একটা গান শুনছি। আমার চাচ্চুর প্রিয় গান। আমার ও বেশ ভাল লাগে।চাচ্চুর প্রভাব আমার জীবনে ব্যাপক। বলতে গেলে আমি তার ফোটোকপি।
"ধন্য ধন্য, ও বলি তারে।
বেধেছে এমন ও ঘর শূন্যের উপর পচতা করে।
ধন্য ধন্য বলি তারে"।
যতবার শুনি মন ভরে যায়। আহা! সুরের কি টংকার, কি আবেদন বাংলা গানের!
চাচ্চু বলতেন লেখক,গায়ক ও সুরকার তিনে মিলে ত্রয়ী যজ্ঞীয় প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরতেন আবহমান বাংলার প্রতিটি মনের আবেদন। কালজয়ী তারা।
আমাদের দেশের সংস্কৃতি হাজার বছরের বহমান নদীর মত। যেদিকে গেছে হাজার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে গেছে।আমাদের কি নেই। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন গানের সংকলন "চযাপদ",রয়েছে অজস্র কবি, কবিতা, গান, ভাওয়াইয়া,ভাটিয়ালি।আমরা সাহিত্য ও কলায় পিছিয়ে ছিলাম না কোন জাতির থেকে।তাই তো আমাদের কবি জসীমউদ্দিনের উপর গবেষণা করে গেছে ক্লিনটন বি ক্লাক। লালনগীতি নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য বই। আর আমরা কিনা ধারন করেছি অন্য দেশের সংস্কৃতি।
আমি ভাবলাম ইশ আসলেই আমরা অভাগা। রমিতের দাদু দিল্লিতে থাকেন । ওদের বাসায় তো কোনদিন শুনিনি কেউ আমাদের গান গাইছে। তাহলে আমরা কেন? চাচ্চু কে জিজ্ঞাস করলাম।
চেয়ারে বসে চাচ্চু তখন কবিতা লেখছে। আমার ডাকে চাচ্চু আমার দিকে তাকাল। বাউল মানুষ কিছুটা পাগলাটে। মনটা পানির মত সাদা। খুব গম্ভীর। কারো সাথে বেশী কথা বলেনা।সেদিন বাবা কথা বলতে গেলেন ব্যবসার উইল নিয়ে। চাচ্চু ফিরেও তাকালেন না। বাবাকে বললেন গান শুনছি পরে এসো। বাবা জানতেন আর কিছু বলে লাভ নাই। দুনিয়া ভেঙে গেলেও এই মুরিদ তার গানের জগত থেকে ফিরবে না। তিনি ফিরে গেলেন।
আমি জানতাম চাচ্চু তার প্রিয় বিষয়ে লেকচার দিবে তাও ভাবলাম শুনে দেখি, কি বলে উনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাচ্চু কিছুক্ষণ উদাসী হয়ে থাকল। এরপর বলল, "জানিস লিটু আজ ভিন্নদেশীয় সংস্কৃতি গ্রাস করেছে আমাদের। কারন আমরা তুলে ধরতে পারিনি আমাদের শিল্পকে। ধারাবাহিতা হারিয়েছি বারংবার। আমরা হয়েছি ভিনদেশীয় মেকি সংস্কৃতির পরজীবী। আমরা অভাগা। আমরা ধীরে ধীরে হয়ে হয়ে পরছি শিকড় বিহীন পরগাছা। আত্মপরিচয় ভুলে থাকা এসব বাঙলাদেশী কে উদ্দেশ্য করে কবি আব্দুল হাকিম যথার্থই বলেছিলেন--
"দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়"।
আমাদের অন্যের সংস্কৃতি জানা দরকার, কিন্তু তার অন্ধ অনুকরণ আমাদের শুধু এবং শুধুমাত্র জলে ভাসা বেনামী শেওলায় পরিনত করবে। রত্নময় বাংলা গানের মন মাতানো সুর আর আবেদন ভুলে কি পাব আমরা? কোথায় যাব আমরা?
তাই আমাদের হতে হবে আরো সৃজনশীল, হতে হবে নিজ কৃষ্টি-কালচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানের প্রতি দোষারোপ করে লাভ নেই। অভিসম্পাত কর হাজার বার নিজের মননের উপর।"
এত গুলা কথা কানের উপ্রে দিয়ে গেল। যদিও কাজের কথা কিন্তু বহুত ভারি কথা। বুঝলাম অযথাই চাচ্চুরে বিরক্ত করলাম। আমি নিজেও বিরক্ত হইলাম। কিছুক্ষন পর চেয়ারম্যান চাচার ছেলে ইয়ো ইউসু বাসায় গাইড বই নিতে এল। এটা ওর বাবার দেওয়া নাম না। নিজে বদলায় নিছে। বাপের দেওয়া ইউসুফ আলী নাম সে পছন্দ করে না।
ইউসুফ গলায় চেইন পড়ে। হাতে ৩-৪ টা বালাও পরছে। ওরে দেখে কাজের বেটি জুলেখা মনে হয়। খালি একটা শাড়ি পরালেই চলবে। কিন্তু ওকে একথা বলার সাহস কারো নেই চাচ্চু ছাড়া। হেলেদুলে হতভাগাটা গান গাইছে তাও আবার চাচ্চুর ঘরের পাশ দিয়েঃ
আফগান জালেবী----
মাশুক ফারেবি----
খাজা জিকে পাস তেরি চুগ্লি করু----- গা
ও তেরি------
চাচ্চুকে দেখে ব্রেক কষল।
চাচ্চু ওকে দেখেই বলা শুরু করল," এই ছেলে কি গান শুন হ্যা। কি গান শুন। ফাইযলামি নাহ।
"আফগান জিলেবি, মাসুক ফারেবি" হিন্দি গান। এটার দোলায় উদ্দেলিত মনকে বল একবার লালনের গানে ডুব দিতে। একবার শুনিয়ে দাও তাকে " আমার হাড় কালা করলাম রে অথবা " আয়না তে ওই মুখ দেখবে যখন" অথবা "যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা"। শপথ করে বলতে পারি দুনিয়ার কোন মিউজিকে মন ভরবে না আর"।
ইয়ো ইউসু তব্দা হয়ে গেল। অবশ্য এরআগেও বহুবার চাচ্চুর ঝাড়ি খাইছে। প্রতিবার তউবা করে সে হিন্দি গান শোনা বাদ দেয়। কিন্তু পারে না। আবার শোনে। এটা না শোনলে তার চলবে না।প্রতিদিনের রিজিক।
অভাগার দল আজকাল রাস্তা ঘাটে চিক্কুর মারে গায় "আজ দিল হে পানি পানি", " চার বোতল ভদকা" ইয়ো ইয়ো হানি সিংগা"। আফসোস এরা জেমসের "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি " শুনে নাই! এরা আজকাল পিটবুল প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার "আই আম সো এক্সোটিক" অথবা কেটি পেরির "রোওয়ার ইন জংগল" নিয়েই বেস্ত। কিছু ভিন্ন অধুনা ঘরনার কিছু বাংলা গান যেমন "জান ও বেবি" গানের আবেদন মনে সুড়সুড়ি কাটলে কাটতে পারে কিন্তু হলফ করে বলতে পারি বহতা নদীর মত বইবেনা, খালপাড়ের মৌসুমী পানির মত মিলিয়ে যাবে এক ঋতুতেই। কিন্তু প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে ভাল কিছু আশা করতেই পারি। আমি অবশ্য এইসব গান শুনছি। আমার তেমন ভাল লাগে নাই। আমার কেন ভাল লাগে না ইয়ো ইউসু বুঝতে চায় না।
সে বলে, "ইয়ো ম্যান আমি জানলাম না বুঝলাম না শুনলাম না রে,
তোর চাচ্চু তোর মাথায় কি ঢুকাইছে বাপ্রে।চাচ্চুর চিন্তার সাথে আমার মিল আছে বুঝতেছি।
যাই হোক, কোন এক অজানা গানে কি কবিতায় ঠিকমনে পড়ছেনা শুনেছিলাম অনেক আগে " আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইল রে, মানুষের মাথা খাইল রে"। আজকে এরা শুধু মাথা না কলবের ভিতরে ঢুকে বসে আছে।
শেষ কবে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গান টেলিভিশন বা রেডিওতে শুনেছি মনে নেই একমাত্র বিটিভি ছাড়া।এই কারনে বিটিভি প্রশংসার যোগ্য। অন্য প্রাইভেট চ্যানেল গুলা বাণিজ্যিক রেস্তোরার মত। বিজ্ঞাপনী ঘরনায় হুটহাট কিছু আয়োজন। সুর আছে তাল নাই, তাল আছে সুর নাই। কিন্তু ৪-৫ মিনিটের সুরেলা জিংগেল অ্যাড চলছে ননস্টপ। আহা! কি আয়োজন। কি পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক রেওয়াজ আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো নয় যেন বংগবাজারে বাদর নাচ দেখছি।
ঝারি খাওয়া ইয়ো ইউসুর মতে এগুলা আমাদের দোষ। আমরা আপগ্রেড না।আমরা মিউজিয়ামে থাকার যোগ্য। বাংলাদেশে না।ঘুম থেকে উঠে ডিশ চ্যানেলে প্রতিদিন তার নাইন এক্স এম এ "আফগান জিলাবী" আর দিনে দুই তিন বার বাংলালিংক কন্যা দেখা লাগবেই। আমিও আজকাল অনুষ্ঠানের ফাঁকেফাঁকে মেরিল কন্যা, ডেনিশ কন্যা, কিংবা আপগ্রেডেড বাংলালিংক কন্যা দেখছি আর ভাবছি এগুলো কেন? আমার হঠাৎ মনে হল আরে হ্যা, মিডিয়া তো অয়েটার। অয়েটার কে অড্রার করার আগে পরখ করে নেই আমরা কি খেতে চাই। শুধু শুধু অয়েটারকে বকে কি লাভ। অয়েটার কে যা আনতে দিবেন তাই আনবে। বকশিস পেতে কে না চায় বলুন। কে জানি বলেছিল আফটার অল এভরিথিং ফেয়ার ইন বিজনেস এ্যান্ড লাভ। দারুন জিনিস পেয়ে গেলাম দেখছি। চাচ্চুকে কাল জানাব।
ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে এল। বিছানায় শুয়ে পরলাম। অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরিক্ষা সামনের মাসে। অনেক পড়া। ঘুম থেকে উঠে পড়তে হবে।কিন্তু ঘুম আসছে না।
রাস্তা থেকে জিংগেল ভেসে আসছে--
আফগান জিলাবী---
মাশুক ফারেবী-
গলাটা পরিচিত মনে হচ্ছে। আগে কোথায় যেন শুনেছি। কিন্তু চিনতে পারছি না। ঘুমের ঘোরে অজান্তে একটা গালি শুনলাম । বেজন্মা। কে দিল আমি না চাচ্চু বুঝলাম না। ধুর ঘুম দেই।
বিঃ দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর করে দেখবেন।
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫১