গত ৭ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সহ ৭৩ সদস্যের বিশাল বহর নিয়ে কুয়েত গিয়েছিলেন। ১০ তারিখে ওনারা ফিরে এসেছেন। তারপর দুই দিন অতিবাহিত হলেও কুয়েত সফরের বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। কোন সরকারী প্রেস রিলিজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। আসল তথ্য হচ্ছে, উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধিদলের সফরের পরও কুয়েতের শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার ব্যাপারে আশ্রপ্রদ কোনো খবর পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুয়েতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে লোক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কুয়েতের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ধরনের আশ্বাস বা আশার বাণী শুনানো হয় নি। এমনকি বাংলাদেশ এবং কুয়েতের মধ্যে যে চারটি স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানেও বন্ধ শ্রমবাজার খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কিছু নেই।
বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার কুয়েত। দেশটিতে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশী আছেন। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে তিন বছর ধরে বাংলাদেশী জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ আছে। বাজারটি চালু করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কুয়েত সফর পরিস্থিতি বদলে দেবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল আশা করেছিলো।
সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আগে বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ কুয়েতে যেতেন, আর ২০০৯ সালে গেছেন মাত্র ১০ জন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবেও শ্রমশক্তি রপ্তানির পরিস্থিতি ভালো নয়। এক বছর ধরে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় বন্ধ আছে। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর বাজারটি ফের চালু হবে এমন আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২০০৯ সালে ১৪ হাজার ৬৬৬ জন কর্মী দেশটিতে গেছেন। একই সময়ে ফিরেছেন ২৭ হাজার ৩০৪ জন। একই অবস্থা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও। ২০০৯ সালে দেশটিতে গেছেন ১২ হাজার ৪০২ জন। ফিরেছেন ১৬ হাজার ৮৭৭ জন। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশের প্রবাসী ৭০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৩৫ লাখই থাকেন এই তিন দেশে। কাজেই এই তিন দেশের বাজার চালু করতে না পারলে জনশক্তি খাতে দুরবস্থা নেমে আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের ঠিক প্রাক্কালে ঢাকার শীর্ষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো কুয়েতের শ্রমবাজার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদেনে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, ‘ তিনটি দেশ বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। রোববার তিনি কুয়েত সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।’ তিনি বলেন, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কুয়েত পুনর্গঠনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিষয়গুলো তাঁদের ভোলার কথা নয়। কাজেই এই সফরের পর বাজারটি চালু হবে বলে আশা করা যায়।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফাকে উদ্ধৃত করে দৈনিক প্রথম আলো ওই প্রতিবেদেনে লিখেছে, ‘কুয়েতের মতো একটি শ্রমবাজারে ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক গেছে। এই তথ্য মন খারাপ করে দেয়।’ তিনি বলেন, কুয়েত, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার চালু করতে না পারলে শ্রমশক্তি রপ্তানির ভবিষ্যত্ অন্ধকার। তিনি আশা করেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর কুয়েতের বাজার আবার চালু হবে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে ৬৪৩ জন কর্মী কুয়েতে গিয়েছিলেন। এরপর প্রতিবছরই এই সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়ে যায়। ওই বছর ২৮ হাজার ৫৭৪ জন কর্মী কুয়েতে যান। পরের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৪ হাজার ৩৭৭। এরপর প্রতিবছরই গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার কর্মী কুয়েতে গেছেন। কিন্তু ২০০৬ সালের অক্টোবরে কুয়েত সরকার বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
বিএমইটির হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সালে কুয়েতে গেছেন মাত্র চার হাজার ২১২ জন লোক। অথচ আগের বছরেও সেটি ছিল ৩৫ হাজার ৭৭৫ জন। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩১৯ জন। আর ২০০৯ এ মাত্র ১০ জন। কামরুল হোসেন বাবলু নামে কুয়েতের এক বাংলাদেশী সাংবাদিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘এখনো কুয়েতের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে। এখনো বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তিন বছর ধরে বাজারটি বন্ধ থাকার পরও সরকারিভাবে সেটি চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
জনশক্তি রপ্তানী ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা বাড়ানো, এবং বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু, ঢাকায় ফ্লাইওভার সহ বেশ কয়েকটি যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে কুয়েতের আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছিলো। সেগুলোও পাওয়া যায় নি। অথচ বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের ২১টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে কুয়েতের সরকারি সাহায্য সংস্থা ‘কুয়েত ফান্ড ফর অ্যারাব ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট’। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই যোগাযোগ অবকাঠামো ও জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতের। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু, সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়ক ও চট্টগ্রামের শিকলবাহায় ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্য পাঁচটি প্রকল্পের কাজ চলছে।
সোজা ভাষায় খালি হাতেই কুয়েত হতে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভারত সফর হতে উনি যে ঘোড়ার ডিম নিয়ে এসেছিলেন তা ছিলো মঈন ইউ আহমেদের ঘোড়া আনার ধারাবাহিকতা। তারপরও সেই ঘোড়ার ডিম আনার সাফল্যেই রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ অভিনন্দন উৎসব হয়েছে। হায় মঈন ইউ, আপনি কেন কুয়েত গেলেন না। তাহলেই তো আমরা আরেকটি সফল সমাবেশ দেখতাম।
____________________________________________
ফুটনোট: ভারত সফরে অর্জিত ঘোড়ার ডিমটি জনগন দেখে ফেলায় আলোচনার মোড় পরিবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী “জিয়ার কবরে লাশ নেই” বিতর্কের সুত্রপাত করেছিলেন। এবার কি করবেন আল্লহ মালুম!!
উৎসঃ প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী তিন দিনের সফরে কুয়েত গেছেন , প্রধানমন্ত্রী কাল কুয়েত যাচ্ছেন: পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা ও জনশক্তি রপ্তানি মূল আলোচ্য এবং কুয়েতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ সাড়ে তিন বছর