১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
৬ষ্ঠ পর্ব
মসজিদে নববী শুধুমাত্র একটি মসজিদ ছিল না। এটি ছিল প্রথম ইসলামি রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থল। এটি যেমন ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তেমনি এটি ছিল একটি সম্মিলন কেন্দ্র অথবা কারো কারো আশ্রয়খানা। মদীনা রাষ্ট্রের সমস্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এখান হতেই নেয়া হত। এই মসজিদ ইতিহাসের স্বাক্ষী। এই মসজিদ যেমন বিজয়ের আনন্দ দেখছে, তেমনি এই মসজিদে অনেক বিয়োগান্ত ঘটনাও ঘটেছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য মসজিদে নববী’র পুরনো অংশের প্রতিটি পিলার, জানালা এবং গম্বুজে অনেক গোপন চিহ্ন আজও বিদ্যমান। এই চিহ্নগুলোর ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। এর রোমাঞ্চকর ইতিহাস কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় এইসব গোপন তথ্য এবং চিহ্ন সর্বসাধারণের কাছে গোপনই রাখা আছে।
তবে মনে রাখতে হবে- মসজিদে নববী’র কোন অংশ স্পর্শ করে, কাপড় দিয়ে মুছে কিংবা চুম্বন করে বরকত গ্রহণ করা জায়েয নয়; সেটা মসজিদের পিলার, দেয়াল, দরজা, মেহরাব কিংবা মিম্বর যাই হোক না কেন।
পুরনো মসজিদের ম্যাপ
রিয়াদুল জান্নাহ’র বাউন্ডারির বাহির হতে খুব সহজেই পুরাতন মিহরাব ও মিম্বর চোখে পড়ে। মিহরাব হচ্ছে মসজিদের সম্মুখভাগে বাড়তি একটি অংশ, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম নামাজ পড়ান। সাদা, কালো টাইলসের মিহরাবের এই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ (সাঃ) নামাজের নেতৃত্ব দিতেন। কিন্তু নবী (সাঃ) বা চার খলিফার আমলে এ ধরণের মিহরাব ছিল না। ৯১ হিজরির দিকে উমাইয়া শাসক খলিফা ওমর বিন আব্দুল আযীয প্রথম নবী (সাঃ) এর নামাযে দাঁড়ানোর স্থানটিতে মিহরাবের আদলে একটি কাঠামো তৈরি করেন। পরবর্তীতে তা ‘মিহরাব নবী’ হিসাবে পরিচিতি পায়।
পুরাতন মিহরাব
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মিহরাবের পেছনের দেয়ালটা অনেক মোটা। এটা ইচ্ছে করে করা হয়েছে। মূলতঃ দেয়লের মোটা অংশটুকোতেই মোহাম্মদ (সাঃ) এর সিজদার স্থান ছিল। মোটা দেয়ালের মাধ্যমে সিজদার স্থানটি ঢেকে দেয়া হয়েছে। এখন যদি কেউ মিহরাবের ভেতরের অর্ধচন্দ্রাকৃতি অংশে সিজদা দেয়, তবে সেই জায়গাটি হবে মোহাম্মদ (সাঃ) এর দাঁড়ানোর স্থান।
রিয়াদুল জান্নাহ’র আশেপাশের প্রতিটি খুটি বা পিলারের একেকটি ইতিহাস রয়েছে। এই স্তম্ভগুলো একসময় খেজুর গাছ ছিল, পরবর্তীতে ওসমানি সুলতান আবদুল মাজিদ পাকা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। বর্তমানে প্রতিটি খুটি আলাদাভাবে আরবিতে চিহ্নিত আছে। খুটিগুলোর উপরের দিকে সবুজ চিহ্ন খুটিগুলোর ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়।
মিহরাবের পেছনের ডানদিকের কোনায় যে পিলারটি আছে তা “উস্তুওয়ানা হান্নানা” বা ক্রন্দন স্তম্ভ নামে পরিচিত। এই জায়গাটিতে একটি খেজুড় গাছ ছিল। মোহাম্মদ (সাঃ) খুতবা দেবার সময় মাঝেমাঝে গাছটিতে হেলান দিতেন। আনসারি সাহাবীরা নবী (সাঃ) কে বলল, ‘যদি অনুমতি দেন, আপনার জন্য একটি মিম্বর তৈরি করে দিতে পারি।’ মিম্বর হচ্ছে খুতবা দেয়ার স্থান। নবী (সাঃ) অনুমতি দিলে একটি মিম্বর তৈরি করা হলো। যখন তিঁনি নতুন মিম্বরটি ব্যবহার করা শুরু করলেন তখন খেজুড় গাছটি কাঁদা শুরু করে যেমনটা একটা দশ মাসের গর্ভবতী উটনি কাঁদে। মোহাম্মদ (সাঃ) গাছটিকে জড়িয়ে ধরেন যতক্ষননা এটি শান্ত হয়। পরে একটি গর্ত করে গাছটিকে সমাহিত করা হয়।
উস্তুওয়ানা হান্নানা
মিম্বর
মিম্বরটি বিভিন্ন সময়ে অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। রিয়াদুল জান্নায় সংরক্ষিত মিম্বরটি সুলতান মুরাদ ৯৯৮ হিজরিতে স্থাপন করেন।
উস্তুওয়ানা হান্নানা’র পাশে নামাজ আদায়ের আগে মোহাম্মদ (সাঃ) উস্তুওয়ানা আয়েশা’য় (আয়েশা স্তম্ভ) নামাজ আদায় করতেন।
মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে এমন একটি জায়গা রয়েছে, লোকজন যদি সেখানে নামাজ পড়ার ফজিলত জানত, তাহলে সেখানে স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত।’ স্থানটি চিহ্নিত করার জন্য সাহাবারা চেষ্টা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর আয়েশা (রাঃ) তাঁর ভাগ্নে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ)কে সে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। হাদিসটি আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণীত ও সঠিক স্থানটি তাঁর জানা থাকার কারনে স্তম্ভটিকে ‘আয়েশা স্তম্ভ’ বলা হয়। স্তম্ভটিকে ‘উস্তুওয়ানা মুহাজিরিন’ নামেও ডাকা হয় কারন এর পাশে মক্কা হতে হিজরতকারীরা বসত।
উস্তুওয়ানা আয়েশা
মিহরাব হতে কোনাকোনি একপাশে আযান প্লাটফর্ম অবস্থিত।
আয়েশা স্তম্ভের বাম পাশের স্তম্ভটি ‘উস্তুওয়ানা তওবা’ এবং ‘উস্তুওয়ানা আবু লুবাবা’ নামে পরিচিত।
একটি ভুল করার পর অনুশোচনায় আবু লুবাবা (রাঃ) নিজেকে এই জায়গার একটি খেজুর গাছের সাথে বেঁধে বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ আমার তওবা কবুল করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজেকে বাঁধন হতে খুলব না। এবং মোহাম্মদ (সাঃ) কে আমার বাঁধন খুলতে হবে।’ এটা শুনে নবী (সাঃ) বলেছিলেন, ‘সে যদি আমার কাছে আসত, তাহলে তার হয়ে আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতাম। কিন্তু এখন তওবা কবুল না হওয়া পর্যন্ত আমি তার বাঁধন খুলতে পারিনা।’ এভাবে দীর্ঘদিন পর আবু লুবাবা (রাঃ) এর তওবা কবুল হলে মোহাম্মদ (সাঃ) নিজ হাতে তাঁর বাঁধন খুলে দেন।
উস্তুওয়ানা তওবা
রিয়াদুল জান্নাতের পূর্ব পাশে অর্থাৎ মোহাম্মদ (সাঃ) এর কবরস্থানের পশ্চিম দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি স্তম্ভ রয়েছে। এদের প্রথমটিকে ‘উস্তুওয়ানা সারির’ বা ‘ঘুমানোর জায়গা স্তম্ভ’ নামে পরিচিত। এই জায়গাটিতে মোহাম্মদ (সাঃ) ইতিকাফে বসতেন এবং ইতিকাফে থাকাকালীন ঘুমাতেন।
উস্তুওয়ানা সারির এর চিহ্ন
পাশাপাশি ৩টি স্তম্ভ
মাঝের স্তম্ভটিকে ‘উস্তুওয়ানা হারস’ বা ‘প্রতিরক্ষা স্তম্ভ’ বলা হয়। এটি ‘উস্তুওয়ানা আলী’ বা ‘আলী’র স্তম্ভ’ নামেও পরিচিত। এখানে বসে কিছু সাহাবা যাদের মাঝে আলী (রাঃ) অধিকাংশ সময়ই থাকতেন, মসজিদে নববী পাহাড়া দিতেন। মহানবী (সাঃ) প্রায় সময় এখান দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। কিন্তু যখন সূরা মায়েদার ৬৭ নাম্বার আয়াত নাযিল হলো তখন মহানবী (সাঃ) সাহাবাদের আর পাহাড়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেন। কেননা আল্লাহ নিজেই মোহাম্মদ (সাঃ) কে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
“...আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।” (সূরা মায়েদা, ৫ঃ৬৭)
দেয়ালের ৩য় স্তম্ভটিকে “‘উস্তুওয়ানা উফুদ” বা “প্রতিনিধিদের স্তম্ভ” বলা হয়। যখন কোন গোত্র হতে কোন প্রতিনিধিদল মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎএ আসত তখন তাদেরকে এখানে বসানো হত। মহানবী (সাঃ) এখানে তাদের সাথে কথা বলতেন এবং তাদেরকে ইসলাম শিক্ষা দিতেন।
আমি খুব চকিত দৃষ্টিতে স্তম্ভগুলো খুঁজে নেই। আশেপাশে এত ভীড় যে এক জায়গায় বেশীক্ষণ দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আগে হতেই আমার কাছে একটা ম্যাপ থাকায় আমি জানতাম স্তম্ভগুলো কোথায় হবে। ছবি তুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ২/৩টি ছবি ছাড়া ধাক্কাধাক্কির কারনে ভালো ছবি তুলতে পারলাম না। তবে ইন্টারনেটে খুঁজতেই অনেক ছবি পেলাম। অনেকেই ইংরেজিতে স্তম্ভগুলোর ইতিহাস লিখেছেন, কিন্তু হয়তোবা বাংলায় এই প্রথম একসাথে সবগুলো স্তম্ভের ইতিহাস সংকলিত করছি।
আমি সবাইকে নিয়ে রিয়াদুল জান্নাহ’র পাশ দিয়ে নবী (সাঃ) এর কবরের প্যাসেজের দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু ভীড়ের কারনে এপাশটা বন্ধ রেখেছে। এখন মসজিদ হতে বের হয়ে ‘আসসালাম গেট’ দিয়ে আবার ঢুকতে হবে।
আসসালাম গেট
আসসালাম গেটের প্যাসেজ দিয়ে যখন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম- আমি শিহরিত হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি ১৪০০ বছর আগের সেই মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে আছি।
(চলবে)