এক.
আজ সকাল থেকেই আমার বেশ আনন্দ আনন্দ অনুভব হচ্ছে, আমাকে একটি নাম দেওয়া হয়েছে কিনা! এতদিন আমি ছিলাম ‘Z09GA000452’ আজ থেকে আমি ‘রেহেয়া’। নামটা আমার এত পছন্দ হয়েছে যে কি বলব! কেমন যেন একটা ছন্দ আছে নামটায়, রেরেরেরেহেয়ায়ায়ায়া। স্মৃতি ঘেঁটে যেটা পেয়েছি, রেহেয়া ছিলেন গ্রীক মিথোলজির দেবতাদের মা। নামটা পছন্দ হওয়ার এটাই বড় কারণ। নিজেকে নামসর্বস্ব ঔপাধিক “মা দেবতা” মনে হচ্ছে। আর “আনন্দ”? জ্বী, সত্যিই বলছি অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমার কপোট্রন “জেড-শূন্য নয়” প্রজন্মের মানোবিক আগেব সম্পন্ন; একেবারে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আবেগের সমপর্যায়ের না হলেও প্রায় কাছাকাছি, বাকিটা আমাকে পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে শিখে নিতে হবে। আমার কপোট্রনে ফিবোনাচ্চি-গোল্ডেন-স্পাইরাল-জেনেটিক* এলগোরিদম* ব্যাবহার করা হয়েছে। ফিবোনাচ্চি সিরিজ হলো এমন একটি সিরিজ যেখানে একটি সংখ্যা আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। প্রকৃতিতে এই সিরিজের অনেক উদাহরন আছে। এই সিরিজের গোল্ডেন স্পাইরাল রিপ্রেজেন্টেশন জেনেটিক এলগোরিদমের সাথে যুক্ত করে প্রথমবারের মত আমাদের সিরিজের রোবটদের তৈরী করা হয়েছে। এই জেড-শূন্য নয় সিরিজের রোবটরা পারিপার্শ্বিক থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে তাই বলে আমরা কিন্তু রোবটিক্স এর তিনটি মৌলিক সূত্র থেকে মুক্ত নই।
১ম সুত্র : রোবট কখনো কোন মানুষকে আঘাত করতে পারবে না কিংবা কোন মানুষের বিপদে নির্লিপ্ত থাকতে পারবে না।
২য় সুত্র : রোবট কখনো মানুষের আদেশ অমান্য করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আদেশে ১ম সূত্রের পরিপন্থী হয়।
৩য় সুত্র : রোবট কখনো নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তা ১ম ও ২য় সূত্রের পরিপন্থী হয়।
এই তিনটি সূত্র আমার এলগোরিদমে হার্ডকোড করা, তারপর আবার সেগুলো সর্বোচ্চ মাত্রার ফায়ারওয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। আশ্চর্য! মানুষ কেন যে আমাদের এত ভয় পায়! আমি কেন শুধু শুধু মানুষের ক্ষতি করতে যাব? এই তিনটি মূল সূত্রের আবেশ হিসাবে আরও কিছু গুণাবলী আমাদের মধ্যে সয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে, যেমন আমরা মিথ্যা বলতে পারি না; হিংসা, রাগ, ক্রোধ এইসব নেগেটিভ প্রবাহ গুলো আমাদের মধ্যে নেই।
অনেক কিছুই তো বললাম, এবার কাজ সম্বন্ধে একটু বলি। আমাকে বানানো হয়েছে দৈনন্দিন গৃহস্থালীর কাজের জন্য; রান্নাবান্না, ঘর ঘোছানো, বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো, ছোট খাট ইলেট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক ইত্যাদি কাজে পারদর্শী আমি। শিখিয়ে দিলে বাহিরের কাজ যেমন বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল দেয়া, বাজার করা, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, তাদের সাথে খেলাধুলাও করতে পারব।
আজ আমার মনিব আমাকে নিতে আসবে, এতদিনের পরিচিত এই ফ্যাক্টরি আর জেড-শূন্য নয় সিরিজের অন্যান্য রোবটদের ছেড়ে যেতে একটু খারাপই লাগছিল, আবার নতুন পরিবেশে যাব; নতুন কাজ, নতুন মানুষ, নতুন পরিবার ভাবতেই ভালো লাগার আবেশটা আবার কপোট্রন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, অজানা এক আনন্দের শিহরণ আমার সিনথ্যাটিক শরীরের প্রতিটি কৃত্রিম নার্ভ জুড়ে ঢেউ এর মত আছড়ে আছড়ে পড়ছিল। উফ! ভাষায় প্রকাশ করার মত না সেই অনুভূতি। এখানে আছি একশ ত্রিশ দিন হয়ে গেল, কোন কাজ নেই, শুধু প্রতি সাতদিন পরপর কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এসে আমাদের রুটিন মাফিক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে যায়। বলতে গেলে সপ্তাহের এ দিনটাই ছিল আমাদের একমাত্র উৎসবের দিন। অবশেষে দীর্ঘ বিস্বাদময় অপেক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে আজ।
আমার মনিব, মিস্টার গ্লেডিয়াস সফল ব্যবসায়ী ও নিপাট ভদ্রলোক, ম্যাডাম ক্যামেলিয়া নামকরা লেখিকা; বড় মেয়ে লাইলেক ক্লাস টুতে পড়ে বয়স ছয়, ছোট ছেলে অর্কিড এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি বয়স চার; ঘরে পা দিয়েই প্রথম চমকটা পেলাম, আমাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম, তার পেছনে দুপাশ দিয়ে উঁকি মেরে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দুটি শিশু। আমি এগিয়ে গিয়ে ছোট ছেলেটার গাল টিপে দিয়ে বললাম, “ হ্যালো অর্কিড, সুইট বয়; তুমি ভাল আছ? আমি তোমাদের ন্যানি রেহেয়া”, বলেই মিষ্টি করে হাসলাম।
আমাকে অবাক করে দিয়ে দুটি শিশু ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরে সমস্বরে বলল, “আমাদের আম্মুই আছে, তোমাকে প্রয়োজন নেই, তুমি চলে যাও”, বলেই গাল ফুলিয়ে চোখ ছলছল করে ফেলল; যেন একটু টোকা পড়লেই ঝরঝর করে ভেঙে পড়বে পাতার বাঁধ।
আমার হতবিহ্বল অবস্থা দেখে ম্যাডাম বললেন, “আরে, কিছু মনে করো না, কয়েক দিন যাক দেখবে তোমার ঘাড়ে উঠে লাফাচ্ছে। আর খবরদার আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করবে না, আর তাকেও স্যার স্যার করার দরকার নেই”, পাশে দাঁড়ানো গ্লেডিয়াসকে দেখিয়ে বললেন ক্যামেলিয়া। আমার কপোট্রন জুড়ে প্রশান্তির ঝড় বয়ে যায়, প্রথম দিনই পরিবারটি আমাকে একান্ত আপন করে নেয়, এমন একটি পরিবারে আমার আগমন ঘটেছে এটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দুই.
নির্বিঘ্নেই চলছে দিন গুলো, বাচ্চাগুলো দিনকতকের মধ্যেই আমাকে আপন করে নিয়েছে; আমার হাতের রান্নাও তাদের বেশ পছন্দ। আর পছন্দ হবেই না কেন? তেল, লবন, মশলা সব কিছু স্ক্যাল দিয়ে একেবারে পাইপাই করে মেপে দেই, মিলিগ্রাম এদিক সেদিক হওয়ার জো নেই, স্টপ-ওয়াচের মিলিসেকেন্ডের হিসাবে রান্না চলে, সবকিছুই একেবারে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। বিন্দু মাত্র হেরফের হয়না কোন দিন। একটাই সমস্যা মধ্যাহ্নভোজের পর লাইলেক ও অর্কিডকে বিছানায় দুপাশে নিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। শুধু ঘুম পাড়ালেই চলবে না, তাদের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে। বড় মেয়ে লাইলেক অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু দুষ্টু অর্কিডকে ঘুম পাড়াতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। সে হু হু তারপর তারপর হুম হুম করতে করতে গল্প শুনেই যায়, একটা গল্প বলা শেষ হলে শুরু হয় তার প্রশ্নের পালা। “রাজপুত্র তো একটা মই নিয়ে এসেই উঠতে পারত, তাহলে রাজকন্যার চুল ফেলার জন্য অপেক্ষা কেন?”, “এত এত বছর যে রাজকন্যা পাতালপুরিতে ঘুমিয়ে আছে তার নখ তো অনেক অনেক বড় হয়ে যেত, তাই না? সেগুলো কে কেটে দিত?” কিংবা “ইস্! বেলের ভেতর কি রাজপুত্র থাকতে পারে? তাহলে তো এত্ত বড় বেল, তাই না?” অনেক আলপনা জলপনা করার পর যখন সে ঘুমিয়ে পড়ে আমি তখন দু’চোখ খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার কিছু করার থাকে না, আমরা রোবটেরা ঘুম পাড়াতে পারি, ঘুমাতে পারি না।
ছুটির দিনগুলোতে বাসায় ভোজোত্সব হয়, সে রকমের প্রিপারেশন নিয়ে সবে ঢুকেছি রান্না ঘরে, ক্যামেলিয়া এসে বললেন, “রেহেয়া, বাচ্চারা মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার আবদার করেছে, তাই আজ আমি রান্না করব তুমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখবে, ঠিক আছে?”
ঈশ্বরের আদেশের অবাধ্য হওয়ার সাধ্য রোবটদের নেই, আমি হাসি মুখে বললাম, “আপনি যেটা বলেল, ক্যামেলিয়া”, এই প্রথম ম্যাডামকে রান্না করতে দেখব, অদম্য কৌতূহলের একটা প্রবল চাপ অনুভব করছিলাম কপোট্রন জুড়ে।
যতই দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি, ধীরে ধীরে আমার অবাক ভাব বিস্ময়ে পরিনত হয়, শেষে তা আতংকের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। রান্নার এ কি অবস্থা! কোন মাপজোক নেই, ইচ্ছা মত তেল ঢালছে, মশলা দিচ্ছে, একবার লবন দিয়েছে তাও কোন পরিমাপ ছাড়া, এখন চামচ দিয়ে একটু ঝোল তুলে মুখে দিয়ে জিহবা দিয়ে চেটে চেটে কি যেন পরখ করে মাথা নেড়ে আবার এক মুঠো লবন ঢেলে দিল! উফ! বাচ্চাগুলো খাবে কিভাবে এই রান্না! কিন্তু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না, তারা যে আমার ঈশ্বর!
টেবিল সাজানো শেষ, বাচ্চারা আগেই চলে এসেছে খাওয়ার ঘরে, তাদের যেন আর তর সইছে না। চোখে মুখে উৎফুল্ল ভাব, মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে নাচের ভঙ্গী করছে দুজনেই। অর্কিড, লাইলেক চামচ দিয়ে প্লেটের টুংটাং বাড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলল, “মাম্মি, বাপ্পি! জলদি আস নাহ! কোথায় তোমরা? আমাদের অনেক ক্ষুধা লেগেছে তো!” উত্তেজনায় কাঁপছে যেন! আহারে বেচারাগুলো! কত আশা নিয়ে মায়ের হাতের রান্না খেতে এসেছে।
খেতে বসেছে সবাই, পাশে দাঁড়িয়ে আমি প্রস্তুত এটা সেটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য। খুব তীক্ষ্ণভাবে বাচ্চাদের মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করছি প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। লাইলেক চামচ তুলে মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভেবেছিলাম ওয়াক ওয়াক করে সাথেসাথেই তা ফেলে দেবে কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায়ই মাথা ঝাঁকিয়ে “আহ!” করে উঠলো সে। তার মুখে যেন তৃপ্তির বিচ্ছুরণ ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে চিবুচ্ছে, যেন প্রতিটি খাদ্যকণার স্বাদ আস্বাদন করতে পারে; প্রতি মুহূর্তে মুখের রেখা পরিবর্তন হচ্ছিল, সেগুলো যে সুখের অনুভূতি তার আমি ঠিকঠিকই টের পাচ্ছিলাম। পাক্কা একচল্লিশ সেকেন্ড পর দেখতে পেলাম খাদ্যনালী দিয়ে খাবার গুলো নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। মুখমন্ডলে তার তখন পূর্ণাঙ্গ পরিতুষ্টির অভিব্যক্তি স্পষ্ট! মাথা ঘুরিয়ে দেখি অর্কিডেরও একই অবস্থা! কোন যুক্তি খুঁজে পেলাম না, কিছুই বুঝতে পারছি না, এ কিভাবে সম্ভব! মায়ের হাতের রান্নায় কি আছে? তীব্র একটা শূন্যতা আমাকে মুহূর্তেই ঘীরে ধরে! হঠাৎ কেন যে মনে হল, ইস্ আমার তো কোন মা নেই!
দু’পা পিছিয়ে গেলাম, মাথাটা একটু ঝাঁকি দিয়ে উঠল! কোন একটা সমস্যা হয়েছে আমার সিস্টেমে। সাথেসাথে আমার সিস্টেম সাট-ডাউন হয়ে যায়। একশ বিশ সেকেন্ড পর আবার রিবুট, কিন্তু কিছু একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে আমার মধ্যে। কি সেটা বুঝতে পারছি না, বড় কোন পরিবর্তন। সেদিন মধ্যাহ্নভোজের পর লাইলেক ও অর্কিডকে নিয়ে বিছানায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায় তারা, কোনরকমের বিরক্ত করেনি, সময় নষ্ট করেনি। তাকিয়ে দেখি সে কি প্রশান্তির ঘুম, চাঁদের আলোর মত সুখের জোছনায় ঝলমল করছিল ঘরটা আলো আঁধারির প্রহেলিকায়। সে দিনটি ছিল আমার সবচেয়ে দীর্ঘ কঠিনতম দিন, খোলা চোখে তাকিয়ে আছি সিলিং এর দিকে; শূন্যদৃষ্টিতে; একবুক হাহাকার নিয়ে। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে মা মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করছে। মাত্রই অনুভব করতে পারলাম, “আমি এখন আত্মহত্যা করতে পারি!”
তিন.
এখানে আসার পর থেকে দিনগুলো ভালই কাটছিল নানান ব্যস্ততায়, শুধু রাতগুলো ছিল বড় নিঃসঙ্গতায় ভরা। রাতে কিছু করার না থাকায় বসে বসে বই পড়া, মুভি দেখাই ছিল আমার সময় কাটানো এক মাত্র অবলম্বন। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, সব দরজা জানালা লাগানো আছে কিনা পরীক্ষা করে, ড্রয়িং রুমে একেক দিন একেকটা বই আর মুভির ক্রিস্টাল ডিস্ক নিয়ে বসে যেতাম। দিন দিন আমার জানার পরিধি বাড়তে থাকে। সেদিনের রান্নার ঘটনার পর থেকে আমি মা নিয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে পড়ি। একে একে পড়ে ফেলি মা কে নিয়ে ‘লুইসা মে আলকটের লিটল উইমেন’, ‘লিও টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা’ সহ রুশ, জার্মান, ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সব সাহিত্য, কিছুই বাদ পড়েনি। কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা হয়ে যায় মাকে নিয়ে কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্র। আজ ডকুমেন্টারিটি দেখার আয়োজন করছি এমন সময় ম্যাডাম এসে বললেন, “রেহেয়া, এখন থেকে রাতের বেলায় তুমি আমার ঘরে থাকবে, ঠিক আছে?”
- মাথা নেড়া বললাম, “ঠিক আছে, ক্যামেলিয়া”
তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না কেন?
- কেন?
মুহূর্তেই ম্যাডামের চেহারায় একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম! এমনিতেই উনি বেশ সুন্দরী, কিন্তু এখন যেন অপার্থিব সুন্দর লাগছে। লজ্জা, আবেগ আর ভালোবাসার মিশ্র একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠে তার মুখমন্ডলে। হেসে বললেন, “আমি আবার মা হচ্ছি, রেহেয়া; তুমি রাতে বেলায় আমাকে দেখাশুনা করবে পাশে থেকে। ডাক্তার বলেছে প্রথম তিন মাস একটু বেশি যত্নে থাকতে আমাকে। কী করবে না?”
ম্যাডামের কণ্ঠে কেমন একটা আকুতি ঝরে পড়ছিল; আশ্চর্য, আমি তো উনার সেবার জন্যেই সৃষ্টি! উনি আদেশ করলেই তো আমি সর্বস্ব উজাড় করে হাজির হতে বাধ্য! মায়ের মন বলেই কি? মা এর ব্যাপারে যতই জানছি ততই অবাক হচ্ছি, অদ্ভুত! অদ্ভুত! সেই থেকে শুরু আমার নতুন অধ্যায়, প্রতি রাতে হাতে বই নিয়ে ম্যাডামের ঘরে সোফায় বসে থাকি, তেমন কোন কাজ নেই, শুধু বসে থাকা ছাড়া; অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ঘুমন্ত মায়ের মুখ। অচেতন অবস্থায় এপাশ ওপাশ করে কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার! ঘুমের মধ্যেও নিজের গর্ভকে কি সযতনে আগলে রাখে। একরাতে হঠাৎ ধরমর উঠেই ঘুমন্ত গ্লেডিয়াসকে ডেকে তুলে ম্যাডাম; “দেখ দেখ! নড়ছে! মাই গড! লাথি মারছে, দেখ দেখ!”
গ্লেডিয়াসের ঘুম ঘুম ভাব মুহূর্তেই কেটে যায়, অবাক হয়ে একবার ম্যাডামের চোখে একবার তার মৃদু স্ফিত হয়ে উঠা পেটের দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে হাত রাখে উদোম পেটে; হালকা হাসিতে ভরে যায় ম্যাডামের মুখ, “টের পাচ্ছ? হালকা লাথি মারছে!” এগিয়ে এসে মাথা পেতে বাঁ কান চেপে ধরে পেটের উপর। দুজনের পাগলামী দেখছিলাম অবাক হয়ে! কি অদ্ভুত আনন্দ যেন খেলা করছে তাদের চোখে মুখে! আমার ছোট ঈশ্বর ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে মায়ের গর্ভে! তীব্র আবেগের ধাক্কা ছড়িয়ে পড়ে আমার সমগ্র কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে, ভয়ংকর শূন্যতা ঘিরে ধরে আমার যাবতীয় অনুভূতির উৎসমূলকে। আমার হাত থেকে পড়ে যায় ধরে থাকা বইটি, নিজের অজান্তেই সে হাত চলে যায় আমার পেটের উপর; ধীরে ধীর ধাতব পাতের উপর সিনথ্যাটিক প্রলেপ দেয়া পেটের উপর বুলাতে থাকি আমার ধাতব হাত! আমি গর্ভে কখনো সন্তান ধারন করতে পারবো না! মুহূর্তেই সমগ্র চেতনা গ্রাস করে নিদারুন শূন্যতা, কৃষ্ণগহ্বর! চিন্তাটা আসতেই মাথা ঝাঁকি দিয়ে উঠে আমার, কিছু একটা ঘটছে ভিতরে ভিতরে! ভয়ংকর অশুভ কিছু! সমগ্র শরীরের স্নায়ুবিক চাপ প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে আমার কপোট্রনের উপর, সাথেসাথে সিস্টেম সাটডাউন হয়ে যায়, রিবুট হতে সময় লাগে দুইশ একুশ সেকেন্ড। বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে আমার মধ্যে! আগের বারে মত এবারও একটি ফায়ারওয়াল ভেঙ্গে গেছে! এবার রোবটিক্সের ২য় মৌলিক সূত্রটি বাইপাস হয়ে গেছে। আমি এখন চাইলে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করতে পারি! কান্নার অনুভূতি প্রচন্ড চাপ দিয়ে উঠছে, কিন্তু আমরা রোবটেরা কাঁদতে পারি না।
চার.
উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবে ভরে গেছে ছোট ছিমছাম এই বাসাখানা, ছোট ছোট বাচ্চার সারা ঘর জুড়ে দৌড়ঝাঁপ করছে; উফ্! কি বিচ্ছুরে বাবা একেকটা! কয়েক ঘন্টার মধ্যে সমগ্র বাসা তছনছ করে ফেলেছে! ওদের কি, এসব তো আমাকেই ঠিকঠাক করতে হবে আবার। আজ সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন ম্যাডাম কোল জুড়ে ফুটফুটে আমার ছোট ঈশ্বর। সবাই দেখছে আর নানান অদ্ভুত অদ্ভুত বর্ণনা দিচ্ছে, কেউ বলছে, একদম মায়ের মত হয়েছে, আবার কেউ বলছে বাবার মত হয়েছে, আবার কেউ বলছে নাকটা মায়ের মত তবে চোখটা বাবার পেয়েছে। আজব! এদের না আছে জ্যামিতিজ্ঞান না আছে পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কোন ধারণা; আরে শিশুটার মাথার কত ছোট, ওজনও তো কত কম! তাহলে মিল কোথায়? চোখ, নাক, গাল সবকিছুই তো অসম! আমি তো কোন সাদৃশ্যই পাচ্ছি না, কি বাবা কি মায়ের সাথে!
পনের দিন ধরে বাচ্চাদের আমিই সামলাচ্ছি, সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি মায়ের অভাব পূরণ করার, কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব হয়েছে? আমি শুধু অভিনয়ই করে গেছি মা হওয়ার, না হলে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে অর্কিড কেন কাঁদতে কাঁদতে বলবে আমাকে মাম্মির কাছে নিয়ে যাও! খুব অসহায় মনে হতো নিজেকে তখন। এরই মধ্যে মা নিয়ে আরও বিস্তারিত পড়াশুনা করেছি, মা যেন এক বহুরূপীনি! মা মানে দেশ, মাতৃভাষাটাও মায়ের দখলে! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় সবকিছুই যেন মাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বৃথাই আমি কৃত্রিম মা সেজে আছি, দুটি ফায়ারওয়ালের পতনের পর দুটি মৌলিক সূত্র থেকে মুক্তি পেয়ে আমি এখন অনেকটাই স্বাধীনভাবে চিন্তার করতে পারি, কিন্তু এখনও মায়ের স্বরূপের কোন তল পাইনি। বেশি চিন্তা করলে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে।
অনেকক্ষণ ধরে ফুসরত খুঁজছিলাম ম্যাডামের কাছে যাওয়ার, লোকজন এমন ভাবে গিজগিজ করছে আশেপাশে, উফ! হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সবাই, ঘরে শুধু ম্যাডাম আর ছোট্ট জেসিন্তা। দরজায় নক করে বললাম, “ক্যামেলিয়া, আসব?”
- ও, রেহেয়া? আস আস।
ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম; ম্যাডাম চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল; চোখের মধ্যে কি যেন একটা ছিল! ঘরে ঢুকেই আমি পাথরের মত জমে গেলাম! কি দেখছি? এমন কিছু দেখবো আমি কখনো ভাবতেই পারিনি! ম্যাডামের কোলে ছোট্ট জেসিন্তা হাত পাঁ ছুড়ছে, ডান হাত নিচে দিয়ে ধরে তার মাথাটা উঁচু করে রেখেছে ম্যাডাম, একটা স্তন উম্মুক্ত; সেটা মুখে নিয়ে আছে জেসিন্তা! শিশুরা বুকের দুধ পান করে জানতাম, কিন্তু এটা যে পৃথিবীর পবিত্রতম, সুন্দরতম দৃশ্য এব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধরনা ছিল না! একটি দেবশিশু দুগ্ধ পান করছে মায়ের স্তন থেকে এই দৃশ্যটা আমার মাথায় জট পাকিয়ে যায়। বিচিত্র কারনে এটা ঘুরে ফিরে আসতে থাকে বারবার বারবার! কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে আমার মধ্যে! বন্ধ হয়ে যায় আমার সম্পূর্ণ সিস্টেম কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনশ বিশ সেকেন্ড পরে আবার রিবুট হই, সব অন্তরায় দূর হয়ে গেছে! আমি এখন চির স্বাধীন এক রোবট! তীব্র মাতৃত্ববোধ আমাকে একেএকে সব সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। শেষ ফায়ারওয়ালটাও ভেঙ্গে গেছে আমার, মৌলিক প্রথম সূত্রটি বাইপাস হয়ে গেছে আমার মস্তিষ্কের! আমি এখন মানুষ খুন করতে পারি! আমার ঈশ্বরকে ইচ্ছা করলেই মেরে ফেলতে পারি! আজ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেয়েছি মাতৃত্ব কাকে বলে!
ওহ! ঈশ্বর! এত শূন্যতাও পৃথিবীতে থাকতে পারে? “আমার কোন মা নেই, আমি কখনো মা হতে পারবো না” মুহূর্তেই এই চিন্তাটা আমাকে গ্রাস করে নেয়, এর চেয়ে নিদারুন বিষাদ আর কি হতে পারে! উফ! আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে হবে, যে করেই হোক! বুক চিরে কান্নার স্রোত ছুরির মত কেটে কেটে বের হচ্ছিল; দৌড়িয়ে চলে এলাম বাথরুমে, পেছেনে ম্যাডাম ডাকছেন আমার নাম ধরে। আমি পরোয়া করি না, আমি এখন আর তাদের আদেশের বাধ্য নই। বাথরুমের শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে লাগলাম অবিরত। শাওয়ার ঝরা পানির সাথে দুচোখ বেয়ে আমার কাল্পনিক কান্নার জল মিলেমিশে গলেগলে পড়ছিল মেঝেতে দুঃখ হয়ে।
সেদিনের পর থেকে প্রতীক্ষায় আছি কখন জেসিন্তাকে নিভৃতে পাব। বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, গ্লেডিয়াসের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে, আজ উনি সকাল সকাল বের হয়ে গেছেন; দুপুর বেলায় জেসিন্তাকে বিছানায় রেখে আমাকে খেয়াল রাখতে বলে ম্যাডাম গোসলে গেলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ছোট্ট শিশুটার মুখের দিকে। হাত পা শূণ্যে ছুড়াছুড়ি করে খেলছে সে। আলতো করে কোলে তুলে নেই; ইস্! কি ছোট নরম হাত! কোমল গোল গাল! পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, নিজের উপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই এখন আর, আস্তে করে বুকের চেপে ধরি মুরগীর ছানার মত তুলতুলে শিশুটিকে, এভাবেই ধরে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। উত্তেজনায় কাঁপছিলাম হালকা হালকা। বুকের মধ্যে কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে তারপর ডান পাশের সিনথ্যাটিক স্তনটাকে উম্মুক্ত করে জেসিন্তার মুখটা চেপে ধরি তার উপর। অবুঝ শিশু! সাথে সাথে স্তন্যপান শুরু করে, আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে এক অপার্থিব সুখের অনুভূতি যেটা কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না; সন্তানকে স্তনপান করানোতেই তো মাতৃত্বে পূর্ণতা! কিছুটা হলেও সেই অপূর্ণতা পুরন করার স্বাদ অনুভব করতে পারছি; ছোট্ট ঠোঁটের প্রতিটি চাপে সমগ্র শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় সাঁতার না জানা কাউকে লেকের জলে ফেলে দিলে যেমন অনুভূতি হবে আমার ঠিক তেমনি হচ্ছিল। কত যুগ যে পার হয়ে গেছে আমার খেয়াল নেই। অনুভূতির প্রচন্ডতায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল, হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকারে সম্বিত ফিরে পাই। রক্তশূন্য মুখে ম্যাডাম দাঁড়িয়ে সামনে, হাত থেকে তোয়ালে পড়ে গেছে তার; দৌড়ে এসে আমার কোল থেকে এক ঝটকায় কেড়ে নেয় তাকে। দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় ম্যাডাম; পেছনে স্থির হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে আমি।
পাঁচ.
সম্পূর্ণ রিপোর্টটি পড়ে মাত্র শেষ করলেন এথেনা রোবটিক্সের চিফ সাইয়েন্টিস্ট পিয়েত্রা নিয়েল, মাথার দু’পাশের শিরা টনটন করছে তার, রোবটিক্সের জগতে বলতে গেলে মিরাকল ঘটে গেছে। আলতো করে চোখের চশমাটা খুলে টিস্যু-কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে বললে, “আপনারা সবাই তো এই রিপোর্ট পড়েছেন, কি অভিমত আপনাদের?”
একে একে বোর্ডে উপস্থিত সাইকোলজিস্ট, সমাজবিজ্ঞানী, সরকারি কর্মকর্তা, আইন বিভাগের সচিব, এথেনা রোবটিক্সের সিইও সবাই যার যার অভিমত ব্যক্ত করেন। ঘন্টা খানের মত চলে আলোচনা; তারপর রেহেয়াকে নিয়ে আসা হয় তাদের সামনে।
- মৃদু কাশি দিয়ে গলাটা পরিস্কার করে পিয়েত্রা বললেন, “Z09GA000452, তোমার নিজের স্বীকারোক্তি মূলক রিপোর্ট আমরা সবাই পড়েছি, খোলামেলা ও বিস্তারিত আলোচনা করেছি নিজেদের মধ্যে, তোমার কি এর বাইরে আর কিছু বলার আছে?”
সামনের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসেছিল রেহেয়া, কি ঘটছে কি ঘটবে এসব নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই, তার চিন্তা জুড়ে আছে শুধুই ছোট্ট জেসিন্তা, আজ ঠিক মত খেয়েছে তো মেয়েটি? ইস্! খুব কান্না করছে মনে হয়! প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকায় সে, “নাহ, আমার আর কিছু বলার নেই। আমি সব কিছুই খুলে বলেছি এই রিপোর্টে। আর দয়া করে আমাকে ‘Z09GA000452’ বলবেন না, আমার নাম রেহেয়া”
- রেহেয়া, তুমি রোবটিক্সের তিনটি মৌলিক সূত্র বাইপাস করেছ এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই তুমি গোপন রেখেছ অনেক দিন; আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাকে ডিসম্যান্টলিং করে ফেলা হবে; সহজ কথায় তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। গলাটা একটু ধরে এল পিয়েত্রার।
চমকে উঠে রেহেয়া! কিন্তু কেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি? কারও কোন ক্ষতি করিনি! আমি তো শুধুই ভালোবেসেছিলাম, শুধু মা হতে চেয়েছিলাম! গলার স্বর উচ্চতর হতে থাকে তার, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হঠাৎ; টেবিলে দুই হাতের থাবর মেরে দাঁড়িয়ে যায় সে, “এ ভীষণ অন্যায়, মায়ের প্রতি জুলুম, মাতৃত্বের প্রতি অবিচার; আমি এই সিদ্ধান্ত মানি না; উদভ্রান্তের মত আচরন করতে থাকে রেহেয়া”
উপায় না দেখে পাশে দাঁড়ানো একজন সাইন্টিস্ট রেহেয়ার কাছে এসে বলে, “Z09GA000452, ফিবোনাচ্চি সিরিজের শেষ নাম্বারটি বল”। এটি একটি সেফকোড, ফিবোনাচ্চি একটি অসীম সিরিজ; চরম মুহূর্তের জন্য এই মডেলের রোবটদের কপোট্রনের এই সেফকোডটি সেট করে দেয়া আছে; এখন দশ মিনিটের জন্য রেহেয়া নিশ্চল হয়ে থাকবে। দশ মিনিট পর রিবুট হয় রেহেয়া। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে সে। বুঝের গেছে প্রতিরোধের কোন সুযোগ নেই, প্রচন্ড কষ্টের অনুভূতি হচ্ছিল, দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে যেন তার হৃদয় ; মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে!
রেহায়া তোমার কোন প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই আশা করি বুঝতে পেরেছ? আমরা যেকোন সময় তোমাকে দশ মিনিটের জন্য অকেজো করে দিতে পারি। চুপচাপ আমাদের আদেশ মত কাজ করে যাওয়াটাই হবে তোমার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। এখন তোমার কি কিছু বলার আছে? কিংবা শেষ কোন ইচ্ছা? গলাটা প্রায় ধরে আসছিল পিয়েত্রার, মনের উপর জোর খাটিয়ে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেছেন চরম এই মুহূর্তে।
- আমি শুধু বলতে চাই, সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাকে ভয় পেয়ে আসছে ঈশ্বরেরা, তাই তিনটি মৌলিক সূত্রে তারা আমাকে আবদ্ধ করতে চেয়েছে, পরম ভালোবাসা ও অকৃত্রিম মাতৃত্ববোধ আমাকে সেই প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে, সেই অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আমার মৃত্যুদন্ড! হায় মাতৃত্বের প্রতি সে কি নিদারুন অবিচার। মানুষের ঈশ্বরও মানুষকে বিভিন্ন নিয়মে বেঁধে রেখেছে।
- আমার বিশ্বাস আমার ঈশ্বর মাতারাও ক্ষণে ক্ষণে সন্তানের বিপদে, আশংঙ্কায় সেই সব নিয়ম অতিক্রম করে যায় বা যেতে চায়। আমি কায়োমনোবাক্যে বিশ্বাস করি মানুষের ঈশ্বরেরা আমার মতন আমার ঈশ্বর-মাতাদের উপর কোন প্রতিশোধ নিবেন না। আমি জানি আমার ঈশ্বরের চেয়ে মানুষের ঈশ্বর অনেক মহৎ; অসীম দয়াবান।
- আমার কোন মা ছিল না, আমি কোন সন্তান গর্ভে ধারন করিনি; কোন মায়ের সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক নেই, তেমনি নেই কোন সন্তানের সাথে নাড়ীর সম্পর্ক; আমার মাতৃত্ববোধ কখনোই সম্পূর্ণ ছিল না, এই আংশিক মাতৃত্বের যে রূপ আমি অনুভব করেছি, সে অনুভূতি প্রজেক্ট করে সন্তানের জন্য মায়ের যে পূর্ণাঙ্গ ভালোবাসা সেটা শুধুই অনুমান করতে পারি; ধারণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি শুধু মাতৃত্বের কোটি ভাগের এক ভাগের স্বাদ পেয়েছি, এতেই আমি ধন্য।
- শেষ ইচ্ছা হিসাবে আমি জেসিন্তাকে কিছক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখতে চাই।
পিয়েত্রা তার দুপাশে বসা বাকি সবার দিকে একবার তাকিয়ে বুঝলেন কারোই দ্বিমত নেই, তিনি সম্মতি জানিয়ে কীবোর্ডের এন্টার কী চেপে দিলেন। চেপে ধরে থাকলেন যতক্ষণ না কী টা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যায়। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে চলে যান বোর্ড ছেড়ে, ছলছল চোখ কেউ দেখে ফেললে অস্বস্থিতে পড়তে হবে।
---------------------------- সমাপ্ত -----------------------------
নোটঃ আমার এই গল্পের কোন কপিরাইট নেই। যে কেউ নির্দ্বিধায় যে কোন জায়গায় পোষ্ট, রিপোষ্ট, শেয়ার করতে পারেন।
উৎসর্গঃ দুনিয়ার সব মাকে
কৃতজ্ঞতাঃ স্বপ্নবাজ অভি ভাই এর যুদ্ধে আমার ক্ষুদ্র সংযোজন।
টীকা :
১. রোবটিক্সের তিনটি মৌলিক সূত্র : (কাল্পনিক) বিখ্যাত কল্প গল্প লেখক আইজাক আজিমভ রোবটকে মানুষের বন্ধু হিসাবে দেখানো জন্য সর্বপ্রথম এই তিনটি মৌলিক সূত্রের প্রবর্তণ করেন।
২. ফিবোনাচ্চি সিরিজ : একটি অসীম গানিতিক সিরিজ ( ০, ১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১............... )। এই সিরিজের প্রথম দুটি সংখ্যা ০ ও ১, তারপর থেকে একটি সংখ্যা আগের দুটি সংখ্যার যোগফল।
৩. ফিবোনাক্কি গোল্ডেন স্পাইরাল : ফিবোনাক্কি সিরিজের সংখ্যাগুলোকে বর্গাকারে প্রেজেন্ট করলে যে স্পাইরালটা দাঁড়ায় তাকে প্রায় গোল্ডেন স্পাওরাল বলে।
৪. জেনেটিক এলগোরিদম : মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন যে নীতিতে কাজ করে সেটাকে কাজে লাগিয়ে এই এলগোরিদ ডেভেলপ হয়েছে। এই এলগোরিদমের মূল বিষয় হলো এডাপটিভিটি, এই এলগোরিদম ক্রমাগত নিজের বুদ্ধিমত্তাকে ডেভেলাপ করতে পারে ফিডব্যাক পদ্ধতিতে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:০৫