বুক রিভিউঃ
মন্টেজুমার মেয়ে – হেনরি রাইডার হ্যগার্ড
মন্টেজুমার মেয়ে প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ সালে।রাইডার হ্যাগার্ডের নিজের মতে, এটাই তার শেষ সেরা লেখা।যদিও এর পরে তিনি অনেক বই লিখেছেন।উপন্যাসটি মূলত এডভেঞ্চার ঘরানার,তবে কেউ কেউ ইতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাসও বলে থাকেন।আমার মতে বইটাকে এডভেঞ্চার হিসাবেই বেশি মানায়।উপন্যাসটির মূল কাহিনী এক ইংরেজ তরুণের উত্তম পুরুষ বর্ণনায় বর্ণিত।কিভাবে সে প্রতিশোধের লক্ষ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে,কিভাবে ভাগ্য তাকে একজন গুরু জুটিয়ে দেয়,আবার ভাগ্যই তাকে নিয়ে আসে জংলীদের মধ্যে,সেখানে সে প্রত্যক্ষ করে স্প্যানিয়ার্ডদের প্রথম আমেরিকা অভিযান।আমি বইটির সেবা থেকে প্রকাশিত বাংলা অনুবাদটি পড়েছি।সুতরাং, আমার রিভিউ মূলত বইটির অনূদিত সংস্করণেরই হবে।
সেবা থেকে প্রকাশিত অনুবাদটি করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সেবা থেকে অনুদিত অন্যসব বইয়ের মতো এই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যাও মূল থেকে অনেক কম। যেখানে মূল ইংরেজি বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৫০-৭০০ (ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনীর বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন) সেখানে সেবার অনুবাদের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮০।বাংলায় অনুদিত বইগুলোর পৃষ্ঠা সাধারণত মুল থেকে কিছু কমই থাকে (যেমন-দ্য শাইনিং - মুল ৪৪৭পৃ.-অনুবাদ ২৮৫পৃ.)।আবার কিছু বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় একই থাকে(অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল রাইডার্স ফ্রম দ্য নর্থ - মূল ৪৪৮পৃ.-অনুবাদ ৪৪৫পৃ.)।কিন্তু সেবার মতো এত পার্থক্য আর কোথাও দেখা যায় না।কত ছোট করা হয়েছে তার উদাহরণ- মুল বইয়ের প্রথম তিন পৃষ্ঠায় যেটুকু বর্ণনা করা হয়েছে সেটুকুর বর্ণনা অনুবাদটির প্রথম পৃষ্ঠায়ই স্থান পেয়ে গেছে।তবে অনুবাদটি পড়ে কোথাও অসম্পূর্ণ লাগেনি,বেশি সংক্ষেপণ হয়েছে বলেও মনে হয়নি।সুতরাং বলা যায় সংক্ষেপণ সফল হয়েছে।
বইটিতে যেহেতু একটি বড় ঐতিহাসিক ঘটনার(স্প্যানিয়ার্ডদের মেক্সিকো অভিযান) কথা উল্লেখ রয়েছে সেহেতু ঘটনাগুলির যথাযথ ও নিখুঁত বর্ণনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।রাইডার হ্যাগার্ড এখানে পুরোপুরি সফল।তিনি বইটির জন্য মেক্সিকোতে গবেষণা করেছেন।এবং মোটামুটি নিখুঁত বর্ণনাই দিয়েছেন।এই বইটির অর্ধেক চরিত্রই অকল্পিত। স্প্যনিয়ার্ডদের অভিযানের সময়কার বিখ্যাত রাত্রি ‘লা নচে ত্রিস্তে’র বর্ণনাও হ্যগার্ড খুব ভালোভাবে দিয়েছেন। মেক্সিকোতে গবেষণা করার সময় হ্যাগার্ড খবর পান তার একমাত্র পুত্র মারা গেছেন,এই ঘটনা উপন্যাসের ঘটনার মধ্যে কিছুটা ছায়া ফেলে।
উপন্যাসটিতে আযটেক জাতীকে জংলী এবং খুব অসভ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।স্প্যানিয়ার্ডদেরও খুব বর্বর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।মূলত ইংরেজদের খুব আদর্শবান হিসেবে দেখানো হয়েছে।প্রায় সকল ভিক্টরিয়ান উপন্যাসেই এরকম দেখা যায়।হ্যাগার্ডও ব্যতিক্রম নয়।আবার,বইটি একজন ইংরেজ নাগরিকের উত্তম পুরুষ বর্ণনা হিসেবে আযটেক,স্প্যানিয়ার্ডদের সমালোচনা থাকাটা খুব অসংলগ্নও বলা যায় না। উপন্যাসটির অনেক জায়গায় কৃত্রিম উত্তেজনা,দৈবের অতি ব্যবহার দেখা যায়,তবে এডভেঞ্চার হিসাবে এসব ভুল মার্জনা করাই যায়।একটা জিনিস খুব বিরক্তিকর লেগেছে,বইয়ের একাধিক জায়গায় পূর্বাভাস।রাইডার হ্যাগার্ড বইটির অনেক জায়গায় ঘটনা আগে গিয়ে কোথায় গড়াবে তার নির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিয়েছেন। এক –দুবার হলে মানা যায় কিন্তু তিনি এরকম অনেকবার করে অনেক জায়গায় মজা নষ্ট করে দিয়েছেন।
বইটির মূল চরিত্রের নাম থমাস উইংফিল্ড। চরিত্রটির সাথে রাইডার হ্যাগার্ডের কিছু মিল আছে।থমাস উইংফিল্ড বড় হয়েছে নরফোক কাউন্টির ডিচিংহ্যাম ডিস্ট্রিক্টে,রাইডার হ্যাগার্ডও একই জায়গায় শৈশব কাটায়।চরিত্রটির সাথে রাইডার হ্যগার্ডের আরো কিছু মিল আছে, যা বললে স্পয়লার হয়ে যাবে তাই বলছি না।হ্যগার্ড চরিত্রটির চিত্রায়নে খুব নিখুঁত ছিলেন।সাহসী কিন্তু সরল যুবক থমাসের এক অজ্ঞাত ভুলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়।থমাস নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উদ্ধত হয়।ঘটনার শুরুর দিকে সরল এবং পরে প্রতিশোধের স্পৃহায় টগবগে এক যুবকে পরিণত হওয়াটা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন হ্যগার্ড।আবার দূর দেশে গিয়ে অনিবার্য সম্পর্কে জড়িয়ে পরেও নিজের দেশে ফেলে আসা সম্পর্কের কথা ভুলে না যাওয়া দ্বারা থমাস চরিত্রে শুদ্ধতা ফুটিয়েছেন হ্যাগার্ড। নিজের কাজের জন্য অপরাধ-বোধের অনুভুতি দ্বারা হ্যগার্ড চরিত্রে বাস্তবতা ফুটিয়েছেন।
কাহিনী সংক্ষেপ(স্পয়লারযুক্ত)-
ইংল্যান্ডের নরফোক কাউন্টির ডিচিংহ্যাম ডিস্ট্রিকে সুখে শান্তিতেই থাকত থমাস উইংফিল্ডের পরিবার।সুখে-শান্তিতেই হয়ত কেটে যেত যদি না স্পেন থেকে এক লোক এসে খুন করত থমাসের মাকে।থমাস তখন তরুণ,শহরেরই আরেক তরুণীকে পছন্দ করে। মায়ের খুনের বদলা নিতে ফুঁসে উঠল থমাস।পাড়ি জমালো স্পেনে।তারপর একের পর এক ঘটনা।ভাগ্য নিয়ে যায় তাকে আযটেকদের মাঝে।সেখানে একবছর দেবতা ছিল সে।দু’বার নরবলির হাত থেকে ফিরে এসেছে।তারপর কি আদৌ ফেরা হল ইংল্যান্ডে,নেয়া হল মায়ের হত্যার প্রতিশোধ?হলেও কিভাবে? পড়ে জানুন।
উপসংহারে বলা যায় ‘মন্টেজুমার মেয়ে’ এডভেঞ্চার হিসেবে উপযুক্ত একটি বই।আগা থেকে গোড়া উত্তেজনায় টানটান,শেষের দিকে অবশ্য কিছুটা বিষাদ চলে আসে। কিছু সমালোচনীয় বিষয় থাকলেও সেগুলোকে মার্জনা করে বইটি উপভোগ করা যায়।সেবার অনুবাদে সংক্ষেপন অতি মাত্রায় হলেও তা দূষণীয় হয়নি।হয়তো মূল বইয়ের চেয়ে কিছুটা সুপাঠ্যই হয়েছে। এডভেঞ্চার প্রেমীরা পড়ে দেখতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:০১