৩১ জানুয়ারি,২০১৪।আমার কাছে একটা আনন্দের দিন,স্বপ্নপুরনের দিনও বটে।এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা একটা চক্র পূর্ণ হওয়ার দিন।আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ছিল সেই দিন।যে ভবগুরে জীবনের শুরুটা হয়েছিল অজান্তেই।তারপর অনেক হাজার মাইল একা পেড়িয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে বাংলাদেশের ৬১ টা জেলায় আমার পদধূলি পড়ে গেছে ইতিমধ্যে।ব্যাপার টা পুরোটাই কাকতালীয়।আমি জেলা হিসেব করে কখনও ঘুরতে বের হইনি।কিন্তু হঠাৎ যখন দেখলাম আর ৩ টা জেলা বাকি আছে তখন ভাবলাম ওদেরকেই বা কেন বঞ্চিত করি আমার চাঁদমুখ খানা দর্শনে ।২ দিনের সাপ্তাহিক ছুটির সাথে আর একদিন ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাংলাদেশের সর্বশেষ উত্তরের ৩ জেলা দিনাজপুর,ঠাকুরগাঁও আর পঞ্চগড়ের দিকে।
প্রচণ্ড শীত কে ঢাকা থেকেই সাথে নিয়ে গেলাম।ওখানে যাওয়ার পথে সঙ্গী হল হিমালয় থেকে ধেয়ে আসা উত্তরের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া।মাঝ রাত থেকে প্রচণ্ড কুয়াশা পড়া শুরু হল যে কারনে বাস খুব ধীর গতিতে চলছিল।দিনাজপুরের কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম তখন তো রীতিমত হাঁটার গতি নিয়ে নিল আমাদের বাস। ১০ হাত দুরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিলোনা।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিল বাস।অবশেষে যখন গড়িয়ে গড়িয়ে পৌঁছলাম ততক্ষনে ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯ টা ছুঁই ছুঁই।হোটেল আগেই ঠিক করা ছিল।কিছু বন্ধুবান্ধব আছে এদিকটায়,আমার এক কলিগ আছে,আমার প্রাক্তন বসও দিনাজপুর শহরেই থাকেন যদিও তাঁকে কিছুই জানাইনি আগে।যাইহোক ফ্রেশ হয়েই নিচে নেমে নাস্তা করে নিলাম।তারপর রুট প্ল্যান ধরে প্রথমেই যাব দেশের অতি প্রাচীন এক মন্দির, কান্তনগর মন্দির দর্শনে যা আমরা কান্তজীও মন্দির নামেই চিনি।
দিনাজপুরের প্রখ্যাত জমিদার মহারাজা প্রাণনাথ ও তাঁর পোশ্য পুত্র রামনাথ এই মন্দির নির্মাণ করেন ১৭০৪-১৭৫২ খৃস্টাব্দে।অর্থাৎ এ মন্দির টি নির্মাণে ৪৮ বছর সময় ব্যয় হয়েছিল।৫০ ফুট বর্গাকৃতির ত্রিতল বিশিষ্ট ইটের তৈরি এ মন্দির টি একটি মঞ্চের উপর প্রতিষ্ঠিত।এটি একটি নবরত্ন মন্দির।মন্দিরের নিচতলার ছাদ ও দ্বিতলের ছাদের চারকোনে চারটি করে আটটি অলংকৃত চূড়া বা রত্ন এবং ত্রিতলের ছাদের মধ্যস্থলে আছে বৃহদাকারের কেন্দ্রীয় চুড়ার ধ্বংসাবশেষ।মন্দিরের সম্পূর্ণ বহিরগাত্র পোড়ামাটির উৎকৃষ্ট ফলকচিত্রের অলংকরণে সুশভিত।এ সমস্ত ফলকচিত্রে উদ্ভিত ও প্রানিকুল,জ্যামিতিক নকশা,রামায়ন ও মহাভারতের পৌরাণিক দৃশ্যাবলী এবং তদানিন্তন সামাজিক ও অবসর বিনোদনের চমৎকার দৃশ্য খচিত রয়েছে।১৯৬০ সালে সরকার এ মন্দির টিকে সংরক্ষিত প্রাচীনকীর্তি হিসেবে ঘোষণার পর প্রত্নতত্ব বিভাগ এর যাবতীয় সংস্কার ও সংরক্ষন করছে।
দিনাজপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠে বসলাম।গন্তব্য বার মাইল।এখানকার জায়গার নামকরন গুলোও বেশ মজার।দশ মাইল,এগার মাইল,বার মাইল।শহর থেকে বার মাইল দুরত্বে বলে জায়গার নামও বার মাইল।তার আগে দশ মাইল তো সবাই চিনে।আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।ওখানে একটা ছোট্ট নদী আছে যার নাম টাও চমৎকার,পূর্ণভবা।বাংলাদেশের সব নদীগুলার নাম এতো সুন্দর কেন?কে বা কারা রাখল এতো সুন্দর সুন্দর নাম?নদীর ওপরে বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে।নদী পেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই সেই মন্দির।বেশ কিছক্ষন থাকলাম ওখানে।ঘুরে ঘুরে দেখলাম মন্দিরে খুব সুক্ষ অনিন্দ্য সুন্দর কাজগুলো।কত ধৈর্য আর অধ্যাবসায় থাকলে এরকম কাজ করা যায়।
ফেরার পথে বস কে ফোন দিলাম।বস আগে কিছুক্ষণ ঝেড়ে নিল আগে তাকে না জানানোর অপরাধে।আবার এও বলল আমি যেন ফিরে বাস স্ট্যান্ডে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি।তিনি আমাকে রামসাগর সহ আরও যা যা দেখানো সম্ভব দেখাবেন।আমিও ভেবে দেখলাম তাঁর বাইকে করে ঘুরে দেখলে আমার সময়ও অনেক বেঁচে যায়।রাস্তা ঘাট তো তাঁর নখদর্পণে।তিন টার দিকে চলে আসলাম বাস স্ট্যান্ডে।এসে দেখি বস আমার আগেই চলে আসছেন।গরুর দুধের অসাধারণ ৩ কাপ চা খেলাম ওখানে।এখনও মাঝে মাঝে ওই চা’টা মিস করি।বসের বাইকে উঠে বসলাম।শহর থেকে ৮কিলোমিটার দূরে তেজপুর গ্রামে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানুষ নির্মিত লেক এই রামসাগর।অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম ওখানে।লেকটি ১০৭৯ মিটার উত্তরে দক্ষিণে এবং ১৯২.৬ মিটার পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত।রাজা রাম নাথ ১৭৫০ খৃস্টাব্দের মধ্যভাগে এই লেক নির্মাণ করেন যার নামানুসারে এই লেকের নাম হয় রামসাগর।তখনকার সময়ে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় হয় লেকটি খননে এবং প্রায় দেড় মিলিয়ন শ্রমিক লেকটি খননকাজে অংশগ্রহন করে।লেকটির চারপাশে চমৎকার ইটের তৈরি রাস্তা।ফলে যারা বাইক অথবা ইজি বাইক নিয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য খুব সহজ ও আরামপ্রদ হয়ে ওঠবে পুরো লেক টি ঘুরে দেখতে।অবশ্য যারা হেঁটে লেক টা একবার চক্কর দিতে চান তাদের জন্য ব্যাপার টা খুব একটা সহজ হবেনা।হাতে অনেক সময় থাকতে হবে।লেকের পশ্চিম দিকে একটা ছোট্ট হরিণের চিড়িয়াখানা আছে।বেশ কিছু হরিণ আছে ওখানে।আমাদের মতো আরও অনেক দর্শনার্থীর ভিড় দেখলাম।কেউ আসছে পিকনিক করতে।স্কুল কলেজ থেকে বাস নিয়ে চলে আসছে কয়েক টা গ্রুপ।তবে কাপল দের সংখ্যাটাই মনে হয় বেশি দেখলাম।যদিও সন্ধ্যার পর ওখানে থাকা একদমই নিরাপদ না শুনলাম।বেশ কিছু ছিনতাইকারি চক্র ওখানে সক্রিয়।সুযোগ পেলেই সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।তাই সন্ধার আগেই চলে আসা ভালো।সূর্যাস্ত টা ওখানে উপভোগ করে তাই আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম।রাতে বসের বাসায় দাওয়াত খেতেই হল।ওখান থেকে হোটেলে ফিরেই দিলাম ঘুম।
পরদিন খুব ভোরে ওঠে চলে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে।এবারের গন্তব্য বাংলাদেশের উত্তরের সর্বশেষ সীমান্ত পঞ্চগড় হয়ে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্দা।দিনাজপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় সাদা পতাকা টানানো কিছু বাস প্রতি ঘণ্টায় ছেড়ে যায় পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে।দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব প্রায় ৯৪ কিলোমিটার।এইটুকো পথ আসতে আমার ২ ঘণ্টাও লাগেনি।এত সুন্দর রাস্তা বাংলাদেশের খুব কম জায়গায় আছে।যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় পুরোটাই ঘুরে ফেলেছি আমি তাই বলতেই পারি এত চমৎকার রাস্তা বাংলাদেশের খুব বেশি জায়গায় নেই।সিলেট হাইওয়ে, গোপালগঞ্জের ওদিকটাও সুন্দর জেনেই বলছি।পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্দার রাস্তাটুকো আরও বেশি ঝকঝকে তকতকে।লোকাল ছোট বাসেও তাই বেশিক্ষন লাগেনি পৌঁছতে।পঞ্চগড় থেকে আবার বাস চেঞ্জ করে নিলাম বাংলাবান্দার।রাস্তার দু’পাশের অসাধারণ কিছু মুহূর্ত বন্দী করে নিয়ে নিলাম সেইসাথে মনের মণিকোঠায়।গ্রামের চিরন্তন সংজ্ঞা বলতে যা বুঝি তেমন সব গ্রামের দৃশ্য যেন দেখছিলাম রাস্তার দু’পাশে বিশাল প্রান্ত জুড়ে।৬২ কিলোমিটারের এই দূরত্ব টুকোও খুব বেশিক্ষন লাগেনি পৌঁছতে।মাঝে তেঁতুলিয়া বাজারে যাত্রাবিরতি।ওখানে দুপুরের খাবার টা খেয়ে নিলাম।তেঁতুলিয়া থেকে সীমান্তের বাংলাবান্দা মাত্র ১৭ কিলোমিটার।অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম প্রত্যাশার গালিচায়।
বাংলাবান্দা মুলত একটা স্থলবন্দর যা বাংলাদেশের সর্বশেষ উত্তরে ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত।ইন্ডিয়া,নেপাল এবং ভুটানের সাথে সরাসরি স্থল বানিজ্যের জন্য এই বন্দরটি স্থাপন/চালু করা হয়েছিল ২০১১ এর জানুয়ারি তে।ওপারে ইন্ডিয়ায় বর্ডার ফুলবাড়ি নামে পরিচিত।বর্ডার পেড়িয়ে আমার খুব পরিচিত শিলিগুড়ি,জলপাইগুড়ি যেতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগবেনা ওখান থেকে।ইচ্ছেও হচ্ছিল একবার ঘুরে আসি অতি প্রিয় ডুয়ারস থেকে।এতো কাছ থেকেই ফিরে যাচ্ছি তাই আফসোস হচ্ছিল।আমার কাছে পাসপোর্ট ছিল,ভিসাও ছিল কিন্তু বর্ডার বেনাপোল/এয়ার থাকায় সেটা সম্ভবও না।যদিও এদিক দিয়ে আমি বর্ডার পেড়িয়ে ওপার যাইনি কখনও।আমি এদিকে যতবার আসছি ততবারই অবশ্য বুরিমারি/চেংরাবান্দা হয়ে আসছি।ওখান থেকে(ইন্দো বাংলাদেশ)ইন্ডিয়ান-নেপাল বর্ডারের(কাঠবারিয়া)দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার, দার্জিলিং ৫৮ কিলোমিটার,ইন্ডিয়ান- ভূটান বর্ডার ৬৮ কিলোমিটার।কিছুক্ষণ গল্প করলাম বিজিবি’র জওয়ান দের সাথে।এটা অবশ্য আমি প্রায়ই করি যখনই ইন্ডিয়ায় যাই।ফটোসেশান চলল কিছুক্ষণ।টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার এই অদম্য গল্পের সাক্ষী হয়ে তারপর বিদায় জানালাম জিরো পয়েন্ট কে।পাশেই আছে মহানন্দা নদী।একটা ভ্যান ঠিক করলাম ২ ঘণ্টার জন্য।সে আমাকে এই দুই ঘণ্টা ঘুরাবে।মহানন্দায় থাকলাম অনেকক্ষন,শ্রমিকদের পাথর উত্তোলন দেখলাম সেই সাথে মহানন্দার টলটলে পানিতে নিজেকে ভিজিয়েও নিলাম এই সুযোগে।ওখান থেকে শত বছরের প্রাচীন, স্থানীয় লোকমুখে বিখ্যাত এক বটবৃক্ষের সাক্ষাত নিয়ে তবেই ফিরলাম পঞ্চগড়ে।ওখান থেকে পঞ্চগড়ে এসে থাকলাম সেই রাত।পরের দিন খুব ভোরে উঠে চলে যাব ঠাকুরগাঁও আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।
এবার চলুন কিছু ছবি দেখি
বিঃদ্র: তখন ব্লগে নিয়মিত ছিলাম না বলে এক বছর পরেই দিলাম পোস্ট টা
“টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া,এক স্বপ্নপুরনের গল্প ”
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৪০টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখানে সেরা ইগো কার?
ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।
‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন