এক আয়েশি শনিবারে আমি, মনির ভাই ও শাহরিয়ার ভাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। লাঞ্চটা মাত্রই শেষ করেছি। মনির ভাই কতকটা রান্না করেছেন, কিছু খাবার ভাবী দেশ হতে পাঠিয়েছেন। লাঞ্চ শেষে জিজানের আম খেতে খেতে হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে সাইফুল্লাহ ভাইয়ের শেয়ার করা একটি ভিডিও দেখে নড়েচড়ে বসি।
সাইফুল্লাহ ভাই আল সুদা হতে কোন একটি দুর্গম জায়গায় গিয়েছেন, পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিছুটা পানি দেখাও যাচ্ছে। কিন্তু উনি সামনে এগিয়ে যাননি, ফিরে এসেছেন। আমি বাসায় ফিরেই গুগুল ম্যাপ তন্নতন্ন করে খোঁজলাম। আবহা’র পাশেই পাহাড় দিয়ে ঘেরা পাশাপাশি ৩টি লেক দেখা যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার জন্য কাঁচা রাস্তা পেলাম। ইউটিউবে কয়েকটি ভিডিও আছে, অনেক সৌদি সেখানে গিয়েছে, পাহাড় বেয়ে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে মোহনীয় লেক ও ঝর্ণার দেখা মেলে। এই স্থানটি নিয়ে বেশীরভাগ লেখা ও ভিডিও আরবিতে থাকার কারনে আমরা আগে জানতে পারিনি। আরবিতে জায়গাটিকে “বুহাইরাতুল মাহতাত্ববাহ” বলে। সাইফুল্লাহ ভাইয়ের কারনে হঠাৎ নজরে এল, এখন কি বসে থাকা যায়?
হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে পোস্ট দিলাম-শীঘ্রই ঝর্ণা অভিযানে বের হচ্ছি। অনেকেই যেতে আগ্রহী হল। এর মাঝে আবু সাঈদ ভাই আল সুদায় একটি কাজে গিয়ে সাইফুল্লাহ ভাই যতদূর গিয়েছিলেন ততটা পথ দেখে আসলেন। আবু সাঈদ ভাই আমার মতোই ঘোরাঘুরি করতে চান। ওনাকে সাথে নিয়েই ‘আবরাহা’র হাতীর রাস্তাটি’ দেখতে গিয়েছিলাম।
এক শনিবার বিকালে আসরের পর আমরা কয়েকজন একসাথে হই। ৪টি গাড়ীতে আমরা এগিয়ে চলছি- আমি, আবু সাঈদ ভাই, আজমল ভাই, আবুল হাসান ভাই, ফিরোজ ভাই, হানিফ ভাই, সানাউল্লাহ ভাই, নাবিল ভাই ও কলকাতার এক ভাই। মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরেই লেক ও ঝর্ণা’র অবস্থান। কিন্তু সরাসরি রাস্তা না থাকায় আল সুদা দিয়ে কিছুটা ঘুরে সেখানে যেতে হবে। আবু সাঈদ ভাই যেহেতু আগে কিছুটা পথ এসেছেন, তাই আমরা সবাই তাকে অনুসরণ করলাম। আবু সাঈদ ভাই এপথ সেপথ ঘুরেন, কিন্তু রাস্তা ভুলে গেছেন। এভাবে আমাদের কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। কিছুটা রিস্ক নিয়ে আমি গুগুল ম্যাপের সাহায্যে পথ দেখালাম, একসময় কাঁচা রাস্তায় পৌছেও গেলাম। অনেক গাড়ী এসেছে, সবাই পায়ে হাটা পথ ধরে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে।
দু’পাশে পাহাড়, মাঝখানে ওয়াদি। পানির শব্দ পাচ্ছি। কিছুটা এগোতেই কুলকুল করে বয়ে যাওয়া পানি দেখতে পেলাম যেন পাহাড়ী কোন নদী। আশপাশটা ঘন শন গাছে ভর্তি। কিন্তু এটাতো মাত্র শুরু, সামনে যা আছে তার তুলনায় এই মোহনীয় সৌন্দর্য্য কিছুই না।
ওপাশে যেতে হলে পাহাড় বেয়ে যেতে হবে। অনেক সৌদি ফিরে আসছিল। তাদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চললাম। সানাউল্লাহ ভাইকে আমরা সবাই ‘জিহাদী’ ভাই বলে ডাকি। উনি যেকোন কথাবার্তা ও বর্ক্তৃতা জিহাদী জোশে দিয়ে থাকেন। কিন্তু আজ ওনার আচরণ জিহাদী তকমা’র সাথে গেল না। উনি সবার পেছনে থাকেন, পা যেন চলেই না। আমরা দুর্গম পথে সামনে এগিয়ে গেল সেই পথে উনি হাটেন, রিস্ক নিতে চান না। সবাই মিলে আমরা তার এক হাত নিলাম।
পাহাড়ের গায়ের খাঁজে খাঁজে পথ। কোথাও মাত্র আধাফুট চওড়া। সে পথ দিয়ে কিছুটা যেতেই একটি ঝর্ণার দেখা পেলাম। ঝর্ণার উপর দিয়ে ওপাশের পাহাড়ে উঠতে হবে। কিন্তু আমাদেরকে আটকায় কে? চার হাতেপায়ে পাথরে ঝুলে ঝুলে পাহাড়ে উঠেই বিষ্ময়াভূত হয়ে গেলাম। নীচে গোলাকৃতি একটি লেক দেখা যাচ্ছে, চারপাশে পাহাড়, একপাশের ফাটল দিয়ে খরস্রোতা পানি ঝর্ণা তৈরি করেছে। আমরা কিছুটা সময় সেখানে অবস্থান করলাম, এতদূর এসে হাপিয়ে গেছি। সৌদিরা অনেকেই সাতার কাটছিল। কেউ কেউ পাহাড়ে অলস বসে আছে।
আমি ভেবেছিলাম এখানেই আমাদের আজকের অভিযান শেষ হবে। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রাত নামার আগেই ফিরতে হবে। কিন্তু আবু সাঈদ, আজমল, আবুল হাসান, ফিরোজ ও কলকাতার ভাইটি ঝর্ণার উৎসমুখটি দেখতে চান। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে আমিও তাদের সঙ্গী হলাম, হাত ছুটলেই সোজা নীচের লেকে পড়তে হবে। বলাবাহুল্য আমি সাতার জানিনা।
জিহাদী ভাই আমাদের চোখের আড়ালে আছেন, যদি আমাদের সাথে যেতে হয়। একটু একটু করে ঝর্ণার কাছটায় পৌছলাম। ওপাশের ওয়াদি হতে পানি আসছিল। সবাই ভেতরে এগিয়ে গেছে। আমি ও আজমল ভাইও এগিয়ে চললাম। এই ওয়াদি’র কি কোন শেষ আছে? এক জায়গায় আমাকে থামতেই হলো, আজমল ভাইকে পাঠালাম বাকীদের ডেকে আনার জন্য। এখনি ফেরার পথ ধরতে হবে। গাড়ীর কাছে যখন ফিরে আসলাম তখন মাগরিবের আযান দিচ্ছে। জিহাদী ভাই, হানিফ ও নাবিল ভাই আমাদের ফেলে রেখেই চলে গেছে।
সবাই ঠিক করলাম একদিন খুব ভোরে আবারো আসব, ওয়াদির ভেতর দিয়ে শেষমাথা পর্যন্ত হেটে যাব।
আরবের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের প্রেমে মজে গিয়েছি।