ঈশ্বর যদি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় যে আমি এক কাপড়ের পুতুল এবং আমাকে সে দান করে একটু জীবন, তাহলে যা ভাবছি তার সবটুকু হয়তো বলব না, তবে যা বলব-সেসব নিয়ে নিশ্চয় ভাবব।
যার যে মূল্য প্রাপ্য, তাকে সে মূল্য দেবো তার গুরুত্বের জন্য।
ঘুমাবো অল্প, স্বপ্ন দেখব বেশি, কারণ প্রতি মিনিটে চোখ বন্ধ করা মানে ৬০ সেকেন্ড আলো থেকে বঞ্চিত হওয়া। হাঁটব, যখন সবাই দাঁড়িয়ে পড়বেন। জেগে উঠব, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকবেন। শুনব, যখন সবাই বলেন। উপভোগ করব ঠান্ডা চকলেট আইসক্রিম।
ঈশ্বর যদি আমাকে এক টুকরো জীবন দান করে, তাহলে একেবারে সাধারণ কাপড়চোপড় পরব, উবু হয়ে শুয়ে থাকব সূর্যালোকে, কেবল শরীরই নয়, আমার আত্মাকেও নেংটো করে দেব।
যদি আমার হৃদয় থাকে,তাহলে বরফের বিরুদ্ধে লিখব আমার যত ঘৃণা; আর অপেক্ষা করব কখন সূর্য আসে। ভ্যান গগের স্বপ্ন নিয়ে নক্ষত্র সম্পর্কে আঁকব বেনেদেত্তির একটি কবিতা। আর সেররাতের একটি গান হবে, চাঁদকে উৎসর্গীকৃত এক সেরেনাতা। কাঁথার আঘাত আর পাপড়ির মাংসল চুম্বন অনুভব করার জন্য গোলাপকে চোখের জলে ভিজিয়ে রাখব।
হে ঈশ্বর যদি আমার এক টুকরো জীবন থাকত, তাহলে মানুষকে যে আমি ভালোবাসি-সে কথা বলতে আমি একদিনের জন্যও ভুলব না। প্রত্যেক নারী-পুরুষকে বোঝাতে চেষ্টা করব যে তারা আমার প্রিয়, তারা যেন ভালোবাসার প্রেমে জীবন যাপন করেন।
বৃদ্ধ হলেই ভালোবাসাকে একপাশে সরিয়ে রাখতে হবে-যারা এ রকম ভাবেন, তাঁরা যে কত ভুল সেটা প্রমাণ করে দেখিয়ে বলতে চাই, প্রেমহীনতাই বৃদ্ধত্ব। শিশুকে দেব ডানা, যাতে সে উড়তে শেখে। আর বৃদ্ধদের শেখাব এই কথা যে বৃদ্ধত্ব নয়, বি্নৃতিই মৃত্যুর কারণ। আপনাদের কাছ থেকে আমি এত কিছু শিখেছি, জেনেছি, সবাই বাস করতে চাই পাহাড়ের চূড়ায়, কিন্তু সত্যিকারের সুখ এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি পথে আরোহনের মধ্যে। সদ্যজাত কোনো শিশু যখন তার ছোট্ট হাতের মুঠোয় প্রথমবারের মতো বাবার আঙুল চেপে ধরে, তখন সে তা চেপে ধরে চিরকালের জন্য।
যা ভাবেন, তা সব সময় করবেন; যা অনুভব করেন, তা বলুন। যদি জানি যে আজই তোমাকে শেষবারের মতো ঘুমিয়ে থাকতে দেখব, তাহলে তোমাকে আমার গভীর আলিঙ্গন দেব আর ঈশ্বরের কাছে তোমার আত্মার সুরক্ষা প্রার্থনা করব। যদি জানতে পারি এটাই হবে তোমাকে দরজা দিয়ে শেষবারের মতো বেরিয়ে যেতে দেখা, তাহলে তোমাকে দেব আলিঙ্গন, চুমু আর আরও কিছু দেওয়ার কথা বলব। যদি জানি যে এটাই হবে তোমাকে শেষবারের মতো শোনা, তাহলে নিশ্চিতভাবে বারবার শোনার জন্য তোমার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ রেকর্ড করে রাখব। যদি জানি যে এগুলোই হচ্ছে তোমাকে দেখার শেষ মুহূর্ত, তাহলে বলব ‘তোমাকে ভালোবাসি’। সব সময়ই থেকে যায় এক আগামীকাল, আর কর্তব্যগুলো সঠিকভাবে পালনের জন্য জীবন আমাদের আরেকটি সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু যদি আমি ভুল করি আর আজকের দিনটিই যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়, তাহলে বলব-তোমাকে এত ভালোবাসি, তোমাকে আমি কোনো দিনই ভুলব না।
তরুণ কিংবা বৃদ্ধ কারোর জন্যই আগামীকালটি নিশ্চিত নয়। হতে পারে আজই তুমি শেষবারের মতো দেখতে পাচ্ছ, যাকে তুমি ভালোবাসো। অতএব, আর অপেক্ষা না করে যা করার তা আজই করে নাও, যেহেতু আগামীকাল কখনো আসবে না। তখন ব্যস্ত থাকার কারণে শেষ আকাঙ্ক্ষাটি বলতে না পারার জন্য এবং একটি হাসি, একটু আলিঙ্গন আর একটি চুমুর জন্য সময় না পাওয়ার জন্য নিশ্চিতভাবেই বিলাপ করবে। যাদের ভালোবাসো তাদের তোমার কাছে রাখো; তাদের কানের কাছে গিয়ে বলো যে তাদের তোমার ভীষণ প্রয়োজন এবং তাদের তুমি ভীষণ ভালোবাসো। সব সময় তাদের সঙ্গে সুব্যবহার কোরো; ‘আমি দুঃখিত’, ‘আমাকে মাফ কোরো’, ‘দয়া করে’, ‘ধন্যবাদ’ এবং ভালোবাসার সব শব্দ বলার জন্য সময় রেখো।
তোমার গোপন ভাবনার জন্য তোমাকে কেউ স্মরণ করবে না। তোমার শক্তি আর জ্ঞ্যান প্রকাশের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। তোমার বন্ধুদের বুঝতে দাও যে তারা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমিকা
মার্কেস, মানে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস [ জন্মঃ ৬ মার্চ ১৯২৮] ৮১ বছর অতিক্রম করছেন। বার্ধক্যের জরাব্যাধি কাউকেই রেহাই দেয় না। মার্কেসই বা এর বাইরে থাকবেন কীভাবে! ইতিমধ্যে লিম্ফাটিক ক্যান্সার দাঁত বসিয়েছে মার্কেসের দেহে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’-এই মধু-কাব্য এড়িয়ে এখনো মার্কেস বেঁচে আছেন। যদিও লেখক হিসেবে সক্রিয় নন আগের মতো।
মার্কেস বহুদিন ধরে আছেন মেক্সিকোতে। মেমোরিজ অন মাই মেলানকলি হোরসের পর তাঁর আর কোনো বই বেরোয়নি। বেরোয়নি পাঠকের প্রত্যাশিত তাঁর আত্ম্নৃতির পরবর্তী খণ্ডও। বোরোবে কিনা তাও নিশ্চিত না।
হঠাৎ করেই সেদিন আমার বউ মারিসোল জানাল মার্কেস পাবলিক লাইফ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন; এ কথা জানিয়ে তিনি বন্ধুদের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেছেন। এই চিঠির কথা আমার জানা ছিল না। বাসা থেকে জরুরি কাজে বেরোব, তখনই আমাকে ও এই সংবাদটা জানাল। বাসায় ফিরে দেখব-এই অপেক্ষাটা আমার কাছে দীর্ঘ মনে হওয়ায় বললাম, ‘চিঠি প্রিন্ট করে নিয়ে নাও, গাড়িতে বসে আমাকে পড়ে শোনাবে।’ আমি গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম আর ও আমাকে চিঠিটি পড়ে শোনাচ্ছিল। চিঠির কিছু কিছু অংশ পড়তে গিয়ে লক্ষ করলাম, অজান্তেই ওর চোখ থেকে পানি ঝরে পড়ছে। গভীর আবেগ আর স্পর্শময় অনুভূতি থেকে উত্থিত বাক্যগুলো আমাদের স্তব্ধ করে রেখেছিল বেশ কিছুক্ষণ। শুধু ‘ধন্যবাদ’ দেওয়া ছাড়া আমি ওকে আর কিছুই বলতে পারিনি।
জানি না, বাংলায় এই চিঠির অনুবাদ করলে কী দাঁড়াবে। তবু, মার্কেস-অনুরাগী বাঙালি পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে চিঠিটির অনুবাদ এখানে হাজির করা হলো।
এই চিঠিটি মার্কেস-সম্পর্কিত একটি স্পেনিশ ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
স্প্যানিশ থেকে অনুবাদঃ রাজু আলাউদ্দিন
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৮