‘সেকুলার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ধর্ম বহির্ভূত,পার্থিব বা ইহজাগতিক। হালের এই বহুল আলোচিত শব্দটি রীতিমত একটা মতবাদে পরিণত হয়েছে বলা চলে। যা কি না রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যাবস্থায় ধর্মের উপস্থিতি অস্বীকার করে। সেকুলার ধারায় রাষ্ট্র ধর্ম সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। বস্তুবাদী সরকার ধর্মকে ব্যাক্তিগত আচারের স্বীকৃতি দেয় মাত্র। সেকুলার শব্দের প্রকৃত বাংলা প্রতিশব্দ আছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা অসম্প্রদায়িকতাকে আমরা এর বাংলা রূপ হিসাবে ধরে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। গ্রীক আর রোমান দার্শনিকেরা অনেক আগেই এর বিচার বিশ্লেষণ করে গেছেন। আর এই কেন্দ্রিক স্পষ্ট ধারনা বা মতবাদটি ১৯ শতকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৮৫১সালে জর্জ জ্যাকব হলিওয়াক এর হাত ধরে আবির্ভূত হয়। তবে আজকের দিনে এই মতবাদকে এগিয়ে আনতে সহায়তা করেন বস্তুবাদী কিছু বিখ্যাত তাত্ত্বিক ও দার্শনিক।
সেকুলার রাষ্ট্র সকল ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমমর্যাদা ও সমগুরুত্ব নিশ্চিত করে। সেই ক্ষেত্রে ‘সেকুলার’ রাষ্ট্রকে লোক কেন্দ্রিক শাসন ব্যাবস্থা বললে যথার্থই বলা হবে।রাষ্ট্র এখানে নাগরিকদের ইহজাগতিক সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করবে। বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে এই চকচকে ভাবটা দুর্নিবিত আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র পরলৌকিক চিন্তার ব্যাপারটা ব্যক্তির উপরই ছেড়ে দিয়েছে। ধর্মকে রাষ্ট্র বেসরকারিকরন করেছে বলা চলে। অনেকের কাছে রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন বৈ আর কিছু না। সংগঠনের ধর্ম চর্চার দরকার নেই। ধর্ম-কর্ম তথা উপসনার প্রয়োজন পড়ে শুধু মানুষজনের। সংগঠনকে এখানে জড় বস্তুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। জড় বস্তুর নিজের কোন অনুভুতি থাকার কথা না। বস্তুর ইহলৌকিক বা পরলৌকিক অবস্থা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাই তার ধর্ম সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন পড়ে না। অনেকে তাই সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন রাষ্ট্রর ধর্মহীন থাকার উপযোগিতা খুঁজে পেয়েছেন এবং তা ঘটা করে প্রচার করছেন। পশ্চিমের রাষ্ট্র এমনকি ব্যক্তি পর্যায় থেকে এমন চিন্তা এখন বিশ্বময় রফতানি করা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, নুন্যতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষকে এটি কি উপহার দিবে?
(২)
ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে রাষ্ট্র কয়েকটি পথে হাঁটতে পারে। সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রসত্তা তার কার্য পরিচালনা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে ধর্মকে ছেঁটে ফেলে রাষ্ট্র ধর্ম বিরোধী অবস্থানও নিতে পারে। আবার ধর্মহীনতাকে রাষ্ট্র পৃষ্টপোষকতাও করতে পারে। আসুন বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী দেশে রাষ্ট্র ও ধর্মের ভিতর যে সম্পর্ক রয়েছে সে ব্যাপারে একটু আলোচনা করা যাক।
(৩)
যুক্তরাজ্য বহুমাত্রিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা করলেও দেশটির আদ্যপান্ত ধর্ম কেন্দ্রিক বলা চলে। সব কিছুই চার্চ অব ইংল্যান্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। দুনিয়ার তাবৎ খ্রিষ্টীয় অনুসারীদের মধ্যে চার্চ অব ইংল্যান্ডের রয়েছে বিরাট প্রভাব। ধর্মীয় এই সংস্থাটি যেন রাষ্ট্রের ভিতর এক বড় রাষ্ট্র। এর প্রধান হচ্ছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সংসদের উচ্চ কক্ষ লর্ডস সভায় প্রভাবশালী ২৪ জন বিশপের (ধর্মীয় গুরু) উপস্থিতি লক্ষণীয়। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। লোকজন বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে চার্চের প্রভাব কমাতে চান তারা সংসদের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনির্বাচিত চার্চ প্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তবে এটা লক্ষণীয় যে, দুইটি ভিন্ন রকমের শক্তি বেশ কাছাকাছি থাকলেও তাদের মধ্যে ঠুকাঠুকি হচ্ছে না বললেই চলে। হয়ত তারা একে অপরকে সমঝিয়ে চলছে। সময়ের স্রোতে বা চাপে যাই বলুন না কেন চার্চ ও রাষ্ট্র উভয়ই ডাইভারসিটি ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতির চরিত্র হজম করতে সমর্থ হয়েছে। যুক্তরাজ্যকে আমার সব বিষয়েই বেশ রক্ষণশীল মনে হয়। তাই চার্চ আর রাজতন্ত্রের হাত ধরে চলতে থাকা সরকার রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর জনদাবির (সংখ্যা বিবেচনায় নিচ্ছি না) প্রতি কতটা সম্মান দেখাতে পারে তা ভাবার বিষয়। নখদন্তহীন জৌলুসে ভরা খরুচে রাজতন্ত্রের প্রতি তাদের ব্যাপক অনুরক্তি দেখে জাতীয় জীবনের আদ্যপান্ত জড়িয়ে থাকা চার্চের ক্ষমতা খর্ব করার যেকোনো প্রচেষ্টা সফল করতে যে সময়ের প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। আমি মনে করি ব্রিটিশ জনগন আদতে এর জন্য এখনও প্রস্তুত নয়! নতুন এই মতবাদকে মূলধারায় নিয়ে আসতে অনেক সময় লাগতে পারে আবার ব্যর্থ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে!
ইংলিশ চ্যানেলের অপর পারের দেশ ফ্রান্সে আইনের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে রাষ্ট্রকে চার্চ থেকে আলাদা করা হয়। সেকুলার ব্যবস্থার পুরোধা বলা হয় ফ্রান্সকে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ তারা ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র থেকে আলাদাই করেনি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বলা চলে। ২০০৪ সালে সরকারী স্কুলে সবধরনের ধর্মীয় সিম্বল (ক্রস, হ্যাড স্কার্ফ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালে মহিলাদের নেকাব পড়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে আইন অমান্যকারীদের রীতিমত জরিমানার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সরকারী স্কুলে বাস্তবায়নের জন্য গেল বছর আবার ফ্রেঞ্চ ফর সেকুলারিজম নামে ১৫টি ধারা সম্বলিত একটি সেকুলার চার্টার পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয়েছে [১]। এখন থেকে আর কোন ছাত্র বা ছাত্রী ধর্মীয় কারণে স্কুল কারিকুলামের কোন কিছুতে অংশ নেয়ার ব্যাপারে না করতে পারবে না! ধর্মের ব্যাপারে ফ্রান্সের আচরনে দ্বিচারিতাও বেশ লক্ষণীয়। একদিকে তারা এক পক্ষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে আবার অন্যদিকে আইন করে ইহুদীদের তোষামোদিতে লিপ্ত রয়েছে! ২০১১তে প্যারিসে খ্রিস্টিয়ান ডিওর এর প্রখ্যাত ডিজাইনার জন গেলিয়ানো ইহুদী বিরুধী মন্তব্য করে কোর্টের রায়ে জরিমানা গুনার পাশাপাশি চাকরি পর্যন্ত হারিয়েছিলেন!
আমেরিকার ধর্ম নিরপেক্ষ চেহারা অনেক পুরনো। সংবিধান মোতাবেক তাদের রাষ্ট্রীয় কোন ধর্ম নেই। রাষ্ট্র ও চার্চ (ধর্ম) এখানে সম্পূর্ণ আলাদা। তথাপি রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমরেডদের টেক্কা দিতে আমেরিকার মটো পরিবর্তন করে “ইন গড উই ট্রাস্ট” নির্ধারণ করেন! যুক্তরাষ্ট্রের ৭১ শতাংশ মানুষ নিজেদের ধার্মিক মনে করে এবং ৫৬ শতাংশ লোক ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বলে রায় দিয়েছে [২]। অন্যান্য পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশে এমনটা বিরল। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নানা জাতি ও গোষ্ঠীর শতাধিক বছরের পরিশ্রমের পর আজ তারা কর্তার আসনে বসেছে। রাষ্ট্র জাত-পাত ব্যতিরেখে নাগরিকদের সম মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। তবে ধর্মীয় কারণে গর্ভপাত ও সমকামীদের ব্যাপারে এখনও অনেক অস্বস্থি রয়ে গেছে। তাদের জাতীয় জীবনে ধর্মের যে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। তবে দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা দেশসমূহে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার টোটকা রপ্তানিতে তারা অদ্বিতীয়!
অতীত ও বর্তমানে অনেক সেকুলার ধারার রাষ্ট্রে ধর্মকে শুধু আলাদা করে রাখার চেষ্টা করেনি তারা ধর্মীয় বিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দিতে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও গ্রহন করেছিল যা এখনও চালু আছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মকে মানুষের মন থেকে মিটিয়ে দিতে মিলিটেন্ট এথিস্ট নামে মিলিশিয়া বাহিনী পর্যন্ত গঠন করা হয়েছিল! ক্রসে চুমো দিলে সিফিলিস হবে এমনতর হাস্যকর প্রোপাগান্ডা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রচার করা হত! আধুনিক রাশিয়ায় সেদিনও কোর্টে ভগবত গিতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে রব উঠেছিল! রেডিকাল এথিজমে বিশ্বাসী উত্তর কোরিয়ায় কেউই আর স্বাধীনভাবে ধর্ম কর্ম করতে পারে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মহীনতাকে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। নাস্তিক মন মানসিকতার চীনা সরকার জিঞ্জিয়ান প্রদেশে লম্বা দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া এমনকি ধর্মীয় পোশাক পড়ায় বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। অফিস-আদালতে উইঘুরদের জোর করে খাইয়ে রোজা ভাঙ্গতে বাধ্য করা হচ্ছে। জাতিগত হানদের সংখ্যালঘু উইঘুরদের উপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। বছর খানেক আগে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর চালানো হয়েছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ!
অন্যদিকে আমরা আফগানিস্থানে তালেবানদের নির্মমতার নিদর্শনও দেখেছি। তারা রাষ্ট্রের প্যারালাল নিজস্ব শাসন ব্যাবস্থা কায়েম করতে সমর্থ হয়েছিল। সমাজে তথাকথিত শৃঙ্খলা আনতে তারা বিনা বিচারে সাজা দেওয়া, পাথর ছুঁড়ে মানব হত্যা, অঙ্গহানির মাধ্যমে (নাক কেটে) সাজা প্রদান করত। তারা নিজেদের ধর্মের প্রকৃত খেদমতগার বলে পরিচয় দিত। ইসলামিক স্টেইটস ইন ইরাক নামে যে সংগঠনের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের পিছনে কে রয়েছে? তারা শুধু ভিন্নমত পোষণ বা বিপক্ষ দলের হয়ে কাজ করার জন্য শত শত মানুষকে বিনা বিচারে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে চলেছে! মসজিদ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, আলেমদের পবিত্র মাজারকে অপবিত্র করে চলেছে! আসলে তারা কাদের সহযোগিতা করছে? কাদের কাজকে সহজ করে চলেছে, তারা আসলে কি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে? এমন কুলাঙ্গারদের কারা যুগভর পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে? আর কেনই বা করছে?
‘[১]। http://tinyurl.com/qgdvpfq
[২] http://religions.pewforum.org/comparisons#
[দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য]
সুনামগঞ্জ, আগস্ট ১০, ২০১৪