এক -পরিযায়ী পাখী
নীলার আজ মন ভালো নেই । তাঁর বসের বদলীর অর্ডার এসেছে । নতুন যিনি আসছেন , তাঁর ব্যাপারে ভালোমন্দ অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে । ভয়ানক বদমেজাজি নাকি তিনি ! কি যে হবে ! তাঁর সাথে চাকরি করতে পারবে তো সে । না পারলে তার পরিণতি নিশ্চয়ই শুভ নয় । হয়তো বদলী নিয়ে চলে যেতে ঢাকার বাহিরের কোন কলেজে !
আগের বস ইব্রাহীম কায়সার এর মত মানুষ হয় না । যেমন চেহারা তেমন ব্যবহার আর তেমনি কাজে কর্মে দক্ষ ছিলেন তিনি । এমন বসের সাথে চাকরী করতে পারাটা বড় ভাগ্যের ব্যাপার ! নীলাকে ভয়ানক স্নেহ করতেন তিনি । যদিও এ নিয়ে অফিসের অনেকেই চোখ টাটাতো , তবে তা গায়ে মাখতো না নীলা ! এখন নতুন বস এলে নির্ঘাত পরিবেশটা বদলিয়ে যাবে । যারা আগে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারেনি , তারা নীলার নামে নির্ঘাত এটা ওটা বলে বসের কান ভারী করবে । এমনই হয় । অফিসের বস পালটালে অনেক কিছুই দ্রুত পালটিয়ে যায় !
ভাল লাগছে না নীলার । নানা দুশ্চিন্তায় মাথাটা ঝিম ঝিম কোরছে । বদলী যদি হোতেই হয় তাহলে সব চেয়ে কাছের পোস্টিং টঙ্গি বা গাজীপুর । অন্যদিকে নারায়নগঞ্জ ! যেখানেই হোক , বাড়ী ছেড়ে বেড়োতে হবে সেই সকাল সাতটায় আর ঢাকায় ফিরতে হবে সন্ধ্যে পেরিয়ে । আর সেই সাথে পথের ধাক্কা তো আছেই । এ তো আর ঢাকার অফিস নয় , নিয়ম করে অফিসের গাড়ি বেলাবেলি নিয়ে আসবে বাড়ি থেকে আর পৌঁছে দেবে টাইম ধরে !
হেড অফিসে একটু গেলে কি হয় । আলতামাস স্যারের সাথে একটু শলাপরামর্শও তো করা যেতে পারে নতুন বসের ব্যাপারে । আর সেই সাথে নতুন পোস্টিং এরও । যদিও নীলা বেশী বেশী ভাবছে , আগাম মন্দটাই ভাবছে বদলী –টদলী নিয়ে , তারপরের মন্দটা তো আগে ভাগে ভাবতেই হবে । ভালো হলে ভালো । কিন্তু উল্টোটা হলে তখন ? সরকারি চাকরি তবুও ঢাকায় থাকা নিয়ে অহেতুক ভোগান্তি আর ভালো না নীলার !
আলতামাস নীলাকে বেশ পছন্দ করে । একই জেলার মানুষ তাই খাতিরটা একটু বেশী রকমের ! এ ছাড়াও আলতামাসের কাজের খুব খ্যাতি আছে । তাঁকে ছাড়া অধিদপ্তরের ডিপিপি লেখা হয় না । তাই সারাদিন তাকে লেখালেখি নিয়ে কম্পিউটারে মুখ গুঁজে পরে থাকতে হয় । আগাম সময় না দিয়ে তাঁর দেখা মেলা ভার ।
বস মন্ত্রণালয়ে গেছেন । বোধহয় সবার কাছে থেকে বিদায় আদায় নিতে । এই সুযোগে অফিস অনেকটাই ফাঁকা । যারা আছে , তারা একে অন্যের টেবিলের মুখোমুখি বসে গালগল্প জুড়ে দিয়েছে । আবার কেঊবা এক গালে হাত দিয়ে অন্য হাতে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাচ্ছে ! অডারলি বা পিওনদের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না । একমাত্র বসের দরজা আগলে বসে থাকা বৃ্দ্ধ আমিন উদ্দীন আলগা ঘুমের ভারে ঝিমুচ্ছে !
এখন আলতামাস স্যারের কাছে যাওয়া যেতেই পারে । এমন ভাঙ্গাচূড়া পরিবেশে কাজ করতেও তো ইচ্ছে কোরছে না আর ! যেতে হবে । তারপরের কাউকে বলে তো যেতেই হবে । বস যদি আবার সকাল সকাল ফিরে আসেন । এসে নীলাকে টেবিলে না পেয়ে যদি অন্য কিছু ভেবে বসেন । বলা তো যায় না । ভাবতেই পারেন । মানুষের মন নাকি পলকা কাঁটা ফুলের মত । ক্ষণিক বাতাসে তা আন্দোলিত হয় ! কাজে মিছেমিছি ফাঁকি নিয়ে এই শেষ সময়ে তাঁর ব্যাপারে বসের ভাবনা বদল হোক তা কোনমতেই চায় না নীলা !
পিএ ভদ্রলোককে আজ মহাব্যস্ত বলে মনে হোচ্ছে । তাঁর সামনে ফাইলের স্তূপ । একের পর এক ওগুলো উলটিয়ে পাল্টিয়ে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে চলেছেন তিনি ! এমনটাই নাকি হয় । অফিসের বসেরা যাওয়ার আগে অনেক পুরনো আবদার মিটিয়ে দিয়ে থাকেন ! নীলার বস ইব্রাহীম কায়সার সেই ফাঁদে পা দেবেন কিনা তা এখন পর্যন্ত জানে না সে । পা দিতেও পারেন । ফাইল হাতে নিয়ে কান্নাকাটি দেখলে মানুষের মন গলতে আর কতক্ষণ !
পিএ সাহেব , আমি একটু পাশের হেড অফিসে যাচ্ছি । স্যার বা কেঊ খোঁজ করলে বলবেন –নীলা পিএর ঘরে ঢুকে তার সামনা- সামনি দাঁড়িয়ে কোথাগুলো বললো !
পিএ সাহেবের বোধকরি তা কানে গেল না । ভয়ানক ব্যস্ত তিনি ! তার দুহাতে রাশি রাশি ফাইল গুচ্ছ । অন্তহীন আবদার , দেনা পাওনা ইত্যাদি ! আজ নীলার মতো পুঁচকে অফিসারের কথা শোনার মতো সময়ও যেন তাঁর নেই ! কদিন আগেও ব্যাপারটা ছিল একেবারে উল্টোটা !
তা যাগ গে । নীলাকে সময় নষ্ট করলে চলবে না । হাতের ঘড়ির দিকে তির্যক চোখ বুলালো সে । প্রায় সাড়ে এগারোটা । এরপর গেলে হয়তো বা আলতামাস স্যারকেও টেবিলে পাওয়া যাবে না । স্যারের কাজের তো শেষ নেই । এই মন্রণালয় , নাতো প্লানিং কমিশন বা ইআরডি এসব সব লেগেই আছে !
ছোট্ট কোরে একটু কাশল নীলা । এ ধরণের কাশিকে বলে এলাট কল ! কিন্তু না পিএ সাহেবের ধ্যান ভঙ্গ হলো না। আবার এরি মধ্যে এলো তাঁর টেলিফোন কল ! হাসি হাসি মুখে আয়েশ করে লম্বা কাঠের চেয়ারে মাথা লাগিয়ে হাত পা নাড়িয়ে কথা বলা শুরু করলেন তিনি !
নীলা বুঝতে পারলো এরপর আর অপেক্ষা চলে না । আর কিসেরই বা অপেক্ষা । এইসব পিছলে লোকেরা শক্তের ভক্ত । নীলার শক্ত হওয়াই দরকার ।
গ্যাট গ্যাট করে কোনদিকে না তাকিয়ে সে সোজা হেড অফিসের দিকে হাঁটা দিল ! আলতামাস স্যারকে আজই বলতে হবে , এ অফিসে চলতি কানাঘুষার কথা । নতুন বস নাকি এসেই অনেককে বদলী করবেন বিশেষতঃ যাদের তিন বছরের বেশী থাকা হয়েছে। নীলাও সেই দলে পরে । এরপরও তার মতো অনেকে হয়ত টিকে যাবে , কিন্তু তাঁর নির্ঘাত বদলী । আগের বসের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে এখন এ অফিসের অনেকেই যে তাঁর শত্রু তা আগে না বুঝা গেলেও এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ।
চলতে চলতে নীলার খুব কান্না পেল ! রাশেদের কদিন আগে ঢাকার বাহিরের একটা ব্যাংকে পোস্টিং হয়েছে । বড় বাবুটাকে সবে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে । ছোটটার বয়স বছর হতে চলল । এদেরকে দুটো পুঁচকে কাজের মেয়ের ঊপর ছেঁড়ে দিয়ে চাকরি করতে হয় ! বাসায় থেকে মা বা শাশুড়ী মাঝে মাঝে আসেন বটে কিন্তু তাদেরও তো বেশ ভরা সংসার ! এসব দেখেশুনে এক একবার চাকরী ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে নীলার । কিন্তু মন তাতে পুরোপুরি সায় দেয় না !
হেড অফিসের লিফট সময় মতো পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া ! পাওয়া গেল ঠিকমত এই যা রক্ষে !
লিফটে দেখা হোল নীলার তানজিলার সাথে । নীলার চেয়ে সে কমবয়সী । নতুন এসেছে অফিসে ! খুব আলাপী । হেসে হেসে আগ বাড়িয়ে কথা বলে সবার সাথে ।
নীলাকে দেখেই একটু দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো ; আপু , আপু কংরাচুলেশন ।
ব্যাপারটা কি ? পাগল নাকি মেয়েটা । কি হোল এত কংরাচুলেট করার । নীলা বেশ একটু অস্বস্তিতেই পড়লো । লিফটের সবাই তাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে । ভাগ্যিস সবাই অচেনা !
তানজিলা নাছোড়বান্দা । এক্ষণই বলতেই যেন হবে তাকে সব । না বললেই নয় । নীলা বারে বারে ইঙ্গিত দিল ছ’ তলায় যেয়ে বলার জন্য ।
না , সে এখনি বলবেই । নাছোড়বান্দা !
আচ্ছা , বল কি ব্যাপার । দু চারজন নামাতে নীলা এক্ষণে তানজিলার গায়ে গায়ে এসে দাঁড়াতে পেরেছে !
আপু আপনি সত্যি জানেন না , আপনার বদলীর অর্ডার এসেছে আমাদের ছ’ তলায় প্লানিং উইং এ ।
না তো জানি না, কিছুই জানি না। আকাশ থেকে পড়লো যেন নীলা । সুগভীর আনন্দে সে কাঁদবে না কি হাসবে তা ভেবে পেল না সেক্ষণে । কেবল তানজিলাকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললো – পরিযায়ী পাখীর জীবনের হাত থেকে তো মুক্তি মিললো!
কিন্তু কে তাঁকে মুক্তি দিল ? ইব্রাহীম কায়সার স্যার নাকি আলতামাস স্যার ! তাঁরা দুজনাই তো জানতো নীলার শতেক সমস্যার কথা !
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:১৫