-এ্যাই ওঠ!
এমন নবাবী চালে ঘুমাচ্ছিস যে বড়!
কাজ করব কি তোর মায়?
বাড়িওয়ালীর হাঁক-ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় রতনের। উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। এমনিতেই যে শীত পড়েছে আজ কাল। তারপরে আবার বাড়িওয়ালীর ফুট-ফরমাশ খেটে গভীর রাতে শুতে হয়।
কতই বা বয়স তখন। পাঁচ-ছয় বছর বয়স হয়ত হবে। ফুটপাতে পড়ে ছিল সে। ঐ বড় মহল্লার ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী আকন্দ সাহেব রোজ সকালে মর্নিং ওয়াকে বের হন। একদিন হঠাৎ করে চোখ পড়ল ছেলেটার দিকে।
-কিরে ? কি নাম তোর?
-রতন।
-এখানে কি করিস? বাড়ি-ঘর নাই তোর?
-এইহানেই থাহি। কিছুই নাই আমগো।
-বাপ-মা নাই?
-হেরাও নাই।
-কি করে খাস?
-কিছুই করিনা, যা পাই তাই খাই।
-তাইলে আমার সাথে চল।
আজ-কাল কাজের ছেলে-মেয়েদের পাওয়া যায় না। একটা ছিল, তাও আবার ভেগেছে। তাই রতনকে সাথে করে নিয়ে এলেন আকন্দ সাহেব। ঠাঁই দিলেন নিজ বাড়িতে।
সেই থেকে তার এ বাড়িতে কাজ শুরু। আজ সাত-আট মাস হতে চলেছে এ বাড়িতে। বাড়িওয়ালার গাড়ি মোছা থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালীর থালা-বাসন ধোয়া পর্যন্ত বাদ যায় না তার।
সেই পাখি-ডাকা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে তবেই নিস্তার, তবেই একটু ঘুম। আদর-যত্ন না পেলেও প্রথম প্রথম ভালই ছিল অন্তত। কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয়েছে বাড়িওয়ালীর গালি-গালাজ আর মার-ধোর। পান থেকে চুন খসলেই সেরেছে তার। চড়-থাপ্পর, আরো কত কি? আর গালি-গালাজ, সে-তো তার নিত্য-সঙ্গী।
-এ্যাই ছোড়া, উঠবি না? উঠ, নইলে…
অগত্যা উঠে পড়ে রতন। এই হাড় কনকনে শীতেও হাড়-ভাঙ্গা খাটুনী খাটতে হয় তার। ঘুম থেকে উঠেই কুয়াশার ভারী চাদরের সামিয়ানার ভেতরে নেমে পড়ে। বাড়ির সামনে গ্যারেজে চলে যায় গাড়ি মুছতে। গ্যারেজ থেকে ফিরেই সোজা রান্নাঘরে। সেখানে যে কত কাজ জমা পড়ে আছে!
হঠাৎ ঝনাৎ শব্দ। বাড়িওয়ালী ছুটে আসে রান্নাঘরের দিকে।
-আবার ভাঙ্গলি! রোজ রোজ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সব তো শেষ করে দিলি! কাজ তো করতেই পারিস না , আবার…! বেরো আমার বাড়ি থেকে !!!
মারতে মারতে রতনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় বাড়িওয়ালী। নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গেটের বাইরে। এখন সে কোথায় যাবে? তার তো কেউই নেই। কাজের বিনিময়ে যা একটু ঠাঁই পেয়েছিল তাও তো শেষ! ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে রতন। এক সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে রাত আসে।
* * * * *
রাশেদ হেঁটে যাচ্ছিল ফুটপাত ধরে আর রুটিন-মাফিক এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ চলে গেল একদিকে। ফুটপাতের উপরে কি যেন একটা কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। কাছে যেতেই দেখল, পিচ্ছি একটা ছেলে। বয়স ছয় কি সাত! গায়ে জামা নেই। ফুটপাতে শুয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেল রাশেদ।
-কি নাম তোমার?
-রতন।
-এখানে কেন? কেউ নেই তোমার?
-স্যার, আমার কেউ নাই। এক বাড়িত কাম করতাম। হেরায় খালি মারত। আমারে তাড়ায়া দিছে হেরা। সেই থিকা আমি এহানে।
-চল আমার সাথে।
রাশেদ ছেলেটাকে নিয়ে নিজ গন্তব্যে হাঁটা দিল।
তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক বন্ধু মিলে একটা সংঘ করেছে পথশিশুদের জন্যে। সংঘের খরচ দেয় বেশ কিছু শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী আর জনহিতৈষী মানুষেরা। এই শীতে যারা ফুটপাতে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে ওদেরও স্থান দিয়েছে সংঘটাতে।
রোজ সকালে একেকজন একেক দিকে বের হয় আর পথশিশুদের নিয়ে আসে। রতনকেও নিয়ে এল আজ। ওকে কাপড়-চোপড় দিল। পথশিশুদের স্কুলে ভর্তি করে দিল। সংঘের হাত ধরে নতুন জীবন পেল রতন।
---------------------------------------------------------------------
(অ.ট. আমার এই গল্পটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া-জানুয়ারী-২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এককপি ব্লগেও দিয়ে দিলাম

মূল গল্প: http://www.skdeendunia.com/archives/252 )