এপ্রিলের শেষ দিন ৯ জনের একটা পাহাড়পাগল দল রওনা দিলাম সাজেকের পথে।সাজেক,যাকে আমরা মেঘেদের দেশ বলেই জানি।যেখানে মেঘেদের সাথে চাইলেই মিতালী করা যায় পাহাড়চূড়ায় বসে।আর মেঘেরাও ভালবাসার পরশ চুম্বন এঁকে যায় উদার ভুজংগভঙ্গিমায়।
ঢাকা থেকে দিঘীনালার একমাত্র পরিবহন “শান্তি পরিবহনে” অশান্ত হয়ে বসলাম আমরা।কারন সাড়ে দশটার গাড়ি ১২ টায় অবশেষে চলতে শুরু করেছে।এমনটা তে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত।আমার প্রতিবারই সাড়ে দশটার গাড়ি ১২ টায় ছাড়ে।কোনভাবেই আগে পড়ে হওয়া যাবেনা!সায়দাবাদ পেড়িয়ে গাড়ি কিছুটা টান শুরু করতেই আমাদের মনটাও আস্তে আস্তে শান্ত হতে শুরু করলো।কিছুক্ষন হইহুল্লোর করে এনার্জি সংশয়ে পড়তেই সবাই দেখি সহজ পথ ঘুমের রাস্তা ধরল।কুমিল্লায় যাত্রাবিরতিতে পেট টাকেও কিছুটা ঠাণ্ডা করে নিলাম।পেট ঠাণ্ডা তো দিল ঠাণ্ডা।আবার ঘুমের রাজ্যে ডুব দিলাম।ঢাকা চিটাগাং হাইওয়ে থেকে আমরা যখন রামগর রোডে নামলাম তখন ইতিমধ্যে ভোর হয়ে গেছে।২০০১ সালে যখন প্রথম খাগড়াছড়ি যাই দেশের সবচেয়ে বড় গুহা আলুটিলা দেখতে তখন এখানে ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি।এই রুটে যত বাস যায় সব এসে একজায়গায় জড়ো হত।তারপর একসাথে রওনা দিত কারন এই নির্জন রোডে ডাকাত দের খুব উৎপাত ছিল তখন।এখনও নাকি একই অবস্থা চলছে।
রিসাং ঝর্ণা
এই পথ যদি শেষ না হয়
এমন দিগন্ত ছোঁয়া পথের শেষেই আমার আবাস !
যেখানে সীমান্ত তোমার,সেখানে বসন্ত আমার
দীঘিনালায় পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় এক টা বেজে গেছে।কারন কিছুটা গল্প আমরা ফেলে এসেছি খাগড়াছড়িতে।খাগড়াছড়ির কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন রমণী বলে বসলো আমরা আলুটিলা দেখিনাই,দেখবো।কি আর করা,নারীকুলের অনুরোধ অগ্রাজ্য করার সৎসাহস আমার নেই কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে এই রিস্ক টা আমি নিতে চাইনি।তাই বাধ্য হয়ে আমাদের প্ল্যান কিছুটা পরিমার্জন করে আমরা খাগড়াছড়িতেই নেমে পড়লাম।আমাদের গাইড হাফিজ ভাই কে বলে দিলাম প্ল্যান চেঞ্জ যেন অতিসত্বর খাগড়াছড়ি চলে আসেন।ততক্ষনে আমরা একটা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।প্রথমে গেলাম আলুটিলা গুহায়।২০০১ এর পর।১৪ বছরে কত যে পরিবর্তন তাঁর পিঠে গাঁয়ে।কিন্তু ভেতরের গল্প সেই পুরনোই।যদিও আগের সেই ছমছম ভাবটা নেই।অনেকেরই প্রথমবার।তাদের উত্তেজনার কোন কমতি ছিলনা।ওখান থেকে গেলাম রিসাং ঝর্নায়।ওখানে যদিও খুব বেশি পানি পাইনি কিন্তু তাতে আনন্দের কোন কমতি ছিলনা।আসলে মজাটা নিতে জানতে হয়।সেটাই শিখালেন আমাদের এক দুঃসাহসিক কন্যা!অতি উত্তেজনায় নিজের ওপর ভারসাম্য হারিয়ে সোজা ১০০ ফিট খাঁদে।মুগ্ধ দর্শক আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম কেমন করে রোলার কোস্টারের গতিতে মুহূর্তেই ওপর থেকে শত ফিট নিচে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়!নিচে নেমেও এসেছে একদম রোলার কোস্টারের মতোই।বোনাস হিসেবে পাহাড়ের একপাশে কয়েকবার বেশ জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে আদর করে দিয়েছে বুনো পাহাড়!ভাগ্যিস নিচে বেশ গভীর পানি ছিল।নইলে এতো ওপর থেকে তীব্র গতিতে নেমে আসা শরীর টাকে অল্প পানি কিছুতেই আশ্রয় দিতে পারতোনা।যার পরিনাম হতে পারতো খুব ভয়ঙ্কর। এজন্য ঝর্নায় গেলে কখনও তাড়াহুড়ো করা উচিত না।আগে ঝর্ণায় পানির ফ্লো টা বুঝতে হয়।তারপর আস্তে আস্তে সতর্কভাবে পা ফেলতে হয়।কারন পানির ফ্লো কম থাকলেই প্রচণ্ড পিচ্ছিল হয়ে মৃত্যুফাঁদ’ও হতে যেতে পারে প্রেয়সী ঝর্ণা।
আমাদের বয়ে চলা অদম্য বাহন
আর এক কন্যা,আমাদের অগ্রযাত্রায় অগ্রপথিক,সম্মুখসমরে সিদ্ধহস্ত তেজী প্রাণ,সর্বদা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে বদ্ধপরিকর যে, সে যখন একটু দেরিতে এসে শুনল এক কইন্যার রোলার কোস্টার অভিযানের গল্প।তখন তাকে আটকায় আর কার সাধ্য।সে সেই রোলার কোস্টারের স্বাদ না নিয়ে কিছুতেই যাবেনা।আমরাও জানি তাকে কিছুতেই দমানো যাবেনা।শেষে সবাই উৎসাহ দিতে শুরু করলাম।নব প্রানে নব উদ্যমে সে ঝর্ণার নিচে গিয়ে রোলার কোস্টারে চড়ে বসলো।আর বিপুল বিক্রমে পাহাড়ের গাঁয়ে ঝড় তুলে শোয়েব আখতার,ব্রেট লি দের বলের চেয়েও দ্রুত গতিতে গিয়ে আছড়ে পড়লো নিচের খাদে।নামার পথে শরীর টা যে ইনসুইং আউটসুইং করলো পাহাড়ের গাঁয়ের সাথে তা কেবল পুরনো বলে অভিজ্ঞ বোলার দের(পড়ুন দুঃসাহসী) পক্ষেই সম্ভব।বাতাসে এতো বাঁক খাওয়ানোর পরেও বলটা কিন্তু ঠিক মিডল ষ্ট্যাম্পেই গিয়ে আঘাত করেছে।নইলে নো বলের ভার বইতে হত তার সাথে সাথে পুরো দলকে।সেটা হয়তো খুব সুখকর হতোনা। এ যেন ”জেনে শুনে বিষ করেছি পান” ।বিষ পানের পর তার চেহারায় যেহেতু তৃপ্তির ঢেকুর,বিজয়ের উল্লাস তাহলে বলতেই হবে কন্যার সাহস আছে বটে।
আরও কয়েকজন এই অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম।দীঘিনালায় পৌঁছতে পৌঁছতে মধ্য দুপুর।ওখানে বিসমিল্লাহ্ হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম আমরা।তারপর মেঘের দেশের দিকে চললাম।দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিলোমিটার।পাহাড়ি রাস্তায় এটা খুব একটা কম দূরত্ব না।দীঘিনালা পেড়িয়ে আমাদের চান্দের গাড়ি পাহাড়ের পথ ধরতেই এলোমেলো হাওয়া এসে নারিয়ে দিয়ে গেল শরীরের উষ্ণকোষ গুলো।গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো আর আমরাও যেন বাতাসের সাথে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম।কে কার আগে ছুটতে পারে।এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি থামালাম। গাড়ীর ভেতরে থেকে ঠিক প্রেম টা জমে উঠছিলনা।বেরসিক ছাদ এসে তাতে বাগড়া দিল।দুজনের মনের মাঝে দেয়াল গড়ে দিল সে।তাই তার ছাদেই উঠে বসলাম আমরা চারজন।নিচে থেকে গেল পাঁচজন।ভাগ্যিস ওপরে উঠে এসেছিলাম।নইলে পরের গল্প টা এতটা আবেগের হতোনা। খোলা ছাদে বসে নিজেকে হারিয়ে ফেলার যে সুখের সন্ধান পেয়েছিলাম তা ফেরার দিনও সেই সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করিনি।এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা।মনে হচ্ছিল যেন উড়ছিলাম খোলা বাতাসে।পাহাড়ের বাঁক নিয়ে গাড়ি যখন ধুপ করে নিচে নেমে যায় তখন নিজেকে বাতাসে ভাসতে থাকা এক একটা পাখির মতোই মনে হয়।আর এর প্রস্তুতি শুরু হয় আগের পথের বাঁকে,যখন গাড়ি ধীরে ধীরে বেয়ে উঠে পাহাড়ের শেষ সীমানায়।এভাবে উঠা নামা করতে করতেই বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম।ওখানে রিপোর্ট করে আবার সাজেকের পথে।এখান থেকে সাজেক আরও ৩৪ কিলোমিটারের পথ।আকাশেও আস্তে আস্তে ঘন কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে।মনে হচ্ছে প্রকৃতি দেবী আজ উদার হস্তে সব ভালবাসা নিয়েই যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।আমরাও তাতে ডুব দেওয়ার অপেক্ষায়।আর একটু সামনেই পেয়ে গেলাম কাসালং আর মাসালং এই দুই জনের এক হয়ে যাওয়ার গল্প।অনেকদিন আলাদা চলার পর এখানে এসে তারা তাদের অভিমান ভুলে এক হয়ে গেছে।চমৎকার এক দৃশ্য সেখানে।দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড় এই মিলন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আছে।টাইগার টিলা আর্মি পোস্টে আসতেই মনে হল মেঘ গুলো এক তীব্র আক্ষেপ নিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।ভাবলাম এদের রুদ্র মূর্তি দেখে যদি ভয় পেয়ে নিচে চলে যাই তো ওদের ভয়ঙ্কর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হব আর পরে আফসোস করবো।তাই থেকেই গেলাম গাড়ীর ছাঁদে।একটু পরই আমার প্রিয়তমা বৃষ্টি এসে আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে আরম্ব করলো।মেঘে ধোঁয়া বৃষ্টি যেন প্রতীক্ষার সুর হয়ে বাজছে আমার কানে।জমাটবদ্ধ অভিমান গুলো ভালবাসার শ্রাবন হয়ে ঝরছে নৈনিতাল উত্তরীয় গাঁয়ে।কতদিন পর মিলনে বিসর্জন ভুলে ফের কলমিলতায় বান জেগেছে।দু’জনের নিশ্চুপ ভালবাসায় ঈর্ষান্বিত বাকী চোখগুলো হঠাৎ ডেকে বসলো।আমি না হয় প্রেমে ভিজি।তাদের সেটা সহ্য হবে কেন।হঠাৎ খেয়াল হল এই প্রেমের দৃশ্য কিছু রেকর্ড করে নেই।পরে ইট কাঠের দেয়ালে যখন বন্দী হয়ে যাব তখন স্মৃতিমন্থন করবো নিরবে।যারা পাহাড় ভালবাসেন,ভালবাসেন বৃষ্টি কে, তারা জানেন,দু’জন প্রেয়সী কে একসাথে পেলে কার আর অন্য কিছু মনে থাকে!আর পাহাড়ের গাঁয়ে বৃষ্টিও আসে তার আহ্লাদী চেহারা নিয়ে।যেখানে সুতীব্র আবেগের সাথে থাকে ভালবাসা মাখানো অভিমানের শিল্পিত রসায়ন।
বৃষ্টির পর আকাশের এমন রং চুম্বকের মত টানছিল আমাদের
অনেকক্ষণ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে চলার পর অবশেষে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন আবার আসবে কথা দিয়ে।তীব্র বাতাসের ঢেউ তখনও আমাদের আদর দিয়ে চলেছে গভীর আবেগে।এভাবে কিছুক্ষণ চললে হয়তো জবজবে ভেজা আমরা শুকিয়ে যাব কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই।বাকীদের অবস্থাও তথৈবচ!বৃষ্টি-প্রেমে মাখিয়ে নিয়েছে সবাইকে,ভিজিয়ে দিয়েছে অন্তরাগের পুষ্পশয্যায়।হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে শেষ বিকেলের আলোয় আমরা রুইলুই পাড়ায় পৌঁছে গেলাম ।এখান থেকে খুব সামান্যই দূরত্ব সাজেকের।প্রায় ১৮০০ ফিট উচ্চতার এই গ্রাম পেরিয়ে আর কিছুদূর এগুতেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাজেকের দেখা পেলাম।তখন হলুদ বিকেলের শেষ আভা দিন কে বিদায় জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।আমাদের জন্য সেনাবাহিনী পরিচালিত রিসোর্টে থাকার ব্যাবস্থা করা আছে আগেই।চমৎকার ঝা চকচকে রিসোর্ট।চটজলধি ফ্রেশ হয়েই এসেই দেখি আমার বৃষ্টি আবার চলে এসেছে বিনা নোটিশে।তাকে তো আমি এখন ডাকিনি।এখন আমাদের পাহাড়ের কোলে হারিয়ে যাওয়া সূর্য কে খোঁজার কথা ছিল।কি আর করা যাবে পাহাড়ে সে যখন তখন আসতে পারে।পূর্ণ অধিকার তাঁর এখানে। ছাঁদে চলে গেলাম আমরা।বৃষ্টি শেষে আগত সন্ধ্যায় সমস্ত আকাশের যেন জন্ডিস হয়ে গেছে।আস্তে আস্তে হলুদাভ আকাশ টা টকটকে লাল হতে শুরু করলো।আকাশের সাথে সাথে আমাদের মনেরও রঙ বদলাতে লাগলো দ্রুত।এই সন্ধ্যায় যেমন খুশি ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলল রক্তাভ আকাশ কে সাক্ষী রেখে।ছবি তোলা শেষে সবাই নিচে নেমে আসলাম।রাতে আমরা বারবিকিউ করবো।তার প্রস্তুতি দেখে আমরা বিজিবি পরিচালিত রুন্ময়ের দিকে এগুতে লাগলাম।এতো সুন্দর ঝাঁ চকচকে রাস্তা সাজেকের।চমৎকার লাগছে হাঁটতে। মনেই হচ্ছেনা আমরা হাঁটছি দেশের কোন এক পাহাড়ি রাস্তায়।দেশ বিদেশের অনেক সুউচ্চ পাহাড়ের কোলে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।কোনভাবেই আমাদের সাজেক তাদের থেকে কম নেই সৌন্দর্যে কিংবা বুনো আবেদনে।নিয়ন আলোয় সে এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশে আমরা হাঁটছি।সবাই যেন আমরা মায়ার পথের যাত্রী।
কংলাক পাড়ায় মেঘেদের নিমন্ত্রনে
হঠাৎ বিজিবির একটা গাড়ি আমাদের পাশে এসে ব্রেক কষল।আর আমাদের স্বপ্ন দেখায়ও ইতি ঘটলো তাতে।তাদের কথায় আমরা অনেকদূর চলে এসেছি।যা খুব রিস্কি।রাতের রাস্তা এমনিতেই খুব একটা নিরাপদ না রুন্ময় বা ওদিকটায়।আমরা সেটা জানতামও।কিন্তু ঐ যে এক ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি এতদূর।কারও খেয়ালই নেই।আবার ফেরার পথ ধরলাম।এসে দেখি এখনও মুরগী পোরানোর বেশ দেরি।এদিকে ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।সামনেই খোলা লেনে বসে গেলাম সবাই।ওদিকে মুরগীর পোড়া গন্ধ আসছে আর আমরা এদিকে টোস্ট চিবাচ্ছি।তাতেও খুব একটা খারাপ লাগছেনা।উত্তরের হিমেল হাওয়া এসে আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে সাথে।হাওয়ার বেগ ক্রমশ বাড়তে লাগলো।একপর্যায়ে মনে হল সাথে একটা কম্বল থাকলে বেশ হত।এই সুন্দর পরিবেশ ছেঁড়ে উঠতেও ইচ্ছে করছিলনা আবার শীতে টিকতেও পারছিলাম না।এই গরমেই এই অবস্থা।শীতে যে কি হবে!সবাই রুমে ফিরে গেলেও আমি আবার রাস্তায় নামলাম।কিছুদূর এগুতেই দেখি একটা ছেলে গীটার বাজিয়ে গান করছে।কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা কিন্তু সুর টা খুব টানছে।তার সাথে পরিচিত হলাম।নাম জন ডিউস মারসেলিয়াস। ওখানকার হেডম্যান লালথাঙ্গা লুসাই তার বাবা।সে ওপারে মিজোরামে পড়াশোনা করছে।সে জানাল তার মত আরও অনেকেই এই পাড়া থেকে মিজোরামে পড়াশোনা করছে।তার সাথে ভাব হয়ে গেল সহজেই।সে পরে কয়েকটা বাংলা গানও করে শোনাল ওর মিষ্টি গলায়।এর পর কোন এক সময় সে আমাকে মিজোরামে নিয়ে যাবে এই আশ্বাস দিল।ভারতের সেভেন সিস্টার্স এর মিজোরামের দেখা পাইনি এখনও।তাই আমার আগ্রহটা খুব বেশিই ছিল।তার সাথে গিয়ে তার বাবা হেডম্যান লালথাঙ্গা লুসাই এর সাথে পরিচিত হলাম।উনি জানালেন ওখানে ৯৬ টা পরিবারের বাস।লুসাই রা ওখানে সংখ্যালঘু।মাত্র ২০ পরিবার থাকে যাদের বেশিরবভাগই মিজোরামের সাথে যাওয়া আসা করেন নিয়মিত।ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে ওখানকার ভালো স্কুলে এমনকি বাজারটাও করেন মিজোরাম থেকে। ওদের বেশীরভাগ আত্মীয়স্বজনও মিজোরামে থাকে।বাকী ৭৬ পরিবারের বেশীরভাগ হচ্ছে ত্রিপুরা কিছুসংখ্যক পাংখোয়া।ফিরে এসে দেখি মুরগী পোরানো শেষ।খাওয়া দাওয়ার ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে।জম্পেশ খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমের প্রস্তুতি।পরদিন সূর্য্যি মামা ওঠার আগেই আমাদের কংলাক পাড়ায় পৌঁছতে হবে।
ওরে মিষ্টি মেয়ে
৫ টায় অ্যালার্ম দেওয়া সবার মোবাইলে।সবার টা বেঝেই চলছে ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গীতে।কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দেওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে দেখাচ্ছেনা।অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ঘুমুতে যাওয়ায় কেউ হয়তো টেরও পাচ্ছেনা।আমি কিচ্ছুক্ষন নাটক দেখে উঠে গেলাম।সবাইকে টেনে টেনে উঠিয়ে দিলাম।হাফিজ ভাই কে ফোন করে দিলাম গাড়ি নিয়ে রেডি থাকতে।আমাদের সাহসী কন্যাদের ডেকে তোললাম।বললাম আপাতত মেইকাপের দরকার নেই আমাদের হাতে সময় খুব কম !যদিও জানি সুন্দরীদের মেকাপের প্রয়োজন পড়েনা!
মেঘের সাথে লুকোচুরি
বিজিবি পরিচালিত রুইপন পাড়া পেড়িয়ে চলে গেলাম কংলাক পাড়ায় সরাসরি।গাড়ি থেকে ছোট একটা পাহাড় বেয়ে উঠলেই কংলাক পাড়া।সাজেকের শেষ গ্রাম কংলাক পাড়া।লুসাই জনগুষ্টি অধ্যুষিত এই পাড়ার হেডম্যান চৌমিংথাই লুসাই।ওরা আমাদের দেখাল ভারতের লুসাই পাহাড়,যেখান থেকে কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি। আমাদের উদ্দেশ্য মেঘের কোল থেকে বেড়িয়ে আসা লাল টুকটুকে সূর্যটাকে দেখবো।কিন্তু মেঘের দল তাতে কিছুতেই রাজী নয়।এরাও জেলাস ! দলবেঁধে এসে তারা হাজির।মেঘের ভেতর থেকে কিছুতেই সূর্যটাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।মাঝে মাঝে যেই একটু বেরুতে চায় পাজি মেঘের দল এসে আবার তাকে ঢেকে দেয়।এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বুঝলাম আজ আর হবেনা।যতটুকো তাকে ধরা যায় ধরে নিলাম মেঘের ভেতর থেকেই।আজ মেঘের দল যেন প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।মিজোরাম থেকে এসেছে সবাই আমাদের স্বাগত জানাতে।শ্বেত শুভ্র মেঘমালা প্রেমময় নয়নে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।ডাকছে দূর থেকে।পেছনের পাহাড়ের গাঁয়ে শাদার ঢেউ লেগেছে যেন।পেজা তুলোর মত ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে আছে মেঘের দল। কংলাক পাড়ার সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলোকে ঘিরে ধরেছে ওরা।ছোট ছোট বাচ্চারা এই ভোরেই মেঘের সাথে খেলতে শুরু করে দিয়েছে।অসাধারণ সে দৃশ্য।ওরা ওদের প্রতিদিনকার খেলার সঙ্গী।ওরা চাইলেই যেন একেঅপরকে ধরতে পারে।আমরা দূর থেকেই দেখছিলাম দস্যু মেঘেদের দস্যিপনা।আমরা চলে গেলাম পাড়ার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টির ওপর।ইচ্ছে ছিল যদি ধরা দেয় মেঘমঞ্জুরি।কিন্তু সে আশায় গুঁড়ে বালি।ওরা শুধু দূর থেকেই আমাদের পিপাশা জাগিয়ে লোভ ধরিয়ে দিয়ে যায়।হুট করে পাহাড়ের গাঁয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে দলবেঁধে আবার পরক্ষনেই নেই।এভাবে লুকোচুরি খেলতে কারই বা ভালো লাগে।শয়তান মেঘেদের ধরতে না পেরে ছবিতে নিয়ে নিলাম ইচ্ছেমত।যা এবার,নাকে তেল দিয়ে ঘুমা!ওখান থেকে হারিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।জোর করেই নিয়ে নিলাম সাথে তোদেরকে।
ইচ্ছে করছিল থেকে যাই মেঘেদের দেশে
রুপের রাণী স্বদেশ আমার
ফেরার পথে রুইপন পাড়ায় নামলাম আমরা।বিজিবি পরিচালিত চমৎকার আর একটা রিসোর্ট এখানে।আছে হ্যালিপেড।পাহাড়ের বুকে এক খণ্ড স্বর্গ যেন দাঁড়িয়ে আছে।এতো ছিমছাম সবুজের সমারোহ চারদিকে।দূরে মেঘেদের নাচন।আমরা ২০ টাকা করে টিকেট কেটে ভেতরে চলে গেলাম।যেখান থেকে খুব কাছ থেকে মেঘেদের দেখা যায়।লাল টকটকে সূর্যটাও আমাদেরকে খুব একটা বিচলিত করতে পারছেনা।সৌন্দর্য মোহনে এতোটাই ব্যাস্ত আমরা।বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলার এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলল নিজেদের মধ্যে।রমণীগণ কেউ কেউ ঢাকা থেকে রীতিমত প্রস্তুতি নিয়ে আসছেন কখন কোন সময় কোন কালারের শাড়ি পরে ছবি তুলবেন।যেভাবেই হোক সময়টাকে ধরে রাখতে হবে নিজের মত করে।এমন মডেলদের সামনে পেলে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ এমনিতেই চলতে থাকে আর আমার মত ননপ্রফেশনালদেরও ফটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্ন দেখায়!
আমাদের ১২ টার মধ্যে রিসোর্ট ছাড়তে হবে।তাই আর দেরী করা যায়না ওখানে।ফিরে এসে নাস্তা করেই ব্যাকপ্যাক গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে গেল সবাই।আমারটা গোছানোই ছিল।আমি আবার চলে গেলাম শেষবারের মত বিদায় জানাতে।সবার গোছানো শেষ।এবার বিদায় বলবো রুপের রানী সাজেক কে।চমৎকার কিছু সময় কেটেছে আমাদের এখানে।রিসোর্ট এর দায়িত্বে থাকা পলাশ ভাই আপ্রান করেছেন আমাদের জন্য।একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লঙ্গদু।আরেক রুপের রানী।তার রুপের গল্প করতে আসবো নিশ্চয় অন্যদিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:২০