সামুদ জাতির আল উলা শহর ঘুরে আসার পর আমার ভ্রমণ লিস্টের এক নম্বরে ছিল “ওয়াদি লাজাব” ভ্রমণ। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য দেখে অনেকেই সেখানে যেতে চেয়েছিল। “ওয়াদি লাজাব” আমাদের আবহা থেকে মাত্র ২০০ কিমি দূরে জিজান প্রভিন্সে অবস্থিত। কিন্তু জায়গাটি না চেনার কারনে ও দূর্গম বিধায় সেখানে যাওয়া হয়ে উঠেনি।
এর মাঝেই আযম ভাই জানালেন জিজান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফারুক ভাই প্রায়ই একটি লেকে মাছ ধরতে যান। মাছগুলো বেশ বড় এবং সুস্বাদু। একদম বাংলাদেশের মাছের স্বাদ। এই সুযোগ কে ছাড়ে? আযম ভাইও ভ্রমণপিপাসু মানুষ। ফারুক ভাইয়ের মাধমে বেশ কিছু ছিপ/বড়শি জোগাড় করে ফেললেন।
ফারুক ভাইয়ের মাছের খুব নেশা। লেকটি খুঁজে বের করেছেন, বড় বড় মাছ ধরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এখন এমন হয়েছে যে, জিজান ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা দল বেধে সেখানে মাছ ধরতে যায়।
৩০ শে জানুয়ারি আমরা আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা করি। ঠিক করা হল- আমাদের আবহা বাহিনী জিজান বাহিনীর সাথে “হাগু” নামক স্থানে মিলিত হবে (“হাগু” নামটি নিয়ে ব্যাপক হাস্যরস তৈরি হয়েছে)। সেখানেই লেকটি অবস্থিত। তারপর মাছ ধরে আমরা ওয়াদি লাজাব যাব।
কিন্তু বিভিন্ন কারনেই আমাদের পরিকল্পনায় ব্যঘাত ঘটে। পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা যার যার মতো ওয়াদি লাজাব সরাসরি চলে যাব, ফেরার পথে হাগু’তে মাছ ধরব। দুটো রাস্তার কোনাটাই আমরা চিনিনা, জিপিএস ফলো করে আবহা হতে আযম ভাই ও তার ফ্যামিলি, সাইফুল্লাহ ভাই ও তার ফ্যামিলি, ইসরাফিল ভাই, আবুল হাসান ভাই ও আমি রওনা হলাম। আমাদের ৩টি গাড়ী এগিয়ে চলল।
জিপিএস দেখে আমরা একটি শর্টকাট রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। তারপরও সকাল ৮ টায় রওনা দিয়ে আবহা থেকে “হাগু” পৌছতে পৌছতে ঘন্টা খানেকের বেশী লেগে গেল। তবে রাস্তা ছিল দারূণ রকমের ভালো। দুপাশে সবুজ আর মরুর সমন্বয়। এখানে সেখানে নালাগুলোতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। মাঝে মাঝে বণ্য গাধার পাল রাস্তার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাদের চোখে কোন ভয় দেখিনি। পথে এক জায়গায় থেমে গাধার পালের ছবি তুললাম। আযম ভাইয়ের ছোট মেয়ে ঈমান বলছিল- "আমরা সবাই গাধা।" ছোট মেয়েটির এই দার্শনিক বোধ আমরা কেউই খন্ডাতে চেষ্টা করিনি।
অনেক ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। সকালে কেউই নাস্তা করে বের হইনি। “হাগু” ছাড়িয়ে আরো অনেকটা দূরে রাস্তার পাশে একটা পার্ক পেলাম। আমরা সবাই সেখানে নাস্তা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পার্কটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ওখান হতে নীচে তাকাতেই নয়ন ও মন উভয়ই জুড়িয়ে গেল। পাহাড় ঘেরা একটি লেক-যেন আঁকা একটি ছবি। কয়েকটি উট আপন মনে হেটে বেড়াচ্ছিল। আযম ভাই জানালেন এটি সেই বিখ্যাত “ওয়াদি বেইশ”।
আরবিতে পাহাড়ের পাদদেশের নীচু ভূমি যেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হয় কিন্তু অন্যান্য সময় শুকনো থাকে তাকে “ওয়াদি” বলে। “ওয়াদি বেইশ” এর এই অংশটিতে বাঁধ দেয়ার কারনে তা লেক ধারণ করেছে। সৌদি আরবের অন্যতম বৃহৎ একটি লেক। এর বাঁধটি উচ্চতায় সৌদি আরবে সবচেয়ে বড়। “ওয়াদি বেইশ” এর পানির একটি ফ্লো “ওয়াদি লাজাবের” সাথে কানেক্টেড।
আমরা নাস্তা সেরে লেকের কাছে গাড়ী নিয়ে যাই। অনেক বিশাল একটি লেক। গভীর ও টলটলে কালো জল। লেকে জিজান ইউনিভার্সিটির দুইজন বাংলাদেশি শিক্ষককে মাছ ধরতে দেখলাম। ওনারা কথা প্রসঙ্গে জানালেন- ফারুক ভাই এখানেই মাছ ধরে থাকেন। আমরা তখন কনফিউজড। আমাদেরতো “হাগুতে” মাছ ধরার কথা ছিল। ফারুক ভাইকে ফোন করলে বিষয়টি খোলাসা হল-আমরা “ওয়াদি বেইশ” এর লেকেই মাছ ধরব। ফারুক ভাই পাশের সিটি “হাগু’র” নাম বলেছেন বোঝার সুবিধার্থে। ঘটনাচক্রে আমরা মাছ ধরার স্থানটিতেই পৌছে গেছি।
সাইফুল্লাহ ভাই জানালেন উনি এখন আর “ওয়াদি লাজাব” যাবেন না। এখানেই মাছ ধরে কাটাবেন। ইসরাফিল ভাই ও আবুল হাসান ভাই তাতে জোড় গলায় সায় দিলেন। ইসরাফিল ভাইয়ের মাছ ধরার খুব নেশা। কোথাও মাছ ধরার কথা শুনলেই সবার আগে উৎসাহ নিয়ে তাতে যোগ দিবেন। সারা রাত ধরে জাল বানাবেন। কিন্তু কোন কারনে তার জালে বা বড়শিতে মাছ আর ধরা দেয় না। তারপরও তিনি উৎসাহ হারান না, পরের প্রোগ্রামের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। মাছ ধরা এক অদ্ভুত নেশার নাম।
জিজানের দলটি ততক্ষণে “ওয়াদি লাজাব” পৌছে গেছে। আমি ও আযম ভাইয়ের ফ্যামিলি বাকী সবাইকে এখানে রেখেই “ওয়াদি লাজাব” এর পথে রওনা দেই। আযম ভাই ড্রাইভ করছিলেন। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলা সর্পিল রাস্তাটি বিভিন্ন জায়গায় অনেক সরু হয়ে যাচ্ছিল। এক জায়গায় রাস্তাটি এত খাড়া ছিল যে গাড়ী বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমরা “ওয়াদি লাজাব” এর একটি সাইন বোর্ড দেখতে পাই।
পিচ ঢালা রাস্তা থেকে একটি মাটির রাস্তা বের হয়ে গেছে। আর মাটির রাস্তাটি হঠাৎ করেই যেন পাহাড়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ছোট পাথর আর নুড়ি বেছানো অপ্রসস্থ রাস্তার দুই পাশে ওয়াদি লাজবের উঁচু দেয়াল- গিরিখাতটিকে বলা হয় গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অব এ্যারাবিয়া।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১০