মে মাসেই শেষ হয়ে যায় ইউরোপের বড় লীগগুলি। দলবদল করতে এরপরই খেলোয়াড়, কোচ, এমনকি ম্যানেজারেরাও ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে উঠেন। খেলোয়াড় দল বদলে এখন পর্যন্ত ইংলিশ লীগে ৬৮ কোটি পাউন্ডের অধিক অর্থের হাত বদল হয়েছে। যদিও এরও অনেক আগ থেকে দল বদলের দৌড় ঝাপ শুরু হয়ে যায়। সাধারণত জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ বিকাল ৬টা পর্যন্ত সময়টা হচ্ছে ইংলিশ লীগের সামার ট্রান্সফার উইন্ডো। ঘণ্টার সময়টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ১ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার ভিতর ইংলিশ দলগুলিকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের স্কোয়াড জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। উল্লেখিত এই সময়ে খেলোয়াড়েরা অফিসিয়ালি দলবদল করে থাকেন। ইউরোপের অন্য লীগগুলি নিজেদের সময়সূচী অনুযায়ী দলবদলে অংশ নিয়ে থাকে। নরডিক দেশগুলি ব্যাতিত ইউরোপের অন্য দেশগুলির ট্রান্সফার উইন্ডো অনেকটা একই সময়ে শুরু এবং শেষ হয়। আর এই দলবদল তদারক করে আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা।
ট্রান্সফার উইন্ডোতে খেলোয়াড়দের চেয়ে ক্লাবগুলিকে অনেক বেশী সক্রিয় থাকতে দেখা যায় । অন্যদিকে, খেলোয়াড়েরা বাঁধা পড়ে থাকেন তাদের এজেন্টদের হাতে। ক্লাবগুলি তাদের চাহিদা অনুযায়ী খেলোয়াড় কিনতে এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করে। অনেক সময় এজেন্টই হয়ে উঠেন সর্বেসর্বা। তারাই ঠিক করেন খেলোয়াড় কোথায় কখন কার হয়ে খেলবেন। খেলোয়াড় দল বদল করলে এমনকি তাদের বেতন থেকে এজেন্টরা ফিস নিয়ে থাকেন। রোনালদোত সেদিন তার এজেন্টের বিয়েতে একটি গ্রিক দ্বীপ কিনে দিয়েছেন। তবে সব এজেন্টের ভাগ্য এতটা রঙ্গিন নয়। ট্রান্সফার মার্কেটে ক্লাবের গুরুত্ব অপরিসীম। আসলে বলতে গেলে খেলোয়াড় কিংবা তাদের এজেন্টদের উপর নিয়ত ছড়ি ঘোরায় ক্লাবগুলি। ইউরোপের ক্লাবগুলিতে ম্যানেজারদের দাপট ক্রমে বেড়েই চলেছে। ক্লাব ম্যানেজার হিসাবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্যার এলেক্স ফারগুসন বর্ণিল ক্যারিয়ারের ইতি টানলেও এখনও ক্লাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে আছেন। তিনি এখনও দলে কোন খেলোয়াড় আসবেন আর কোন খেলোয়াড় যাবেন তা শেষ সম্মতি দেন। ১৭ বছর ধরে ম্যানেজারের পদে থাকা আরসেন ওয়েঙ্গার অনেক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। এই দুইজন তাদের ক্যারিয়ারে কত ডজন খেলোয়াড় কিনেছেন আর কতজনকে বিক্রি করেছেন তার ইয়ত্বা নেই। ম্যানেজারেরা তাদের চাহিদা মোতাবেক খেলোয়াড় কিনেছেন, অনেক সময় জিতেছেন, অনেক সময় হেরেছেন। ডেভিড ব্যাকহ্যাম রোনাল্ডো কিংবা বার্গক্যাম্প থিয়েরি হেনরি আপনি যার কথাই বলেন না কেন তারা যদি সঠিক সময়ে সঠিক ক্লাব খুঁজে না পেতেন তারা হয়ত তারকা সুখ্যাতি পেতে বঞ্চিত হতেন।
খেলোয়াড় তৈরিতে ইংলিশ লীগে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে এভারটন আর সাউদাম্পটন। এদের ফুটবল একাডেমী কাতালানের বিখ্যাত ল্যা মাসিয়া ফুটবল একাডেমীর সাথে পাল্লা দিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করছে আর চড়া দামে খেলোয়াড় বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে আনিচেভি, জো বার্টন, রুনি, স্টোন, কোলম্যান, রদ্রিগেজ, ওয়ালকট, শো, লালানা, চেম্বারলিন, বেল, চেম্বারস এর নাম উল্লেখযোগ্য।
আসুন ট্রান্সফার মার্কেটের কয়েকটি আশ্চর্যজনক ঘটনার সাথে পরিচিত হই। ২০১২ সালের সামারে পল পগবার সাথে ম্যান ইউ আর নতুন কোন চুক্তি করেনি। ১৯ বছরের পগবা চলে যান ইতালির জুভেন্টাসে। বর্তমানে ২২ বছরের পরিণত পগবাকে পেতে ইউরোপের অনেক ক্লাব দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। জুভেন্টাস তার খেলোয়াড়ি প্রতিভার ভেল্যু ধরেছে প্রায় ৭ কোটি পাউন্ড! ট্রান্সফার মার্কেটের আরেক তারকা খেলোয়াড় বেলজিয়ান ফরওয়ার্ড কেভিন ডি ব্রুইনকে বেশ আগে চেলসি ৬৭ লক্ষ পাউন্ডে উলফসবার্গ থেকে দলে ভিড়িয়েছিল! তারপর প্রিমিয়ার লীগে দুই বছরে মাত্র দুইটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন ব্রুইন! ২০১৪তে উলফসবার্গ ১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডে তাকে আবার দলে ফিরত নিয়ে আসে! এই মৌসুমে তাকে আবার ম্যান সিটি কিনেছে ৫ কোটি ৫০ লক্ষ পাউন্ডে! আর তার সাপ্তাহিক বেতন ঠিক হয়েছে ৩,১২,৫০০ পাউন্ড! ভাবা যায়? এথলেটিক মাদ্রিদ চেলসির কিপার করটুয়াকে বছর কয়েক আগে ধারে দলে ভিড়িয়েছিল। পরে এথলেটিকোর হয়ে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন যে মাঠে চেলসিকে তার কাছে হারতে হয়েছিল। পরে মরিনহো কোনও দেরি না করেই করটুয়ার লোন বাতিল করে দলে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এতে পিটার চেকের কপাল পোড়ে। অনেক দেন দরবার চেক গানারদের হয়ে খেলতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে চেক তার ১ কোটি পাউন্ডের ট্রান্সফার মর্যাদা দিতে শুরু করেছেন।
মুদ্রার অপর পিঠের হিসাব আপনাদের আরো কঠিন মনে হবে। ব্রিটিশ ফরোয়ার্ড এন্ডি কেরলের পারফরমেন্স দেখে লিভারপুল তাকে ২০১১ সালে সাড়ে ৩ কোটি পাউন্ডে নিউক্যাসেল থেকে দলে ভিড়িয়েছিল। বারবার ইনজুরিতে পড়ার কারণে পরের বছর তারা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কোচের সাথে মারপিটের কারণে মারিও বালতেলি ম্যান সিটি থেকে এসি মিলান চলে গিয়েছিলেন। গেল বিশ্বকাপের পর ইটালিয়ান মারিও বালাতেলির এজেন্ট অনেক কষ্ট সৃষ্টে তাকে লিভারপুলের হাতে সপতে পেরেছিলেন। কিন্তু অমিত সম্ভাবনাময়য় এই খেলোয়ার তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বর্ণবাদের কারণে এসি মিলান ছেড়ে লিভারপুলে যোগ দিলেও আবারো নিয়তি তাকে ইতালি ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
অনেক সময় দেখা যায় বিপক্ষ দল যাতে ভালো খেলোয়াড় কিনতে না পারে সেজন্য ক্লাবগুলি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেলোয়াড় কিনে থাকে। অনেক ক্ষত্রে তারা ফাইনেন্সিয়াল ফেয়ার প্লের ফাঁক ফোঁকর ব্যবহার করে। বিশেষ করে আরব আর রাশিয়ান ধনকুবেররা ইংলিশ লীগে মনোযোগ দেয়ার পর থেকে খেলোয়াড় কিনতে বানের মত পয়সা বিনিয়োগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে চেলসি আর ম্যান সিটির কথা উল্লেখ করতেই হবে। কোয়াডরাডো, মোঃ সালাহ, গিংকেলের মত প্রতিভাবানরা চেলসির মত দলে সুযোগ না পেয়ে বেঞ্চে বসে সময় কাটিয়েছেন। ম্যান সিটি খেলোয়াড় কিনতে দেদার পয়সা খরচ করেছে। জরিমানার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেজন্য তারা আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন লীগে ফুটবল দল নিজেরদের নামে করে নিয়েছে। এখন তাদের মালিকানাধীন বিদেশী অন্য ক্লাবের মাধ্যমে খেলোয়াড় কিনে তাকে আবার ম্যান সিটিতে লোন হিসাবে ট্রান্সফার করিয়ে আনছে। উদাহরণ হিসাবে ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্লাবগুলির এমনতর আনফেয়ার আচরণ খেলার মূল মজাটাই নষ্ট করে দিচ্ছে!
খেলোয়াড়েরা দল বদলের পাশাপাশি ক্লাবের সাথে ব্যাক্তিগত চুক্তি করে থাকেন। এখানে তার বেতন, বোনাসসহ আরো অনেক কিছুর উল্লেখ থাকে। মারিও বালতেলির সাথে করা চুক্তিতে এসি মিলান ইত্যকারসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে। মাঠে ভালো আচরণ করতে হবে, উল্টা পাল্টা চুল কাটা বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি! দেখা যার খ্যাপাটে মারিও কতটা সুবোধ আচরণ করেন? ম্যান সিটিতে সদ্য যোগ দেয়া কেভিন ডি ব্রুইনের বেতন ঠিক হয়েছে বার্ষিক ১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড! বোনাস, এপায়ারেন্স ফিসসহ আর অন্যান্য সব সুবিধাদি মিলিয়ে শেষ যে অংকটা দাঁড়াবে তা অনেকের অজানাই থেকে যায়। অনেক সময় খেলোয়াড়দের আয়ের হিসাবে অনেক নয় ছয় হয়ে থাকে। এদানিং বার্সার মেসি ইনকাম ট্যাক্স সংক্রান্ত এক মামলায় জড়িয়ে পড়েছেন। নেইমার যে ট্রান্সফার ফি দিয়ে বার্সায় যোগ দিয়েছিলেন তা সঠিক নয় বলে জানানো হয়। প্রাথমিকভাবে ৪ কোটি ৮৬ লক্ষ পাউন্ডে তিনি ব্রাজিলের সান্টস থেকে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানানো হয়েছিল। পরে সরকারী এক তদন্তে মূল হিসাব বেড়িয়ে আসে। তার ট্রান্সফার ফির আসল অংক ছিল ৭ কোটি ১৫ লক্ষ পাউন্ড! পরে বার্সাকে ১ কোটি ১০ লক্ষ পাউন্ডের বেশী অর্থ স্প্যানিশ ট্যাক্স অফিসে জমা দিতে হয়। এর জের ধরে বার্সার প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন।
এই বছর অনেক ফুটবলবোদ্ধা শেষ দিনের ট্রান্সফার মার্কেট অনেক জমজমাট হবে বলে জানিয়েছেন। কেননা শেষ মুহূর্তে এখনও বেশ কয়েকজন নামি দামি খেলোয়াড় দল বদল করতে পারেন। আর্সেনালের একজন ভালো স্ট্রাইকারের প্রয়োজন। বেঞ্জেমা নিজেই তার দরজা বন্ধ করে দিলেও আর্সেনাল তার জন্য ৫ কোটি পাউন্দ খরচ করতে রাজি আছে। এই ডিল না এগুলে ওয়েঙ্গার কাভানির দিকে হাত বাড়াতে পারেন। চেলসির অবস্থা তথৈবচ। ৪ খেলায় ৪ পয়েন্ট! ডিফেন্স একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। রক্ষনভাগ শক্ত করতে মরিনহো এভারটনের জন স্টোনের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এভারটনের প্রেসিডেন্ট আর কোচ সাফ বলে দিয়েছেন টাকার অংক যাই হোক না কেন ব্রিটিশ খেলোয়াড় স্টোনকে তারা বিক্রি করবে না। মরিনহো তার জন্য এখন পর্যন্ত ৫ কোটি পাউন্ড পর্যন্ত ফি দিতে রাজি ছিলেন! স্টোন তাকে ছেড়ে দিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট পাঠান, ক্লাব সমর্থকরা এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা তার বাড়িতে হামলা চালায়। অতঃপর স্থানীয় হোটেলে তার জায়গা হয়! যাইহোক, বার্সিলোনার পেদ্রো আর ম্যান ইউর ফ্যালকাওকে দলে ভেড়ানোর পর পল পগবাকে পেতে মরিনহো কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রান্সফার ফির ব্রিটিশ রেকর্ড ভাঙ্গতে পারেন। গেলবার ৫ কোটি ৯৭ লাখ পাউন্ডের রেকর্ড ফিতে ডি মারিয়াকে দলে ভিড়িয়েছিল ম্যান ইউ আর এখন পর্যন্ত এই রেকর্ড বলবত আছে। ডি গেয়া গোল-কিপারদের মধ্যে সাড়ে ৩ কোটি পাউন্ডের রেকর্ড ফি দিয়ে শেষ দিনে আলো ছড়াতে পারেন। দেখা যাক শেষতক রিয়াল কতটুকু আগ্রহ দেখায়? খেলোয়াড় কিনতে প্রায় ৮ কোটি পাউন্ড খরচ করার পরও লুই ভ্যান গল এখনও ব্যস্ত আছেন, দেখা যাক তিনি শেষ পর্যন্ত কত টাকা খরচ করেন। বার্সার পেদ্রোকে ম্যান ইউর হাত থেকে চেলসি বলতে গেলে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে, ভ্যান গল এখন কি প্রতিক্রিয়া দেখান সেটা বেশ উপভোগ্য বলে মনে হচ্ছে!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩১