(৪)
পশ্চিমের আধুনিক রাষ্ট্র মিডিয়ার বদৌলতে ধর্মের নামে চলতে থাকা বোমা হামলা, হত্যা, সন্ত্রাস ইত্যকার জিনিস তুলে ধরে এটা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে যে, ধর্ম হচ্ছে সব সমস্যার মূল এবং এটিকে রাষ্ট্র বা রাজনীতি থেকে আলাদা করতে পারলেই কেবল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব! আজকের আলোচনায় যুক্তরাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় চার্চের প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের লালিত ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্র জীবনের উপর কি ছাপ রাখছে তা কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আগে চার্চ সরাসরি শাসন ব্যাবস্থায় প্রভাব রাখত এখন রাষ্ট্র শাসন ব্যাবস্থায় ধর্মকে সহযোগী হিসাবে কাজে লাগাচ্ছে। পশ্চিমে পরস্থিতির আদতে কি কোনও পরিবর্তন ঘটেছে? আপনাদের কি মনে হয়? তারা যেখানে নিজেদের বদলাতে পারিনি সেখানে গরিব রাষ্ট্রগুলিকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার সবক দেয়া কতটা যৌক্তিক? পশ্চিমারা নিজেদের ধর্মের অনেক কাছেই রাখছে আবার আমাদের মত দেশে সেকুলার রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছে!
পশ্চিমারা সহিংসতার মধ্যেও রকমভেদ আছে বলে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে! আজকাল ধর্ম নিরপেক্ষ বা সেকুলার ইঙ্গ-মার্কিন-ফ্রাঙ্ক বলয়ের কৃত সব সহিংসতাকে প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ২০০৩ সালে বিনা উস্কানিতে ইরাক দখল ও ১ মিলিয়ন নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ, ড্রোন হামলায় প্রতিনিয়ত আফগানিস্থানের নিরীহ মানুষ হত্যা, আফ্রিকায় জাতিগত দাঙ্গা উস্কে দেওয়া, আরব বসন্তের সময় অবাধ্য রাষ্ট্র প্রধানদের সরিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পরও তারা তাদের সহিংসতাকে প্রয়োজনীয় ও শান্তিকামী বলে বিশ্বাস করাতে সমর্থ হয়েছে! অন্যদিকে, আস্তিকদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, স্বাধীন হওয়ার আকাংখা বিশ্বের চোখে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও সহিংস বলে বোঝাতেও তারা বেশ সক্ষম হয়েছে!
সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়ার ঢেউ আমাদের দেশেও লেগেছে। আমরাও দলবেঁধে সবাই এর পালে বুঝে না বুঝে বাতাস দিয়ে চলেছি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পুনর্বহাল করা হয়েছে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামও জারি আছে! ব্যাপারটা দ্বিচারিতার মতই শোনায়, তাই না? “বিসমিল্লাহহির রহমানির রাহিম” বলে অন্য ধর্ম বা মতের (নাস্তিক) মানুষদের প্রতি কতটুকু সুবিচার করা সম্ভব হবে এই ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে! একজন মুসলিম নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বহাল থাকায় আমারত খুশি থাকার কথা কিন্তু আমার অস্বস্থি বোধ হচ্ছে! এই পুনর্বহাল কি পশ্চিমা নটদের খুশি করার স্বার্থে? রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ইসলামের বহাল থাকা কি মধ্য প্রাচ্যের কাঠ মোল্লাদের খুশি করার জন্য? যাই হোক, যে কারণে আমাদের এই অবস্থান তাতে চাপের লক্ষন বেশ স্পষ্ট! জনমত এখানে উপেক্ষিত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। কাউকে খুশি করার জন্য বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে যে নীতির জন্ম তা মানুষের উপকারে আসতে পারে না। নীতির সাথে যদি জনগণের সম্পর্ক না থাকে তাইলে সেই নীতি শো-পিস বৈ কিছু না।
(৫)
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত মাতাকে ভাগ করা হয়েছিল। শুধু ধর্মের অনুষঙ্গটি মাথায় রেখে আমাদের যুক্ত করা হয়েছিল পাকিস্থানের সাথে। যদিও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমারা কখনই পশ্চিমের অপর অংশের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও আমদের হিন্দু সত্তাই যেন বড় হয়ে উঠেছিল। এই অবিশ্বাসের যাঁতাকলে অনেক প্রাণের অপচয় হয়েছিল। তাদের আত্মত্যাগে আমরা স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছিলাম। দেশ চালাতে পথ নির্দেশিকা হিসাবে ৭২’রে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ একটি সংবিধানও পেয়েছিলাম। এটা যত না রাষ্ট্রীয় আকাংখা ছিল তার চেয়েও বেশী ছিল ছিল আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রদের খুশি করার প্রচেষ্টা। এই ব্যাপারে অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তাদের মতামতকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারো কাছে আমার কথা যদি ব্যাক্তিগত আবেগ বা অবান্তর বলে প্রতীয়মান হয় তাইলে তারা নিশ্চয় বলতে পারবেন কিসের আশায় আমরা স্বাধীনতার পরপরই ওআইসির সদস্য পদ পেতে এতো উদগ্রীব হয়েছিলাম! একটা সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেই ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আমাদের সেকুলার হওয়ার বাসনায় যে ঘাটতি রয়েছে তার ইঙ্গিত কি দেয় না?
প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশের নাগরিকগণ সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য কতটা প্রস্তুত? দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিচারের পর কারোরই এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পেতে বেশী সময় লাগার কথা না! জনকল্যাণের চূড়ান্ত নির্দেশিকা সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র এখনও প্রতিটি নাগরিকের নুন্যতম চাহিদা পুরন করতে পারিনি! এমতাবস্থায়, রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছে নতুন কিছু চাপিয়ে দিতে চাইলে তা বদ হজমের সৃষ্টি করবে! বমিও হতে পারে!
(৬)
বাংলাদেশ সরকার যে শুধু কৌশল (পররাষ্ট্র) হিসাবে নিজেদের সেকুলার বলে দাবি করছে (যদিও সংবিধান অন্য কিছু বলছে) তা কিন্তু নয়। সরকার সকল ধর্মের সমমর্যাদার ও সমগুরুত্বের যে বিষয়টি বারবার সামনে নিয়ে আসছে তা আমার কাছে রীতিমত হাস্যকর লাগে! একদিকে সরকার সমর্থকেরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের চেষ্টা (পাবানায়) চালায় অন্যদিকে দলের সিনিয়র মন্ত্রী থেকে সাংসদেরা এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে! সরকার একদিকে পার্বত্য এলাকায় মিশনারিদের চলাফেরার অবাধ সুযোগ করে দেয় আবার অন্যদিকে ব্রিটিশ বেইসড মুসলিম চ্যারিটি সংগঠনদের আরাকান থেকে বিতাড়িত মুসলিমদের সাহায্য করতে বাঁধা দেয়। একদিকে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক গুরুকে সফরে আনার উদ্যোগ নেয় আর অন্যদিকে বিলাল ফিলিপস কে ভিসা দিতে অস্বীকার করে! লালবাগ আর হাটহাজারিতে তদবির করতে লোক পাঠায় আবার রাতের আঁধারে এদের উপর হামলেও পড়ে! একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিকুচি করে আবার খেলাফতের সাথে চুক্তিও করে! সরকারে থাকা লোকজন নবীর সুন্নত তাহাজ্জুদের নামাযও পড়েন আবার নবীর শানে আঘাত দেয়া স্বঘোষিত নাস্তিককে শহীদ বলেও আখ্যা দেন! উদাহরণগুলি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জাতীয়ভাবে সেকুলার হওয়ার পথে আমরা কতটা অপ্রস্তুত! রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিচ্ছেদ ঘটুক বা এই দুইটি শক্তি একসাথে থাকুক তাতে সাধারণ লোকজনের কি কিছু যায় আসে? অধিকাংশ নাগরিক আজ দুমুঠো অন্নের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করছে। রাষ্ট্রের এহেন কৌশলী আচরণ পরিশ্রমী মানুষদের এক হয়ে জাতীয় প্রগতিতে অংশ নিতে বারবার বাঁধা দিচ্ছে।
ধর্ম নিয়ে অহেতুক ঘাটাঘটি অনেক আগ থেকেই চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে এখন পর্যন্ত কারা বেশী লাভবান হয়েছে? বিশ্ব আজ বিনে সুতোয় গাঁথা। প্রতিটি নাগরিক দিন দিন একে অন্যের কাছে আসছে। পৃথিবীর এক কোণের ঘটনা খুব সহজেই অন্য কোণের মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলের নানা চাপ, অবিচার, শোষণ, অপপ্রচার তাই মানুষকে আরো বেশী করে ধর্মের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। শোষিত মানুষজন প্রতিনিয়ত তাদের বিশ্বাসকে হেনস্তা হতে দেখছে, অপমানিত হতে দেখছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি তাই বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম সংশ্লিষ্টতা বেড়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কয়েকদিন আগে এক মন্ত্রী বললেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা খালি খেয়ে বেড়ায়, তারা অলসের দল। কিন্তু রাষ্ট্র জাতীয় প্রগতিতে তাদের কাজে লাগাতে বা সক্রিয় করতে কি ভূমিকা নিয়েছে? তাদের মানহীন শিক্ষায় (সেকুলারদের মতে) রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কত? রাষ্ট্র যেখানে পৃষ্টপোষকতা করে না সেখানেও কর্তৃত্ব করতে চায়, নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেকুলার হয়েও কি রক্ষা আছে! ইরাক, তিউনিশিয়া, লিবিয়া আর হালের সিরিয়াতেত সেকুলার ব্যবস্থাই চালু ছিল? ফাতাহ সরকারত সেকুলার ভাবধারারই ছিল, তাই না? কিন্তু হটাৎ গণেশ পাল্টে গেল কেন? ফাঁসিতে প্রাণ গেল সাদ্দামের, পালিয়ে প্রানে বাঁচলেন বেন আলী, গুলিতে মরলেন গাদ্দাফি, দৌড়ের উপর আছেন বাশার আর পোলনিয়াম বিষক্রিয়ায় মারা হল আরাফাতকে! আসলে পশ্চিমের প্রয়োজন ফুরালে যে কারো দফারফা হতে বেশী লাগে না! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কাদের খুশি করতে অহেতুক ছুটে বেড়াচ্ছে? এই ব্যাপারে আগে বাড়তে কি আমাদের মধ্যে মতৈক্য আছে? কৌশলে নতুন কিছু চাপিয়ে দেয়ার আগে রাষ্ট্রের উচিত তার অধিবাসীদের প্রস্তুত করা। অপ্রস্তুত অবস্থায় যেকোনো নতুন কিছুতে লোকজন প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। আর এর স্থায়িত্বও হয় অনেকটা ভঙ্গুর প্রকৃতির।
[প্রথম পর্বঃ Click This Link ]
সুনামগঞ্জ, আগস্ট ১০, ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:১৫