পূর্বকথা
আগে জেনে নিন যেভাবে ৫/৬ জনকে জামা দেয়ার প্ল্যান করে আমরা একেবারে ৪৪৩ জন শিশুকে ঈদের জামা দিয়ে ফেললাম। ওই ইভেন্ট এর সফলতার পর আমরা এই শীতে উত্তরাঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণের সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই কথা সেই কাজ। খোলা হয়ে গেল ফেসবুকে আরেকটি ইভেন্ট। ধীরে ধীরে আমাদের কাছে আসতে শুরু করলো মানুষের ডোনেশন। কেউ টাকা আর কেউবা সোয়েটার, টি-শার্ট, প্যান্ট দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে লাগলো। অনেকে আবার সাহায্য করলো বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে। দেখতে দেখতে আমাদের কাছে জমা হয়ে গেল ৩৫০০০ টাকা আর বেশ কিছু শীতের কাপড়।
নভেম্বর ২৬, ২০১১
শীতের কাপড় কিনতে হবে। কম খরচে যত ভালো কাপড় পাওয়া যায়। জনাব নাইমুল হাসান নাফি'র পরামর্শ অনুযায়ী সকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হাজির হল শুভ, ফারাহ, রুমন ও মিরাজ। একদিন আগেও আমি জানতাম না এদের মাঝে আমিও থাকব কিন্তু নিজেকে হঠাৎ তাদের মাঝে আবিস্কার করলাম। খুজতে খুজতে সদরঘাটে গিয়ে পেলাম মনের মত কোয়ালিটির কাপড়। দেখতেও ভালো (আমার নিজেরও এরকম সোয়েটার আছে), দামেও ঠিক। কয়েক দোকান ঘুরে কিনে ফেললাম বৃদ্ধ ও বাচ্চাদের সাইজের ৮০০ সোয়েটার। ৩টি হস্তিসম বস্তায় সেই ৮০০ সোয়েটারের জায়গা হল ফারাহদের বাসার গ্যারেজে।
এখন শুধুই সৈয়দপুর যাবার অপেক্ষা।
নভেম্বর ৩০, ২০১১
সকাল ৮:২৫ এর "নীলসাগর" ট্রেনে চেপে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে আমরা রওনা হলাম সৈয়দপুরের উদ্দেশ্যে। আমরা মানে আমি, মিরাজ, রুমন, নয়ন, সাবা আর অ্যান। রুপা, ফারাহ, কাঙাল মামা আর তাসবির আসতে পারেনি। না থেকেও তারা সবসময় আমাদের সাথেই ছিল, মোবাইলে। ৩ বস্তা কাপড় ততক্ষণে এস. এ. পরিবহনের কল্যাণে পৌছে গেছে গন্তব্যে। দীর্ঘ ১১ ঘন্টার ভ্রমন শেষে সন্ধ্যা ৭:১৫ তে আমরা পৌছলাম সৈয়দপুর স্টেশনে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সাবার আব্বু।
এই পর্যায়ের সাবাদের পরিবার নিয়ে দু-একটা কথা না বললেই নয়। এটা এমন এক পরিবার যার সদস্যদের নিয়ে বেশি কিছু লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেগে যাবে। সাবার দাদা শহীদ ডা. জিকরুল হক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ৪ জন বাংলাদেশী এমপি-দের মধ্যে অন্যতম। ওর বড় চাচা আলহাজ্ব মো: বখতিয়ার কবির ছিলেন স্বাধীন সৈয়দপুর জেলার প্রথম চেয়ারম্যান। আর সাবার বাবা মো. মাহফুজুল হক হচ্ছেন শহীদ কুদরত-ই-এলাহী স্মৃতি ক্লাবের বর্তমান সভাপতি।
আঙ্কেলের সাথে বাসায় ফিরে দেখি ৩ বস্তা সোয়েটার আঙ্কেল নিজ উদ্যোগে ভাগ করে রেডি করে রেখেছেন। আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের সাথে যোগাযোগ করে সেখানকার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের নামের একটা লিস্টও তৈরী করেন রেখেছেন তিনি।
ডিসেম্বর ১, ২০১১
সকালে একটি মাইক্রোবাসে বের হয়ে গেলাম বিতরণের কাজে। ঠেলাগাড়ি দিয়ে আগেই রওনা হয়ে গেছে ৮০০ শীতের কাপড়। প্রথম গ্রাম ছিল পলাশবাড়ি। সেখানে প্রায় ৩৫০ শিশু, বৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষকে দেয়া হল শীতবস্ত্র। তাদের চকচকে চোখ আর উজ্জল হাসিই বলে দিচ্ছিল এই শীতের কাপড় তাদের কতটা প্রয়োজন ছিল।
বড় করে দেখতে এখানে ক্লিক করুন
পলাশবাড়ি আর উত্তর ডাগরবাড়ি মিলে অনেক বড় এলাকা। পুরোটা কাভার করতে করতেই দুপুর হয়ে গেল। তখনও লিস্টের আরো অনেক গ্রাম বাকি। তাই তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলাম ডাঙ্গারহাট আর দেবীগঞ্জের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে খেয়ে নিলাম গুড়ের জিলাপি আর সাবার আম্মার দেয়া চিপস ও বিস্কিট। ডাঙ্গারহাট আর দেবীগঞ্জে শীতবস্ত্র পেল আরো প্রায় ২৫০ জন। সেখান থেকে আমরা গেলাম চক সন্ন্যাসীপাড়া। ততক্ষণে বাচ্চাদের শীতের কাপড় সব শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং শুধু বৃদ্ধ ও মাঝবয়সীদের কাপড় দিয়েই ফিরে আসতে হলো আমাদের। ফেরার পথে সাথী হয়ে রইলো চক সন্ন্যাসীপাড়ার বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের অতৃপ্ত চেহারাগুলো।
বড় করে দেখতে এখানে ক্লিক করুন
আর এভাবেই ৩ দিনে ৮০০ কাপড় দেয়ার প্ল্যান করে যাওয়া আমরা ১ দিনেই বিতরণ করে ফেললাম ৮০০ কাপড়।
ডিসেম্বর ২, ২০১১
শুক্রবার। ঢাকা থেকে সাথে করে নিয়ে আশা ক্লান্তি আর অলসতা পিছু ছাড়ল না। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেরী হয়ে গেল তাই জুম্মার নামাজের আগে তেমন কিছু করা হলো না। অবশেষে দুপুরে খেয়ে বের হলাম সৈয়দপুর পোস্টঅফিসের পাশের লুন্ডা বাজারের দিকে। উদ্দেশ্য ডোনেশনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আরো কিছু শীতের কাপড় কিনা।
একজন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কাপড় ব্যবসায়ী
দুই দোকান ঘুরে আমরা তৃতীয় দোকানে। বয়জ্যেস্থ দোকানি আমাদের উদ্দেশ্য জেনে জিগ্গেস করলেন, "আপনাদের বাজেট কত?"
এমন অপ্রস্তুত প্রশ্নে ইতস্তত করে জানালাম, "১২,৫০০ টাকা"।
তখন বয়োজেষ্ঠ দোকানি তার দোকানের সামনে রাখা এক গাদা শীতের কাপড় দেখিয়ে বললেন, এগুলো সব নিয়ে যাও। এখান থেকে ১২,৫০০ টাকার কাপড় তোমাদের, বাকিগুলো আমার পক্ষ থেকে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠেই সবগুলো কাপড় নিয়ে নিলাম। সবমিলিয়ে সেখানে প্রায় ৩০,০০০ টাকার কাপড় ছিল।
সেই বয়োজেষ্ঠ ব্যবসায়ীর বিশেষ অনুরোধে তার নাম প্রকাশ করা হলো না।
ডিসেম্বর ৩, ২০১১
খুব সকালেই দুই ঠেলা গাড়ি করে প্রায় ১২০০ কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেলাম। ঠাকুরহাট, কালাচাদ, কেশরবাড়ি, শাস কান্দর, পাইকেরপাড়া, বাশবাড়ি সহ আরো কিছু গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ১০০০ কাপড় দেয়া হলো। শেষে আবার ফিরে এলাম চক সন্ন্যাসীপাড়া। এবার আমাদের লক্ষ্য শুধু বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানো। প্রায় ১০০ বাচ্চাকে শীতবস্ত্র দেয়া হলো সেখানে। সব শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল।
বড় করে দেখতে এখানে ক্লিক করুন
বিকালে বের হলাম সৈয়দপুর শহরে। নতুন বাবুপাড়ায় শহীদ কুদরত-ই-এলাহী স্মৃতি ক্লাবের মাধ্যমে দেয়া হলো আরো প্রায় ৫০০ বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুকে।
রাত ১১ টার ট্রেনে ঢাকা ফিরতে হবে। হাতে সময় অনেক কম। ব্যস্ততার কারণে সৈয়দপুর শহরটাই দেখা হলো না। সন্ধ্যায় সব মোটামুটি গুছিয়ে তাই বের হলাম শহর দেখতে। দেখা হলো সৈয়দপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল, বিমানবন্দর ও ১৮৬৩ সালে নির্মিত বিখ্যাত চিনি মসজিদ।
এবার বিদায়ের পালা। বিদায় নিলাম আন্কেল, আন্টি থেকে যাদের জন্য গত ৪ দিনের কখনই মনে হয়নি আমরা বাসার বাইরে আছি। অবশেষে সৈয়দপুর শহর থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ৫ জন উঠে বসলাম "নীলসাগর" ট্রেনে, ঢাকার উদ্দেশ্যে।
শেষকথা
পুরো ইভেন্ট শেষে যখন পিছনে ফিরে তাকাই তখন বুঝা যায় এমন কিছু কখনই সম্ভব ছিল না কিছু মানুষের নিঃস্বার্থ অবদান ছাড়া। যারা শুধু মাত্র বিশ্বাসের উপর আমাদের হাতে এতগুলো টাকা আর শীতের কাপড় তুলে দিল। পুরোটা সময়ই তাদের এই বিশ্বাস আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর বিশেষ ধন্যবাদ জানাই সাবার বাবা, মা, বড় চাচ্চু, শফিক আঙ্কেল, বাবু আঙ্কেল, আবুল কাকা, খাদেমুল, ইমরান ভাই সহ সবাইকে যাদের সাহায্য ছাড়া এতদূর আসা আমাদের পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না।
৮০০ শীতের কাপড় দেয়ার প্ল্যান করে যখন ৩২০০ কাপড় দেয়া হয় তখন তাকে সফলই বলতে হয়। কিন্তু আরো কত মানুষকে আমরা শীতবস্ত্র দিতে পারলাম না তা চিন্তা করলে মনে হয় সফলতা এখনো অনেক দূর। আর এটা তো গেল শুধু সৈয়দপুরের কথা, পুরো বাংলাদেশের কথা তো বাদই দিলাম। এভাবে আমরা হয়তো কিছু মানুষের সাময়িক দরিদ্র অবস্থা দূর করতে পারি কিন্তু দেশের দারিদ্রতা তো আর দূর করা সম্ভব হবে না। সেটা কিভাবে করা যায়? এটাই এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে।
ফেসবুকে আমাদের গ্রুপ-এর লিঙ্ক: http://www.facebook.com/DSP.BD
ফেসবুকে আমাদের ইভেন্ট-এর লিঙ্ক: Click This Link