একটি অতিক্ষুদ্র ভাইরাস কোভিড-১৯ অথবা করোনা রোগ। এই মুহূর্তে এটি পৃথিবীর একমাত্র মূর্তিমান আতংকের নাম। গত কয়েক মাস যাবত পুরো বিশ্বজুড়ে এর তাণ্ডব চলছে। করোনা আক্রান্তদের ডাটাবেজ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা http://www.worldometer.com এর মতে সমগ্র পৃথিবীর মধ্য অদ্যাবধি (২৮.০৬.২০২০ইং পর্যন্ত) প্রায় ১ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এবং ৫ লক্ষ জন মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। তাইতো বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়াতে করোনা রোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চলছে। বর্তমানে করোনা রোগের প্রভাবে পুরো বিশ্বের স্বাভাবিক কাজকর্ম অনেকটাই থমকে আছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জীবাণু বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে কোভিড-১৯ অত্যন্ত শক্তিশালী ভাইরাস। কেউ কেউ বলছেন, এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা এতোটাই ব্যাপক যে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি করা এখনও সুদূরপরাহত।
পাশ্চাত্য গবেষকরা গবেষণা করে এটা বের করেছেন যে কোভিড-১৯ ক্ষণে ক্ষণে নিজের চরিত্র বদলায়। এবং জনমনে একটি ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বিধ্বংসী চরিত্রের দিক থেকে কোভিড-১৯ অতুলনীয়। হয়তো কেউ একে সৃষ্টি করেছে অথবা ও নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছে। কি কারণে সৃষ্টি হয়েছে বা এর উদ্দেশ্য কি? এটা এখন আর পুরাপুরি অজ্ঞাত নয়? সৃষ্টির বিনাশ সাধন ওর মূল লক্ষ্য। তাই তো দেখি আবির্ভাবের পর থেকেই ওর ধ্বংসযজ্ঞ বিরামহীন গতিতে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে চলছেই। এবং ওর আক্রমণের তীব্রতা ক্ষণে ক্ষণে ভৌগোলিক সীমানা পাল্টাচ্ছে।
এই ভাইরাস কে থামানোর জন্য কোন প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ নেওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না। যা নেওয়া হচ্ছে তা আপা-ততঃ পদক্ষেপ। যেমন: পারস্পারিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে সরে থাকা, মাস্ক পরিধান করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং আরও কিছু বিষয় ইত্যাদি। কিন্তু এখানে দুশ্চিন্তার বিষয় এই, যেহেতু কে আক্রান্ত অথবা কে আক্রান্ত নন এটা পুরোপুরি ভাবে চিহ্নিত করা এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্ভব নয়। তাই এই আপা-ততঃ পদক্ষেপ আপেক্ষিক ভাবে কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এই আপাতত পদক্ষেপ সমান ভাবে কার্যকর হতে পারে না। কারণ- উদাহরণ দিচ্ছি:
১। অনেক বিদগ্ধ জনেরা বলে থাকেন যে পারস্পরিক সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখা এবং নিয়ম-নীতি মেনে চলার মতো শিষ্টাচার ইত্যাদি গুণাবলি/বৈশিষ্ট্য আমরা এখনও অর্জন করতে পারি নাই।
২। খাওয়ার আগে অথবা ওযু করার সময় মসজিদে এবং টয়লেট থেকে ফেরার পরে আমাদের সমাজের এক বিরাট অংশ সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতে অভ্যস্ত নন।
৩। আমি বা আমরা যে অঞ্চলের বাসিন্দা সেখানে, আমাদের সামাজিক প্রথা অন্য রকম বিশ্বাস দ্বারা আক্রান্ত। এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা ঘোষণা করেই দিয়েছি “উনি রাখলে মারবে কে? অতএব সকল রকম চেষ্টা করা বৃথা”।
৪। আমার মতো অনেকেই আপা-ততঃ পদক্ষেপ মেনে চলেছি তবুও আমি বা আমরা এই আপা-ততঃ পদক্ষেপ এর অকার্যকারিতার শিকার হয়েছি (বিস্তৃতভাবে এই প্রবন্ধের শেষের ভাগে বর্ণনা করেছি)।
অতএব বলতে চাচ্ছি যে, আপাতত পদক্ষেপ উন্নত সভ্য দেশের জন্য যতটুকু কার্যকর আমাদের মতো দেশের জন্য ততখানি নয়। আমাদের দেশের জন্য প্রত্যক্ষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ ঔষধ আবিষ্কার করতে হবে। এবং এ জন্য আমাদের অঞ্চলের বিশেষজ্ঞদের এখনই মাঠে নামতে হবে। মৌলিক গবেষণা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করতে হবে। তবে কেউ কেউ বলেন যে বাংলাদেশের গবেষণা কার্যক্রমের শতকরা হারের বেশিরভাগ অংশ শুধুমাত্র ফাইলিং ওয়ার্কের মধ্য সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সফলতা ধরা দেয় না ও আগ্রহ জন্মায় না। বিজ্ঞজনেরা বলেন যে গবেষণা কাজকে উপভোগ করতে হবে। তবেই মৌলিক গবেষণা কার্যক্রমে আমাদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
এই উপভোগ শব্দের আগে আমি একটি বিশেষণ ব্যবহার করতে যাচ্ছি। চরম ভাবে উপভোগ। অর্থাৎ উপভোগ করার জন্য আমার মনঃপ্রাণ সবকিছু উজাড় করে দিব। যাতে সফলতা ধরা দেয়ই। দুটি উদাহরণ দিচ্ছি: আপনি, আপনার প্রিয় একটি খাবার খাচ্ছেন। যেমন: একটি চকোলেট আইসক্রিম। বাহ: কি! মজা! বড়ই ধীরেলয়ে, চেটে-পুঁটে, উপভোগ করে খাচ্ছেন। নাহ! ব্যাপারটি এ রকম উপভোগ নয়। তাহলে কি রকম? ভাবুন! আপনি একজন দৌড়বিদ। টার্ফে দৌড়চ্ছেন। সামনেই মাইলফলক। শেষ রাউন্ডে এসে গেছেন। কিন্তু শরীর আর কুলচ্ছে না। দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এবারই শেষ পদক্ষেপ। মাটিতে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছেন। কিন্তু না। এক অদৃশ্য ফুঁৎকার আপনাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে। কি সেই টনিক। হ্যাঁ সামনেই সেই মাইলফলক। ওটা আপনাকে স্পর্শ করতেই হবে। জগত জোড়া খ্যাতি আপনাকে অর্জন করতেই হবে। এবার আপনি পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন। নতুন শক্তিতে দৌড়াতে শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই মাইলফলক স্পর্শ করলেন। বাঃ দারুণ লাগছে। সবাই আপনার দিকে চেয়ে আছে। কোন ক্লান্তিই আপনাকে স্পর্শ করছে না। বরং একধরনের ভালোলাগা তীব্রভাবে উপভোগ করছেন। আমি একেই বলছি চরমভাবে উপভোগ। অর্থাৎ গবেষণা কাজকে এভাবেই গ্রহণ করতে হবে। তবেই আপনি সফল হবেন।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসছি। প্রত্যক্ষ কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য এই নভেল কোভিড-১৯ ভাইরাস সম্পর্কে কিছু তথ্য বিশ্বাস করা জরুরী। তথ্যসমূহ মৌলিক। এতে গবেষণা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। কি সেই তথ্যসমূহ? ধাপে ধাপে বলছিঃ
১। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে সমস্ত তথ্য পৌঁছেছে তাতে অনেকের মাঝে একটি ধারনা বদ্ধমূল হয়েছে যে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ক্ষমতা অসীম। করোনা গায়েবী। এবং মানুষের দ্বারা এর ঔষধ তৈরি করা সম্ভব হবে না।
এর বিপরীতে আমার যুক্তি, একমাত্র মহান আল্লাহ/সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউই অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। অতএব করোনাতো নয়ই।
২। একটি আক্রান্ত এলাকায় করোনা একই সাথে সবাইকে আক্রমণ করে না। অর্থাৎ কোন এলাকার ১০০ভাগ লোক করোনায় আক্রান্ত হন না। যদিও এটা ছোঁয়াচে রোগ তবুও না। এমনকি একই সাথে গাদা-গাদি করে থাকলেও সবাই আক্রান্ত হন না। অতএব বলা যায় যে মানুষকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ করোনা ভাইরাসেরে শক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
৩। একজন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলেন। স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হবেন। অথবা কোন রকম জটিলতা থাকলে উনি মারা যাবেন। আমার লক্ষ্য সুস্থ ব্যক্তি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পরে উক্ত ব্যক্তির দেহে করোনা ভাইরাস কার্যকর থাকেনা অর্থাৎ করোনা অপসারিত হয়। এবং উক্ত ব্যক্তি সুস্থ হবেন। যেহেতু উক্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠলেন অতএব ওনার দেহে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যার কারণে করোনা নেগেটিভ হয়েছে অথবা বলতে পারি সময়ের পরিক্রমায় করোনা ভাইরাস তার কার্যকরীটা হারায় এবং দুর্বল হতে হতে পৃথিবী হতে বিদায় নিতে বাধ্য হবে। এটাই করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।
৪। এখন পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যমতে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের হার কম এবং বেশী (সূত্র-www.worldometer.com, তারিখ: ২৮.০৬.২০২০)। অথচ দেশ সমূহ পাশাপাশি অবস্থিত। কিন্তু ছোঁয়াচে রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু অণুকুল পরিবেশ দরকার। এটা দেখে আশ্চর্য হই, যে দেশে অণুকুল পরিবেশ বেশি সেদেশে সংক্রমণ এখন পর্যন্ত কম। কেন এরকম হচ্ছে? এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের দুর্বলতা বের করা গেলে এ ভাইরাস দমনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আশাবাদী হওয়া যাবে?
সম্মানিত গবেষকগণ উপরোক্ত বিষয় সমূহ বিশ্বাস আকারে ধারণ করে গবেষণা করলে ফল আসবেই। দরকার ধৈর্য।
আমি যেদিন করোনায় আক্রান্ত হলাম।
আনুষ্ঠানিক লক-ডাউন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই আমি কঠোরভাবে সামাজিক দুরত্ব মেনে চলেছি। শহরের প্রধান কাঁচা বাজারের সাথে লাগোয়া আমার যে মুদি মালের দোকান ছিল তা বন্ধ করে দিয়েছি। নিয়ম-কানুন মেনে বাড়ীতে আবদ্ধ জীবন পালন করেছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র শহরের উক্ত বাজার থেকে নির্দেশনা মেনে সংগ্রহ করেছি। তখন বাজারে লক-ডাউনের আনুষ্ঠানিক কার্যকারিতা দেখা যেত।
গত কিছু দিন যাবত লক-ডাউন কার্যক্রমের শিথিলতার কথা শোনা যাচ্ছিল। এদিকে আমার পকেটের অবস্থা প্রায় ফাকা হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম এই সময় আমিও বাজারে গিয়ে আমার দোকানটা খুলি, কিছু বেচা-কেনা করি। তাই দোকান খোলার জন্য এবং আমার নিজের পরিবারের কিছু দরকারি জিনিষ ক্রয়ের জন্য উক্ত বাজারে গমন করি। বাজারে গিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। বাজারে একদম স্বাভাবিক সময়ের মত মানুষজনের ভিড়। ছোট একটু জায়গায় হাজারো মানুষ কিলবিল করছে। বেশির ভাগ জনতা সিস্টেম মানছেন না। রুটি রুজির দরকারে সবাই রাস্তায় বেরিয়ে পরেছেন। সবাই সবাইকে ধাক্কা ধাক্কি করে নিজের প্রয়োজনীয় কাজটি সমাধা করছেন। বাজার করছেন, পণ্য বিক্রি করছেন। বেশিরভাগ লোকের মাঝে নিয়ম মানার কোন লক্ষণ দেখতে পেলাম না। বেশিরভাগ মানুষের সাথে কোন রকম সুরক্ষা/প্রতিরোধক ব্যবস্থা নাই। মনে হচ্ছে কোন ধরণের লক-ডাউন কার্যক্রম নাই। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম! এই হাজারো জনতাকে বোকা আর নেশাগ্রস্ত মনে হল। আর নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করলাম। অতএব বাজার না করে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। কিন্তু মনে পড়ে গেল শূন্য পকেটের কথা। পকেটে থাকা বউয়ের দেয়া দরকারি পণ্যর লিস্টের কথা। বাজারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি। কিভাবে দোকান খুলব, কোথা থেকে বাজার করব? সবখানেই তো একই অবস্থা। বাজার না করলে খাব কি? দোকান না খুললে বেচব কি? পণ্য বিক্রি না করলে অর্থ আসবে কিভাবে। বাঁচব কি খেয়ে। অতএব পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিলাম আগে তো বাচতে হবে। তারপরে না হয় করোনাকে মোকাবেলা করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। হাজারো জনতার সাথে নিজেকেও মিশিয়ে দিলাম। দোকান খুললাম। মুদি-মাল বিক্রি করতে লাগলাম এবং শেষে পণ্য বিক্রির টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনে বাজার থেকে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে ভাবতে লাগলাম আমি বিগত ৬০ দিন যাবত নিজেকে সামাজিক দুরত্বের মধ্য আবদ্ধ রেখেছি। নিরাপদে ছিলাম। কিন্তু আজকে বাজারে যে পরিস্থিতির মুখামুখি হলাম, তাতে আর নিজেকে নিরাপদ বোধ হচ্ছিল না। এবং কাঁকতলিয় ভাবে হলেও তাই।
অবশেষে আমি করোনায় আক্রান্ত হলাম। অথচ আমি যাবতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েই বাজারে গিয়েছিলাম। দোকান খুলেছিলাম। বেচা-বিক্রি করে ছিলাম। বাজার করে ছিলাম। কিন্তু আমি আপা-ততঃ পদক্ষেপের অকার্যকারিতার শিকার হলাম। আমি করোনা ভাইরাস দ্বারা আবদ্ধ হলাম।
কিভাবে বুঝলাম? তার বর্ণনা দিচ্ছি। যেমন: ঐ দিন রাত থেকেই শরীরে জ্বরজ্বর ভাব, গলায় ব্যথা হতে লাগল। প্রথম ৪ দিন পাত্তা দিলাম না। শুধু ফোন মারফত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জ্বরের জন্য ট্যাবলেট ও গলায় ব্যথার জন্য গরম পানি খেতে লাগলাম। তারপরেও যখন জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ সমূহ কমতে ছিল না তখন ভয় পেয়ে গেলাম। এবং নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রে ফোন করলাম। তারা নাম ঠিকানা লিপিবদ্ধ করল এবং এর পরের দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে নমুনা দিয়ে যেতে বলল। এবং আমি তাই করলাম।
১ দিন পরেই আমি রিপোর্ট হাতে পেলাম। পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বলা হল, আপনার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ হয়েছে। এবং সাথে একটি প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিল। যেখানে কিছু ঔষধের নাম ও হোমকোয়েরেন্টাইনের নিয়ম কানুন দেওয়া আছে। এবং পরীক্ষা কেন্দ্র থেকেই আমাকে দ্রুত বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। আমাকে ও সাথে অন্যান্য লোকজনসহ দেখে পরিবারের লোকজন কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরবর্তীতে আমিই ওদেরকে দুশ্চিন্তা করতে না করলাম। বুঝিয়ে বললাম এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে। পরীক্ষাকেন্দ্রের লোকজন আমার স্ত্রী ও আমার ৬ (ছয়) বছরের সন্তানের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেল। এদিকে আস-পাশের লোকজন আমার পরিবারকে অপরাধী গণ্য করল এবং আমাদেরকে একঘরে করে দিল। তারা বিভিন্ন ভাবে আমাদের সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করার পাশাপাশি আমাদেরকে বিরক্ত করতে লাগল। এবার আমি নিজেই নিজ থেকে কয়েকজন নিকট আত্মীয় ও বন্ধুকে ফোন করলাম ও তাদের পরামর্শ নিলাম। কেউ বলল ভয়ের কিছু নাই এবং বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিতে বললেন। কেউ কেউ তাৎক্ষনিক ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেন। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য যে রকম কাকুতি বিনতি করতে হয় তাতে হাসপাতালে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাছাড়া হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বরাবরই আমার আপত্তি ছিল। এছাড়া সরকারী হাসপাতালের রুক্ষ ব্যবহারকে আমি ভয় পাই। অন্য দিকে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়ের অর্থ এই মুহূর্তে আমার কাছে নাই। অতএব কি করব?
বসে বসে ভাবতে লাগলাম। আমাকে এক ধরনের হতাশা পেয়ে বসলো। সাথে সাথেই শুঁকনো কাশি দিতে শুরু করলাম। এবার ভীষণ রকমভাবে ভয় পেতে লাগলাম। মৃত্যুর ভয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ভয়।
এখন পর্যন্ত করোনা সম্পর্কে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছি, করোনায় আক্রান্ত হলে নাকি মৃত্যু অনেকটাই কাছাকাছি চলে আসে। এবার হঠাৎ করে অনুভব করলাম আমার শাঁস প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে আসছে। সাথে পূর্বের শুরু হওয়া শুকনো কাশির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু কি! আশ্চর্য! এই কিছুক্ষণ আগেও তো আমি তেমন ভাবে অসুস্থ ছিলাম না। শুধু অল্প অল্প জ্বর ও গলা ব্যথা ছিল। কিন্তু করোনা পজিটিভ হবার খবর পাবার পরেই সব এলোমেলো হয়ে গেল। কাশি শুরু হল, শাঁস প্রশ্বাসের গতি ধীর হয়ে গেল। নাহ! এমন হতে পারে না। এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। জোড়ে নিঃশ্বাস নিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার গায়ে স্ত্রী হাত। ওর হাতের স্পর্শে এবার সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এবার কেমন জানি একটু অন্য রকম মনে হল।
স্ত্রী বলল: আরে এত চিন্তা কিসের? মৃত্যুকে এত ভয় করছ কেন? মৃত্যু তো সবারই হবে। আমি তোমার পাশে আছি।
আমি বললাম: মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি না। চিন্তা করছি। করোনাতো হল। এবার আমার না জানি কোন ধরনের কষ্ট শুরু হয়। অথচ দেখ আমার তেমন কোন রোগ ছিল না। আমি ভয় পাচ্ছি এক অজানা আতঙ্ককে।
স্ত্রী বলল: শোন। তুমি এখনো এক শক্ত সমর্থ পুরুষ। তোমার বয়স মোটে ৪০ বছর। তোমার কোন ডায়াবেটিকস নাই। উচ্চ রক্তচাপ নাই। তোমার ওজন নিয়ন্ত্রণে আছে। তোমার কোলেস্টেরল স্বাভাবিক। অতএব এক নগণ্য ভাইরাস আক্রমণ করে তোমাকে হত্যা করবে। আর তুমি কিনা তোমার দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ করার আগেই এক কাপুরুষের মতো এই নগ্ন ভাইরাসের হাতে পরাজিত হবে। ছিঃ! স্বামী আমার ছিঃ?
এবার আমি আর্ত-চিৎকার করে বললাম: আমি করোনায় আক্রান্ত। আর তুমি কিনা বলছ আমাকে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে। তোমার কি আমার প্রতি একটুও মায়া নেই।
স্ত্রী: অবশ্যই আছে। তোমার সন্তানের কথা মনে করে তোমাকে বাচতে হবে। তুমি কেন এত ভয় পাচ্ছ? করোনা হলেই মৃত্যু নয়।
আমি এবার আমার ৬ বছরের বাচ্চার দিকে তাকালাম। ও চুপ করে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। আমাদের কথা শুনছিল। ও জানেই না করোনা কি?
স্ত্রী: শোন? পত্রিকাতে, মিডিয়াতে প্রতিনিয়ত বলছে করোনা হলে কি করতে হবে এবং কি করা যাবে না। তোমাকে শুধুমাত্র কিছু নিয়ম কানুন মানতে হবে। তাহলে তোমার কিচ্ছু হবে না।
আমিও বিষয়টি মেনে নিতে পারছিনা। সারাজীবন কঠোর ভাবে নিয়মনীতি মেনে এসেছি। আর বলা নাই কওয়া নাই করোনার মতো একটা ঘৃণ্য শত্রু আমাকে হত্যা করবে? নাহ! এতো এক ধরণের পরাজয়। করোনার হাতে পরাজয়। প্রতিজ্ঞা করলাম করোনার হাতে পরাজিত হব না। সকল নিয়মকানুন শতভাগ মেনে চলব। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা মৃত্যু’র ওতো একটা পরিপূর্ণতা আছে। এখনো তো আমার অনেক কাজ বাকী আছে। পরিবারকে আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিতে পারি নাই। অনেক বন্ধুর ঋণ শোধ করতে পারি নাই। দেশের জন্যও কিছু করতে পারি নাই। এতো কিছু কাজ অসমাপ্ত রেখে যদি করোনার হাতে পরাজিত হই তবে মহান সৃষ্টিকর্তা পরকালে আমাকে ক্ষমা করবেন না। মৃত্যুবরণ এবং পুনঃজন্ম লাভের পর মহান বিধাতা প্রথমেই আমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন যার উত্তর আমি দিতে পারব না।
প্রশ্ন-১ সৃষ্টিকর্তা: করোনা একটি ছোঁয়াচে রোগ। তুই এটা জেনেও কেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিস?
আমি: অবনত মস্তকে থাকব। কোন উত্তর দিতে পারব না।
প্রশ্ন-২ সৃষ্টিকর্তা: তোর জীবন হরণ করার মতো এতোটা শক্তি আমি করোনাকে দেই নাই। তবুও কেন করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পারলি না। কাপুরুষ, নিষ্কর্মা।
আমি: নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকব।
প্রশ্ন-৩ সৃষ্টিকর্তা: করোনার হাতে ধরাশায়ী হওয়ার আগে তুই অনেক কাজ অসম্পূর্ণ রেখেছিস। অথচ তুই যথেষ্ট সময় পেয়েছিস। তবুও কেন অসমাপ্ত রেখেছিস? অলস, বেহায়া কোথাকার?
আমি: আমি মিথ্যা বলতে আপ্রাণ চেষ্টা করব কিন্তু পারব না। সত্যিই তো আমি এক মহা ফাঁকিবাজ, ভণ্ড। ইত্যাদি।
অতএব সিদ্ধান্ত নিলাম মরার আগে মৃত্যু বরন করা যাবেনা। আর করোনার মতো ঘৃণ্য বস্তুর হাতে মৃত্যু বরণ, কোন ভাবেই নয়।
এবার যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় ছাড়া কোন লক্ষ্য নাই।
প্রথমেই কেস স্টাডি তৈরি করলাম। অর্থাৎ আমার যাবতীয় শারীরিক অবস্থা লিপিবদ্ধ করলাম। এবার লিপিবদ্ধ করতে লাগলাম করোনা-গ্রস্ত হওয়ার পর আমাকে কি ধরনের শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হতে পারে।
এই পয়েন্টে এসে হোঁচট খেলাম। কি আশ্চর্য! আমার মতো বয়সের রোগীদের ক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হলে কি হতে পারে তার কোন আলাদা বিবরণ নেই। যা আছে সব গড়পড়তা বিবরণ। অর্থাৎ সকল রোগীর ক্ষেত্রে একই রকম অনুমান নির্ভর তথ্য। যেমন: আমাকে বলা হল তীব্র শ্বাস কষ্ট হতে পারে, হার্ট এট্যাক হতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিবে ইত্যাদি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম: আমার তো পূর্বে কখনো এসব ছিল না। আমারও কি এসব হবে। বলা হল হতে পারে। এবার আমি অজানা শ্বাস কষ্ট’র আতংকে ভোগতে শুরু করলাম। আমার ভয় দেখে বউ অভয় দিল।
বলল: আরে তুমি স্বাভাবিক হও। Google, Facebook এ ঢুকে একটু study করে সব তথ্য নাও।
এবার আমি তাই করলাম। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে আমার বয়স ও শারীরিক গঠনের রোগীর জন্য যে সমস্ত তথ্য জোগাড় করলাম তাতে ভীষণ ভাবে আশ্বস্ত হলাম। এবার মনে প্রচণ্ড রকম সাহস পেলাম এবং নিজেকে অন্য রকম অনুভব করলাম। অনেকটাই সুস্থ মনে হল নিজেকে।
বউকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম: দেখ, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এ বিভিন্ন রকমের রোগীর প্যাটার্ন অনুযায়ী বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গের বর্ণনা দেওয়া আছে। সেক্ষেত্রে অর্থাৎ তোমাকে অজানা আতংকে ভুগতে হবেনা। তুমি বুঝতে পারবে তোমার শত্রুর আক্রমণের নমুনা। তুমি জেনে-বুঝেই তোমার শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে। যাই হোক তোমার পরামর্শ শুনে আমি এখন খুব ভাল বোধ করছি।
বউ: প্রিয় আমার। এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দাও।
এবার একটু চিন্তায় পড়লাম। দুই রুমের বাসা। একটি বাথরুম। কিভাবে যে মেইনটেইন করব। বুঝে উঠতে যাবার আগেই খাবারের কথা মনে পড়লো। তাড়াতাড়ি খাদ্যতালিকা তৈরি করলাম। এক্ষেত্রেও ওয়েবসাইট এর সাহায্য নিলাম। প্রাধান্য দিলাম অতি-উচ্চ ক্যালরি-যুক্ত খাবার। যেহেতু আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও রুচিহীনতার প্রশ্ন জড়িত তাই কিছু মূল নীতি সামনে রেখে খাদ্যতালিকা সাজালাম। প্রধান লক্ষ্য অল্প সময়ে দ্রুত খাদ্য গ্রহণ এবং দ্রুত সময়ে বেশি পুষ্টি জোগাড় করা।
অর্থাৎ পরিকল্পিত উপায়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এজন্য শরীরকে প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিতে হবে। সঠিক-খাদ্য সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। এবং আরও কিছু অনুশাসন মেনে চলতে হবে। এভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যা আমি করেছিলাম। এবং সীমিত সমর্থ দিয়েই আমি করোনা মুক্ত হলাম। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে আমার দুই রুমের বাসা তবুও আমার পরিবারের একমাত্র আমি ব্যতীত অন্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। কারণ আমরা সঠিক কিছু অনুশাসন মেনে চলেছিলাম। কিন্তু আমাদের মত দেশে যেখানে বিরাট সংখ্যক অধিবাসী শৃঙ্খলা মানতে অভ্যস্ত নন সেখানে সামাজিক দুরুত্ব বা এই ধরনের আপা-ততঃ পদক্ষেপ তেমন করে কার্যকরী হতে পারে না।
সর্বশেষে আবারো বলছি। সবাইকে এড়িয়ে আমি শুধুমাত্র একা বাচতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। অতএব চিন্তা করতে হবে আমাদেরকে নিয়ে। তবেই পারব।
এক্ষেত্রে আমি আশাবাদী। ভীষন রকম আশাবাদী। কোন এক সময় বাস্তবে একটি দৃশ্য দেখা যাবে। একজন এসেছেন। যিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন, পরিচালিত করছেন। জনতা সামাজিক ভাবেই শৃংক্ষলাপরায়ন হয়ে উঠেছেন। আমরা অনেক বেশি সভ্য হয়ে উঠেছি। তখন শুধুমাত্র করোনা ভাইরাস নয়, আমরা জয় করব দরিদ্রতা। আমরা অর্জন করব সমৃদ্ধি। আমরা উপভোগ করব সুখ, পরম সুখ।
আমরা যেন সফল হই।
নোট:
১। লেখাটিকে সুখপাঠ্য করার জন্য কিছু কিছু বিষয়ে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ রাত ১২:১৩