৭০র ঘূর্ণিঝড়ের পরে পুনর্বাসন কার্যক্রমের মধ্য দিয়া আমাদের জাতীয় এনজিওগুলার অভ্যুদয় ঘটছিল। বিদেশী সাহায্য সংস্থাগুলা তারও আগে থাইক্কা দেশে আছিল। সেই সময় থাইক্কা আইজ পর্যন্ত তাদের কাজগুলারে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করন যায় (এইটা এক্কেবারে আমার নিজস্ব বিচার)। একটা সামাজিক আর অন্যটা অর্থনৈতিক মুক্তি। এনজিওআলারা আমাদের বুঝাইছিল উন্নয়নের বিচারে মহিলারা পুরুষগো থাইক্কা ম্যালা পিছাইয়া আছে। আর সামগ্রিক উন্নয়ন যদি করণ লাগে তাইলে মহিলাগো দিকে মনোযোগ দেওন দরকার। মহিলাগো টেকা পয়সায় ধনী করতে পারলে পরিবারে তাগো সম্মান বাড়ব, স্বামীরা মাইরের বদলে সোহাগ করব আর একসময় তারা সমাজের এমনকি দেশ চালাইবার মত ক্ষমতাবান হইতে পারব! এনজিওঅলাদের এই চিন্তা কইতে গেলে আমাগো স্বাধীনতা সংগ্রাম থাইক্কাও পুরানা!
মহিলাগো অর্থনৈতিক মুক্তি দেওনের লাইগা মাঠে নাইমা এনজিওআলারা দেখল মাইয়া মানুষেরা পকেট বিহীন সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি-ব্লাউজ পড়ে। পকেটের অভাবে তারা টেকা হাতের মুঠির ভিতরে চুঙ্গা বানাইয়া রাখে, শাড়ির আচলে গিট্টু মাইরা রাখে এমনকি ব্লাউজের নিচে রাখে! ওরা ভাবল পকেটবিহীন এইসব কাপড়-চোপড় মহিলাগো মুক্তির পথে বড় বাধা! সেই থাইকা অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এনজিওআলারা কাপড়-চোপড়ে পকেট লাগানির ভার্চুয়াল চেষ্টা করন শুরু করল। ওরা ঘোমটা দেয়া গ্রামের মহিলাগোর হাতে গরু-বাছুর, হাঁস- মুরগী কিননের লাইগা টেকা দেয়া আরম্ভ করল। দুর্ভাগ্যবশত সেইসব টেকা ঘরের পুরুষদের ইচ্ছায়ই খরচ করতে হইত। এই ব্যাপারে ওরা জানলেও ব্যবসার খাতিরে তেমন কিছু বলে নাই।
গ্রামের অবলা নারী মান সম্মানের ভয়ে নয় ছয় কইরা অন্য এনজিও থেইক্কা ঋণ কইরা সেই টেকা সপ্তাহে সপ্তাহে শোধ দিতে নিয়ত বাধ্য হইছে। আর সেই ঋণের টেকা ১০০% সুদসমেত ফিরত পাইয়া এনজিওআলারা ভাবল নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ঘইটা গেছে, এক্ষণ অন্য কিছু প্রয়োজন। এক্ষন প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়নের! দাতারা এই সময়ের অপেক্ষায় আছিল। ওরা সিগন্যাল পাইয়া গিয়ার চেঞ্জ করল। পারিপার্শ্বিকতা বিচার না কইরা তারা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে দেদার টাকা আর বুদ্ধি পরামর্শ লইয়া মাঠে নামা শুরু করছিল।
এনজিওআলারা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়া গত চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধইরা কাজ করতাছে। চার দশক একটা দেশের পরিবর্তনের লাইগ্যা ম্যালা সময় না হইলেও একটা পালস ঠিকই বুঝা যাওয়ার কথা। যাইহোক, সময়ের হাত ধইর্যা আজকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল, স্পিকার এমনকি দেশের বৃহৎ একটা রাজনৈতিক দলের নেতা পদে মহিলা নাগরিকদের দেখা যাইতাছে। বেসরকারি অনেক মিল ফ্যাক্টরিতে ম্যালা মাইয়া একজিকিউটিভ আর শ্রমিকরা সুনামের সাথে কাজ কইরা খাইতাছে। তাগো হাতে এখন মেলা পয়সা আর ক্ষমতা। দিন বদল হইছে কইলে বেশী কওন হইব না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা সফল কওন যায়!
অনেকে মার্কিন মুল্লুককে আধুনিক গণতন্ত্রের আঁতুড় ঘর কয়। কিন্তু সেইখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্বে কতজন মহিলা আছেন আর অফিস আদালতেইবা তাদের উপস্থিতি কেমন তা আমাদের কম বেশী জানা আছে! এটর্নি জেনারেলের পদে লরেটা লিঞ্চ এর নিয়োগ কট্টরপন্থীরা মাইনা নিতে পারে নাই। একেত সে কালো তার উপর মহিলা! গ্লাস সিলিং(অদৃশ্যমান বাঁধা) ভাইঙ্গা উপরে উইঠা আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী সিইওরা এখনও যে আয় বৈষম্যের শিকার হইতাছেন তা খালি চউখেই দেখা যাইতাছে। হলিউডে নায়িকারা নায়কদের চাইয়া অনেক কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হইতাছেন। ২০১৩ সালেও বিলাতের উইম্বল্ডন টেনিস টুর্নামেন্টে মাইয়ারা পুলাগো সমান টেকা পাইত না। চেলসি ফুটবল ক্লাবের মহিলা ফিজিও ইভা দৌড় দিলে গ্যালারির সাদা দামড়ারা এখনও বগল আর শিস বাজাইয়া ফুর্তি শুরু করে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের লাইন্সম্যান নাকি খেলার কিচ্ছু জানে না, কারণ সে বেটি! তারপরেও তারা নারী ক্ষমতায়নের পিল এক্সপোর্ট কইরা বেড়ায়।
চোখ-কান খোলা থাকলে নারী ক্ষমতায়নে ইউরোপ-আমেরিকার বর্তমান অবস্থা আমাদের অজানা থাকার কথা না! ওরা যেখানে নিজেরাই প্রস্তুত হইতে পারে নাই সেইখানে আমাদের বুদ্ধি দেয় কোন যুক্তিতে? আচ্ছা, তাদের যুক্তি না শুইন্না আমরা নিজেদের লাইগাতও মাইয়া মানুশগো একই কাতারে আনতে পারি, নাকি? আনতাছি না কেন? আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক কায়দা কানুন কি এই ব্যাপারে সম্মতি দেয়? বর্তমানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বইসা থাকা ক্ষমতাধর মহিলারাইবা এই নিয়া কি ভাবতাছেন? আমরা কতটা প্রস্তুত আর কতটা অপ্রস্তুত? এইসব আলোচনার লাইগ্যা আসলে অনেক স্পেস দরকার!
মেস্কুইলিন পরিবেশে নারী শোভিত বর্তমান শাসন ব্যবস্থার একটা চিত্র আলোচনার খাতিরে সামনে আনা দরকার। বাপ আর স্বামীর কাছ থাইকা ধার করা রাজনৈতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হইয়া দেশনেত্রী আর জননেত্রীরা ফিল্ডে নামায় কতখানি জনকল্যান হইছে তার বাস্তবতা এতদিনে টের পাইয়া যাওনের কথা! ঘোমটার আড়ালে থাইকা গৃহস্থালি করা আর রাজদণ্ড হাতে সফলভাবে প্রজা সেবা করা এক কথা না। রাজনীতি আসলে মুখস্ত কইরা ফিল্ডে নাইমা পরীক্ষা দেওনের মতন জিনিস না। বাপ আর স্বামী মইরা যাওন বা শহীদ হইয়া যাওনের পরে একটা লেগেছিকে তুইলা ধরবার লাইগা তাদের প্রয়োজন পড়ছিল। কারণ জীবিত থাকা অবস্থায় মহানায়কেরা পার্শ্ব নায়ক তৈয়ার কইরা যাইতে পারেন নাই বা করতে চান নাই। এই ফাঁকাতলে দুই পরিবারের দুই অনভিজ্ঞ নারী দলের লাগাম হাতে নিছিলেন। অন্যদিকে বেগম রওশন এরশাদের নাম থাইকা এরশাদ নাম বাদ দিলে আসলে কিছুই থাকে না। তিনি তার নেতৃত্বগুণ দিয়া খুব বেশী হইলে ঘরদোর সামলাইতে পারেন!
রাষ্ট্র পরিচালনায় আসলে অনভিজ্ঞতার কোনও স্পেস নাই। এইখানে পয়লা দিন থাইকা বিড়াল মারায় পারদর্শী হইতে হয়। অন্যথায় প্রজা মঙ্গল ব্যহত হয়। যাইহোক, অনেক ট্রায়াল এন্ড এররের মধ্যে দিয়া আজকের নারী নেতৃত্ব যতখানি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছেন তার রেশ টানতে হইছে সাধারণ মানুষদের। এই প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ যে একটা এক্সপেরিমেন্টের শিকার হইছে তা নির্দ্বিধায় কওন যায়। এই এক্সপেরিমেন্টের ইতি টানা দরকার। কেননা নারী নেতৃত্বের শিক্ষানবিশ কাল যত লম্বা হইব মানুষের দুর্ভোগ তত বাড়তে থাকব। সেইসাথে নারী ক্ষমতায়নের পথও কঠিন হইতে থাকব।
পরিবার কেন্দ্রিক রাজনৈতিক লেগেছিরে ডুইবা যাওন থাইকা বাঁচানোর লাইগা দেশনেত্রী আর জননেত্রী তাদের পরিবার আর ফলোয়ারদের কাছ থাইকা বাহবা পাইতেই পারেন। কিন্তু, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাদের সামনের কাতারে চইলা আসার সুযোগটারে প্রকৃত ক্ষমতায়নে রুপান্তর করতে না পারাটা আসলে এক ধরনের ক্ষতি। তারা সুযোগ পাওয়ার পরেও এমন কিছু রাইখা যাইতে পারতাছেন না যা দেইখা পরবর্তী প্রজন্ম উৎসাহ পাইতে পারে। প্রাপ্ত সুযোগটারে কাজে লাগাইতে পারলে আমগো দেশ আসলে প্রকৃত অর্থে বিশ্বে উদাহরণ হইয়া থাকত।
গত চল্লিশ বছরে যতটা নারী প্রগতি হইছে তার কারণ যাইহোক আমরা যে এই ক্ষেত্রে একটু আগাইছি তা অস্বীকার করণ যাইব না। যতটুকুন আগাইতে পারি নাই তার লাইগা আমাদের সিস্টেম অনেকটা দায়ী কওন যায়। চাটার দল, তেলবাজ, চোর-বাটপার আর ভুঁড়িআল অকাল কুষ্মাণ্ড আমলারা এই সিস্টেমের প্রতিনিধি। দেখা গেছে রাজদন্ড যার হাতেই গেছে সেইখানে এই সিস্টেমের কেউ না কেউ গিয়া হাজির হইছে। কিছু জিগাইলেই কয় ম্যাডাম সব ঠিক আছে। আর ম্যাডামেরা চশমা পইরা যার যার মতন দেশ চালাইয়া গেছেন। এরা ম্যাডামদের সামনে রাইখা ইচ্ছা মতো লুটপাট কইরা গেছে। ফলশ্রুতিতে জনরোষে যখনই রাজদন্ড হাত ছাড়া হইছে তখন ব্যর্থতার সকল দায় ম্যাডামদের কান্ধে আইসা পড়ছে; কারণ কাগজ কলমে নেতাত তারাই। চাটার দল সুযোগ বুইঝা পিঠ টান দিছে। দেশের ক্ষতির সাথে সাথে উল্লেখিত কারণে নারী নেতৃত্বের প্রতি ধীরে ধীরে পাবলিকের মানসিকতারও পরিবর্তন হইছে। পাবলিক চিন্তা করতে বাধ্য হইছে যে, মাইয়ারা ভালো নেতা হইতে পারে না! ক্ষমতা পাইলে মাইয়ারাও দুই নাম্বারিও করতে পারে! এইসব চিন্ত চেতনা দুর্নীতিগ্রস্থ একটা দেশে নারীরা কম দুর্নীতি করে এই ধারনায় বড় এইটা ঝাকি দিয়া গেছে। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে নারী ক্ষমতায়নের বড় একটা উপকারী দিকরে সমাজপতিরা সহজেই কবর দিয়া দিতে পারছে। এইখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান নারীরা ব্যাপারটা ঘটতে দিছেন যা মোটেও কাম্য আছিল না।
নারীর ক্ষমতায়ন একটা চলমান প্রক্রিয়া কওন যায়। ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যাপারটা অনেক দরকারি জিনিস। নারীদের যে প্রজন্ম আজকে নেতৃত্ব দিতাছে কালকে ঐ জায়গায় নতুনদের দরকার পড়ব। কিন্তু, পরবর্তী প্রজন্ম কতখানি প্রস্তুত আছে? ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার লাইগা জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ধাপে নারী সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হইছে। এর উদ্দেশ্য মহৎ হইলেও প্রাপ্তি খুব একটা মধুর না। কাউরে রাস্তা থাইক্কা, পালা গানের মঞ্ছ থাইক্কা ধইরা আইনা চেয়ারে বসাইয়া দিলে নারী ক্ষমতায়ন হয় না। সীমাহীন স্বেচ্চাচারিতার কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মহিলার বদলে পুরুষ মুখ আনতে হইছে। আনাড়ির মতন আচরণ করতে থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকেও নারী মন্ত্রীকে বাদ পড়তে হইছে! ক্ষমতায়নের শোভা বইলা খ্যাত জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের মহিলারা একে অন্যেরে যে ভাষায় গালাগালি করেন তা খারাপ পাড়ায়ও অশ্রুত! অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে অনেক মহিলা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হইছেন এর পাশাপাশি সংরক্ষিত মহিলা কোটায় আগতরাও আছেন। যে উদ্দেশ্যে তাদের নেতা বানানো হইছিল তার কিয়দংশও সফল হয় নাই। পদ দেয়া হইছে ঠিকই কিন্তু কাজ দেয়া হয় নাই। এরা অনেকটা ₺ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের মতন।₺ এরা বইসা বইসা সময় পার করতাছেন। আমাদের ওয়ার্ডের সংরক্ষিত পদের মহিলা কাউন্সিলর তার স্বামীর ভাঙ্গা বাই সাইকেলের পিছনে চইড়া পৌরসভা আসা যাওয়া করে। এমন অবস্থা দেইখা সমাজে একটা পুরান ধরনা মাথা থাইক্কা ফালান যাইতাছে না তা হইল, ₺মাইয়ারা আসলে কামের না, হেরা ঘরে থাকলেই পারে।₺
এনজিওতে কাজ করতে থাকা এডভোকেসি ফোরামের আপারা ক্ষমতায়নে ভালো ভূমিকা রাখতে পারতেন। আমার কথার মানে এই না যে আমি তাদের সাফল্যরে অস্বীকার করতাছি। তবে সমালোচনা ছাড়াই তাগো সব কৃতিত্ব দিয়া দিতে আমি রাজি না। বিদেশিদের মদদে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক না কইরাই তারা অনেক হম্বি-তম্বি শুরু করছিলেন। এতে অসুবিধার থাইকা সুবিধা খুব একটা করতে পারেন নাই। রক্ষণশীল সমাজেরে তারা এক নিমিষেই আধুনিক বানাইতে চাইছিলেন। তাই কাজ করতে যেখানে গেছেন সেখানেই হাঙ্গামা বাঁধছে। সমাজপতিদের সাথে সাথে তারা মোল্লাদেরও অকারণে খেপাইয়া তুলছিলেন। যার কারণে একসময় এনজিও মানে খারাপ কিছু বইলা মনে করা হইত। সেই অপবাদ কিছুটা কাটলেও সন্দেহ দূর হয় নাই। আমার কাছে এইসব হ্যাংকি প্যাংকি না করলেও চলত বইলা মনে হয়। তারা নারী ক্ষমতায়নের পথে ধর্মরে প্রধান প্রতিবন্ধক বইলা ধইরা নিছিলেন। অথচ এই ক্ষেত্রে আজকে যতখানি অনগ্রসরতা আমাদের চোখে ধরা পড়ছে তার অনেকটার পিছনে আমাদের মানসিকতা দায়ী, বোবা ধর্ম না। আমাদের টিপিক্যাল মানসিকতা একা ইসলামের সৃষ্টি না। ইসলাম এই অঞ্চলের অনুশাসন না আর এইটা প্রচলনেরও আরো অনেক আগ থাইকা আমাদের আজকের এই মানসিকতা তৈরি হইছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের কোটা সিস্টেমটাও আমার কাছে নারী ক্ষমতায়নের লাইগা যথার্থ মনে হয় না। ৫৫ শতাংশ কোটার মধ্যে মাত্র ১০ ভাগ নারী আর অন্যদিকে ৩০ ভাগ কোটা রাখা হইছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততির লাইগা! দেশে রেজিস্টার্ড মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩ লাখের মতন হইব। পোশ্য কোটা আমার কাছে তাই ওভার এমফেসাইজড হইছে বইলা মনে হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী গোত্রের হওয়ার পরেও কোটা রাখা হইছে মাত্র ১০ ভাগ! পাবলিক পরীক্ষায় মাইয়ারা সংখ্যায় বেশী পাস করলেও তাগো নেতৃত্ব দেয়ার জায়গায় আনার ব্যাপারে আমাদের অনীহা কিসের জন্য তা আমি বুঝতে পারি না। এইখানে আবেগরে বাস্তবতার উপরে জায়গা দেয়া হইছে যা নারী ক্ষমতায়নে পক্ষে সহায়ক না।
অনেক বাঁধা বিপত্তি পিছনে ফালাইয়া উচ্চ শিক্ষায় মাইয়ারা আগাইয়া থাকলেও সরকারী বেসরকারি দফতরে সিদ্ধান্ত গ্রহন আর পলিসি তৈরি করার মতন জায়গায় তাগো খুব একটা দেখা যাইতাছে না! হানাহানি যুক্ত হওনের পর রাজনীতিতে মহিলাগো আগ্রহ আরো কইমা গেছে। মেধাবীরা রাজনীতি থাইকা গা ঢাকা দিছে বইলা মনে হয়। বড় দলগুলির ছাত্র সংগঠনে চিরুনি অভিযান দিলেও আগামীতে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন নারী কর্মী পাওয়া যাইব না। এইটা নারী ক্ষমতায়নের পথে বড় একটা বাঁধা হইয়া দাঁড়াইয়া যাইতাছে। বাম মোর্চার নারী কর্মীরা নিজেগো প্লাটফর্ম থাইকা পরিবর্তন আনার চেষ্টা হয়ত করতাছেন কিন্তু সহায়ক পরিবেশ না থাকায় তারাও খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বইলা মনে মনে হয় না। একদিকে মেধাবি নারী কর্মকর্তার ঘাটতি অন্যদিকে তাদেরকে পথ দেখাইবার ঝানু মহিলা রাজনীতিবিদও নাই। এই যুগপৎ সমস্যা সমাধানে বর্তমান নেতৃত্ব কতটা ইচ্ছুক সেই ব্যাপারে আমার বেশ সন্দেহ আছে।
পরিবার পরিচালনায় মহিলাগো সহজাত একটা দক্ষতা আছে। বংশ বিস্তারে তারা অন্যতম ভূমিকা পালন কইরা থাকেন। বাচ্চাদের সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে একজন সুনাগরিক হিসাবে গইড়া তুলতে তারা যথেষ্ট মেধা ও শ্রম দিয়া থাকেন। আমাদের মেসকুইলিন আবহ তা অনেক সময় বুঝতে দিতে চায় না। ঠেলাঠেলির কারণে তাদের এই নিঃস্বার্থ বিনিয়োগরে কখনই সঠিক মুল্যায়ন করা যায় নাই। সময়ের স্রোতে এই মুল্যায়নহীন কাজটা গুরুত্ব হারাইতে হারাইতে এজইউজাল কাজে চিহ্নিত হইয়া গেছে। সঠিক মূল্যায়ন থাকলে ₺তোমরা ঘরে বইয়া কি করো₺ এই সমস্ত চিন্তা ধারার বিপক্ষে মহিলাগো কথা বলার একটা স্কোপ তৈরি হইত। নারীরা তাদের সহজাত কাজে ব্যাস্ত থাইকা সমাজের সদস্য হিসাবে নিজেরে গুরুত্বপূর্ণ বইলা মনে করতে পারত।
আগে নির্যাতন হইলেও তেমন প্রতিবাদ হইত না। এখন হয়। তারপরেও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সবকিছুই এখনও মেয়েদের নিরবে সহ্য কইরা যাইতে হইতাছে। সমাজ আগাইছে। সমান নাই হোক দাবি আদায়ের দিক দিয়া নারী সমাজ অনেক আগাইয়া গেছে। তবে আজকে ডেইলি স্টারের একটা ছবি দেইখা সেই চিন্তায় একটা ধাক্কা লাগল। নিয়মিত টিজিংয়ের কারণে এক মাইয়া হাতে লোহার ডাণ্ডা লইয়া নিয়মিত অফিসে যাওয়া আসা শুরু করছে। ব্যাপারটা হাস্যকর শুনাইলেও এইডা আগাইয়া থাকা সমাজের পিছে পইড়া থাকনের একটা চিত্র মাত্র! এক বিংশ শতকে একটি দেশের রাজধানীতে একজন মাইয়া মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করনের লাইগা হাতে কিছু একটা নিয়া চলাফেরা করতাছে, এইডা ক্যামুন পরিবেশে? ১লা বৈশাখের ঘটনায় তড়িৎ ব্যবস্থা নিলে একটা মেসেজ চারদিকে ছড়াইয়া যাইত, কিন্তু, ঘটল উল্টোটা! সাফ কথায় রাষ্ট্র তার অর্ধেক নাগরিকরে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হইছে! এইভাবে চলতে থাকলে নারীদের ঘর থাইক্কা বাইর কইরা আনবেন ক্যামনে? রাস্তায় বাইরিলেই যদি নারীদের সম্ভ্রমহানি হয় তাইলে হাজারে হাজারে পোলাগো পিছনে ফালাইয়া মাইয়া মানুষ নেতা হইব ক্যামনে?
নারী সমাজে পরস্পরের প্রতি আস্থার একটা সংকট এখনও বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করতাছে। মাচো পরিবেশে নারী ক্ষমতায়নে এইটা একটা বাঁধা বইলা মনে হয়। সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি পরিবারের মধ্যে নারীর প্রতি নারীর বিদ্বেষ, অসহযোগিতা, অশ্রদ্ধা এবং মারমুখী আচরণ লক্ষ্য করণ যায়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বইসা নারীরা যে ভাষা এবং আচরণে একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতাছেন তাতে ক্ষমতায়নের পথে বাঁধা তৈরি হইতাছে। এইসব বাজে ইঙ্গিত, কুবচন আর মারমুখী আচরণ সমাজে জায়গা কইরা নিতাছে। সবসময় কর্তৃত্ব করতে চাওয়া সমাজের সংখ্যাগুরু অংশ এতে বাড়তি প্রশ্রয় পাইতাছে। আমরা এই ধরনের আচরণ অনেকটা গা সওয়া এমনকি স্বাভাবিক বইলা মনে করা শুরু করছি। চুল, লিপস্টিক থাইক্কা শুরু কইরা নারী নেত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এমনকি বেশভূষা নিয়াও মঞ্চ, পেপার-পত্রিকা, অল্টারনেটিভ মিডিয়ায় আলোচনা চলে। মার্কিন নারী রাষ্ট্রদূতের দিকে একজন মহিলা মন্ত্রীর অশালীন শব্দ চয়ন শুধু ভদ্রতাকেই পাশ কাটাইয়া যায় নাই এই কিসিমের আচরণরে আমরা আন্তর্জাতিক একটা রূপ দেয়ার নির্লজ্জ চেষ্টা করতাছি বইলা আমার ধারণা। পারিবারিক কলহে পুরুষ কর্তৃক নারী নিগ্রহের পিছনে শাশুড়ি, জা, ননদদের সরব সমর্থন পরিবেশের উন্নতি হইতে দিতেছে না। সিস্টেমের উপর থাইকা কথার অত্যাচার নিচের দিকে আইসা লাঠিতে পরিণত হইছে। সত্যিকার অর্থে আমরা যদি নারী প্রগতি চাই তাইলে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের পাশাপাশি আচরণগত পার্থক্য তৈরি করার চেষ্টা করটা এখন খুব দরকার। বটম আপ পরিবর্তনের অপেক্ষায় না থাইকা টপে যারা আছেন তারা যদি সংযত আচরণ করেন তাইলে টপ ডাউন ভিত্তিক পলিসির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব। মোদ্দা কথা, নিজে কুইনাইন না খাইয়া সমাজরে তা খাইতে কওন মানায় না।
নারী ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার লাইগা অনেক আইন তৈরি করা হইছে। তাড়াহুড়া কইরা তৈরি করায় নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে আইনে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রইয়া গেছিল। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন আইন (১৯৯৫) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০) এর বেশ কয়েকটি ধারা অসাংবিধানিক বইলা সুপ্রিম কোর্ট রায় দিছে। আদালত পাড়ায় নিপীড়ন রোধে করা মামলার ৮০ ভাগই ভুয়া বইলা প্রমাণিত হইছে। যা আস্থার পরিবেশ তৈরি করার পথে বড় একটা ধাক্কা। আইনের কাম সুরক্ষা দেওয়া, আইন যদি সেইটাই না দিতে পারে তাইলে তা পণ্ড শ্রমের নামান্তর। মারধর, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপের মত চলমান নির্যাতনের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে সাইবার অত্যাচার। যুগোপযোগী আইনের অভাবে সাইবার অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে নারীরা আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে না যা প্রগতির পথে বাঁধা হিসাবে কাজ করছে।
স্বাধীনতার পর থাইকা নারী ক্ষমতায়নে এনজিওগুলার অর্থনৈতিক মডেল যে অসফল তা উপরের আলোচনা থাইকা কিছুটা হইলেও আন্দাজ করতে পারার কথা। আর নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তাদের অর্জন যে শূন্য তাও কওনের অপেক্ষা রাখে না। সৎ উদ্দেশ্য থাকার পরেও তারা ব্যর্থ হইছে। ক্ষমতায়নের লাইগা যে পরিবেশ দরকার তা তৈরি না কইরা তারা নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির লাইগা কাজ শুরু করছিল। ফলশ্রুতিতে তাদের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করা সম্ভবপর হয় নাই। নারী ক্ষমতায়নে প্রথমে একটা সহায়ক পরিবেশের দরকার। পারিবারিক ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সরব উপস্থিতি, নিপীড়ন রোধক আইনের সফল প্রয়োগ হইতাছে সহায়ক পরিবেশের অনুষঙ্গ। এইসব ব্যাপারে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাগো অনেক কিছু করার আছে। অথচ এইক্ষেত্রে আমরা শুরু থাইকা উল্টা পথে হাঁটছি। রাজতন্ত্রের ন্যায় পারিবারিক সুত্রে আজকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীদের পদচারনাকে ক্ষমতায়ন হিসাবে না দেখতে চাইলেও একে এইক্ষেত্রে এক প্রকারের সুচনা হিসাবে ধইরা নিতে অসুবিধা কি? এই সূচনাটারে যদি বর্তমান নারী নেতৃত্ব আগাইয়া নিতে পারেন তাইলে বর্তমান প্রক্রিয়াটির দুষ ত্রুটি মাইনা লইতে সবাই উৎসাহ দেখাইবেন বইলা মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:১৫