১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
বহুবার মক্কা গিয়েও ‘মক্কা মিউজিয়ামে’ ঢুকা হয়নি। ভেবেছিলাম এবার অন্তত মিউজিয়ামটিতে যাওয়া হবে। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ জাদুঘরে ইতিহাসপ্রেমীদের কিছুটা সময় না কাটানো অন্যায়। কিন্তু এবারও হতাশ হতে হলো। জাদুঘরে গিয়ে দেখি তা বন্ধ।
হতাশ মনে মিনায় যাবার পথে আমরা “জাবাল সওর” দেখতে গেলাম। মক্কায় এটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হিজরতের সময় মোহাম্মদ (সাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) এই পাহাড়ের একটি গুহায় ৩ দিন ও রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখানেই আবু বকর (রাঃ) মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিরাপত্তার জন্য সাপের গর্তের মুখে নিজের পা চেপে ধরেছিলেন এবং সাপের দংশনেও অস্থির হননি বরং শত্রুর পদধ্বনি শুনে অস্থির হয়েছিলেন।
তখন মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন,
কোরআনের ভাষায়- ‘তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গেই আছেন...।’ –সূরা তওবা: ৪০
গুগুল ম্যাপ দেখে জাবাল সওরের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আশেপাশেই কোথাও রাস্তাটি আছে, কিন্তু হদিস পাচ্ছি না। আবু সাঈদ ভাই একজনকে রাস্তার কথা জিজ্ঞাসা করলে সে রাস্তা দেখিয়ে দিল। আমারা একটি অপ্রশস্থ, গলিমত রাস্তায় পৌছলে বুঝতে পারলাম, ঠিক জায়গাটিতে চলে এসেছি। গলিটিতে ট্যাক্সি আর পাকিস্তানিদের আনাগোনা। এ দুটি যেখানে আছে, সেখানে কিছু একটা থাকবেই। ইতিহাসের এ ধরনের স্থানগুলো কোন ঈবাদতের জায়গা নয়, শুধুমাত্র ইতিহাসের স্বাক্ষী হবার জন্য আমরা এখানে এসেছি। কিন্তু পাকিস্থানিরা বেশীরভাগ সময়েই এসব স্থানে বিদা’ত আর শিরকে লিপ্ত হয়। তারা এসব জায়গায় নামাজ পরে, চুমু খায়, মাটি তুলে নিয়ে যায়। সারা সৌদি জুড়েই পাকিস্তানিদের আমি এসব করতে দেখেছি।
জাবালে সওর
আমরা জাবালে সওরের পাদদেশে গাড়ী পার্ক করি। প্রচন্ড গরম। পাহাড়ে চড়ার পায়ে চলা পথ ধরে অনেকেই উপরে উঠছে। তাদের বেশীরভাগই পাকিস্তানি। আমার কোন ইচ্ছেই নাই উপরে উঠে গুহাটি দেখার। হাতে সময়ও নেই। আজই মদীনা রওনা হতে হবে। এর মাঝে ফিরোজ ভাই ৫ রিয়াল দিয়ে ছোট ছাতা নিয়ে এসেছেন যা মাথায় আটকে রাখা যায়। খুবই আরামদায়ক। আমিও একটি ছাতা কিনলাম। আমাদের দেখে বাকীরাও ছাতা কিনে নিল। সেই ছাতা মাথায় দিয়ে আমরা সবাই পাহাড়ের কিছু অংশ উঠে ফটোসেশন করে ফিরে আসি। আমাদের গন্তব্য এখন-মিনা।
মিনায় যেখানে শয়তানকে পাথর ছোড়া হয় তার কাছাকাছি একটি পুরনো মসজিদ আছে যা মসজিদুল বিয়া বা মসজিদুল উকাবা নামে পরিচিত। এটাই সেই জায়গা যেখানে ১২ জন আনসার মদীনা হতে এসে মোহাম্মদ (সাঃ) নিকট আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিলেন।
দূর হতে ছোট মসজিদটি দেখতে পেলাম। জায়গাটি বেস্টনী দিয়ে ঘেরাও দেয়া। এক জায়গায় রাস্তা পাওয়া গেল। ছাদখোলা মসজিদটির পুরনো দেয়ালগুলো ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার ধারণা বর্তমান দেয়াল অটোমান আমলের। মসজিদটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সেখানে কিছুটা সময় থেকে আমরা আরাফা’র ময়দানের দিকে এগিয়ে চলি।
মসজিদুল বিয়া
আরাফা’র ময়দানে যাবার পথে একটি মসজিদে চোখ আটকে গেল। এটাইতো সেই মসজিদুল খায়ফ। এই মসজিদটা আমাদের লিস্টে ছিল, কিন্তু খুঁজে পেতে দেরী হবে বলে দেখার আশা বাদ দিয়েছিলাম।
মসজিদুল খায়ফ
খায়ফ অর্থ “পাহাড়ের পাদদেশ”। সাফাইহ/সাবিহ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মসজিদের এই স্থানটিতে মোহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর পূর্বে আরো অনেক নবী (৭০ জন) নামাজ আদায় করে ছিলেন। হজ্জের সময় ছাড়া এই মসজিদ বন্ধ থাকে।
আমার খুব ইচ্ছা ছিল মিনা ও মুজদালিফার মাঝখানে ওয়াদি মুহাসসার খুঁজে বের করার। ওয়াদি মুহাসসারে আব্রাহা ও তার হস্তিবাহিনীর উপর পাখির ঝাক পাথর বর্ষণ করেছিল। আমার আগের একটি লেখায় কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকা আব্রাহা’র ইয়েমেন হতে মক্কার হস্তি রোডটি ভ্রমণের বিস্তারিত তুলে ধরেছিলাম। আমার আশা ছিল ওয়াদি মুহাসসার দেখার মধ্যমে এর শেষ অংশটুকোর স্বাক্ষীও হয়ে থাকব। কিন্তু ম্যাপ খুঁজে বা অন্যকোনভাবেই এর হদীস খুঁজে বের করতে পারিনি। হয়তো বর্তমানে জায়গাটি চিহ্নিত করে রাখাও হয়নি।
মিনার হাজার হাজার তাবুর মাঝখান দিয়ে আবু সাঈদ ভাই গাড়ী চালিয়ে নিচ্ছেন। তাবুগুলো হজ্জের সময় ব্যবহৃত হয়। এখন শূন্য, যতদূর চোখ যায় নিস্তব্ধতা। আমরা এখন জাবাল আরাফার (জাবাল রহমা নামে বেশী পরিচিত) দিকে যাচ্ছি। রাস্তার দু’ধারে নিম গাছের সারি। কতিথ আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিছু নিম গাছ সৌদি সরকারকে উপহার দিয়েছিলেন। আরাফা’র ময়দানের যেদিকেই চোখ যায় নিম গাছে পরিপূর্ণ। জাবাল রহমাকে ঘিরে একটি রিং রোড করা হয়েছে। অন্যকোথাও ভীড় না দেখা গেলেও পাহাড়টিকে ঘিরে মানুষের আনাগোনা, বিভিন্ন জিনিসের বেচাকেনা। প্রচন্ড গরম লাগছিল, সওর পাহাড় হতে কেনা ছাতাগুলো এখন কাজে লাগল। আমরা সবাই মিলে কাপ আইসক্রিম কিনলাম। এই দাবদাহে আইসক্রিমের চেয়ে তৃপ্তিদায়ক আর কিছু নাই।
ছবিঃ ইন্টারনেট
হজ্জের দ্বি্তীয় দিন ৯ জিলহজ্জ হাজীদেরকে আরফার সীমানার মধ্যে অবস্থান করতে হয়। এটি হজ্জের একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ। জনশ্রুতি আছে, আদম ও হাওয়া বেহেশত হতে পৃথিবীতে নিপতিত হবার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং পরবর্তীতে এই জাবাল রহমা বা রহমতের পাহাড়ে তাদের সাক্ষাৎ ঘটে।
জাবাল আরাফা/রহমা
আমি আগেও এখানে এসেছিলাম, কিন্তু পাহাড়ে চড়িনি। সবাই মিলে পাহাড়টিতে উঠলাম। সিঁড়ি করে দেয়া আছে, পাহাড়টি খুব বেশী উঁচু নয়। সিঁড়ির বিভিন্ন স্থানে আতর, তসবি বিক্রি হচ্ছে। কয়েকজনকে দেখলাম ইন্সট্যান্ট ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার জন্য ঘুরঘুর করছে। পাহাড়ের উপরে, একপাশে সমতল জায়গার মাঝখানে কংক্রিটের একটি পিলার। পিলারটি দেখতে অবলিস্কের মতো। কিন্তু এটি নিছকই একটি পাহাড় চিহ্নিতকরণ পিলার। ঠিক কবে পিলারটি দিয়ে পাহাড়টি চিহ্নিত করা হয়েছিল আজ আর তার ইতিহাস পাওয়া যায় না। ঠিক এমন করেই শয়তানকে উদ্দেশ্য করে পাথর মারার ৩টি স্থান পিলার দিয়ে চিহ্নিত করা ছিল। প্রাচীনকালে বিস্তীর্ণ বালুময়, রুক্ষ, কখনোবা পাথুড়ে খোলা প্রান্তরে সঠিক স্থানটি খুঁজে পেতে এধরণের পিলারের বিকল্প ছিল না।
পিলারটির গায়ে বিভিন্ন ভাষায় সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে, এখানে এসে হাজীরা কি কি ভুল করে। এই পিলারের বিশেষ কোন মহাত্ম নেই, এর পাশে নামাজ পড়েও আলাদা কোন পূন্যও নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা- পিলারটি ঘষে কাল বানিয়ে ফেলা হয়েছে, তার পাশে লাইন ধরে নামাজ পড়ছে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এদের বেশীরভাগই আমাদের উপমহাদেশীয়, বিশেষ করে পাকিস্তানিরা।
উপর হতে নীচের বিস্তীর্ণ নিম বাগান দেখতে পেলাম। অদূরেই নিমরাহ মসজিদ, সেখানে নামাজ পড়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হব।
ওয়াদি উরানাতে অবস্থিত নিমরাহ মসজিদ হজ্জের সময় ছাড়া বন্ধ থাকে। এখান হতেই হজ্জের খুতবা দেয়া হয়। মূল মসজিদটি আরাফার সীমানার বাহিরে অবস্থিত। পরবর্তীতে আরাফার দিকে বর্ধিত করা হয়। তাই হজ্জের সময় মসজিদের সামনের দিকে অবস্থান করলে হজ্জ হবে না।
ওয়াদি উরানা হতেই মোহাম্মদ (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণ দেন। এখানেই ইসলাম ধর্মকে আল্লাহ পূর্নাঙ্গ করার ওহী নাযিল করেন।
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (আল কোরআন ৫ঃ৩)
নিমরাহ মসজিদ
মসজিদের একটি বারান্দায় কার্পেট ফেলে রাখা আছে। আমরা সেখানে নামাজ আদায় করলাম। কিছুক্ষন শুয়ে বিশ্রাম করে বিকাল ৪টার দিকে মদীনার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।
“জাবাল সওর” হতে যে এক্সোডাসের সূচনা, তার শেষটা হয়েছিল মদীনায়। আমরা মরুর পথ ধরে মদীনার দিকে যাচ্ছি। মদীনার আবহাওয়া ও শান্ত পরিবেশ সবসময়ই আমাকে দারূণভাবে টানে। তখনো জানতামনা আমাদের এই ভ্রমণে ইতিহাসের প্রসিদ্ধ এক্সোডাসটিও হানা দিয়ে যাবে।
(চলবে)