স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যে কয়েকটি কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্ধুতে ছিল তার মধ্যে ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সালে সংগঠিত রানা প্লাজা দুর্ঘটনা অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার সাক্ষী ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজা। বিল্ডিং ধ্বসে মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারায় কয়েকশত অসহায় গার্মেন্টস শ্রমিক। টিভি ক্যামেরার সামনে কয়েক ডজন শ্রমিককে আমরা তিলে তিলে মরতে দেখেছি। সেদিন অনেক শক্ত মনের মানুষও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। শোকে স্তব্ধ ছিল চারপাশ, নিরুপায় ছিল গোটা দেশ। শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনায় ১১৩৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ২৫১৫ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় (রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন সেল)। জীবিত উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অনেকেরই অঙ্গহানি হয়েছে। ৭০০টি শিশু বাবা বা মা অথবা দুইজনকেই হারিয়েছে (সেইভ দ্যা চিলড্রেন)। উদ্ধারকারিদের মধ্যে দুইজন মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ২০ দিনের মাথায় সর্ব প্রকারের বিদেশী সাহায্য অগ্রাজ্য করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে। দুর্ঘটনার ৮ মাস পরেও ধ্বংস স্তুপে নিহত শ্রমিকদের দুই শত হাড় খুলি পাওয়া যাওয়ায় উদ্ধার অভিযান যে তরিঘড়ি করে সমাপ্ত করা হয়েছে তার প্রমান মেলে (নিউ ইজ)। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পরপর এবং এখনও রাজনিতিকেরা যে পরিমাণ কাদা ছুড়াছুড়ি করেছেন তা নিহতদের আত্মাদের কষ্ট দিচ্ছে, ক্ষোভ জমা হচ্ছে বেঁচে যাওয়া কয়েকশত হতভাগ্য শ্রমিকদের মনে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার ১ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র দিন কয়েক বাকি, কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের এতটুকু পরিবর্তন কি হয়েছে?
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১১ মাসের মাথায় স্বাধীনতার মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করে আমরা একটা বিশ্ব রেকর্ড করলাম! আমরাত ১১ মাস আগেই শুধু মাত্র লোভের বশবর্তী হয়ে সর্ববৃহৎ কারখানা দুর্ঘটনার হৃদয়বিদারক একটা রেকর্ড করলাম! এত বড় একটা ঘটনার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া কি? প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের এই খাত নিয়ে সরকার কি ভাবছে? লোভী কারখানা মালিকের দায়িত্ববোধ কি এতটুকু বদলেছে? বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানদের কি টনক নড়েছে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কিশোরী শ্রমিকের কষ্টের কথা কি পশ্চিমা ক্রেতাদের কানে পৌঁছেছে?
এইত দিন কয়েক আগে দঃ কোরিয়াতে ফেরি দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকশ লোক নিখোঁজ হয়। নিখোঁজদের আত্মীয়রা সরকারী উদ্ধার অভিযানে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। প্রেস কনফারেন্সে একজন নিখোঁজের আত্মীয়ত রীতিমত এক সরকারী কর্মকর্তার গলা টিপে ধরেছিলেন। ব্রিফ করতে থাকা সরকারী কর্তারা এর কোনও রুঢ় প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। আপনাদের কি মনে পড়ে, আমাদের কর্তা আর রাজনীতিবিদেরা রানা প্লাজা ধ্বসের পর কি রকম আচরণ করেছিলেন? ষড়যন্ত্র তত্ব, পিলার ধরে টানাটানিসহ আরো কত বেহুদা তর্কে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছিল? রানার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কারখানা মালিকেরা ভাঙ্গতে শুরু করা ইমারতে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। কারখানার মালিকেরা কাজ না করলে ১ মাসের বেতন কেটে নেয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন! সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ কাম ব্যবসায়ী রানা প্লাজার মালিক রানা আজ জামিনে মুক্ত? বিচার মনে হয় খেঁটে খাওয়া মানুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়!
টিআইবির তথ্যানুযায়ী রানা প্লাজা ধ্বসের পর সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে মাত্র ৩১ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৬০ ভাগ কাজ এগিয়েছে এবং ৯ ভাগ কাজের কোনও প্রকারের অগ্রগতি হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়াদি যথা- তৈরি পোশাক খাত বিষয়ক আলাদা মন্ত্রনালয় গঠন, শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরি, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, হয়রানিমূলক চাকুরিচ্যুতি বন্ধসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে কোনও ধরনের অগ্রগতি নেই।
ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা একশন এইডের এক জরিপে দেখা যায় যে, আহত নিহতদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ শ্রমিক কোনও প্রকারের আইনি সহায়তা পায়নি, উদ্ধারকৃত ৯২ শতাংশ শ্রমিক এখনও কাজে যোগ দিতে সক্ষম হয়ে উঠেনি। কাজে যেতে না পারাদের মধ্যে আবার ৪৬ শতাংশ অঙ্গহানি ও পক্ষাঘাতের শিকার। উদ্ধার পাওয়া প্রায় সবাই এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
এই সব নিপীড়িত শ্রমিকদের কল্যানে ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন (industriall-union.org) নামক সংস্থা আইএলওকে সাথে নিয়ে ৬০০ কোটি টাকার একটা ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনে কাজ করছে। তারা পোশাক প্রস্তুতকারক ২৮টি বিদেশী ব্র্যান্ড বা কোম্পানিকে এই তহবিলের অর্ধেক অর্থ দেয়ার জন্য বলেছে। নামি দামি অনেক ব্র্যান্ড বেশ আগে থেকেই অর্থ ছাড়ের ব্যপারে অসম্মতি জানিয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানত দায় এড়াবার জন্য বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়েছে!
ছাত্রত্বের সুবাদে কয়েক মাস ছিলাম লন্ডনে। কাজ করতাম প্রাইমার্ক নামের ব্রিটিশ তৈরি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন দিতেন সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির প্রায় সমান সমান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব কাপড়ই আবার রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা কবলিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও প্রাইমার্কের পোশাক তৈরি করত। আমার এখনও মনে আছে ২০১১’র দিকে প্রাইমার্ক দুই পাউন্ডের গোল গলার টিশার্ট মাত্র আড়াই পাউন্ড করার পর লন্ডনবাসীদের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত! দেশে এসে যখন আমার এক মার্চেন্ডাইজার বন্ধুকে এই ব্যপারে জিজ্ঞাস করলাম সে বললো যে ওরা (ক্রেতা প্রতিষ্ঠান) দুই পাউন্ডে ১ ডজন টিশার্ট কিনে একেকটাই আড়াই পাউন্ডে বিক্রি করে। তার উপর পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাইমার্ক, গ্যাপ, ডিজনি, জেসি পেনির মত ক্রেতা ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত দাম কমিয়ে রাখার অন্যায্য যুদ্ধে জড়িয়ে থাকে। পশ্চিমা দেশের ক্রেতারা যখন দাম দিয়ে কাপড় কিনতে রাজি থাকে না তখন শেষমেশ এর খড়গ নেমে আসে অসহায় শ্রমিকদের উপর। তারা বাধ্য হয় ওভার টাইম আর অনিরাপদ কারখানায় কাজ করতে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, রানা প্লাজায় যে ২৮টি বিদেশি কোম্পানি বা ব্রান্ডের কাপড় তৈরি হত তার মধ্যে কেবল কুঞ্জুস প্রাইমার্কই মৃত ও আহত ৩,৩০০ শ্রমিককে তিন মাসের বেতন (মোট ১৫ হাজার) দিয়েছে আর বাকি নামি দামিরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
গেল বছরের ২৭ জুন শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ায় অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জেনারেল সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা বাতিল করে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ তারা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের শ্রমিকদের কল্যানের ব্যাপারে কতটা চিন্তিত? বাজার অর্থনীতিতে যে যত কম দামে পন্য উৎপাদন করতে পারে তার ততই কদর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কথা না হয় বাদই দিলাম তাদের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলির আচরণই বা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কতটুকু সোচ্চার? বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মাকসুদা আমেরিকায় গিয়ে হয়েছেন ম্যাক্স! মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান “আমেরিকান এপারেল্স’এ” চাকুরির সুবাদে তাদের এক বিজ্ঞাপনে সেই বাঙ্গালি ললনা ম্যাক্স খোলা শরীরে হাজির হয়েছেন বিশ্ব মঞ্চে! এইভাবে যারা তাকে বিবস্ত্র ও নাপাক করে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা কাজ করা শ্রমিকদের প্রতিনিধি আর অধিকারের প্রতিরুপ বলে মনে করিয়ে দিতে চায় তারা অন্তত মানসিকভাবে সুস্থ বলে দাবি করতে পারে না। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নযুক্ত নির্বাচনের পর থেকে মার্কিন সরকারের কাছে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যাতিরেখে এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপেই ব্যবহিত হচ্ছে বলে আমার জোর বিশ্বাস।
প্রায় ৩০ লাখ নারী শ্রমিকসহ আরো প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই তৈরি পোশাক শিল্পে। এখনও তাদের অভাব অভিযোগের সুরাহা হয় মান্ধাত্তা আমলের শ্রম আইন দ্বারা। পাঠক আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, নিহত ১১৩১ জন শ্রমিকের একজনেরও বীমা করা ছিল না! সরকার জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে চলতি শ্রম আইন একটু ঘশা মাজা করেছে সত্য কিন্তু এর দ্বারা এই খাতের শ্রমিক কল্যাণ কতখানি সম্ভব? সরকারের উচিত এই শিল্পের সাথে মানানসই একটি সতন্ত্র নীতিমালা প্রনয়ন করা। চাইলে জীবন বিমার নুন্যতম একটা বাধ্যবাধকতা সরকার খুব সহজে প্রনয়ন করতে পারে। পোশাক রপ্তানিতে সরকার ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এই প্রণোদনাকে আরো শর্তযুক্ত করা উচিত বলে মনে করি। এতে কর্ম পরিবেশের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হবে যা শ্রমিকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
শ্রম আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রায় প্রতিটি সংগঠন এক কথায় ব্যর্থ। স্বীয় স্বার্থে বিদেশী ক্রেতা, কারখানা মালিক, সুবিধাবাদী শ্রেণী, জুলুমবাজ এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে আতাত করার অভিযোগ আছে তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে। যারা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কথা আজ তারা আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। যা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি। এই সত্যটি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আরো প্রকটভাবে আমাদের সামনে ধরা পড়েছে। ভাবতে অবাক লাগে একটি দেশের সর্ববৃহৎ একটি শিল্প খাত কিভাবে প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে আছে। শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে যে কয়জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কথা বলছে তার আকার খুব ছোট। এদের না সরকার পাত্তা দেয়, না মালিক পক্ষ। শ্রমিকদের সাথে এদের যোজন যোজন দুরত্ব তৈরি হয়েছে। এরূপ অবস্থা এই শিল্পের স্বার্থপর পক্ষগুলিকে আরো লোভাতুর করে তুলছে যা শ্রমিকদের জীবন দিন দিন ঝুকির মধ্যে ফেলছে!
ব্যক্তিগত নৈপুণ্য হোক বা রাজনৈতিক প্রভাব যেকোনভাবে একটা অর্ডার বাগে আনতে পারলেই কেল্লা ফতে। যেনতেন একটা ইমারতকে কারখানা বানিয়ে তার ভিতর জীবন্ত রোবট পুরে ব্যবসা শুরু! এমনই হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের ভাবদর্শন। আইন কানুন ফাকি দেয়ার সব অজুহাত তাদের নখদর্পণে। মাতৃত্বকালীন ছুটির বাধ্যবাধকতা থাকলেও হাতে গোণা কয়েকটি কমপ্লায়েন্স কারখানা ছাড়া বাকি কেউই এর ধার ধারে না। গার্মেন্টসে কাজ করা আমার এক বন্ধু জানিয়েছে যে, মালিক কর্তৃক লোক নিয়োগ করা আছে যাদের কাজ হচ্ছে গর্ভবতী কর্মী দেখলেই অজুহাত দেখিয়ে তাদের কারখানা ছাড়া করা। এত গেল বাড়তি সুবিধা না দেয়ার ফন্দি ফিকির, মাসের মাসের পর শ্রমিকের ঘাম ঝরিয়ে কত শত কারখানা মালিক বেতন না দিয়ে চম্পট দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর এইসব জুলুমবাজ মালিকেরা প্রশ্রয় পায় বিজিএমই নামক সংগঠনের কাছে।
অভিযোগ আছে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার বাছ বিচার না করেই অসাধু কারখানা মালিকদের লোন দিয়ে থাকে। রানা প্লাজার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও দেশের নামকরা কয়েকটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছিলো। এই দুর্ঘটনায় তাদেরও দায় আছে।
উন্নত বিশ্বে জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকজন এখন আগের চেয়ে অনেক ফ্যাশন সচেতন। এক ঋতুর কাপড় তারা অন্য ঋতুতে পড়ে না। নামি দামি ফ্যাশন হাউজ আর খুচরা বিক্রেতারা সেই সুযোগে লাভের অংককে স্ফিত করতে ব্যস্ত। গরিব দেশের সুবিধাবাদী কারখানা মালিকেরা এইসব নামি দামিদের সেবা করে নিজেদের আঙ্গুলও বেশ মোটা করে চলেছেন। আর এই দুষ্ট চক্রে পড়ে শ্রমিকদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। দুর্ঘটনায় যে শ্রমিকের জরায়ু বেড়িয়ে পড়েছে তার চিকিৎসার টাকা কে দেবে? যে সন্তান এতিম হল তাকে বাবা-মায়ের আদর স্নেহে কে বড় করবে? পঙ্গু শ্রমিকের মুখে কে খাবার তুলে দেবে? ক্রমবর্ধমান এই লোভকেন্দ্রিক চক্র ভাঙ্গবেইবা কে? প্রশ্ন অনেক উত্তর কম! লজ্জা ঢাকতে পোশাকের প্রয়োজন আছে সত্য কিন্তু সে প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে নতুন লজ্জা সৃষ্টি করলে মানবতা বিপন্ন হবে। রানা প্লাজার মত ৮ তলা ইমারত সরাতে কয়েক মাস লেগেছে। সারা দেশে এইরকম শত শত কারখানা ছড়িয়ে আছে। নির্মাণ ত্রুটি বা দৈব ঘটনায় রানা প্লাজার পুনরাবৃত্তি ঘটলে উত্তরণের কোন উপায় কি আমাদের জানা আছে?
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যে কয়েকটি কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আলোচনার কেন্দ্রবিন্ধুতে ছিল তার মধ্যে ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সালে সংগঠিত রানা প্লাজা দুর্ঘটনা অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার সাক্ষী ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত রানা প্লাজা। বিল্ডিং ধ্বসে মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারায় কয়েকশত অসহায় গার্মেন্টস শ্রমিক। টিভি ক্যামেরার সামনে কয়েক ডজন শ্রমিককে আমরা তিলে তিলে মরতে দেখেছি। সেদিন অনেক শক্ত মনের মানুষও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। শোকে স্তব্ধ ছিল চারপাশ, নিরুপায় ছিল গোটা দেশ। শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনায় ১১৩৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ২৫১৫ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় (রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন সেল)। জীবিত উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে অনেকেরই অঙ্গহানি হয়েছে। ৭০০টি শিশু বাবা বা মা অথবা দুইজনকেই হারিয়েছে (সেইভ দ্যা চিলড্রেন)। উদ্ধারকারিদের মধ্যে দুইজন মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ২০ দিনের মাথায় সর্ব প্রকারের বিদেশী সাহায্য অগ্রাজ্য করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে। দুর্ঘটনার ৮ মাস পরেও ধ্বংস স্তুপে নিহত শ্রমিকদের দুই শত হাড় খুলি পাওয়া যাওয়ায় উদ্ধার অভিযান যে তরিঘড়ি করে সমাপ্ত করা হয়েছে তার প্রমান মেলে (নিউ ইজ)। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পরপর এবং এখনও রাজনিতিকেরা যে পরিমাণ কাদা ছুড়াছুড়ি করেছেন তা নিহতদের আত্মাদের কষ্ট দিচ্ছে, ক্ষোভ জমা হচ্ছে বেঁচে যাওয়া কয়েকশত হতভাগ্য শ্রমিকদের মনে। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার ১ বছর পূর্ণ হতে আর মাত্র দিন কয়েক বাকি, কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের এতটুকু পরিবর্তন কি হয়েছে?
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১১ মাসের মাথায় স্বাধীনতার মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ করে আমরা একটা বিশ্ব রেকর্ড করলাম! আমরাত ১১ মাস আগেই শুধু মাত্র লোভের বশবর্তী হয়ে সর্ববৃহৎ কারখানা দুর্ঘটনার হৃদয়বিদারক একটা রেকর্ড করলাম! এত বড় একটা ঘটনার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া কি? প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারের এই খাত নিয়ে সরকার কি ভাবছে? লোভী কারখানা মালিকের দায়িত্ববোধ কি এতটুকু বদলেছে? বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানদের কি টনক নড়েছে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কিশোরী শ্রমিকের কষ্টের কথা কি পশ্চিমা ক্রেতাদের কানে পৌঁছেছে?
এইত দিন কয়েক আগে দঃ কোরিয়াতে ফেরি দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকশ লোক নিখোঁজ হয়। নিখোঁজদের আত্মীয়রা সরকারী উদ্ধার অভিযানে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। প্রেস কনফারেন্সে একজন নিখোঁজের আত্মীয়ত রীতিমত এক সরকারী কর্মকর্তার গলা টিপে ধরেছিলেন। ব্রিফ করতে থাকা সরকারী কর্তারা এর কোনও রুঢ় প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। আপনাদের কি মনে পড়ে, আমাদের কর্তা আর রাজনীতিবিদেরা রানা প্লাজা ধ্বসের পর কি রকম আচরণ করেছিলেন? ষড়যন্ত্র তত্ব, পিলার ধরে টানাটানিসহ আরো কত বেহুদা তর্কে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছিল? রানার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কারখানা মালিকেরা ভাঙ্গতে শুরু করা ইমারতে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন। কারখানার মালিকেরা কাজ না করলে ১ মাসের বেতন কেটে নেয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন! সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ কাম ব্যবসায়ী রানা প্লাজার মালিক রানা আজ জামিনে মুক্ত? বিচার মনে হয় খেঁটে খাওয়া মানুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়!
টিআইবির তথ্যানুযায়ী রানা প্লাজা ধ্বসের পর সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে মাত্র ৩১ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৬০ ভাগ কাজ এগিয়েছে এবং ৯ ভাগ কাজের কোনও প্রকারের অগ্রগতি হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়াদি যথা- তৈরি পোশাক খাত বিষয়ক আলাদা মন্ত্রনালয় গঠন, শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরি, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, হয়রানিমূলক চাকুরিচ্যুতি বন্ধসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে কোনও ধরনের অগ্রগতি নেই।
ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা একশন এইডের এক জরিপে দেখা যায় যে, আহত নিহতদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ শ্রমিক কোনও প্রকারের আইনি সহায়তা পায়নি, উদ্ধারকৃত ৯২ শতাংশ শ্রমিক এখনও কাজে যোগ দিতে সক্ষম হয়ে উঠেনি। কাজে যেতে না পারাদের মধ্যে আবার ৪৬ শতাংশ অঙ্গহানি ও পক্ষাঘাতের শিকার। উদ্ধার পাওয়া প্রায় সবাই এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
এই সব নিপীড়িত শ্রমিকদের কল্যানে ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন (industriall-union.org) নামক সংস্থা আইএলওকে সাথে নিয়ে ৬০০ কোটি টাকার একটা ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনে কাজ করছে। তারা পোশাক প্রস্তুতকারক ২৮টি বিদেশী ব্র্যান্ড বা কোম্পানিকে এই তহবিলের অর্ধেক অর্থ দেয়ার জন্য বলেছে। নামি দামি অনেক ব্র্যান্ড বেশ আগে থেকেই অর্থ ছাড়ের ব্যপারে অসম্মতি জানিয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানত দায় এড়াবার জন্য বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়েছে!
ছাত্রত্বের সুবাদে কয়েক মাস ছিলাম লন্ডনে। কাজ করতাম প্রাইমার্ক নামের ব্রিটিশ তৈরি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন দিতেন সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির প্রায় সমান সমান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব কাপড়ই আবার রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা কবলিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও প্রাইমার্কের পোশাক তৈরি করত। আমার এখনও মনে আছে ২০১১’র দিকে প্রাইমার্ক দুই পাউন্ডের গোল গলার টিশার্ট মাত্র আড়াই পাউন্ড করার পর লন্ডনবাসীদের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত! দেশে এসে যখন আমার এক মার্চেন্ডাইজার বন্ধুকে এই ব্যপারে জিজ্ঞাস করলাম সে বললো যে ওরা (ক্রেতা প্রতিষ্ঠান) দুই পাউন্ডে ১ ডজন টিশার্ট কিনে একেকটাই আড়াই পাউন্ডে বিক্রি করে। তার উপর পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাইমার্ক, গ্যাপ, ডিজনি, জেসি পেনির মত ক্রেতা ধরে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত দাম কমিয়ে রাখার অন্যায্য যুদ্ধে জড়িয়ে থাকে। পশ্চিমা দেশের ক্রেতারা যখন দাম দিয়ে কাপড় কিনতে রাজি থাকে না তখন শেষমেশ এর খড়গ নেমে আসে অসহায় শ্রমিকদের উপর। তারা বাধ্য হয় ওভার টাইম আর অনিরাপদ কারখানায় কাজ করতে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, রানা প্লাজায় যে ২৮টি বিদেশি কোম্পানি বা ব্রান্ডের কাপড় তৈরি হত তার মধ্যে কেবল কুঞ্জুস প্রাইমার্কই মৃত ও আহত ৩,৩০০ শ্রমিককে তিন মাসের বেতন (মোট ১৫ হাজার) দিয়েছে আর বাকি নামি দামিরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।
গেল বছরের ২৭ জুন শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ায় অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জেনারেল সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা বাতিল করে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ তারা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের শ্রমিকদের কল্যানের ব্যাপারে কতটা চিন্তিত? বাজার অর্থনীতিতে যে যত কম দামে পন্য উৎপাদন করতে পারে তার ততই কদর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কথা না হয় বাদই দিলাম তাদের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলির আচরণই বা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কতটুকু সোচ্চার? বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মাকসুদা আমেরিকায় গিয়ে হয়েছেন ম্যাক্স! মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান “আমেরিকান এপারেল্স’এ” চাকুরির সুবাদে তাদের এক বিজ্ঞাপনে সেই বাঙ্গালি ললনা ম্যাক্স খোলা শরীরে হাজির হয়েছেন বিশ্ব মঞ্চে! এইভাবে যারা তাকে বিবস্ত্র ও নাপাক করে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা কাজ করা শ্রমিকদের প্রতিনিধি আর অধিকারের প্রতিরুপ বলে মনে করিয়ে দিতে চায় তারা অন্তত মানসিকভাবে সুস্থ বলে দাবি করতে পারে না। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নযুক্ত নির্বাচনের পর থেকে মার্কিন সরকারের কাছে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যাতিরেখে এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপেই ব্যবহিত হচ্ছে বলে আমার জোর বিশ্বাস।
প্রায় ৩০ লাখ নারী শ্রমিকসহ আরো প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই তৈরি পোশাক শিল্পে। এখনও তাদের অভাব অভিযোগের সুরাহা হয় মান্ধাত্তা আমলের শ্রম আইন দ্বারা। পাঠক আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে, নিহত ১১৩১ জন শ্রমিকের একজনেরও বীমা করা ছিল না! সরকার জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে চলতি শ্রম আইন একটু ঘশা মাজা করেছে সত্য কিন্তু এর দ্বারা এই খাতের শ্রমিক কল্যাণ কতখানি সম্ভব? সরকারের উচিত এই শিল্পের সাথে মানানসই একটি সতন্ত্র নীতিমালা প্রনয়ন করা। চাইলে জীবন বিমার নুন্যতম একটা বাধ্যবাধকতা সরকার খুব সহজে প্রনয়ন করতে পারে। পোশাক রপ্তানিতে সরকার ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। এই প্রণোদনাকে আরো শর্তযুক্ত করা উচিত বলে মনে করি। এতে কর্ম পরিবেশের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হবে যা শ্রমিকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
শ্রম আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রায় প্রতিটি সংগঠন এক কথায় ব্যর্থ। স্বীয় স্বার্থে বিদেশী ক্রেতা, কারখানা মালিক, সুবিধাবাদী শ্রেণী, জুলুমবাজ এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে আতাত করার অভিযোগ আছে তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে। যারা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কথা আজ তারা আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। যা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি। এই সত্যটি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আরো প্রকটভাবে আমাদের সামনে ধরা পড়েছে। ভাবতে অবাক লাগে একটি দেশের সর্ববৃহৎ একটি শিল্প খাত কিভাবে প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে আছে। শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে যে কয়জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কথা বলছে তার আকার খুব ছোট। এদের না সরকার পাত্তা দেয়, না মালিক পক্ষ। শ্রমিকদের সাথে এদের যোজন যোজন দুরত্ব তৈরি হয়েছে। এরূপ অবস্থা এই শিল্পের স্বার্থপর পক্ষগুলিকে আরো লোভাতুর করে তুলছে যা শ্রমিকদের জীবন দিন দিন ঝুকির মধ্যে ফেলছে!
ব্যক্তিগত নৈপুণ্য হোক বা রাজনৈতিক প্রভাব যেকোনভাবে একটা অর্ডার বাগে আনতে পারলেই কেল্লা ফতে। যেনতেন একটা ইমারতকে কারখানা বানিয়ে তার ভিতর জীবন্ত রোবট পুরে ব্যবসা শুরু! এমনই হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের ভাবদর্শন। আইন কানুন ফাকি দেয়ার সব অজুহাত তাদের নখদর্পণে। মাতৃত্বকালীন ছুটির বাধ্যবাধকতা থাকলেও হাতে গোণা কয়েকটি কমপ্লায়েন্স কারখানা ছাড়া বাকি কেউই এর ধার ধারে না। গার্মেন্টসে কাজ করা আমার এক বন্ধু জানিয়েছে যে, মালিক কর্তৃক লোক নিয়োগ করা আছে যাদের কাজ হচ্ছে গর্ভবতী কর্মী দেখলেই অজুহাত দেখিয়ে তাদের কারখানা ছাড়া করা। এত গেল বাড়তি সুবিধা না দেয়ার ফন্দি ফিকির, মাসের মাসের পর শ্রমিকের ঘাম ঝরিয়ে কত শত কারখানা মালিক বেতন না দিয়ে চম্পট দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর এইসব জুলুমবাজ মালিকেরা প্রশ্রয় পায় বিজিএমই নামক সংগঠনের কাছে।
অভিযোগ আছে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার বাছ বিচার না করেই অসাধু কারখানা মালিকদের লোন দিয়ে থাকে। রানা প্লাজার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও দেশের নামকরা কয়েকটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছিলো। এই দুর্ঘটনায় তাদেরও দায় আছে।
উন্নত বিশ্বে জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকজন এখন আগের চেয়ে অনেক ফ্যাশন সচেতন। এক ঋতুর কাপড় তারা অন্য ঋতুতে পড়ে না। নামি দামি ফ্যাশন হাউজ আর খুচরা বিক্রেতারা সেই সুযোগে লাভের অংককে স্ফিত করতে ব্যস্ত। গরিব দেশের সুবিধাবাদী কারখানা মালিকেরা এইসব নামি দামিদের সেবা করে নিজেদের আঙ্গুলও বেশ মোটা করে চলেছেন। আর এই দুষ্ট চক্রে পড়ে শ্রমিকদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। দুর্ঘটনায় যে শ্রমিকের জরায়ু বেড়িয়ে পড়েছে তার চিকিৎসার টাকা কে দেবে? যে সন্তান এতিম হল তাকে বাবা-মায়ের আদর স্নেহে কে বড় করবে? পঙ্গু শ্রমিকের মুখে কে খাবার তুলে দেবে? ক্রমবর্ধমান এই লোভকেন্দ্রিক চক্র ভাঙ্গবেইবা কে? প্রশ্ন অনেক উত্তর কম! লজ্জা ঢাকতে পোশাকের প্রয়োজন আছে সত্য কিন্তু সে প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে নতুন লজ্জা সৃষ্টি করলে মানবতা বিপন্ন হবে। রানা প্লাজার মত ৮ তলা ইমারত সরাতে কয়েক মাস লেগেছে। সারা দেশে এইরকম শত শত কারখানা ছড়িয়ে আছে। নির্মাণ ত্রুটি বা দৈব ঘটনায় রানা প্লাজার পুনরাবৃত্তি ঘটলে উত্তরণের কোন উপায় কি আমাদের জানা আছে?