আমি আমার আশেপাশে যে সব নারীবাদীদের দেখি তাদের আমি দুইটি দলে ভাগ করব।
১। যারা নারীদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে কাজ করে, কথা বলে।
২। যারা নারীদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে, কথা বলে।
আমার চারপাশে আমি যেসব নারীবাদীদের দেখি তারা শতকরা নব্বই ভাগই দ্বিতীয় দলে পড়েন।
বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মতো দেশ যেখানে মেয়েদের জন্ম থেকে মৃত্য অব্দি প্রতিটা মুহূর্তই যন্ত্রনাকর সেখানে নিরাপত্তা আর স্বাধীনতা নিয়েই কথাবার্তা বেশি হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কী জানেন? আপনি যদি কোন কিছুরই উন্নতি করতে যান, আপনার সেই জিনিসটার অবকাঠামোগত দিকটা শক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের উন্নতি চাইলে ভাল কোচ আনুন, খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত স্কিলের দিকে চোখ দিন, খেলায় দেশ ভাল করুক ক্রিকেটকে দেশের মানুষ এমনিই সম্মান দিবে, খেলায় মানুষের আগ্রহ এমনিই বাড়বে, দেশে যে ক্রিকেটের এত বড় জোয়ার, এ কারণেই তো হল নাকি? কিন্তু আমার আশেপাশের নারীবাদীদের আমি সেই দিকটা সম্পর্কে একদম উদাসীন অবস্থায় দেখতে পাই।
তাদের নারীবাদীতার একটা বড় অংশ, কিংবা বলতে পারেন পুরোটা জুড়েই আছে কেবল স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা আর নিরাপত্তা। আমি মোটেও বলছি না যে এ ধরণের নারীবাদীদের আমাদের দরকার নেই, কিন্তু এর চেয়ে যারা নারীদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে বেশি আওয়াজ তুলে আমাদের তাদের আরও বেশি দরকার, যাদের আমরা পাচ্ছি না। এর পেছনে কারণগুলোও আমিই ভাবতে চাই, আমার সামনে বিভিন্ন জিনিস চোখে পড়ে তখন।
নারী স্বাধীনতা বলুন আর যাই বলুন মানে দ্বিতীয় ভাগের নারীবাদীদের কথায় এবং ওধরণের লেখায় কথায়, এক ধরণের আকর্ষণ কাজ করে, আবেগ কাজ করে। আর আবেগ সব সময় আমাদের যুক্তির চেয়ে বেশি টানে। আর এই ভার্চুয়াল মিডিয়ায় সবাই আজকাল কেমন যেন ফেইম পেতে চায়। আমার কেমন যেন মনে হয় তাদের ও ধরণের কাজকর্মের পেছনে এই একটা ব্যাপার খুব বেশি কাজ করে, যে কারণে তারা নারীরা আসলে যেদিক দিয়ে পিছিয়ে আছে সেদিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন কম অনুভব করে। ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট ভিনা ভেনুগোপালের 'ফেমিনিস্ট হ্যাভ কিল্ড ফেমিনিজম'-এর কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি-
We should be allowed to wear what we want, look how we choose. Yes, these are meaningful things, but the trouble is that the outrage rarely extends beyond anything that was endorsed by Sex and the City. Just this week, bang in the middle of the Women’s Day hoopla, two surveys were published about salaries and wages in India. The gender pay gap they showed was 25 per cent — that is, women are paid 25 per cent less than men for the same job. However, there has hardly been a conversation about this, much less, outrage. Which is why I am certain that feminism is dead. It has forgotten what the battle is about. And is now simply reduced to “you go, gurl” vacuousness.
আমার মনে হয় এখানে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথা বলেছেন। বাংলাদেশের অবস্থাও কিন্তু ইন্ডিয়ার মতো, বাংলাদেশে নারীরা কোনদিকে কীভাবে পিছিয়ে আছে সে কথা বলতে গেলে নিশ্চই তারা কী রকম কাপড়-চোপড় পরছে কিংবা তাদের স্বাধীনতা কতটুকু তা নিয়ে কথা বলবেন না আপনি, কথা বলবেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে।
বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৪টি৷ এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩, অর্থাৎ শতকরা ৭.৬ ভাগ৷ উপসচিব পদ থেকে সচিব পদ পর্যন্ত নারীদের সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ বা তারও কম৷ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিচার বিভাগে বিচারক পদের ১০ শতাংশ হলো নারী৷ তবে হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি পদে এখনো নারীকে দেখা যায়নি৷ আমার মনে হয় আপনি যদি নারীরা কতটুকু এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে তা নিয়ে কথা বলতে চান তাহলে এই একটি দিকই আপনাকে হাসিয়ে যাবে। তবে আপনার আশেপাশে কজন এ নিয়ে কথা বলছেন?
ব্যানবেইজবিডির একটা জরিপে দেখলাম বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের শিক্ষাগ্রহণের হার পুরুষদের অর্ধেকের কাছাকাছি। যে কোন দিক দিয়ে দেখতে গেলেই আসলে এ ধরণের ছবি চোখে পড়ে। নারীরা এগিয়ে নেই কোথাও, কিন্তু অনেক পিছিয়ে আছে অনেক দিকে। কিন্তু তা নিয়ে কথা হচ্ছে কই? উমেন চ্যাপ্টারের মতো কিছু ব্লগ যেখানে ভেবেছিলাম আশীর্বাদ হয়ে আসবে আমাদের জন্যে সেখানে তাদেরও এসব নিয়ে কথা বলতে দেখি না। এখন একটা পসিবল উত্তর হতে পারে, তারা ওসব বিষয় নিয়ে আওয়াজ তুলছে ওগুলোর মাঝ দিয়ে এসব বিষয়ে এগিয়ে আসার জনে? আমি নিজের মনকে এ কথা যদি বলি সে মানতে চাইবে না, বলবে এটা তারা চাইলেও সম্ভব নয়।
অথচ আমার মনে হয় এসব জিনিস নিয়ে কথা বললেই, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করলে, এইসব ক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ বাড়ালেই নারীদের অবস্থা বর্তমানের চাইতে অনেক উন্নত হয়ে যাবে আমাদের দেশে। কিন্তু তারা এটা করছেন না, করবেন বলে আমার মনেও হচ্ছে না। ঐ যে বললাম, তাদের অধিকাংশের এসব কিছুর পেছনে আমি কেমন একটা খ্যাতি পাবার প্রবণতা দেখি। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, বরং অনেক পুরানো। ২০১৩ সালে বিয়োন্সে নারীবাদীতার জোরেই তার এলবামকে নব্বইটি দেশে সবচেয়ে বিক্রিত এলবাম বানান। অথচ এলবামটি নিয়ে কোন হাইপ ছিল না।
আমার মনে হয় অন্তত আমাদের দেশের নারীবাদীদের উচিত এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলা, এগিয়ে আসা। বিভিন্ন দিক থেকে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এখন যদি তারা কেবলমাত্র খ্যাতি পাবার জন্যে নারীবাদী হয়ে থাকেন তাহলে তারা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন এটাই সবচাইতে ভাল উপায়। তবে এতে বাংলাদেশের নারীসমাজের কোন দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৪৪