । আহা ,এই করুণ শব্দটাই বেড়িয়ে এল তাঁর মুখ থেকে ।
কিন্তু আর না । আর ওই গাড়িতে নয় । স্থির হয়ে রেহানা মনে মনে সিন্ধান্ত নিল ! কিন্তু তাকে নিয়ে মতিয়র রহমানের কবিতা না লেখার চিলতে দুঃখটা কেন জানি রয়েই গেল মনের মধ্যে !
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২৭