টানা ৫ টা বছর খোজখবর নাই, হুট করেই আনিস ভাইয়ের ফোন। তার নাম্বার আমার কাছে সেইভ করা আছে, বা উনি ই মিথুনের টা রেখেছেন এটা বিশাল আশ্চর্যের ব্যাপার। আনিস ভাই সেইবার ম্যাস ছাড়লেন, উনার আর দেখা পাওয়া যায়নি।
আনিস ভাই জীবনে পরাজিত একজন মানুষ, পরাজিত মানুষদের ফোন প্রথম বার ধরতে নাই। সেকেন্ডবার ধরতে হয়, এতে করে বোঝা যায় কল টা কারনেই করেছেন। আনিস ভাই অকারনে ফোন করেন না, করার মানুষ না, প্রথমবার ই ধরলাম।
হাই হ্যালোর ধার ধারেন নাই জীবনেও। এমনভাবে কথা বলবেন যে ৬ বছর পর না, যেন দুপুরেই আড্ডা দিয়ে আসলাম, বিকেলে ফোন দিয়েছেন।
- মিথুন?
ঃ জী ভাই। আপনি ভালো আছেন?
- হু। প্রশ্ন করবি না, সময় সংকট। একটা কাজ কর তো।
ঃ বলেন ভাই।
- সাজ্জাদ বলে একটা ছেলে আছে। ওর থাকার ব্যাবস্থা করতে হবে।
ঃ পাঠায় দেন ভাই।
আনিস ভাই কারো থাকার কথা বলেছেন মানে তার তো ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দরকার নাই। উনাকে না বলার ক্ষমতাও নাই আমার।
- পাঠায় দিলেই হবে না। ও একা না, একটা মেয়েও থাকবে সাথে।
ঃ পলাইছে ভাই?
- প্রশ্ন করতে মানা করলাম, মিথুন তুই প্রশ্ন করতে শিখছিস, উন্নতির লক্ষন। যা বলতেছি শুন।
ঃ জী ভাই।
- ছেলের নাম সাজ্জাদ। সে জান্নাত নামের এক মেয়েকে অত্যাধিক পছন্দ করে।
ঃ জী ভাই।
- সমস্যা হচ্ছে মেয়ের সাথে ছেলের কোনদিন কথাই হয় নাই। তুই ওদের ব্যাপার টা ম্যানেজ করে দে। ওদের একসাথে থাকা দরকার।
ঃ এ্যা?
- যা বলছি কর, ওর নাম্বার দিতেছি, তোর কাছে যাক, বাকিটা সামাল দিবি। পারবি না?
জী ভাই বলার সাথে সাথে ফোন কেটে দিলেন। তৃপ্তি ভাবী আনিস ভাইরে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর উনি কেমন গোলায় গেলেন। ডিভোর্স পেপার যেদিন পাইলেন, সেইদিন কিছুই হয় নাই ভাব করে দুপুরের দিকে বেরিয়ে গেলেন, রাত ১১ টার দিকে ম্যাসে ফিরলেন। আমার ধারনা মাঝখানের এই সময় উনি কোথাও গিয়ে কেদেছেন। চোখ টোখ লাল। লালপানি খাওয়া লাল না, উনার মুখ শরীর থেকে একরকম সুগন্ধ বের হইতো। আতরের মত, লালপানিটানি খেলে গন্ধ তো পাইতাম।
এসেই জিগেস করলেন খাইসিস? কইলাম না, উনি কইলেন আমার কাছেও টাকা নাই, তর কাছে আছে? কইলাম অল্প কিছু আছে, হয়ে যাবে ভাই। উনি বললেন চল পুরান ঢাকার দিকে চলে যাই, বাখরখানি খাবো ঘন ধুধচা দিয়ে। আমি কিছুই না বলে টিশার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে পড়লাম। রাত ৩ টা পর্যন্ত আমরা বাখরখানী খুজলাম, পাওয়া গেলো না। শেষে উনি আর আমি হাকিমপুড়ি জর্দা, কাচা মজা সুপারী দিয়ে পান চিবাইতে চিবাইতে বাসায় ফিরলাম।
ভোর রাতের দিকে আনিস ভাইয়ের তীব্র জ্বর আসলো। আমি ম্যাসের সবাইরে ডেকে এনে পানি ঢাললাম মাথায়। জ্বরের ঘোরে উনি যা বিরবির করতেছিলেন, সেগুলো একদম টপ লেভেল ক্লাসিফাইড কথাবার্তা, শুনলে তৃপ্তি ভাবী এসে উনাকে উঠায় নিয়া যাইতেন ফর শিওর। কিন্তু আমি কাউকেই কিছু বলি নাই। আমার সেই অধিকার নাই। জ্বর সেরে উঠে উনি একদিনের মাথায় কিভাবে জানি একটা চাকরী জুটিয়ে ফেললেন, এসে আ,আদের দুজনের ম্যাসের ২ মাসের বাকি ভাড়া দিয়ে দিলেন, কাজের বুয়া খালার জন্য টাংগাইল শাড়ি কিনে আনলেন, গাড় সবুজ রংগের শাড়ি। মাস দেড়েক পর ম্যাস ছাড়লেন, তারপর আজ ফোন।
এই সাজ্জাদ ছেলেটারে নিয়ে চিন্তা করা দরকার। এইখানে আমাদের টার্গেট জান্নাত নামের এই আপুনিরে ম্যানেজ করে নিয়ে তার সাথে থাকানোর ব্যাবস্থা করা। বাংলাদেশে কম করেও ৬০ লাখ জান্নাত আছে, এদের মধ্যে খুজে বের করা একরকম অসম্ভব ব্যাপার আমার জন্য।
চিন্তা গুলায় যাচ্ছে, আমার আগে এই সাজ্জাদ রে ফোন করা দরকার। এই ভোররাতে সেই ছেলে ঘুমাচ্ছে খুব সম্ভবত। সম্ভবত সে প্রেমিক, প্রেমিক দের যেগে থাকা নিয়ম। তীব্র অশান্তিতে থাকা মানুষ আর নতুন নতুন প্রেমে পড়া মানুষ রা রাত যাগেন। সাজ্জাদ ক্যারেক্টার প্রেম করতেছে না ফর শিওর, প্রশ্ন হচ্ছে তার তীব্র অশান্তি হচ্ছে কিনা। ভালোবাসার মানুষ কে চাওয়া অশান্তী ক্যাটাগরীতে ফালানো যায় না। এই ছেলে ঘুমাচ্ছে।
এই জান্নাত ক্যারেক্টার টা কি হইতে পারে ভাবা যাক। যা কিছু সহজে পাওয়া যায়, তার জন্য মানুষ স্বপ্ন দেখে না। তার জন্য মিথুনের প্রয়োজন পড়ে না। এই মেয়ে তার হাতের নাগালের বাইরে। বাট ইউনিভার্স চাইতেছে এরা এক হোক। বেশ ভালো যন্ত্রনায় পড়া গেলো। দেখতে অসুন্দর মেয়েদের প্রেমে ছেলেড়া পড়ে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটনা উলটা। এই সাজ্জাদ ছেলের কাছে সুন্দরের সংজ্ঞা কি?
মেয়েটারে খুজে বের করে ফেলতে পারলে তার সাথে আলাপ কেমন হতে পারে?
ঃ আপনার নাম কি জান্নাত?
- জী, আমার নাম জান্নাত।
ঃ সাজ্জাদ নামের একটা ছেলের সাথে আপনার চলে যেতে হবে।
- কোন সাজ্জাদ? ( এইখানে আমি অবাক হবো, প্রশ্ন টা চলে যাওয়া বিষয়ক হবার কথা, তা না করে ইনি কোন সাজ্জাদ সেই প্রশ্ন করেছেন। )
ঃ আমি সঠিক জানি না কোন সাজ্জাদ, তবে আপনার পরিচিত হবার কথা।
- না, এমন কারো কথা মনে করতে পারতেছি না আমি।
তার চোখ মুখ অসম্ভব শান্ত, রাগ বিরক্তী বা উনি মজা পাচ্ছেন এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এমন ক্যারেক্টার এর দেখা সহজে মেলে না। একবার কুষ্টিয়া গেলাম সাইজির ম্যালাতে, সেখানে গঞ্জিকা সেবন করেও সাধুরা এমন শান্ত থাকতে পারেন না। এই অসম্ভব শান্ত ভাব ভংগী আমাকে নার্ভাস করে ফেলতেছে, আমার ডিফেন্স মেকানিজম রিস্ক ডিটেক্ট করতেছে। এনার সাথে খুব সতর্ক ভাবে পরের কথা বলতে হবে, উনি আমার ভেতর পড়ে ফেলেছেন, ফোরকে রেজুলেশনে স্পষ্ট আমার ব্রেইন ওয়েভ পড়তে পারতেছেন এমন মনে হচ্ছে।
ঃ সাজ্জাদ আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করেন।
- আপনি ই সাজ্জাদ?
ঃ না, কি বলেন। আমি মিথুন।
- আচ্ছা, মিথুন সাহেব, সাজ্জাদের সাথে আমার চলে যেতে হবে, যে আমাকে পছন্দ করে।
ঃ হু। ( আমার ডিফেন্স ফেইলড, গলা একটু কেপে গেলো কি? )
- যাবো না। কফি খাবেন? বাসায় চা চিনি কিছুই নাই, একদম ব্ল্যাক কফি খেতে পারেন।
ঃ হু।
উনি খুব স্বাভাবিক ভাবে কফি আনতে গেলেন। আমি ধরা খেয়ে গেছি একদম। আমি শিওর উনার বাসায় সবি আছে, উনি জেনে ফেলেছেন আমি ব্ল্যাক কফি ই খাই। চেইন স্মোকার দের আংগুল দেখে বুঝা যায়, কি দেখে উনি বুঝলেন কফির ব্যাপার টা? কোয়েন্সিডেন্স ওয়াটসন, শান্ত হউ।
কফি এনে রাখলেন সামনে, বেশ প্রিমিয়াম কোন জাতের হবে। অদ্ভুত সুন্দর স্বাদ, তিতাভাব একেবারেই কম।
- তো মিথুন সাহেব, আপনাকে মিথুন ভাই বলেন ডাকি, কি বলুন?
ঃ জী, ডাকুন।
- এই সাজ্জাদ ভদ্রলোক, আপনাকে পাঠালেন কেন নিজে না এসে, আপনাকে পাঠিয়েছেন কোন পরিচয় ছাড়াই, তাকে ভীতু ভাবতে পারছি না।
ঃ সাজ্জাদ আমাকে পাঠায় নি। আনিস ভাই বললেন, তাই এসেছি।
= আপনার যাদের নাম বলছেন, তাদের কাউকেই চিনি না। আনিস নামে একটা ছেলেকে চিনি, এই পাড়ার ই, ক্লাস নাইনে পড়ে, সে আপনাকে পাঠায় নি।
ঃ না, উনি সিনিয়ার হবেন।
- আচ্ছা উনি থাকুক, এই সাজ্জাদ সম্পর্কেই বলুন। নাকি আমি গেস করবো?
ঃ আমি তেমন কিছু জানি না, তার সাথে আমার কথা হয়নি।
এইবার ভদ্রমহিলা কিছুক্ষন থামলেন, উনার টোটের কোনে মুচকি হাসি দেখলাম। উনি কি ভাবছেন আমি ফাজলামী করতে গেছি, অথবা গল্প বানাচ্ছি? আমি গল্প বানাচ্ছি না !
- মিথুন ভাই?
ঃ হু?
- আপনি গল্প বানাচ্ছেন না। এই সাজ্জাদ সাহেব আছেন, উনার অসম্ভব একটা শখ হয়েছে। উনার শখ কে চাওয়া ভেবে ইউনিভার্স আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। ইউনিভার্স ভুল করে।
ঃ আচ্ছা।
- ইউনিভার্স ভুল করে মিথুন ভাই। আমাদের সিম্পলী চয়েজ দেয়। আমি সবসময় সঠিক চয়েজ টাই করি।
ঃ হু।
- আপনি এই সাজ্জাদ কে বলবেন কোন মানবীকে খুজে বের করে তার প্রেমে পড়তে। পারবেন না?
ঃ আপনি মানবী না?
- না। আমি ইশ্বরী, ভক্তরা আসবেন, বেদীতে ফুল রাখবেন, আমি বড়জোড় সেই ফুল গ্রহন করে হাসতে পারি। এর বেশী দেয়া দেবীর শোভা পায় না, আমার হাসি সুন্দর না?
ঃ আমি জানি না। আপনি হাসেন নাই।
- আপনি বেদীতে কিছুই রাখেন নি, হাসবো কেনো?
ঃ আমি সাজ্জাদ কে রাখলে?
এইবার দেবীর মুখে হাসি ফুটলো। কিন্তু ঠিক মহান না, কেমন একটা ভীতি সৃষ্টি করা হাসি। এই হাসির অর্থ আমি সম্ভবত জানি, তোমার হাতের ট্রাম্প কার্ড শেষ, এইবার খেলা আমার ধরনের হাসি।
- মিথুন ভাই, আপনি আসুন। এই বলিতে আমি সন্তুষ্ট না। সাজ্জাদ আমার ঠিকানা জানে?
ঃ জানে বোদহয়, আমি সঠিক জানি না।
- তাকে থামাতে হবে, আপনি থামাবেন।
ঃ আমি কিভাবে থামাবো !
- আপনি অবশ্য সেটাও পারবেন না। দিন, উনাকেই আসতে দিন। তার নিজেকে বলি দেবার ক্ষমতা দেখতে চাই আমি। বলে আবার হাসলেন। এবারের হাসি টা আমার বুকে তীব্র ভয় সৃষ্টি করলো, আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার হাসি সুন্দর, উপরের লেয়ারে, ভেতরের লেয়ারে আমি ভয়াবহ হিংস্র কিছুর আভাস টের পাইতেছি।
সাজ্জাদ রে খুজে বের করে তাকে থামাইতে হবে। এইখানে, এই বাসাটায় এক দেবীর না, এক দানবীর বাস। এলে সাজ্জাদ ছেলেটা ভস্ম হয়ে যাবে। ভালো হয় সাজ্জাদ রে সাথে নিয়ে পালাইলে। এই শহর ই ওর জন্য নিরাপদ না, দেবী বলি চেয়ে বসছেন, না দিলে কি হবে আমার ধারনার বাইরে। আমার মনে হচ্ছে আমি ওকে আটকাইতে পারবো, আটকাইতেই হবে, নিজেরে ঢাল হিসেবে সামনে দাড় করায় দিলেও।
জান্নাত কি বলতেছিলেন? ইউনিভার্স ভুল করে? করে বোদহয়, আমার সাথে করে নি, যাবতীয় ভুল আমি মানুষ কেই করতে দেখেছি। আনিস ভাইকে ফোন দিয়ে যে কিছু বলবো, আমার ধারনা উনার নাম্বার বন্ধ পাবো। আনিস ভাই সুধুই একজন ম্যাসেঞ্জার। এই সাজ্জাদ ছেলের ঠিকানা খুজে বের করা তেমন কঠিন কিছু হবে না। আনিস ভাই, ইউনিভার্স আর এই জান্নাত ক্যারেক্টার ওরে নিয়ে যে ধ্বংসের খেলায় নেমেছেন, বেচারা হয়তো জানেই না। ইউনিভার্স ভুল করে না, তার নির্দিষ্ট প্ল্যান থাকে। জান্নাত ভুল বলেছেন, ভুল করা একমাত্র সৃষ্টি মানুষ, তাহলে তিনিও মানুষ। উনার ভুল ভাংগাতে আরেকদিন যাব উনার বাসায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২৪ ভোর ৬:০২